টোকন ঠাকুরের সাক্ষাৎকার । আলাপকারী : শিমন রায়হান

‘কবিতার শিল্পমাধুর্যটাই এমন, কম পড়লে তার ক্ষতি নেই’


(২৫ মার্চ, ২০২৩। বৃষ্টি আসন্ন এক সপ্তাহান্তের সন্ধ্যা আর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ছয়তলা বাড়িটির চিলেকোঠা। আলাপ শুরু হয়।)

শিমন রায়হান: দাদা, কাগজ দেখে সাক্ষাৎকার নেওয়া আমার বিবেচনায় যদিও ভাল পদ্ধতি না। তবে যে বিষয়গুলো থেকে আমি কথা তুলব সেটার সাহায্যের জন্য আমি কাগজটি সামনে রাখছি। আর প্রথাগত সাক্ষাৎকারগ্রহীতাদের মতো প্রশ্নোত্তরেও আমি থাকব না। একটি আড্ডা হবে এবং প্রসঙ্গক্রমে আমিও অনেক কথা বলব।

টোকন ঠাকুর: এতে যিনি বলেন তার পক্ষেও সুবিধা হয়।

শিমন রায়হান: একদম ঠিক। আমরা শুরু করতে পারি, দাদা। আমার মনে হয়, আমার কাছাকাছি বয়স যাদের এবং যারা এক দশকের কম-বেশি লিখছি, তাদের অনেকের ওপর আপনার লেখার একটি ভাল প্রভাব রয়েছে। আমি সেই অর্থে দশক বিভাজনে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আলোচনার স্বার্থেও যদি বলি, তাহলে বলা যায় এমনকি গত দুই দশকের তরুণ কবিতা লিখিয়েদের ওপর আপনার কবিতার একটি প্রভাব রয়েছে; যেখানে আপনার লেখালিখির বয়স তিন দশকের বেশি হবে হয়ত।

টোকন ঠাকুর: তিন দশক হয়ে গেছে। তিন দশকের বেশি।

শিমন রায়হান: নানান ফর্মে আপনি লিখেছেন কিন্তু কবি হিসেবে আপনার লেখালিখি তিন দশক পেরিয়েছে। আমি যতটুকুই যা লেখার চর্চা করেছি, আমার লেখার ওপরেও আপনার লেখার প্রভাব আছে। আমার মনে পড়ে কৈশোরে একটি লন্ড্রির দোকানে পাওয়া একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায় আপনার ‘হাউ আর ইউ, মৃগয়া’ কবিতাটি পড়ি এবং আপনার নাম প্রথম শুনি। আমার তখনকার সেই বয়সে, যখন আমি কবিতা পড়ার জন্য তেমন প্রস্তুত হয়ে উঠিনি, তখন আমার মতো করে কবিতাটির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি। কিছুদিন পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গেলাম তখন আমার চলচ্চিত্র সংসদকর্মী বন্ধু, মুনতাসির মামুন সজীবের কাছে আপনার ‘নার্স, আমি ঘুমোইনি’ বইটি পেলাম। ও ঢাকা থেকে বইটি কিনে নিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা আমাদের কাছে তখনও পর্যন্ত বেশ দূরের শহর। ঢাকা থেকে আমাদের বন্ধুরা কেউ ফিরলে নানারকম বইপত্র ও সিনেমার কালেকশন নিয়ে ফিরত। তো তখন ও কিছু চলচ্চিত্রের বইপত্র, লিটলম্যাগ ও আপনার ‘নার্স, আমি ঘুমোইনি’ বইটি নিয়ে ঢাকা থেকে হাজির হলো। তখন আমি ও আমরা অনেকেই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। সমসাময়িক কবিতার সাথে আমাদের খুব একটা সংযোগ নেই। সুকান্তের ‘একটি মোরগের আত্মকাহিনি’ আমাদের কবিতাচর্চার সর্বোচ্চ দৌঁড়। জাতীয় কিছু দৈনিকের সাহিত্যপাতার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় কেবল। আপনার ‘নার্স, আমি ঘুমোইনি’ পড়ে আমরা চমকে গেলাম একপ্রকার। মনে হলো, আপনার ভাষা আমাদের থেকে বেশ দূরবর্তী যার সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল না আগে। আমাদের অনেকের পড়া আপনার প্রথম কোনো বই ‘নার্স, আমি ঘুমোইনি’। সেই দিক দিয়েও আপনার কবিতার কাছে আমাদের ঋণ রয়েছে। আমরা যারা লিখি তাদের কাছে কবিতা তো এক ধরণের চিঠির মতো। পাঠক তো এক অর্থে প্রাপকও। সেই পাঠকের কাছে কবিতা যখন পৌঁছয় তখন একটা প্রাপ্তিস্বীকারও ঘটে। যখন সেই পাঠক কবির কাছে সরাসরি চিঠি লেখেন অথবা, দেখা হলে বলেন অথবা, অন্য কোনো মাধ্যমে অথবা, কোনো না কোনোভাবে কবির কাছে হয়ত পৌঁছয়। এটা নিয়ে একটু বলেন যে, আদৌ কি সেটা জরুরি? লেখার আনন্দপ্রাপ্তিই কি যথেষ্ট? নাকি এই প্রাপ্তিস্বীকারেরও দরকার আছে?

টোকন ঠাকুর: প্রথমত, নিজের আনন্দ আর চাওয়া থেকেই লেখা। সেই লেখা হয়ত পত্রিকায় দিলাম। ছাপা হলো। লেখক হিসেবে ছাপা দেখেও একটা আনন্দ পাওয়া যায়। ভাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে ছাপা হলে আমি এখনও আনন্দ পাই। সেটা পড়ে পাঠকের মধ্যে যে অভিঘাত হয় সেটা তো আসলে জানা যায় না। কজন পাঠক পড়েন? পাঠকও তো একই মাত্রার নন। নানান শ্রেণির পাঠক, নানান অভিজ্ঞতার পাঠক। সোশ্যাল মিডিয়া আসার আগে পাঠকের রিয়্যাকশন এক ধরনের পাওয়া যেত। তুমি বলছিলে ‘নার্স, আমি ঘুমোইনি’র কথা। এটা যখন বেরোয়, আট সালে, তখন আমি ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলি। তখন থেকে আমি অনলাইনে নিয়মিত। এবং এটাও বলে রাখি আমার হাতে লিখে কবিতা পাঠানোও তখন শেষের দিকে। তখন কম্পোজ করেই একবারে লেখা পাঠাই। কম্পিউটারেই লিখি তখন থেকেই। এর আগের পাঠকেরা পত্রিকার ঠিকানায় চিঠি লিখত কখনো-কখনো। কখনো-কখনো আমার ব্যক্তিগত ঠিকানাও কেউ-কেউ সংগ্রহ করে ফেলত। সে রকম চিঠিপত্র আমি অনেক পেতাম। আজিজ মার্কেটে একটি বইয়ের দোকান ছিল, এখনও আছে, পাঠক সমাবেশ। আমার অনেক চিঠিপত্র পাঠক সমাবেশে আসত। আর চারুকলায় একটা নোটিশ বোর্ড ছিল। চিঠিপত্র এসে লটকে থাকত। ওখানেও চিঠি আসত। তারপর আট-নয় সাল থেকে ফেসবুকে নিয়মিত হয়ে গেলাম। সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্লগ অ্যাকটিভ হয়ে গেল। তখন থেকে চিঠিপত্রের দিন, ডাকবিভাগের দিন প্রায় শেষ হয়ে গেল। সেই শেরশাহের ডাকব্যবস্থা প্রায় তিনশ’ বছর পর প্রায় স্তিমিত হয়ে গেল, ইয়াহু-জিমেলের চাপে পড়ে, ফেসবুকের চাপে পড়ে। লেখাপড়া করে এমএ-বিএ পাস করেও একজন শিক্ষিত লোক কবিতার পাঠক নাও হতে পারেন। একজন কবিতার পাঠক তার মতো করেই কবিতার পাঠক। এমনকি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বোধগম্যতার মধ্যে কবিতা নাও পৌঁছতে পারে। কিন্তু তিনি সমাজে একজন শিক্ষিত লোক বলে পরিচিত। কিন্তু কবিতার প্রশ্নে তিনি শিক্ষিত নন। একেবারে পরিষ্কার কথা। যেমন রবিশঙ্করের সেতারের সামনে বসলে সবার ভাল নাও লাগতে পারে। সেতারের সুর নেবার মতো ততোটা উৎকর্ণ হয়ত হয়ে ওঠেননি তিনি। তো অনলাইনেও অনেকে এ রকম কমেন্ট করেন কবিতা পড়ে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। এভাবে এখন নানা মাধ্যমেই পাঠকের রিয়্যাকশন পাই।

 


যেকোনো শিল্পমাধ্যমই ওই শিল্পীর কাছে পুরো সময় দাবী করে। দাবী করে কিন্তু ওই শিল্পী টের পান কিনা এটি একটি প্রশ্ন।

 

শিমন রায়হান: একটা গতানুগতিক ধাচের প্রশ্ন করতে চাই। প্রশ্নটি করা জরুরি এই অর্থে যে, আপনি অ্যাকাডেমিকভাবে ছবি আঁকার স্কুলের ছাত্র, পরবর্তীতে সিনেমা বানানোর সাথেও আপনি সংযুক্ত হয়েছেন, সেই দিকে আমি যাবো একটু পরে, আবার সাহিত্যের মধ্যে কবিতা থেকে কথাসাহিত্য থেকে শুরু করে শিশুসাহিত্যও আপনি করেছেন, গল্পও আপনি লিখেছেন। কিন্তু আপনার নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই, যাদের বাংলাদেশের লেখালিখির পাড়ায় বিচরণ, তারা আপনাকে কবি হিসেবেই জানেন। সিনেমানির্মাতা হিসেবে হয়ত কেউ-কেউ জানেন। পেশাগতভাবে ছবি আঁকার সাথে খুব নিবিড়ভাবে আপনার থাকার সুযোগ ছিল। তার মানে এই নয় যে, ছবি আঁকা লোকজন কবিতা লেখেন না এবং নিশ্চয় চারুকলায় ভর্তি হবার অনেক আগে থেকেই কবিতায় আপনার যাত্রা। তো সেই জায়গা থেকে একটি অতি পুরোনো প্রশ্ন, তবু আমি এ প্রশ্নটি করতে চাই। কেন কবিতার মাধ্যমটাকেই আপনার মনে হয়েছিল বা, পরবর্তীতে মনে হতে থাকল দিনের পর দিন, যখন আপনি এই মাধ্যমটার সাথে থেকে গেলেন, যে আপনার মনের ভাব প্রকাশের জন্য আপনার শিল্পযাপনের জন্য অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম?

