জিহাদ,ইসলাম এবং আবদেরেহেমান সিসোকোর চলচ্চিত্রে আফ্রিকা! ।। সুজন ভট্টাচার্য

আবদেরেহেমান সিসোকো খুব একটা পরিচিত মুখ না। কিন্তু অপরিচিত সিসোকোই এখন আফ্রিকান চলচ্চিত্রের নতুন ভ্যানগার্ড। জন্মভূমি আফ্রিকা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে চলে এসেছিলেন রাশিয়াতে। গেরাসিমভ ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফিতে পড়াশোনা শেষ করে আবারো ফিরে আসেন আফ্রিকা। আবদেরেহমান সিসোকোর জন্ম আফ্রিকার মোরিতানিয়াতে কিন্তু বেশিদিন থাকা হয়নি সেখানে যেহেতু তাঁর পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলো মালিতে। মোরিতানিয়া থেকে মালি আর এই সূত্রেই রেহেমান দেখেছেন আফ্রিকার বিচিত্র সংস্কৃতি। আফ্রিকার প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার ওসমান সেমবেনের সিনেমা তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করলেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাইফ অন আদারস’। অনেকগুলো ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে সিনেমাটি প্রশংসিত হয়। আবদেরেহমান সিসোকোর চলচ্চিত্র অভিযাত্রা শুরু হয় এভাবেই…..

২০১৩ সালের দিকের ঘটনা। সিসোকো তখন লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভালে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। জন্মভূমি মোরিতানিয়া এবং শৈশবের দেশ মালি তখন জঙ্গিদের তাণ্ডবে দিশেহারা। সিসোকো হোটেলে বসেই জানতে পারলেন মালির একটি গ্রামে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে এক দম্পতিকে! আনসার দ্বীন জঙ্গিগোষ্ঠি তার ভিডিও আপলোড করলো ইউটিউবে। বিদেশিরা সিসোকোকে জানালো বর্বর আফ্রিকার কথা। ভীষণ আহত আবদেরেহমান সিসোকো ফেস্টিভালে অংশ না নিয়েই চলে এলেন মালি এবং সিদ্ধান্ত নিলেন ঐ গ্রামের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানানোর। ‘টিমবাখতু’ গ্রাম খুব দূরের নয়! সিসোকো সেই গ্রামে গিয়েই জানলেন বিষণ্ণ নির্মমতা। দুই সন্তানের জনক-জননীকে ব্যাভিচারের অপরাধে গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে! আবদেরেহমান সিসোকো শুটিং করতে গিয়ে দেখলেন টিমবাখতু গ্রামের মানুষ ভয়ে মুখ খুলছে না। তিনি শহরে ফিরে এলেন ব্যর্থ হয়ে। টিমবাখতু একটি গ্রাম। আবদেরেহমান সিসোকো ২০১৪ সালে নির্মান করলেন ‘টিমবাখতু’। ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে বুঝেছিলেন ব্যর্থতা, তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফিকশন নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। প্রায় ছয়মাসের চেষ্টা আর বহু ঝুট-ঝামেলা অতিক্রম করে নির্মাণকাজ সমাপ্ত করলেন। মালির মরুভূমি আচ্ছাদিত একটি গ্রাম টিমবাখতু। সিনেমার প্রথম দৃশ্যায়নে লং-শট ব্যবহার করেন সিসোকো। ছাদখোলা টয়োটা গাড়িতে উল্লাস করছে জঙ্গিদল! গাড়ি ছুটছে আর প্রাণভয়ে পালাচ্ছে হরিণ। পেছনে টয়োটা গাড়ি থেকে ছুটে আসা মেশিনগানের গুলি। ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠি আনসার দ্বিনের সদস্যরা ছুটছে হরিণ শিকারে। এই হরিণ যেন বিপন্ন আফ্রিকা! ফরাসি উপনিবেশ শেষ হয়েছে কবে, কিন্তু নতুন উপদ্রপে ছিন্নভিন্ন আফ্রিকার প্রতীক যেন এই হরিণ। ঠিক তখনই আরো একটি কাট ইউজ করেন সিসোকো। আমরা দেখি আফ্রিকান আদি সংস্কৃতির রূপ, কাঠের দেবীমূর্তি গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা। টিমবাখতু গ্রামের দখল নিয়েছে ‘আনসার দ্বীন’ জঙ্গিরা। মাইকে এনাউন্সম্যান্ট শুনি…’আজ থেকে ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ…,মেয়েরা বোরখা আর হাতে হাত মোজা পরবে.., ইত্যাদি ইত্যাদি…!!

স্থানীয় মসজিদে প্রবেশ করে জঙ্গিরা। তখন প্রার্থণারত কিছু মুসল্লিকে নিয়ে ইমাম তসবি গুনছে।… ডায়ালগ শুরু হয়…

জঙ্গি নেতা: আপনাকে আমাদের সাথে জিহাদে যোগদান করতে হবে।

ইমাম: জিহাদ!! এখানে? (মসজিদ দেখিয়ে)

নেতা: হ্যাঁ। আপনি জানেন না আমরা এই গ্রামে ইসলামি আইন কায়েম করেছি?

ইমাম: ইসলামি আইন কায়েম করার তুমি কে? জিহাদ করার তুমি কে? প্রথমত, আল্লাহর ঘরে জুতা এবং বন্দুক নিয়ে ঢুকে অন্যায় করেছ আর এখন বলছো জিহাদ?

