রাতে গুলি লাগে ছেলেটির। সকালে হাসপাতালেই মারা যায় মারিও (ছদ্মনাম)। ওর নামও আমার জানা ছিলো না। পরদিন সিগনাল লাইটের পাশেই কিছু ফুল আর মোমবাতির মাঝে একটা স্কেটবোর্ডে ওর নাম লেখা ছিলো, সঙ্গে ছবি। হাস্যজ্জল। বয়স হয়ত ষোলো-সতেরো। এখানে গুলি খেয়ে পড়ে ছিলো। সে আর রক্তাক্ত স্কেটবোর্ড পুলিশ এসে উদ্ধার করে সেই রাতে। ওখানে আমিসহ আরও কিছু প্রতিবেশি এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ কিছুটা সময়। ছেলেটা লোকাল নয়, ছবি দেখে আমাদের তাই মনে হলো। কেউ কখনও দ্যাখেনি তাকে এ পাড়ায়।
‘ও আমার বন্ধু ছিলো , আমার সঙ্গে আসতো এখানে, একসঙ্গে অনেক গ্রাফিতি করেছি আমরা ‘ — কথাটা বলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ম্যানুয়েল (ছদ্মনাম)। এই এলাকারই ছেলে সে। হ্যালুইনে ওর ছোটভাইকে নিয়ে পাড়াতে ঘুরতে দেখেছি। হাইস্কুলে পড়ে বোধহয়।
দু’দিন পর। তখন বিকেল। হঠাৎ করেই ম্যানুয়েলের সঙ্গে দেখা । ওর সঙ্গে ছিল গ্লোরিয়া— মারিওর বড় বোন। আমরা পরিচিত হই। কথা প্রসঙ্গে গ্রাফিতি বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানুয়েল হেসে বলে,
– এ এলাকায় হাইস্কুল ড্রপআউট বোধহয় আমি একাই, তোমরা কি আমাকে হেইট করো?
– আমরা তো তেমন কিছু জানি না তোমাদের ব্যপারে, কি হয়েছিলো তোমার বন্ধুর?
সেদিন ওদের সঙ্গে আমি হাঁটি অনেকটা পথ। বাসে করে আমরা পাশের শহরেও যাই। ওরা একটা ঝুলন্ত জুতোর খোঁজে বেরিয়েছে। স্প্যানিশ একটি গ্যাং-এর মেম্বর ছিলো মারিও। গুলি করার পর লাশের পা খালি ছিলো। ওকে মেরে ফেলার পর শত্রুপক্ষ গ্যাং মেম্বারেরা মারিওর জুতাজোড়া কোনো পাওয়ার বা টেলিফোন লাইনে ঝুলিয়ে রেখেছে বলে ম্যানুয়েলের ধারণা। গ্যাংদের মধ্যে এইসব হয়ে থাকে। কিছু অজানা , কিছু বিস্ময় নিয়ে আমি শুনে গেছি ম্যানুয়েল আর গ্লোরিয়ার কথা।
মৃত্যুর আগে প্রায় ৫/৬ দিন ওরা গ্রাফিতি করেছে ফ্রি-ওয়ের ব্রিজে, পার্কে, স্কুলে, হোটেলে এমনকি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে। সিগনেচার শেষ করে ওরা বাড়ি ফিরতো ভোরে। গ্রাফিতিই ছিলো প্রতিবাদের ভাষা। সাদাকালোর বিভেদ আর বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ওদের এ লড়াই। পেশিশক্তি প্রদর্শনে এসব গ্যাং-এর মেম্বাররা গ্রাফিতি এঁকে এভাবেই নাকি এলাকা দখল করে !
গ্রাফিতির নিজস্ব এক ভাষা আছে। আমাদের মাঝে অনেকেই শুধু এ শিল্পকর্মটুকুই বুঝে নিতে চায়, কেউবা ওদের অপরাধী ভেবে কাজটিকেই ঘৃণা করে। সেদিন কথার মাঝে মাঝে কিছু গ্রাফিতি ফ্রেমবন্দি করেছি আমি। মারিও গ্যাং এবং ওর শত্রুদের গ্রাফিতি।
হয়ত চলার পথে অনেকবার চোখে পড়েছে এ আর্ট, কিন্তু কখনও একবারও থেমে তাকিয়ে দেখিনি। আজ চোখে পড়লো কিছু অক্ষর, শব্দের আড়াল। কারা যেনো স্প্রে আর রঙতুলির যুদ্ধে মাতাল ! লাল-কালো-সাদা কখনও বা হলদেটে যা শুধু মনের ধুলো মুছে ফর্সা করে। নামে-বেনামে তারা চোখ রাঙ্গায় তথাকথিত ভদ্রপাড়ার মানুষদের।
সেদিন আমরা ফিরে আসি শূন্য হাতে, কোথাও দেখা গেলো না সাদারঙা এডিডাসের জুতা। যেতে যেতে গ্লোরিয়া বলে,
– জুতার লেইস ভালো করে বাঁধতে পারতো না আমার ছোট ভাই, আমি সেদিন বেঁধে দিয়েছিলাম।
শিল্প ও অপরাধের দোলাচলে আমি ও আমরা সেদিন খুঁজেছিলাম একজোড়া ঝুলন্ত জুতা। যতদুর চোখ যায়, আমিও আকাশে খুঁজেছি টেলিফোন লাইনে ঝুলে থাকা একজন মানুষের শেষ নিশানা।
ছবির লোকেশন : সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া