টোকন ঠাকুর: এই প্রশ্নের ব্যাপারে আমি বলতে পারি যে, আমার জন্ম ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার ভায়না গ্রামে। সেই গ্রামে তখন কোনো মোটরযান যেতে পারত না। কারণ নদী অধ্যুষিত গ্রাম, কোনো ব্রিজ সেখানে ছিল না। নৌকায় পারাপার চলত। ফলে ওই গ্রামে মোটরগাড়ির শব্দ তখনও শোনা যায়নি। যখন আমি বড় হচ্ছিলাম ভায়না গ্রামে, বাঁশঝাড় থেকে কেউ বাঁশ কেঁটে নিয়ে যাচ্ছে সেই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, কারো সাথে কারো ঝগড়া হচ্ছে সেই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর গাছপালার পাতার শব্দ, পাখি-গরু-হাঁস-মুরগির ডাক- এ রকম শব্দসমগ্রের মধ্যে আমার জন্ম। পরে আমি বড় হচ্ছিলাম পৈতৃক বাড়িতে, শৈলকুপা থানার গাড়াগঞ্জ বাজার সংলগ্ন মধুপুর গ্রামে। যার পাশ দিয়ে কুমার নদ বয়ে গেছে শৈলকুপার দিকে। সেই গ্রামটিও একটি পাকা রাস্তার ধারে। কিন্তু ওটাও একটি গ্রাম। টেলিভিশন নেই, পত্রিকা আসে না। কারো-কারো বাড়িতে একটি রেডিও আছে। তো এই রকম জায়গায় একটি বালক ছেলে তার মনের কথা কার সাথে ভাগাভাগি করবে? কিভাবে সে ছবি আঁকবে? কারণ ছবি আঁকার সরঞ্জাম দেখেনি সে ওই সময়ে। সিনেমা কিভাবে বানাবে? সিনেমার ক্যামেরা সে দেখেনি। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখে আসতাম বটে কিন্তু সিনেমা বানানোর বা ছবি আঁকার মাধ্যম দেখার সুযোগ তখনও হয়নি। একজন শিল্পী মুস্তফা আজীজ, চারকোলে পোট্রেট করতেন, একবার তার আঁকা দেখলাম বটে কিন্তু হাজার রকমের মাধ্যম আছে- এইসব তখনও জানি না। জয়নুল আবেদিন একজন শিল্পী ছিলেন এবং ঢাকায় একটি আর্ট কলেজ আছে- এই তথ্যটুকুই কেবল জানা ছিল। তো এভাবেই মনের কথা জানানোর জন্যই কবিতা লেখা। গাড়াগঞ্জ বাজারের যে পোস্ট অফিস, সেখানে হাতে লেখা কবিতা ডাকবাক্সে ফেলে দিলে কোনো একটা পত্রিকায় হয়ত ছাপা হতো। হাইস্কুল লাইফের কথা বলছি আমি। এরপর কলেজে ভর্তি হলাম, ঝিনাইদহ সরকারি কেশব চন্দ্র কলেজ। সেখান থেকেও ঢাকা অনেক দূর। দুইটা ফেরি পার হয়ে আসতে হোতো। সে কারণেই কবিতা লেখার একটা নেশা ও অভ্যাস হয়ে ওঠে। এবং কবিতার মাধ্যমেই যে আমিটা বাড়ির সঙ্গে, প্রতিবেশীর সঙ্গে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে থাকি- সে আমিটার বাইরের আমার ভেতরের মানুষটার লেখালিখি শুরু হয়ে যায়। বইপত্র পড়া শুরু হয়ে যায়। শৈলকুপা যেতাম দাউদ আল হাফিজ, সুনীল শর্মাচার্য্য- এদের সাথে দেখা করতে। তারা অনেক বড়-বড় বই দিতেন। যেসব বই আমি দেখিনি তখনও। সুনীলদা পরে কলকাতা চলে গেছেন। এখন সুনীল আচার্য্য নামে লেখেন। তখন দেখতাম তার লেখা ঢাকার পত্রিকায় খুব ছাপা হতো শৈলকুপার বিজুলিয়া গ্রাম থেকে। দাউদ আল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘একবিংশ’ পত্রিকা আনতেন এবং আমাকে পড়তে দিতেন। তখন এ রকম কাগজ আমি দেখিনি। সুনীলদাও আমাকে মোঁপাসা, বোদলেয়ার, মালার্মে, র‌্যাবো এসব অনুবাদ পড়তে দিতেন। পরে ঝিনাইদহে আসার পর কেসি কলেজের লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, বেসরকারি লাইব্রেরিতে পড়তাম। কেসি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, কবি ও গল্পলেখক শহীদুর রহমান, তার কাছে আমি ভীষণ রকম ঋণী। তো কবিতার অনুশীলন যাকে বলা হয়, সেগুলো চলছিল এভাবে। ছবি আঁকার বিষয় তখনও আমার মধ্যে ঢোকেনি। কলেজে পড়তে পড়তেই আমার মনে হলো যে, এই প্রচলিত মাধ্যমের পড়াশোনা সব ফলস্; এই ইতিহাস ফলস্, এই পৌরনীতি ফলস্, এই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ফলস্, এই নৈতিকতা যা শেখানো হচ্ছে পাঠ্যসূচিতে এর একশ’ভাগই ফলস্। তখন দেখতাম, আমাদের যা পড়ানো হচ্ছে তা বড়দের কেউ পালন করছেন না। আবার আমরা যারা পড়ছি, আমাদের কেউও পালন করছে না। তো এইসব যে ফলস্ তা অতো আগেই টের পেয়ে গেলাম। পড়াশোনায় উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার উৎসাহও পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষার ফর্মফিলাপের টাকা দিয়ে ঢাকার এসে বইপত্র কিনে নিয়ে যাওয়া, ফুটপাত থেকে সস্তায় বই কেনা- এইসব নেশার মধ্যে ছিলাম। তারপর ঝিনাইদহ সরকারি কলেজে পরীক্ষা না দিয়ে ড্রপ করে চলে গেলাম খুলনা। খুলনা আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। ওখানেও আমার কিছু লেখক বন্ধু জুটে গেল। মিল্টন মোল্লা, মনির হাসান, মাসরুর আরেফিন, সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, লাভলু- এ রকম আরো অনেকেই। আমি ঝিনাইদহে যখন পড়তাম তখন ঢাকায় এসে ফিল্মের বই কিনে নিয়ে যেতাম। চিত্রকলার বই কিনে নিয়ে যেতাম। মুহম্মদ খসরুর তোলা ছবি দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের বিরাট বড় একটি পোস্টার কিনে নিয়ে গেলাম একবার। ভিসিআর-এ ছবি দেখতাম কলকাতার, মুম্বাইয়ের। বাংলাদেশের ছবি তো হলেই দেখা যেত। অন্য কোনো মাধ্যম আমার কাছে সহজলভ্য না থাকায় আমার মনে হয়, কবিতা না লিখে আমার উপায় ছিল না। কাগজ-কলম নিলেই কবিতা লেখা যায়। আর বাষ্পীভূত অনেক কথা থাকে কিশোরবেলায়; প্রথম যৌবনে যখন দূর্বোদ্ধ লাগে জীবন-যৌবন-যৌনতা-সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার-ধর্ম-বন্ধু-বান্ধব-বিভিন্ন সম্পর্ক। এইগুলোর একটি পরিষ্কার ধারণা মানুষের নিজের মতো করে গড়ে ওঠে পরবর্তীতে। প্রথম জীবনে তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ তাকে এসব ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণায় রাখে না। তাকে পরিষ্কার হতে হয় তার মতো করে। তো আমিও পরে খুলনা থেকে ঢাকা চলে এলাম। চারুকলায় ভর্তি হলাম। তখন আমার রাজ্য আরেকটু বেড়ে গেল। ঢাকায় এসে সিনেমা দেখতাম। প্রচুর চিত্রপ্রদর্শনীতে যেতাম। সামগ্রিক শিল্পকলার প্রতি একটি নেশা আমার আছে, যার জন্য চিত্রকলায় পড়াশোনা, সিনেমার দিকে ঝুঁকে থাকা। ভাস্কর্যও আমার সাবসিডিয়ারি ছিল। তো কবিতাটা সেই হাইস্কুল থেকে শুরু হলো। কলেজ হয়ে, আর্ট কলেজ হয়ে, ইউনিভার্সিটিতে যখন গেলাম তখনও কবিতাটা সঙ্গেই থাকলো। আস্তে-আস্তে পক্ক হতে লাগলাম। তখন সিনেমা বানানোর মাধ্যম আস্তে-আস্তে আমার কাছে চলে এলো। কিছুদিন বাদেই পত্রিকার সম্পাদকদের চাপেই লেখালিখিটা আমার কনটিনিউ করে যেতে হলো। নাহলে হয়ত কনটিনিউ করাও হতো না। ব্যক্তিগতভাবে কবিজনচিত স্বভাব আমার মধ্যে কম। সবাই বলে, আমিও মানি। কবিতা তো আলাদা কিছু না। সব মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে। নিজের কহতব্য বিষয় সে বলতে চায়। গত দশ-পনেরো বছরে তো আমার লেখার চাহিদার কারণেই আসলে আমাকে লিখতে হয়। আমার নিজের প্রয়োজনে লিখি খুব কম। লেখা হয়ই না। সব সময় কোনো না কোনো সম্পাদকের লেখার চাপ আমার ওপর থেকেই যায়। এখনও দু-তিনটে লেখা লিখতে হবে। আমার আলস্য লাগছে। কবিতা খুব নির্বাচিত মানুষের সৃজনমাধ্যম। আমার মনে হয়, আমার আরো বেশি মানুষের সাথে সংযুক্ত হওয়া দরকার। অন্য ভাষাভাষীদের সাথেও সংযুক্ত হওয়া দরকার। আমার কবিতা অনূদিত হয়ে অন্যভাষার লোকদের কাছে যাবে- কিন্তু কবে? আর পৃথিবীর সব দেশের লোকই কবিতা কম পড়ে। কবিতার শিল্পমাধুর্য্যটাই এমন, কম পাঠক পড়লে তার ক্ষতি নেই। কম পাঠক আছে বলে কবিতার কোনো অমঙ্গল নেই। বেশি হলেও আর কত বেশি হয়। একটি কবিতার বই তিনশ’ কপি চললে কবি ও প্রকাশক উভয়েই খুশি হয়ে যান। আঠারো কোটি লোকের মধ্যে তিনশ’ কপি কবিতার বই একটি হাস্যকর ব্যাপার। কিংবা এটাই বাস্তবতা। কিন্তু একটা খারাপ সিনেমাও পৃথিবীর অনেক লোক দেখে ফেলে এক সপ্তাহের মধ্যে। সিনেমা তো সব শিল্পমাধ্যমকে আত্মীকরণ করেই রুপায়িত হয়। তাই সিনেমার দিকে যাচ্ছি। কবিতার সাথেও আছি। কিন্তু চিত্রকলার থেকে বিযুক্ত হয়ে গেছি। দু’একজন বললে হয়ত তাদের প্রচ্ছদ করে দিই। কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্পকলা নয়। প্রচ্ছদ কতবড় শিল্পমাধ্যম তা আমাদের অন্যতম বড় লেখক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ-এর বই দেখলেই বোঝা যায়। সেখানে প্রচ্ছদের বালাই নেই। কেবল লেখকের স্বাক্ষর, আর বইয়ের নাম, অনেক সময় তাদের ছবি। তো ভবিষ্যতে ছবি আঁকাআঁকির মধ্য দিয়ে প্রদর্শনী করার কথা এখনও মাথাতেই নেই। রবীন্দ্রনাথ তো ৬৭ বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেন। আমার ৬৭ হতে দেরী আছে অনেক।

শিমন রায়হান: যে কোনো শিল্পমাধ্যমের মধ্যে কবিতা কি অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ? যেমন দেখি বাম রাজনীতি ফুলটাইমারদের ডিমান্ড করে। একজন কেরানির পক্ষে কি ভাল কবি হয়ে ওঠা সম্ভব?