নেতা: আপনি জিহাদ করতে চান না?

ইমাম: আমি প্রতিদিন জিহাদ করি।

নেতা: কিভাবে? ( খুব অবাক হয়ে)

ইমাম: আমি নিজের সাথে জিহাদ করি। প্রতিদিন নিজের সাথেই জিহাদ করি।

এই কথোপকথন থেকেই সিসোকোর ধর্মীয় বোধ বুঝতে পারা যাবে, নিশ্চিত। ইমাম চরিত্রের মাধ্যমেই আমরা ভিন্ন প্রতিবাদ দেখি। টিমবাখতু গ্রামের ইমাম জবরদস্তির বিরুদ্ধাচরণ করেন। বোরখা এবং মোজা পরতে বাধ্য করার জন্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ইমাম চরিত্রের মাধ্যমেই আবদেরেহমান সিসোকো বুঝিয়ে দেন, এই জঙ্গিগোষ্ঠি বাইরে থেকে আসা আরব হানাদার। আফ্রিকার নিজস্ব চিন্তাজগত এবং পরম্পরা ধরে চলে আসা ইসলামের সাথে আরব হানাদারদের মিল হতে পারে না। টিমবাখতু শুধু একটি গ্রাম না, বরং এটি বহু সংস্কৃতির আফ্রিকান রূপক। এই চলচ্চিত্রে এমন আরো ঘটনার অবতারণা হয়। গ্রামের এক মৎস্যজীবী নারী তাই হাতে মোজা লাগাতে অস্বীকার করে। তীব্র প্রতিবাদে ঐ নারীকে বলতে শোনা যায়,’এই হাত খেটে খাওয়া। মোজা পরানোর পরিবর্তে এই হাত দুটো তোমরা কেটে নাও’!

এতকিছুর পরেও ধর্মান্ধদের উগ্রতা থামেনা। গ্রামের যুবকদের ফুটবল খেলার অপরাধে শাস্তি দেওয়া অব্যাহত থাকে। আফ্রিকানদের রক্তের মধ্যেই মিশে আছে ফুটবল; তাই কোন ধর্মীয় স্বেচ্ছাচারী আচার এই জীবন রক্তের ফুটবলকে থামাতে পারে না। সিসোকো সিনেমাটোগ্রাফির ছাত্র। অতএব, এখানেও দারুন সব কাজ দেখি। ভোরবেলায় খেলার মাঠ..(আবারো লং-শট)। আনসার দ্বীনের সদস্যরা মোটরসাইকেলে একে৪৭ রাইফেল নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে আফ্রিকান জীবন ফুটবল খেলাকে ধ্বংস করে দিতে। মিড শটে তখন ফুটবল মাঠ..(ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক)। পেনাল্টি নেওয়ার জন্য ফুটবল বসানো হল কিন্তু ফুটবল তো নেই!! ছেলেরা কল্পনায় ফুটবল খেলছে! বলে শুট…গোওওওল…!!! দুরন্ত খেলা চলতে থাকে…জঙ্গিরা এসে দেখে ছেলেরা ফুটবল ছাড়াই ফুটবল খেলছে! এমন দৃশ্য তারা জীবনে দেখেনি। কিন্তু দেখেছিলেন আবদেরেহমান সিসোকো। তাই একটি নাইট সিকোয়েন্সে আমরা দেখি উগ্র জঙ্গিরাও রাতের অবসরে ফুটবল নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে! কে বেশী ভালো?… জিনেদিন জিদান না লিওনেল মেসি? বার্সেলোনা না রিয়াল মাদ্রিদ? এই এক অদ্ভুত প্রশ্নের মধ্যে সিসোকো আমাদের ফেলে দেন।

সঙ্গীত যেন আফ্রিকার আত্না। টিমবাখতু শুধু সিনেমা না; বরং যেন হয়ে ওঠে সঙ্গীতের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা। মৌলবাদীরা গান গাওয়া নিষিদ্ধ করে এবং শিল্পীদের বেতের আঘাতে জর্জরিত করে। তবুও গান থামে না। আফ্রিকার মাটির সাথে মিশে আছে ঢোল করতাল! কীভাবে একে থামানো যাবে? এই সিনেমাতেই দেখি গভীর রাতে কোন এক ঘর থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসে! শাস্তি অন্যায় লুণ্ঠন চলতে থাকে…চলতে থাকে আনসার দ্বীনের উগ্রতা। ‘টিমবাখতু’ চলচ্চিত্রটি সিসোকো বিয়োগান্তক অবস্থায় শেষ করেন। কিন্তু উপহার দিয়ে যান আফ্রিকান জীবনের কথা, মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের কথা। অস্কারে শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে সিসোকোর ‘টিমবাখতু’ মনোনীত হয়; কিন্তু পুরস্কার পাওয়া হয়নি। তাতে কি আসে যায়…? আবদেরেহমান সিসোকো গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অবরুদ্ধ মানুষের কথা বলতে গিয়ে আমি কোন মৌলবাদীকেই পরোয়া করি না। চলচ্চিত্রে আমার লড়াই অব্যাহত থাকবে’। তিনি আফ্রিকার মানুষ ও টিমবাখতু ছবির কথা বলতে গিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘The most terrible thing about this is that they are people like us. It’s always hard to say. But they are. It’s the only film of my own that makes me cry. I’ve cried several times watching it.’

শেয়ার