টোকন ঠাকুর: এই ক্ষেত্রে আমি বলব, যেকোনো শিল্পমাধ্যমই ওই শিল্পীর কাছে পুরো সময় দাবী করে। দাবী করে কিন্তু ওই শিল্পী টের পান কিনা এটি একটি প্রশ্ন। যে শিল্পী অনেক টাকা ও ক্ষমতা পাবেন বলে বিসিএস দিলেন এবং তার মানে উনি কবিতাও লেখেন। কিন্তু বিসিএস-এর জন্য উনি যা করেছেন, কবিতার জন্য তা করতে পারেন না। কারণ একই সঙ্গে দুটো হয় না। কঠিন, খুবই কঠিন। ব্যতিক্রম আছেন। শহীদুল জহির আছেন। কিন্তু ৫০ বছরে সচিবালয়ে ওই একজনই। হয়ত আরেকজনের নাম বলতে পারব। আবু জাফর ওবায়দুল্লার নাম বলা যাবে। কিয়দংশ সাচিবিক চরিত্রের জায়গা থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাম বলা যাবে। বা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের জায়গা থেকে বললে অন্নদাশঙ্কর রায় বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলা যাবে। কিংবা এই আমলের রণজিৎ দাশের কথা বলা যাবে। মেক্সিকান আমলা অক্টাভিও পাজের কথা বলা যাবে। যিনি দিল্লিতেও অ্যামবাসেডর ছিলেন এবং নোবেল পেলেন কবিতায়। তো সবার পক্ষে কি সম্ভব ওই মাধ্যমটার জন্য নিজের জীবন পুরোপুরি দিয়ে দেওয়া? এইটা একটা দ্বন্দ¦বহুল প্রশ্ন। প্রেমিক সবাই। এখন লেখক কতটা লেখায় সময় দেবেন তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রেমিক কতটা প্রেমে সময় দেবেন তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনো প্রেমিক প্রেম করতে যায়, প্রেমিকার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, পথের ধারে তাকিয়ে থাকে, কথা বলার জন্য আকুপাকু করে। তারপর সেই মেয়ের সাথে হয়ত প্রেম হয়। হয়ত হয়ই না। অন্যত্র প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায়। সে প্রেমিক তবু অপেক্ষায় থাকে। কোনো-কোনো প্রেমিক তাকে আজ প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে কালই বিয়ে করে ফেলে। অনেক ধরণের প্রেমিক। কোনো-কোনো প্রেমিক আছে সারাজীবন প্রেমিক। আবার কোনো-কোনো প্রেমিকের বিয়ের পর বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে যায়। সেও প্রেমিক। যে যার মতো। সেভাবে কোনো-কোনো শিল্পী শিল্পকলার জন্য জীবনটা দিয়ে দেন। বুদ্ধদেব বসু বলতেন যে, শিল্পের দেবী শিল্পীকে ভোগ হিসেবে নেয়। জীবনানন্দ দাশ একজন অসফল সংসারী লোক, কবিতায় দারুণভাবে সফল। তবে এটা ঠিক যে শিল্পকলা একটু বৈরাগ্যের দিকে টানে। আর শিল্পকলার বাইরের যে দৈনন্দিন জীবন তা একটা বিষয় ও বাসনার দিকে নিয়ে যায়। তো বিষয় ও বাসনার সাথে বৈরাগ্যের একটা দ্বন্দ্ব তো আছেই। বাড়ির সঙ্গে রাস্তার একটা দ্বন্দ্ব আছে। রাস্তা তাকে নিয়ে যাবে একদিকে, বাড়ি বলবে থামো, এখানে এসে ঘুমোও। আমি মনে করি যেকোনো শিল্পমাধ্যমেই পুরো সময় দিলে সিদ্ধি যেখানে যায় সেখানে আরো যেতে পারবে। কেরানিগিরি, অধ্যাপনা, ব্যবসা, বউ-বাচ্চা-কাচ্চা এসব করে শিল্পকলাও একটু করি- এই লোকদের সংখ্যাই বেশি। তাই তাদের হয় না। বইমেলায় ৯০ শতাংশ বই ট্র্যাশ হয় এই কারণে। তারা মনে করছে হয়েছে। কিন্তু আসলে হয়নি। আমি ফুলটাইমের পক্ষপাতী। প্রেম করলে ফুলটাইম। শিল্পকলার সাথে প্রেম করলেও সেটা ফুলটাইম। এই যে শহীদুল জহির- উনি কি সংসার করেছেন? উনি সচিবালয়ের মধ্যেও অন্য সচিব থেকে আলাদা ছিলেন। সাচিবিক ক্ষমতা প্রয়োগ, একটা বিরাট কিছু, ঔপনিবেশিক ব্যাপার- এইসব তিনি ওন করতেন না। আমি বলতে পারি, শহীদুল জহিরও শিল্পকলাকে তার পুরোটা দিয়েছেন।

 


একটি পাখি একটি পাখিকে ভালবাসতে গেলে তো সেখানে কোনো কাজী বা পুরোহিত পাখি যায় না। মানুষের জন্য এইসব রাখা হয়েছে। কারণ মানুষকে কনজিউমার করে কিছু লোক সুবিধায় থাকবে পরিশ্রম না করে। চুমু খাওয়া বা সেক্সের বর্ণনা আমাদের সাহিত্যে-কবিতায় দেখা যায় না খুব একটা। অথচ এই দেশের জনসংখ্যা বিশ কোটি হয়ে বসে আছে।

 

 

শিমন রায়হান: এই প্রশ্নটিও পুরোনো এবং মীমাংসিত। অনেকের কাছেই মীমাংসিত। আমাদের কাছেও এই প্রশ্ন এক ধরনের মীমাংসা পেয়ে আছে। এই উপমহাদেশে বিশেষত বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে তরুণ কবিরা তাদের বেড়ে ওঠার সময়টিতে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে, সাধারণত একটি প্রশ্ন ফেস করে মার্ক্সবাদী বন্ধুদের কাছ থেকে। তা হলো, শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিষয়ে। যদিও একজন শিল্পীমাত্রই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। এবং দাবী-দাওয়া, একটা গৎবাঁধা ফর্মের মধ্যে লেখা, কী নিয়ে লেখা হবে এইসব শর্তের সাথে তার যেমন সংঘাত থাকে, তেমনি বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠানের সাথেও তার সংঘাত থাকে। সে আসলে আজন্ম প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সেই মীমাংসা নিশ্চয় আপনার মধ্যে হয়ে আছে। এই প্রশ্নগুলো ফেস করেই আপনারা নিশ্চয় বেড়ে উঠেছিলেন আপনাদের প্রস্তুতিপর্বে। মানুষের কাছে আপনার কবিতার দায়বদ্ধতা কী রকম?

টোকন ঠাকুর: বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা আমারো আছে। বামপন্থী দলগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হয় আর জেলাশহরে তাদের শাখা সংগঠন থাকে। এরা সব চাকর-বাকর। মহাভারতে একটা কথা আছে ‘যযাতি’। পুত্রের যৌবন হরণ করে পিতা যুবক হয়ে বিয়ে করতে গেলেন। পুত্রকে বললেন, বাড়ি পাহারা দাও। এইভাবে বয়স্ক কিছু লোকেরা তাদের মূল সংগঠনের ব্যানারে যুবকদের আটকে রাখে ছাত্র সংগঠনের নামে। যুবকেরা বুড়োদের স্বার্থ সংরক্ষণে মিছিল-মিটিং করে। বুড়োদের নেই যৌবন, নেই যৌনতা, আছে স্বার্থের খায়েশ। শুরুর দিকে আমার কাছে এদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। এখন মনে হয়, সবই ভুয়া। কিছু যুবক একসাথে দাঁড়িয়ে মাস্তানি করে। মাস্তানির নাম দিয়েছে ছাত্ররাজনীতি। ফলে তাদের বক্তব্যের কোনো ভেল্যু নেই আমার কাছে। বানোয়াট, জোচ্চুরি। আর কবিতাচর্চা তার-তার মতো। যে যেমন খুশি লিখবে। তার মতো করে বিকাশ হবে। কে কী বলল এটা আমলে নেয়ার বিষয় না। নিজে করতে-করতে একটা ভাষা দাঁড়াবে। নিজের ভাষা অর্জন করতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। অনেকে নিজের ভাষায় পৌঁছুতে পারেই না সারাজীবনে।

শিমন রায়হান: দাদা, দুইটা শহর এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা এবং ঢাকা। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে। একটা শহরের যেমন চরিত্র থাকে তেমনি সেই শহরে, সেই অঞ্চলে বসবাসকারী শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্পকর্মের মধ্যেও তার একটা প্রতিফলন থাকে, একটা ক্যারেকটার দাঁড়ায়। সেই শহরে যদি শিল্পীরা না জন্মাতেন তাহলে সেই শহর হয়ত গণমানুষের রক্ত-ঘাম ও করে খাওয়ার একটা শহর হিসেবে কেবল থেকে যেত। শহরে শিল্পীরা থাকেন বলে তাদের কবিতায়-ভাস্কর্যে-সিনেমায়-গানে সেই শহরের একটা আলাদা চরিত্র শিল্পীরা দাঁড় করান। আপনি নাগরিক হিসেবেও ঢাকায় বসবাস করছেন বেশ কয়েক দশক। কলকাতা শিল্পসাহিত্যের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর এই অঞ্চলে। এবং ঢাকাকেও সেই শহরের একটি প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকা কতখানি মেট্রোপলিটন, কতখানি আরবান সেটি নিয়ে নানারকম প্রশ্ন আছে। আপনার চোখে ঢাকা-ঢাকার কবিতা-শিল্পচর্চা কিভাবে ধরা পড়েছে?

টোকন ঠাকুর: এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আগের প্রশ্নের একটি অংশ মনে পড়ল। প্রতিষ্ঠানের সাথে তরুণদের একটি বিরোধ থাকে। এটি সত্য। কারণ তরুণরা স্বভাবতই অনাপোষী। তারা স্বভাবতই সাহসী। অধঃপতন তার দ্রুতই হয় না। আর অপোজিটে প্রতিষ্ঠানমাত্রই দুর্নীতিগ্রস্ত। বিশ্ববিদ্যালয় একটি ক্লাবঘর। সুতরাং তার ভেতরে একটি দুর্নীতি আছেই। অসংখ্য মানুষকে ঠকানোর জন্য ওই ক্লাবে লোক বসে আছে। এটি সচিবালয় হতে পারে, ব্যাংকও হতে পারে। প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতেই জন্মায়নি। তরুণরা এটি মেনে নিতে পারবে না এটিই স্বাভাবিক। তরুণরা সাহসী, অনাপোষী এবং রোমান্টিক। রোমান্টিক লোক একটু কম অসৎ হতে পারে। সেই কারণে তরুণদের সাথে প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব থাকে। এইজন্য লিটলম্যাগাজিন হয়, ব্লগ হয়। আবার এমন কেউও আছেন যিনি লিটলম্যাগ করেন না, ব্লগ করেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সাথে বোঝাবুঝি করে তিনি তার মতো মুভ করেন। সেই লোকটিও তরুণ। সেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার কথা হয়ত আমরা জানবও না। কারণ সে লিটলম্যাগাজিনের লোক নয়, বড়কাগজেরও নয়। তো এই দ্বন্দ্ব চিরকালের। প্রতিষ্ঠানগুলো বয়স্করা চালায়। আর বয়স্করা দুর্নীতিগ্রস্ত হন। প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা দুর্নীতিগ্রস্ত হন। এই আকাক্সক্ষাতেই তো একটি ছেলে বিসিএস দেয় যে, দুর্নীতি করে বউ-বাচ্চা বড়জোর বাবা-মাকে নিয়ে ভাল থাকবে। এদের আবার বলে মেধাবী। বোকাচোদাদের আমাদের দেশে বলে মেধাবী! যদি এই বিসিএস-বোকাচোদাদের সাথেই থাকতে হয় তো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলাম কেন? পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলাম কেন? প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কি কেবল কবিতায়? কবিতা তো একটা সামান্য ব্যাপার। সব কিছু মিলেই জীবন। জীবনের প্রশ্নে আসতে হবে। জনভাষাকে এড়িয়ে যাওয়া হয় আমাদের মূলধারায় মিডিয়ায়। আমি আমার বক্তব্যে কয়েকটি জনভাষার স্ল্যাং দিয়েছি। এটি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। বোকাচোদাকে বোকাচোদা বলা শ্রেয়তর। এই বোকাচোদা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে আমরা শিল্প-সাহিত্যের আঁটি বেঁধে যাচ্ছি! এর মধ্যে কেউ ছোটকাগজ, কেউ বড়কাগজ- দু’পক্ষই বালেশ্বর বাল! বাংলাদেশে একটি অশিক্ষিত পদের নাম- অধ্যাপক। তারাই বেশিরভাগ লেখক হয়ে বসে আছে। মূর্খরা এখানে বিসিএস আর অধ্যাপক হয়েছে। চাকরি পাওয়া পর্যন্ত যা জানার ওইটুকু জেনে এদের পড়াশোনা শেষ। তোমার প্রশ্নটা কী ছিল যেন?

শিমন রায়হান: দুইটা মহানগর…

টোকন ঠাকুর: কলকাতা শহর এই অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠেছে। পূর্ববাংলাও অনেক ঘামশ্রমে গড়ে উঠেছে। কলকাতাও একটি দুর্নীতিগ্রস্ত শহর। নগর মানেই তো দুর্নীতির শুরু। শহরের ষোলজনাই বোম্বেটে- দেড়শ’ বছর আগে লালন ফকির বলে গেছেন এই কথা। লালন ফকিরের চেয়ে বড় কোনো দার্শনিককে এই অঞ্চলে আমরা চিনি না। তো উনি তো বলে গেলেন এটা। ওই শহরের লোকেরা লাউটা-মাছটা-সবজিটা কী করে শহরে আসবে তার জন্য যা করা দরকার তাই করেছে তিনশ’ বছর। এখন ঢাকা করছে পঞ্চাশ বা সত্তুর বছর। বৃহত্তর মানুষকে ঠকানোর জন্য নগরায়ন হয়, নগর গড়ে ওঠে। সেইখানে বসে শিল্প-সাহিত্য যা হয় সেটাও এক ধরণের ঠকবাজি। গ্রামের একটা সরল লোক এসে প্রথমে দ্বন্দ্ব হলেও পরে সে যত নষ্ট হয় তত এই শহরের সাথে তার আত্মীকরণ হয়। সে এই শহরের লোক হয়ে ওঠে। নাগরিক হয়ে ওঠে। নাগরিক জীবন মানেই একটা ফঁড়িয়ার জীবন। নগরে কোনো ভাল লোক থাকে না। কবি নগরে থাকতে পারে না। আমিও এই নগরে একটি ফঁড়িয়ার জীবন গ্রহণ করেছি। আমি কখনো দেখিনি ঢাকা বা কলকাতার কোনো লিটলম্যাগ লেখক নগর ও গ্রামের এই দূরত্ব নিয়ে কথা বলছেন। সে হয়ত সুবিমল মিশ্র আর আনন্দবাজার নিয়ে বহু বছর কাঁটিয়ে দিয়েছে। এখন যেমন ঢাকায় বসে প্রথম আলো আর প্রথম আলো নয় এই দিয়েই ২০-২৫ বছর কেটে যাচ্ছে জেনারেশনের। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো অফিস। সেখানে বিরাট বড় সবজির বাজার। সেখানে ঘুরলে বোঝা যাবে কী করে কৃষকের দুই টাকার সবজি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝখানে ৬৩ টাকা কোথায় গেল- এই অংকটা টের পাওয়া যাবে সেখানে। এটা বাংলা কবিতার অদ্যোপান্ত খুঁজে পাবার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তো এই নগরগুলো দুর্বৃত্তায়িত। এখানে সবাই শোষিত-বঞ্চিত, আবার তারাই লুটেরা হতে আগ্রহী। এই লড়াইয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যে কবিতা টিমটিম আলোয় জ্বলছে। এ রকম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পলিউটেড একটা শহরে কবিতার কথা কেন যে বলে লোকে? আদিক্ষেতা করে বলে হয়ত।

শিমন রায়হান: আপনার একটি লাইন আছে, ‘রাক্ষসের ছদ্মবেশে কবিতা লিখি’ এবং একটি কবিতার ভেতরে আপনি বলছেন, আপনি দরিদ্র সাধুকন্যার পতি- এর মধ্যে নিশ্চয় একটি গাঢ় অভিমান আছে। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে পৌঁছয় এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা। কবির জন্য এই বিচ্ছিন্নতা কি অনিবার্য?

টোকন ঠাকুর: বলে কয়ে বিচ্ছিন্নতা বা অন্তরঙ্গতা আসলে হয় না। আমি ব্যক্তি এই সমাজের সাথে বিচ্ছিন্ন তা নয়, আবার বিচ্ছিন্নও। প্রতিটি মানুষই তাই। দিন শেষে একা ঘুমোতে যাই। পাশের মানুষটিও টের পায় না যে, ও কী মাথায় নিয়ে ঘুমোচ্ছে। তবে হ্যাঁ, একজন কবি যদি মাছবাজারে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বোঝা যাবে চারদিককার যে কোলাহল, যে শব্দ, তার সাথে এই লোকটির সম্পর্ক কম, সে যদি খেঁয়াঘাটে গিয়ে দাঁড়ায় বা রেল স্টেশনে, পাসপোর্ট অফিসে যদি যায়, ব্যাংকে যায়- সেখানকার যে পরিভাষা তাতে কবি কেন যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। সংবেদনশীলতা আর নষ্টামির জগৎ একসঙ্গে চলে না। চাকরি করে বউ-বাচ্চা থেকেও একটি লোক বিচ্ছিন্ন হতে পারেন। প্রমাণ- জীবনানন্দ দাশ, কুসুমকুমারী দাশের ছেলে। আমরাও প্রমাণ তার।

 


বইমেলা তো আমাদের মূল লক্ষ্য না। মূল লক্ষ্য ভাল বই, তার পাঠক এবং ওই বইয়ের টেক্সট ওই পাঠকের মধ্যে ঢুকে পড়া। সেটা তো হচ্ছে না। তিনশ’টি কবিতার বই বিক্রি হয় না একজন তরুণ কবির। বই বিক্রির কমতি দিয়েই বোঝা যায়, ঘাপলা আছে।

 

শিমন রায়হান: একটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে ঢুকব। যৌনতা। সেটা এজন্যেই ঢুকব যে, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, একটি সমাজ কতখানি সভ্য তা বিচারের অনেকগুলো অনুষঙ্গের মধ্যে একটি হচ্ছে, সেই সমাজ কিভাবে তার যৌনতার চর্চা করে? সেই সমাজের যৌন সংস্কৃতি কী? আমাদের সমাজ অত্যন্ত রুদ্ধ। এবং আমরা বইপত্র-ইতিহাস ঘেটে যা জানি, চার-পাঁচ হাজার বছর আগেও তাদের মতো করে একটি আপাত মুক্ত যৌনতার ক্ষেত্র হয়ত ছিল। হয়ত সেটা খুব একটা প্রকাশ্য না কিন্তু তা এখন নানাভাবে আরো অতিরুদ্ধতার দিকে যাচ্ছে। এই সমাজে শরীর এখনও একটা মারাত্মক রকমের ট্যাবু। এবং শরৎ ও মানিক দুটো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাওয়া ক্যারেকটার আমাদের বাংলাসাহিত্যে, যেহেতু কথাসাহিত্যে এটি আরো স্পষ্ট হয়ে আসে, কবিতায় ধরতে পারে না সাধারণ মানুষ। হয়ত শরৎ-এর তিনশ’ পাতার একটি উপন্যাসে পাত্র-পাত্রী হাতই ধরছে না। যারা প্রচণ্ড অযৌন, শরীর সেখানে ট্যাবু। সেখানে মানিক হয়ত বিপরীত শিবিরে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু পপলিটারেচার যা মধ্যবিত্তকে অনেক বেশি প্রভাবিত করলো। সেখানে বাঙালি আধাশিক্ষিত মধ্যবিত্তকে এই ট্যাবুর মধ্যে আটকে রাখার পেছনে শরৎ সাহিত্যের কিছুটা ভূমিকা ছিল কি না? আমরা আজকের সমাজেও দেখি গোপনীয়তার ব্যবসা। প্রচণ্ড নীতি পুলিশীর সমাজ। রিসোর্টের ব্যবসাগুলো টিকে আছে নীতি পুলিশী এড়াতে। তারা মূলত গোপনীয়তা বিক্রি করছেন। প্রশ্নটি হচ্ছে, প্রেমের সাথে তো যৌনতা একেবারেই অবিচ্ছেদ্য। আমার মনে হয়, বয়ঃসন্ধি থেকে পরিণত যৌবন, তারপর আরো পরিণত যৌবন এবং মাঝবয়সের দিকে গিয়ে প্রেম এবং যৌনতার ধারণা নিজের মধ্যে বহুভাবে বদলায়। একজন শিল্পীর মধ্যেও সেটি ব্যাপকভাবে ঘটে। তার লেখালিখিতেও এর প্রভাব পড়ে। আমরা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও দেখেছি বিয়ের পর তাঁর লেখায় যৌন প্রতীক ও অনুষঙ্গগুলো যেভাবে এসেছে। সব লেখকেরই এটা হয়। হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তি প্রসঙ্গক্রমে বলা, প্রবচনগুচ্ছে উনি বলেছেন, ‘প্রেম পুঁজিবাদের আমলের সবচেয়ে বড় কুসংস্কার’। এই বিশ্বাসের ওপর যদি আমরা দাঁড়াতে যাই বা কাছাকাছি কোথাও দাঁড়াই, তাহলে কবিতার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যায় কিনা। কবিতার বিরাট একটা ভরকেন্দ্র প্রেম। সে জায়গাটিতে আমাদের ট্যাবু, যৌনসংস্কৃতি এবং হুমায়ুন আজাদের এই বক্তব্য ধর্তব্যে নিলে আপনার মতামত কী হবে সব মিলিয়ে?

টোকন ঠাকুর: আট-দশটি প্রাণীর মতো মানুষও একটি প্রাণী। সেই হিসেবে নর-নারীর মধ্যে আকর্ষণ থাকবে এবং তারা মিলিত হবে। কিন্তু সব নারী বা পুরুষ সব পুরুষ বা নারীর সাথে মিলিত হতে চাইবেন না। তাদের পছন্দ আলাদা হয়ে যাবে। যেকোনো পুরুষ দিয়েই তার হচ্ছে না, যেকোনো নারী দিয়েই তার হচ্ছে না। শুধু শরীরেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আরো কিছু লেগে যাচ্ছে। এ কারণে প্রেম থেকে যাচ্ছে। আবার হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যকে ধর্তব্যে নিলে তাঁর নিজেরই অনেক কবিতা উড়ে যাবে তাঁর কথার ধাক্কায়। তবে প্রেম বা যৌনতা প্রধানত ব্যবসা। মানে ব্যবসার আওতাভূক্ত। আমরা যে সময় ও সমাজে আছি সেখানকার শাসকেরা তাদের টিকে থাকার জন্য কিছু আইন ও নীতি-আদর্শ বানিয়েছেন। এগুলো বানাতে গিয়ে তারা প্রেম ও যৌনতার ওপর শর্ত আরোপ করতেও বাদ রাখেননি। এখানেও তারা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। ধর্ম যেহেতু পুঁজিবাদের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, তাই ধর্মও পুঁজির পক্ষে বুলি আওড়ায় কিতাবের নামে। সাধারণ মানুষদের আটকে রাখা দরকার এইজন্য যে, তারা ক্লায়েন্ট এই ব্যবসার। সাধারণ মানুষের জন্য যৌনতা এতো সহজপ্রাপ্য রাখা হয়নি কারণ এটা বিজনেস। একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসবে সেখানে কাজী অফিসে গিয়ে ট্যাক্স দিয়ে আসতে হবে কেন? হু ইজ কাজী? একটি পাখি একটি পাখিকে ভালবাসতে গেলে তো সেখানে কোনো কাজী বা পুরোহিত পাখি যায় না। মানুষের জন্য এইসব রাখা হয়েছে। কারণ মানুষকে কনজিউমার করে কিছু লোক সুবিধায় থাকবে পরিশ্রম না করে। চুমু খাওয়া বা সেক্সের বর্ণনা আমাদের সাহিত্যে-কবিতায় দেখা যায় না খুব একটা। অথচ এই দেশের জনসংখ্যা বিশ কোটি হয়ে বসে আছে। সাধারণ মানুষ জানেও না, তারা কনজিউমার হয়ে বসে আছে। পলিটিক্যালি দেখতে হবে সব কিছু। পলিটিকস্-এর বাইরে কিছুই নয়। শিল্পপতির কিশোরী-কন্যার মতো শ্রমিকের কিশোরী-কন্যা অতো সুন্দর হয় না। কারণ তার খাওয়া হয়নি ঠিকমতো, ঘুমোনো হয়নি, বিশ্রাম হয়নি। তাই তার লাবণ্য কম। অর্থ বিনিয়োগ হয়নি তার যৌবন বিকশিত হতে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে ভাবতেই পারে না যে, গার্মেন্টস-এর মেয়েদের বিয়ে করা যায়। কারণ মেয়েটি হলুদ, পান্ডুর বর্ণ, রুগ্ন। তাদের দর্জিগিরিতেই এই উন্নতি কিন্তু তারা এই সমাজে একটা অন্য প্রজাতি হিসেবে আছেন, যাদের মধ্যবিত্ত কখনই প্রণয় প্রস্তাব দেবে না। এটাও কর্তৃত্বের অংশ। আমিও কর্তৃত্বকারীদের মধ্যে অবস্থান করছি কোনো না কোনো ভাবে। প্রথমে এই সমাজটিকে একটি বাজে সমাজ হিসেবে মেনে নিতে হবে। যে সমাজে একটি হিন্দু ছেলের সাথে একটি মুসলমান মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবই হয় না, সেই সমাজ কী করে অসাম্প্রদায়িক সমাজ হয়? যে সমাজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও হিন্দু হল আলাদা, মুসলিম হল আলাদা, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার একশ’ বছর পূর্তি করছে। তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কী শেখালো! দেশের আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো তো হাইস্কুলও না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এদেশের হাজার-হাজার লোক যখন দাবী করেন তারা শিক্ষিত, সেটা একটা বাখোয়াজি, সেখানকার শিল্প-সাহিত্যও বাখোয়াজি।

শিমন রায়হান: একটি সম্পূরক প্রশ্ন। তা হলো ফ্রয়েডের চোখে দেখা, মানিকের চোখে দেখা প্রেম, যা আসলে যৌনচেতনার একটি স্তর ব্যতীত আর কিছুই নয়। সেই চিন্তার কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন? নাকি আমাদের হাজার বছরের প্রথা-পদ্ধতি, শিল্প-সাহিত্য, আর নানা ইন্ডাস্ট্রি যার ওপর দাড়িয়ে আছে, সেই নরম-কোমল যে প্রেমপ্রতিমা তার পক্ষেই আপনি থাকছেন?

টোকন ঠাকুর: আমি কোন পক্ষে আছি তা তো এই প্রশ্ন শোনার আগ পর্যন্ত ভেবে দেখিনি। তবে একটু বিশ্লেষণে গিয়ে দেখতে পারি আমরা। হাজার বছরের যে স্বপ্ন-কল্পনা, প্রেম-প্রতিমা আছে তা একেবারে যৌনতা বহির্ভূত করে ফেলার দরকার নেই। যৌনতা বহির্ভূত হয় নাকি কিছু? যেখানে প্রতিটা প্রাণী জন্মায়ই যৌনতার ভেতর দিয়ে। আবার শুধু যৌনতা বলেও কিছু নেই। যদি থাকত তাহলে আফটার সেক্স একজন আরেকজনকে ছেড়ে চলে যেত। তাই প্রেম ও যৌনতা আলাদা করার কিছু নেই। এটা খাবারের মতো। সবার যেমন সব খাবার ভাল লাগবে না। তাই সবার সাথে সবার প্রেম ও সঙ্গমও ভাল লাগবে না। এগুলো এক কথায় বলা যাবে না। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন একটি ছেলে ও একটি মেয়ে স্কুল শেষে একসাথে বাড়ি যাচ্ছে এই দৃশ্যই কল্পনা করা যেত না। অথচ সেই সময়ে ঢাকার ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরছে, ঘুরছে, সেক্স করছে- এই অবস্থা ঘটমান ছিল। তাই ওই সময়টা ঢাকা আর আমার গ্রাম এক নয়, বাংলাদেশের মধ্যে থেকেও। এখানে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতি জড়িত।

শিমন রায়হান: এই সূত্রে কি বলা যায় নগর যেভাবে গ্রামের কাছে গরীব তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য ও অন্যান্য বিবেচনায়, কিছু-কিছু বিবেচনায় নগর আসলে ধনীও গ্রাম অপেক্ষা?

টোকন ঠাকুর: গ্রামীণ সমাজ তো আমাদের প্রাচীন সমাজেরই ধারাবাহিকতা। নগর তো অতো প্রাচীন নয়। তাই তারা গ্রামীণ জীবন থেকে বেরিয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের পথে হয়ত কিছু বিষয় অর্জন করেছে। সেখানে যেমন মানুষ ঠকানো আছে আবার নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ও আছে। সেই অভিপ্রায় থেকে নগর কিছু সুবিধা পায়। তারা এই ক্রাইসিস থেকে মুক্ত কারণ তাদের সারাদিন ডিল করার মতো আরো অনেক সাবজেক্ট আছে। যে সাবজেক্ট গ্রাম ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নেই। তাদের ওইটাই সংস্কৃতি। থাইল্যান্ডে যৌনতা বিক্রি করে জাতীয় রাজস্ব আসে। তিব্বতে এক নারী বহুপতি ধরেন। আমাদের এখানে হলে তো ব্যাভিচার হতো। লালন ফকিরও এই কথা বলে গেছেন। ঢাকার মধ্যেও অনেক ঢাকা। কাঠালবাগান ঢালে যিনি থাকেন আর গুলশান-বনানীতে যিনি থাকেন তারা ভিন্ন-ভিন্ন নাওয়া-খাওয়া, বিছানা-বালিশ, যৌনতা নিয়ে থাকেন। এ রকম বাড়িও আছে, যে বাড়ির প্রথম কেউ শিক্ষিত হবার জন্য আজ স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। আবার এমন বাড়িও আছে যেখানে আশি বছরের লোকটি মারা গেলেন, যিনি এমএ পাস ছিলেন।

শিমন রায়হান: রাজনীতি নিয়ে একটু কথা বলতে চাই এখন। বাংলা সিনেমার সুবাদে, খান আতাউর রহমানের সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা দেখে বাঙালিরা মনে করতেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি। আমরাও একটা সময় পর্যন্ত মনে করতাম। পরে পড়ে জানলাম। আরো জানলাম যে, বারো ভূঁইয়ারাও আসলে বাঙালি ছিলেন না। তো হাজার বছরের পথ পরিক্রমায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা প্রথম তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের যে অধিকার পেলেন- সেই বিবেচনায় যদি এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকে, তার প্রেক্ষিতে আজকের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য, মৌলবাদের দিকে তার যাত্রা- আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে গেছে? বা এতো কঠোরভাবেও যদি না বলেন- কতখানি আশা পূরণ করতে পেরেছে?

টোকন ঠাকুর: ব্যর্থ হয়ে গেছে, আমি বলব না। একটি লড়াই অব্যাহত আছে। ১৯৭১, অনেক বছরের লড়াই সংগ্রামের একটি পরিণতি। কিন্তু লড়াই শেষ হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে। জাতিগতভাবে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার অনুশীলন করতে পারে শুধু শাসকবর্গ। তাই বৃহত্তর মানুষ এক অর্থে পরাধীন। সাধারণ মানুষের ওপর শাসকবর্গের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব কমানোর দরকার ছিল। তাহলেই স্বাধীনতা অর্থবহ হতো। এখানে শাসকবর্গ যেন দানব আর সাধারণ মানুষ ভয় পাওয়া খরগোশ। একজন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরে যাচ্ছে, সেও স্বাধীন দেশের নাগরিক। আর একজন ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে নামবে, সেও স্বাধীন দেশের নাগরিক। মৌলবাদিতাকেও এসবের নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। কারণ এর বাইরে কিছুই নয়। পেটে ভাত না থাকলে কিছুই চলে না। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যান। কিন্তু হয়তো একই বেশ্যালয়ে সবাই যায়। সেই হিসেবে বেশ্যালয়কে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে। টাকাও অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের। কেননা টাকা দিয়ে ধর্মগ্রন্থও কেনা যায়, মানুষ খুন করানোও যায়, বেশ্যালয়েও যাওয়া যায়। কিন্তু টাকা যার হাতে ক্ষমতা তার হাতে। আসলে বিনিময় যুগের পর মুদ্রা আসার পরেই মানুষকে অধিক বঞ্চিত করা শুরু হয়েছে।

শিমন রায়হান: এবার একটু বইমেলা প্রসঙ্গে আসি। আয়তনের বিচারে আমাদের বইমেলা পৃথিবীর অন্যতম বড় বইমেলা। হয়ত স্টলের বিচারে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা সর্ববৃহৎ। কলকাতা বইমেলাকে সম্ভবত বছর দুই আগে আমরা পেছনে ফেলেছি আয়তনের বিচারে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার ব্যাপ্তি দিয়ে। তো গায়ে-গতরে এতো বড় একটা মেলা, এতো মানুষের পদচারণা, আমি কদাচিৎ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা কিছু লোককে মেলায় দেখি। এই জাতীয় লোকদের বইমেলায় পেলে আমি বিশেষ কৌতুহলে তাদের চোখের দিকে তাকাই। আমি বোঝার চেষ্টা করি, ওরা যখন বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আসে তখন আমাদের একটু ইনফিরিয়র মনে করেই আসে। তো এরকম রাস্তার পাশে প্রসাব করা, ফুটপাতে ঘুমোনো, পশ্চাৎপদ চিন্তা, রাজনীতি ও সংস্কৃতির লোকজনের দেশে যখন এতোবড় বইমেলা হয়- সেটা তো কিছুটা পরস্পরবিরোধী। সেই দেশে রেঁনেসা নাই, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও সমৃদ্ধি নাই অথচ গায়ে-গতরে বিশাল বড় একটি বইমেলা হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি মেলানো যায় না। অদ্ভূত! ওরাও হয়ত মেলানোর চেষ্টা করে। তো এই ক্রমবর্ধমান বইমেলার সাথে আমাদের প্রকাশনা শিল্প, লেখকদের জীবিকার মতো নানা প্রশ্ন জড়িত। আমরা জানি, বাংলাদেশে পেশা হিসেবে লেখালিখি তেমনভাবে দাঁড়াতে পারেনি। আপনার জীবন দিয়েও তার একটা উপলব্ধি আপনার আছে। এই জায়গা থেকে যদি একটু বলতেন- বাংলাদেশের বইমেলা, প্রকাশনাশিল্প ও লেখকের জীবিকা প্রসঙ্গে।

 

 


পুঁজি ঢুকলেই পুঁজিওলার মতামত ঢুকে যাবে। নিজের মতো করতে দেবে না। অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি ঘটে গেলে শহীদুল জহিরের মতো লেখকের পাঠক যেমন বাড়বে, তেমনি ভাল সিনেমার দর্শকও বাড়বে।

 

টোকন ঠাকুর: প্রায় হাফ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেলা হচ্ছে। চারশ’ স্টল হচ্ছে এবং প্রচুর লোকসমাগম হচ্ছে। যেদেশে হচ্ছে সেদেশের লোক মূলত আঠারো কোটি। বইমেলা তো আমাদের মূল লক্ষ্য না। মূল লক্ষ্য ভাল বই, তার পাঠক এবং ওই বইয়ের টেক্সট ওই পাঠকের মধ্যে ঢুকে পড়া। সেটা তো হচ্ছে না। তিনশ’টি কবিতার বই বিক্রি হয় না একজন তরুণ কবির। বই বিক্রির কমতি দিয়েই বোঝা যায়, ঘাপলা আছে। একটি লোক দেখানো হুজুগেপনা আছে। বইমেলার ওখানে বইয়ের না হয়ে যদি গাবের মেলা হতো, লোক এই বইমেলার চেয়ে আরো বেশি হতো। একমাস ধরে যেখানে শুধু গাব পাওয়া যাবে। বইমেলার ওখানে যদি শুধু ব্রা দিয়ে মেলা করা হতো, চারশ’ স্টলে চারশ’ রকমের ব্রা পাওয়া যাবে, তাহলেও আরো বেশি নারী ও পুরুষ আসত। বইমেলার এই আয়তন দিয়ে কিছুই যায় আসে না। যেখানে আঠারো কোটি লোক, সেখানে একটি ভাল বই কমপক্ষে ৬০-৭০ লাখ যাবার কথা। সেটা তো কল্পনাও করা যায় না। এতোটুকু জায়গার মধ্যে যখন আঠারো কোটি লোক জন্মে গেছে, তার মানে এখানে বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা আর নেই। বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থাকলে তো এতো লোক হতোই না। বইমেলাও তো চলছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। তাতে কী হলো? লোক তো বেড়েই যাচ্ছে। আমাদের যে প্রধান রপ্তানির বিষয়, প্রবাসী শ্রমিক- তাদের নামের আগে লেখা থাকে ‘অদক্ষ শ্রমিক’। মানে কিছুই পারে না সে। তাই সর্বোচ্চ কম বেতনে তাকে নেওয়া হয়। মানে এতো টাকা খরচ করে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে, প্রিয়জন থেকে দূরে থেকে যদি ১২ হাজার টাকা বেতন হয়! প্রকাশকও এখানে অনেক। আলু-পটলের ব্যবসাও করা যায়, বইয়েরও করা যায়- করি একটা! বইয়ের ব্যবসা করে যাচ্ছে তাই। বইমেলার ৯০ শতাংশ বই বাজে প্রকাশনা। দু’য়েকটি বিতর্কিত বইকে বইমেলা থেকে বের করে দেয়। আসলে তো দরকার ছিল ৯০ শতাংশ বই বের করে দেওয়া। বাংলা একাডেমির মতো অকেজো একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তো তা সম্ভব না। এটা কোনো একক নিয়ন্ত্রিত জায়গাও নয়। যার ফলে যে যার মতো করে যাবে। সুষ্ঠু একটি পরিবেশ হবে বলে মনে হয় না। হিসেবে তো শহীদুল জহিরের একটি বই ৫০-৬০ লাখ বিক্রি হবার কথা ছিল। এক কোটিও হতে পারত। হবে কী করে মানুষকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে আমরা ঠকিয়ে রেখেছি। যার ফলে মানুষের এখনও বিষাদসিন্ধু আর মহাভারত ভাল লাগে। চমস্কি, দেরিদা, ফুকো কী করে আমার কৃষকের কাছে পৌঁছবে। ওর তো এলাকার পুঁথিপাঠের আসরে যাওয়ারই সময় নেই সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর। সে তার টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। তাকে বইমেলা কিভাবে কানেক্ট করবে। মানুষের এই পিছিয়ে থাকার জন্য এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব দায়ী। রবীন্দ্রনাথ কি এখানে ছায়ানটে একটা ভবনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবেন? সাধারণ মানুষের সাথে তার বিচ্ছিন্নতা তো তাহলে থাকবেই। কিন্তু ঠিকই কিছু সুবিধাবাদী লোক রবীন্দ্রনাথকে ‘আমার’ করেই রাখবে। তাই এই বইমেলার ব্যপ্তি নিয়ে আমার কোনো উচ্চাশা নেই।

শিমন রায়হান: আজকে সিনেমা নিয়ে খুব বেশি কথা আমরা বলব না। কেবল একটি প্রশ্ন আমি করতে চাই। সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আপনার সিনেমা দেখার চোখ আছে। আপনি ছবি বানিয়েছেনও- ‘ব্ল্যাক আউট’, পরবর্তীতে সরকারি অনুদানে করছেন- ‘কাঁটা’। বাংলাদেশী সিনেমার আসলে সংকট কী? আমি এখানে অলটারনেটিভ সিনেমা নিয়েই কেবল বলছি না, মেইনস্ট্রিমের কথাও বলছি। আপনার কী মনে হয় না বাংলাদেশে শিক্ষিত যে ক’জন তরুণ সিনেমা বানাতে এসেছিলেন- তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেশি, কিছু একটা বানিয়েই কানে গিয়ে পুরষ্কার জিতে আসতে হবে এমন? একটি বিরাট অংশের মানুষ তো আসলে ফিল্ম সোসাইটি করা না, সত্যজিৎ-ঋত্বিক চেনা না, তাদেরও তো বিনোদনের প্রয়োজন আছে, তাদের জন্যেও একধরণের ছবির ধারা সুভাষ দত্তদের মতো পরিচালকদের পরম্পরায় চলে আসছিল। সেখানে একটা ধাক্কা লাগলো। সেই জায়গা থেকে যদি বলতেন, আপনার কি ওই ধরণের নির্মাণের দিকেই যাত্রা ছিল, যারা কিছু একটা বানিয়েই কানের স্বপ্ন দেখেন? নাকি আপনি বিপুল অংশের মানুষের জন্য সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন?

টোকন ঠাকুর: আমি কোনো মানুষকে ভেবেই সিনেমা বানাতে চাইনি। টার্গেট পিপল যারা আরকি। আমার কিছু বক্তব্য আছে, সেটা সব মানুষের জন্যেই। কিন্তু সব মানুষের জন্য আসলে একই প্রোডাক্ট যায় না। যে পারফিউম শহরের লোকটি ব্যবহার করে, তা গ্রামে পৌঁছয় না। বেশিরভাগ লোকের কাছে পৌঁছনোর একটি আকাক্সক্ষা আমার মধ্যে আছে। শহীদুল জহির কতজনের কাছে পৌঁছেছেন, আর হুমায়ুন আহমেদ কতজনের কাছে পৌঁছেছেন? হুমায়ুন আহমেদের মতো একজন কিশোরমনস্ক লেখককে বাংলাদেশের অন্যতম লেখক মনে করা হয়। তার মানে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাঠক কিশোরমনস্ক। যেখানে ইমদাদুল হক মিলন পৌঁছে গেছেন পাঠকের কাছে, খুবই পুতুপুতু লেখক সাদাত হোসেন পৌঁছাচ্ছেন- অথচ শহীদুল জহির পৌঁছাননি। তাতে শহীদুল জহিরের কিছু যায় আসে না অবশ্য। তবে সিনেমা না পৌঁছতে পারলে সিনেমার যায় আসে। কারণ সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। আমি সেই শহীদুল জহিরকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় সেই চেষ্টা আমার চিত্রনাট্যে করেছি। প্রোডাকশন শেষে যতটা পৌঁছানো যায় পৌঁছাবো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্রাইসিসের জায়গায় আমি দায় নিয়ে কথা বলব না। আর করপোরেটের টাকা নিয়ে কেউ যদি বলে আমি ইনডিপেনডেন্ট নির্মাতা, যেটা এদেশের প্রধানতম নির্মাতাদের কয়েকজন বলেন। কোনো বারবনিতা যদি বলে, আমি পরপুরুষের সাথে শুই না- ব্যাপারটা তেমন আর কি!

শিমন রায়হান: ক্রাউড ফান্ডিং করলেও কি ইনডিপেনডেন্ট বলা যাবে?

টোকন ঠাকুর: সেক্ষেত্রে তাও কিছুটা হলেও বলার সুযোগ থাকবে কারণ তার নির্মাণে কোনো পুঁজিওলার ইচ্ছা সরাসরি ঢোকেনি। পুঁজি ঢুকলেই পুঁজিওলার মতামত ঢুকে যাবে। নিজের মতো করতে দেবে না। অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি ঘটে গেলে শহীদুল জহিরের মতো লেখকের পাঠক যেমন বাড়বে, তেমনি ভাল সিনেমার দর্শকও বাড়বে। ধর্মসভায় বা রাজনৈতিক সভায় যত লোক যায় এখনও- এটা দেখতেই তো অশ্লীল লাগে এই যুগে। রাজবংশের লোকজনের চাপাবাজি শুনতে হাজার-হাজার লোক সারাদিন বসে থাকে রাস্তায়। এটা মানবতার অপমান। এটা নিয়েই তো বই লেখা উচিত। এই অবস্থা থেকে আগে বের হওয়া দরকার। তাহলে সব একবারে ঠিক হয়ে যাবে। এই ডিজিটাল যুগে মানুষ জনসভা শুনতে মাঠে কেন যাবে? বাড়িতে বসেই তো শোনা যায়। এটাই তো বদল হয়নি এখনও। লিটলম্যাগাররা জানেই না সমাজ কোথায় আছে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েই যাচ্ছে, যেগুলোর দরকারই নেই। ছাগলরা পড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে! রামছাগলরা পড়তে আসছে! যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটি ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবার যোগ্য নয়, সেখান থেকে পাস করে বের হচ্ছে হাজার-হাজার। কিছু লোককে পদায়ন করার জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে আর সেখানে পড়তে আসছে কৃষকের ছেলেরা। শিক্ষা-দীক্ষা এখানে বড় বিষয় নয়, করে খাওয়াটাই এখানে বিষয়। এখনও শিশুরা নেশা করে রাস্তায় শুয়ে থাকে। ভূখা বৃদ্ধ ও শিশুরা হাত পেতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা মনেই করেন না তাদের কোনো দায়িত্ব আছে। সব দায়িত্ব কি শিল্প সাহিত্যের লোকজনের? তারা তো কাঠামো চালাচ্ছেন না। যারা চালাচ্ছেন তারা একটু বেটার করলেই শিল্প সাহিত্যের জন্য উপযোগী হতে পারত এই সমাজ। এটা একটা অসভ্য-ইতর সমাজ! একটা অসভ্য সমাজের ভেতর বসে আমরা কথা বলছি। ফলে এখানে যে নান্দনিক শিল্পকলা হচ্ছে তা ইতরামোর শিল্পকলা!

শিমন রায়হান: দাদা, আমরা কবিতার আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ করব। অনেকে বলেন কবিতা আজকের দিনে একটা ডেড আর্ট?

টোকন ঠাকুর: কবিতা ডেড আর্ট এতো বড় কথা বলা যাবে না। কবিতা কেন ডেড আর্ট হবে? কোথাও তো কবিতা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বাতিল হয়ে যায়নি।

শিমন রায়হান: নাকি কবিতা চিরকালই এতো কমসংখ্যক লোক পড়ে এসেছেন?

টোকন ঠাকুর: সে তো আগেই বলেছি। কমলোক পড়লে কবিতার মঙ্গল। কবিতা কমলোক পড়ার কারণে আফসোস থাকার কোনো কারণ নেই। রবিশঙ্করের বাদ্য এদেশের নব্বই শতাংশ লোক শোনেননি। তাতে কি রবিশঙ্কর কম বড় বাজিয়ে হলেন? কবিতার মতো শিল্পকলা খুব বেশি লোক পড়ছে দেখলে ভাবার সুযোগ আছে যে, কবিতা ভালো হয়নি। উৎকৃষ্ট কবিতার পাঠক কম থাকবে, গুপ্তমন্ত্র না?

শিমন রায়হান: দীর্ঘদিন পড়ার জায়গা থেকে আপনার কবিতা নিয়ে বলছি। আপনার একটি স্বতন্ত্র ভাষা আছে। ঢাকার বা বাংলাদেশের কবিতায় তো আপনাকে আলাদা করে নেওয়াই যায়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশকে আপনার আগে পরে যারা লিখছেন, তাদের ভেতরেও আপনাকে আলাদা করে নেওয়া যায়। আপনার ভাষা বেশ বিরল আমি বলব পাঠকের জায়গা থেকে। আপনার ভাষা ঈশ্বরকে গার্লস কলেজের গেটে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে ভাষায় রাক্ষসের ছদ্মবেশে কবিতা লেখা হয়। আপনার কাব্যভাষা অনেক সময় মনে হয় নাগরিক জীবনের মুখের ভাষা, আরবান ফোক এ রকম মনে হতে পারে। যে ভাষা খুব একটা প্রমিত বা বিদ্যাসাগরীয় নয়, যে ভাষা দুঃখকে বিড়াল বা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে দেখে, যে ভাষা এক প্রকার কথার জাদুতে একটি গভীর প্রদেশে ডুব দেয় আবার ভেসে ওঠে। একটা মিহি মশকরার মতন। জীবনকে হালকাভাবে নিয়ে প্রকারান্তরে গভীরভাবে তুলে আনার যে নির্মাণকৌশল। আপনার প্রতীক-উপমাও খুব চেনা আমাদের। আবার খুব বেশি প্রচলও নয়। যেমন: দুপুর কিংবা কুয়াশা আপনার কবিতার পাত্র-পাত্রী হয়ে হাজির হয় নিমেষেই। এবং সেই গভীর কথার হালকা প্রদর্শনী অথবা, হালকা কথার গভীর রন্ধন- যা পাঠককে ক্লান্ত করে না, ভাবের ভার চাপায় না। এগুলো একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ। এই কাব্যভাষা কি অপেক্ষাকৃত অধিক পাঠকের কাছে যাওয়ার একটি সচেতন প্রয়াস ছিল?

টোকন ঠাকুর: যেভাবে তুমি বললে তাতে বুঝতে পারলাম আমার কবিতার ওপর একটা পর্যবেক্ষণ তোমার আছে। বেশ দৃঢ়ভাবেই আছে। সেটা আমি টের পেলাম। অনেকেই আমার ইন্টারভিউ নিয়েছে। আমার কবিতা নিয়ে এতো গভীর পর্যবেক্ষণের কথা বলেছে- এমন লোকই আমি পাইনি। থরে-থরে এবং ধারাবাহিকভাবে। গ্রাম থেকে জেলা-বিভাগীয় শহর হয়ে আমি ঢাকায় এসেছি। এই আসতে আসতে পরিভ্রমণটা- কবিতার বই পড়তে পড়তে, মানুষজন দেখতে দেখতে। অনেক কথাই এখানে খুব ভালভাবে বলেছো- মিহি মশকরা। যেভাবে বলেছো তার বেশিরভাগ জায়গাতেই আমি একমত। তবে সচেতন প্রয়াস বলে কিছুই ছিল না। নিজের মতো করে এগিয়েছি এটা ঠিক। এভাবে যা দাঁড়িয়েছে, যার কাছে যেভাবে ধরা পড়ে। নির্মাণের গাঁথুনিতে হয়ত আমি কিছুটা সচেতন থাকি কিন্তু কার কাছে পৌঁছবে, কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো ভাবনা নেই। তবে নির্মাণের ক্ষেত্রে যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমি অনুশীলন চালাই এখনও।

শিমন রায়হান: কবিতা তো এমনিতে খুব কম সংখ্যক মানুষ পড়েন। আমরা যারা লিখছি তাদের লেখা হয়ত আরো কম লোকে পড়েন। এমনকি যারা পড়েন- তাদের আলাদা করে ফেলা যাবে। আপনার লেখা সেই তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি লোকে পড়েন। কিন্তু আপনার সেই পাঠকদের মধ্যে আমরা টের পাই- কেরাণি, অভিনেত্রী ইত্যাদি প্রকারের ব্যক্তি আছেন। আপনার একটি বইও আপনার গুণমুগ্ধ একজন অভিনেত্রীকে উৎসর্গ করেছেন। আমি বলতে চাইছি যে, এই ধরণের বিচিত্র মানুষেরা আপনার লেখা পড়েন। আপনার কবিতার বহুস্তরের ও শ্রেণীর পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত হবার একটি ক্ষমতা আছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বা বিরোধী নন, প্রথম আলো বা অ-প্রথম আলো- এ জাতীয় যেকোনো দল বা উপদল যদি বাংলা কবিতার ইতিহাস লিখতে বসেন বা বিশ্লেষণ করতে বসেন, আপনাকে অস্বীকার করা কঠিন হবে। আপনাকে উপেক্ষা করে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হবে।

টোকন ঠাকুর: প্রথমত সমালোচক আর ব্যবচ্ছেদ যারা করবেন তাদের কথা ভেবে আমি কবিতা লিখি না। আমার মাথায় লেখা নিয়ে যে খচখচানি তৈরি হয় তা পূর্ণমাত্রায় নামলো কিনা- এছাড়া আরা কোনো ভাবনাই আমার নেই। তুমি অভিনেত্রীর কথা বলেছো- হুমায়ুন ফরীদি নিজেও কবিতা লিখতেন। মাঝেমধ্যে আমার কবিতা বিষয়ে আলাপ করতে রাতে-বিরেতে ফোন দিতেন ফরীদি ভাই। তুমি অপি করিমের কথা বলছিলে। উনি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কবিতা লেখার সময় আমার মস্তিষ্কের ভেতর কী ঘটে এটা নাকি তার দেখতে ইচ্ছে করে আমার মাথার ভেতর ঢুকে। তো এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই একটি বই উৎসর্গ করেছি। আমি জানতামও না। প্রথম আলোর একটি ইন্টারভিউয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন। পরে নয়ন (আলতাফ শাহনেওয়াজ) একদিন আমাকে জানায়। এমনকি এই মন্তব্যের পাঁচ বছর পরে আমি জানতে পারি। পাঠক আমার কিভাবে তৈরি হয়েছে আমি বুঝতে পারিনি। অনলাইন না আসলে বোঝা যেত না। আমি গ্রেফতার হওয়ার পর একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আমাকে ও আমার কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন পত্রিকায়। আমি কবিতার সাথে ভন্ডামি করিনি। বউ-বাচ্চা-সংসার নিয়েও বিরহী-প্রেমিক কবির মতো ভন্ডামি আমি করিনি। যেটা প্রায় সব কবিই করে থাকে। বউ-বাচ্চা সংসারে ঘুমোচ্ছে, তখনও সে বিরহী-প্রেমিকের কবিতা লিখছে। আমি অসততা করতে চাইনি কবিতার সাথে। বরং সামাজিকভাবে নিন্দনীয় যেসব বিষয় প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে আমার পঙতিতে, তা প্রকাশে নিজেকে বাঁধাও দিইনি আমি। অনেক পোশাক পরা ফটো তো আছেই- আমার ইচ্ছে একজন ভাল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে উইদাউট কসটিউম কিছু ন্যুড ফটোগ্রাফি আমি করিয়ে যাবো মরার আগে। সেটা সমুদ্র সৈকতে, জঙ্গলে না মহাসড়কে করব তা ভাবতে হবে। ইভেন আমি মনে করি, আমার যৌনতার ফটোও থাকা উচিত। বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গির। একজন চিরকাল গোপনে পতিতালয়ে যাবে কিন্তু সে খারাপ না, কারণ সে ধর্মকর্ম, দান, সমাজ-সংসার করে। অথচ আমি কোনোদিন পয়সা দিয়ে যৌনতা কিনিনি আজো। আমার এইসব বক্তব্য পড়ে কেউ যদি আমাকে খারাপ মনে করে, সেই শুয়োরের বাচ্চা কতবড় খারাপ তাহলে!

শিমন রায়হান: দুটো প্রসঙ্গে যাব। প্রথমটি হচ্ছে, কেউ কেউ আছেন- মৃত্যু বিষয়ে আলাপ উঠলে বলেন, পেসিমিস্ট, হতাশাবাদী!

টোকন ঠাকুর: না, না..

শিমন রায়হান: আমি মৃত্যু নিয়ে অনেক চিন্তা করি তূলনামূলক কম বয়স থেকে। হতাশার জায়গা থেকে নয়। আমার মনে হয় আশা অথবা, হতাশার ঊর্ধ্বে মৃত্যু একটি গভীর বিষয়। যে বিষয় একজন শিল্পীর চিন্তার বাইরে থাকার কথা নয়। আমরা জানি, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশের মতো কবিদের লেখাপত্র এবং গানে এবং পৃথিবীর অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্মে অবশ্যই মৃত্যু একটি বড় অনুষঙ্গ হিসেবে আছে। আমার গভীর পাঠ বলে, আপনার কবিতায় মৃত্যু সেভাবে আসেনি।

টোকন ঠাকুর: হ্যাঁ, নেই তেমন। এবং আমারো তাই মনে হলো আজ। আমার কবিতা অনেকেই পড়েন হয়ত কিন্তু তোমার পর্যবেক্ষণ এবং ধরতে পারার ক্ষমতা বেশি। এরকম পাঠক সাধারণ একশ’ পাঠকের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান।

শিমন রায়হান: আমি ভেবেছি হয়ত কোনো কোড ল্যাংগুয়েজে থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু দৃশ্যমানভাবে আপনার কবিতায় মৃত্যু দেখা যায় না। এখন ধরেন, এমন কোনো একটি ভিনগ্রহে যাওয়ার প্রস্তাব আপনি পেলেন যেখাসে সব আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর মজুত আছে কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরতে পারবেন না। তো আপনি কি এই কর্দমাক্ত-দূষিত-বিষাক্ত পৃথিবী ত্যাগ করে সেই সমস্ত উত্তর খুঁজতে সেখানে যেতে চাইবেন? এক অর্থে এই যাত্রাকে মৃত্যুও ধরা যেতে পারে। সেটা নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

টোকন ঠাকুর: আমার লেখায় মৃত্যু উপস্থিত কম।

শিমন রায়হান: শব্দ হিসেবে তো নেই, চিন্তা হিসেবেও প্রায় নেই।

টোকন ঠাকুর: হ্যাঁ, নেই। খুবই ভাল বলেছো। এটা ওইভাবে ভাবিওনি। এটা ঠিক। আমার তো মনে হয় আমি মরবই না। এমন একটি ভাবনা কাজ করে। অথচ কতবার আমরা মরি। মানুষ নানাভাবে মরে। যখন পতন ঘটে, কিংবা চিন্তায় আবার যখন অমোচনীয়-গ্লানিকর কোনো কাজ করে ফেলি। সেই মুহূর্তেও এক ধরনের মৃত্যু হয়। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই মারা গেছেন। নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবার অবস্থায় এখনও আসিনি। কখনো কখনো এসেছে। তখন আমি দেখেছি, মরে তো যেতেই হবে এবং আমি একজন নন বিলিভার। তবুও মৃত্যু হবে। আমি থাকব না। কিন্তু কিছু কাজ করে যেতেই হবে। নাহলে যা বলতে চেয়েছিলাম সেই আত্মপ্রকাশ তো হলো না। আমার অনেক কাজ বাকী আছে। তাই মৃত্যুর কথা ভাবি না।

শিমন রায়হান: কিন্তু কোনো না কোনো একদিন সূর্য উদিত হবে-অস্ত যাবে, সবই চলবে, কেবল আপনি থাকবেন না- এই বাস্তবতা ভাবতে পারেন?

টোকন ঠাকুর: হ্যাঁ, এতো হবেই। ছোটবেলায় এ রকম খুব বেশি মনে হতো। আমাদের বন্ধুরা মারা গেছেন। আমরা আছি। এটা তো হবেই।

শিমন রায়হান: এড়িয়ে যেতে চান কি? বেদনার উদ্রেক হয়?

টোকন ঠাকুর: কেউ মরে গেলে তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয় না। খারাপ তো লাগে। খুব বেশিক্ষণ স্টে করে না। কিছুক্ষণ পর শিফট করে ফেলি। আমি না কেবল, প্রত্যেক মানুষই করে কারণ সেও তো বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে হলেই শোক থেকে নিজেকে শিফট করতে হবে।

শিমন রায়হান: জন্মান্তরের ধারণার সাথে কোনো…

টোকন ঠাকুর: গরু-বাছুর, পিপড়ে, তেলাপোকা, সাপের মতো আমিও একটি প্রাণী। আমার মাংস পঁচে মিশে যাবে। এর বেশি কী আর।

শিমন রায়হান: সর্বশেষ প্রসঙ্গ। শিল্পীর শিল্পযাপন তো তার একটি আত্মজিজ্ঞাসাও বটে। কেউ হয়ত দেখছেন রাজনীতি হিসেবে, প্রকাশক দেখছেন বাণিজ্য হিসেবে, আমরা হয়ত লিখতে গিয়ে মনে করছি আনন্দ কিন্তু গভীর অর্থে এটা তো আত্মানুসন্ধান। অর্ধ শতকের বেশি প্রকৃতির মধ্যে আপনার এই যে অস্তিত্বযাপন, তিন দশকের বেশি শিল্পযাপন- এই আত্মানুসন্ধান কোথায় এসে ঠেকলো?

টোকন ঠাকুর: এটা আলাদা করে ভাবিনি কিন্তু একটি চিন্তা মাঝেমধ্যে কাজ করে। আরো যখন কম বয়স ছিল তখন অভিজ্ঞতা কম ছিল। জীবনটা না দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়। বুঝে ওঠা যায় না। অনেকটা আইসক্রিম হাতে ধরে খাওয়ার মতো। না খেলেও কিছুক্ষণ বাদে ওটা গলে ফুরিয়ে যাবে। অর্থাৎ আইসক্রিমটা থাকবে না। অনেকটা বুদবুদ। ও জন্মমাত্রই ফেটে যাবে এবং মরে যাবে। এটাই বুদবুদের আত্মজীবনী। এখানে আফসোসের কিছু নেই। কখন যে ত্রিশ হলো, চল্লিশ হয়ে পঞ্চাশ হয়ে গেল- খেয়ালই করতে পারলাম না। ইউনিভার্সিটি শেষ করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি- ওইরকম একটা সময়েই আছি বলে এখনও মনে হয়। কিন্তু মাঝখানে ভাবি, এতো সময় গেল কী করে? কিন্তু আমার এই জীব-শরীর- এর তো বয়স হয়েছে। আসলে অনেকটা শরীরের মধ্যে নেই আমি আর। শরীরটাকে টেনে যাচ্ছি নিজেকে রক্ষার জন্য। আমার নিজেকে দিয়ে যখন বেশি কাজ করাই, তখন মনে হয়- খাট্ শালা, বেশি করে শ্রমিকের মতো খাট্। তখন শরীর ও আমি দুইপক্ষের লোক হয়ে যাই। আমি ও আমার শরীর রীতিমতো দু’জন। শরীরটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে খেয়াল করে দেখি। তা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না। এটা অতি স্বাভাবিক বিষয়। ওঠা-নামা। এই স্বাভাবিকতাকেই অতিপূজা করে নানারকম কালচার করা হয়। ধর্ম ও সাহিত্য দুই’ই তা করে। আমার হাইস্কুলের বয়সটা মরে গেছে। কলেজে পড়ার বয়সটাও মরে গেছে। আমার না থাকাটাও তাই। আমার তো আর মনে পড়বে না। হয়ত অন্য কারো মনে পড়বে। সেও হয়ত মরে যাবে। তারপর আরেকজন আসবে- যে হয়ত আর মনেই করতে পারবে না যে আমি ছিলাম। আজ থেকে দু’শো বছর আগে তোমার-আমার মতো দু’জন লোক বসে এ রকম কোনো কথোপকথন করছিল কিনা তা আমি ও তুমি আজ একটুও ভাবছি না যে, কেউ এমন আলাপ করেছিল কিনা? সেই কথাগুলো কী ছিল? সেই কথাগুলো কোথায় গেল? কোথায় গেলে পাবো তাদের আলাপ? জঙ্গলে গেলে যে পাতার আওয়াজ শুনি, ধরে নেওয়া যাক এই পাতার মর্মর ধ্বনিই সেই মানুষদের ফিসফাস। নদীর পাড়ে গিয়ে মনে হতে পারে, এই যে নদীর জলের কূলকূল ধ্বনি- এও কারো না কারো কথা। ফাঁকা মাঠের মধ্যে যে হাওয়ার ঘূর্ণন, সেটাও কারো না কারো কথা। গদার মারা গেলেন কিছুদিন আগে। গদারের একটি কথা মনে পড়ে গেল- মানুষ হিসেবে এটা যেন আমাদের একটা ডিউটি, অমর হও এবং মরে যাও।

শিমন রায়হান: এটার সম্পূরক প্রশ্ন, পৃথিবী ছায়াপথ নামক একটি গ্যালাক্সির বালুকণারও অধম সৌরজগতের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। সৌরজগতের মধ্যে কেবল পৃথিবীতেই প্রাণ আছে। এই পর্যন্ত আমরা যেতে পেরেছি। ছায়াপথের মতো বিশাল একটি গ্যালাক্সিতে আরো বুদ্ধিমান প্রাণীর আবাস আছে বলেই ধারণা করা হয় এবং বেশ আগেই জানা গেছে যে, ছায়াপথের মতো অগুন্তি গ্যালাক্সিতে ভরপুর এই মহাবিশ্ব। এমনকি মাল্টিভার্স পর্যন্তও মানুষের মস্তিষ্ক গেছে। অন্য কোনো ইউনিভার্সে অথবা, এই ইউনিভার্সের দূরবর্তী কোনো এক গ্যালাক্সিতে, কোনো এক অচেনা নক্ষত্রজগতে, পৃথিবীর মতো আরো কোনো গ্রহে মানুষ কবিতা লেখে, সিনেমা বানানো হয়, বইমেলা হয়- এ রকম কখনো ভেবেছেন?

টোকন ঠাকুর: এটা একটা সায়েন্স ফিকশনের মতো। বিজ্ঞান আমাদের জানার উপায়। তুমি যেহেতু ভেবেছো একটা সিগন্যাল পাচ্ছে তোমার মাথা। আমিও যে কখনো ভাবিনি তা না। এগুলো মেঘের মতো। আসে আবার চলে যায়। আগামীতে আরো আরো অনাবিষ্কৃত বিষয় হয়ত মানুষ জানতে পারবে যা এখন মানুষের কল্পনাতেও নেই।

শিমন রায়হান: যদি এমন কিছু থাকে। সেখানে কোনো তরুণ কবি লিখছে…

টোকন ঠাকুর: থাকতেই পারে। এমনকি সেখানেও এই মুহুর্তে আমাদের মতো কেউ গল্প করছে। ইন্টারভিউ দিচ্ছে।

শিমন রায়হান: যদি জানেন, যে তারা আছে তো তাদের লেখা পড়ার কৌতুহল থাকবে?

টোকন ঠাকুর: থাকলে অনুবাদ করে তাদের লেখা পড়া হবে। যেমন নিকারাগুয়ার লেখকদের লেখা পড়া হয়। তাদের হয়ত আলাদা ভাষা থাকবে। আবার এ রকম থাকলেও পৃথিবীর মতো নাও হতে পারে। পৃথিবীর চরিত্র হয়ত আলাদা। পৃথিবীর মতো এমন হয়ত আর কোথাও হয়নি। হয়ত অন্য রকম হয়েছে। এটা আমার চিন্তায় ওইভাবে আসেনি। তবে তুমি যা বললে, তা ভাল ফিল্ম বানানোর জন্য বা সায়েন্স ফিকশন লেখার একটি উপাদান। কিন্তু সেই সোসাইটি কী নির্মাণ করবে, সেখানকার অর্থ-সমাজব্যবস্থা কেমন হবে, বেঁচে থাকা কেমন হবে- যা কিছু কল্পনা করব এই পৃথিবী থেকে আদল নিয়েই করতে হবে। আমার মাকে আমি পৃথিবীতে খুঁজে বেড়াতে পারি অন্যান্য মহিলাদের মধ্যে আমার মায়ের আদল নিয়েই। এইটুকু আমার সীমানা। তবে কবিতা থাকবে। প্রেম থাকবে, পাওয়া ও না পাওয়া থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে পাওয়া-না পাওয়ার। শোষণ থাকবে, প্রতিরোধ থাকবে- তাই কবিতাও থাকবে।

শিমন রায়হান: আপনার ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা প্রায় দু’ঘন্টা কথা বললাম। অশেষ ধন্যবাদ, দাদা।

টোকন ঠাকুর: তোমাকেও ধন্যবাদ। আর যে পাঠক কখনো এই কথোপকথন পড়বে, তাকে ভালোবাসা জানিয়ে রাখলাম।

শেয়ার