‘জলের জ্যামিতি’ পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা ।। সুবর্ণা গোস্বামী

আমার কাছে কবিতা এক ধরণের ওহী। অবচেতন থেকে আসা প্রগাঢ় ঘুমের মতো শব্দাবলী যা আমরা কাগজে কলমে লিখে যেতে পারি। শব্দগুলি সার্বজনীন শুধু ভাবনাটি আমার। তবে এখানে শেখার ব্যপার আছে অনেক। লেখা যখন শুরু করেছি তখনকার লেখা দেখলে নিজেরই হাসি পায় আবার এখনও কিছু চরম ভালোয় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি তাও মনে হয় না। কবিতা আসলে সংশয় আর অশেষ এর যোগফল, চেতনা আর অবচেতনের যোগফল। অথচ এত যোগের পরেও তার ফলাফল শূন্য। অনেকটা জলের উপরে আঁকা জ্যামিতিক নকশার মত। এই যে সংসার- দুঃখ সুখের হাটবাজার, এর কি সত্যিই কোন অর্থ আছে? অথবা নেই যে এরই নিশ্চয়তা কোথায়? আমার বেশ কিছু সময় নিজের সঙ্গে কাটে। বলতে দ্বিধা নেই আমার সঙ্গ আমার চমৎকার লাগে। নিজের সাথেই চলে কথোপকথন,কখনও কখনও রাতভর।কবিতা মানেই নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই দেয়া; যৌক্তিক বা অযৌক্তিক।এই সব কিছু মিলেমিশেই আমার কবিতা। আর আমি ভাল কবিতার পাঠক। সময় কমই মেলে তবে যতটুকু মেলে তার সাথে ভীষণ অন্তরঙ্গ আমি। গল্প বা উপন্যাসের যে ঘাটতি তা হছে সেগুলো পাঠ শেষ করার ক্ষমতা আমরা রাখি। কিন্তু কবিতার শেষ নেই, যতবার ভাল কবিতাগুলি পড়ি মুগ্ধ হই। জয় হোক অসঙ্গায়িত মুগ্ধতার। জয় হোক কবিতার। সুবর্ণা গোস্বামী


বইয়ের নামঃ জলের জ্যামিতি
প্রচ্ছদঃ বিধান সাহা
প্রকাশকঃ চৈতন্য


ঝাড়খণ্ডের চাঁদ

একটি বাসী রবীন্দ্ররচনাবলীর পাশে শুয়ে আছে ঝাড়খণ্ডের চাঁদ।বিবস্ত্র।পাশে রুমালি রুটির মত তার অহম।তিনিও বলাই বাহুল্য,বিবস্ত্র।
এসো যুবতীরা,আজ স্নান হোক।অজগরের কাছে হেরে যাক উল্টোপুরাণ।
নির্মাতা ধমনী কেটেছেন। তৃতীয় মাত্রার বিশেষ দৃশ্যটিতে ফোয়ারা ছুটে যাচ্ছে রক্তের-
ভেতরে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে এক প্রশ্ন দম্পতি।
তাদের গর্ভে অসংখ্য অনাগত শূন্য।

 

একটি আষাঢ়ে গল্প

ঘুম আর তানপুরার মাঝখানে বৃষ্টি ঘুঙুর। ছাদে উতলা খুব কার যেন ওড়না কামিজ, নৌকার পালের মত।গাঢ় হয়ে উঠেছে শিরীষের শরীর। ছুটে যাওয়া চার চাকাও যেন অনেকখানি মায়াবতী।যেন তারা কোনদিন খুন করেনি কারো।
এমন বৃষ্টির তোড়ে -ছন্দে-ঘুঙুরে ধুয়ে যাচ্ছে ঘুণ আমাদের আবহ থেকে।

শস্যক্ষেতে জলচূড় ধানের নাচে মিশে যাচ্ছে গারো নারীর কৃষ্ণচূড়া সাজ। পাহারের গায়ে ঢলে পড়ছে বাতাস-মাদলের ত্রিতাল।এবং তারাও পরস্পর মিশে যাচ্ছে লুকোচুরির গোপন গাঙে।

আজ মেঘচুমুতে ইরা আরও হয়ে উঠেছে নারী,আরও হয়ে উঠেছে মোহ।

 

মা অথবা কৃষ্ণচূড়া

আমার মা আজন্ম কিশোরী ছিলেন। ধোঁয়া বা কুয়াশার মত নয়,অশরীরী ভ্রমরের মত। তিতকুটে এক দুপুরে সদ্য তেরোর মা মধুজলে নামলেন স্নানে। আমি তখন মেধাবী ভ্রূণ, ছৈয়ের ভেতর থেকে যৌগিক চোখে তুলে নিলাম তার জলজ বিষণ্ণতা।
তখন দিগন্তে ছাই রঙ শাড়ি মেলে রেখেছিল বর্ষা।

মা আমার তখন দু চুমুক জলকাতরতা; কচুরিপানার ফুলের মত অবুঝ। তার চোখে নৈশব্দের হিমবাহ রেখে চলে গিয়েছিলেন গুহার গভীরে কিশোর প্রেমিক,শব্দ বা ঈশ্বরের খোঁজে।
তারও অনেক ক্ষতবর্ষের পর মা আমার হাত তার সবুজাভ বুকে টেনে নিয়ে শোনালেন নখরের মিথ। আমি আবার ম্লান হাসলাম।

মা আমার,ঝিনুকপ্রবণ-
ক্ষরণের রক্ত থেকে তারই বুকে জন্মায় কৃষ্ণচূড়া ফুল।অবিরত …

 

অন্য বিবর্তন

কারো কারো শোবার ঘরের লাগোয়া সবুজ ব্যালকনি থাকে। ব্যালকনিতে থাকে ততোধিক সবুজ সাপ,তার গায়ে লেগে থাকে বাসমতি চালের গন্ধ।
সাপপর্ব ঊণসত্তর হলে চেতনার ধারাবাহিকে আসেন একজন বাজপাখি। তিনি সর্পউপনিষদ ও অন্যান্য পাখিপুরাণ ঘুড়ি বানিয়ে আকাশে ওড়ান। সেইসব ঘুড়িদের ধড় মাছ,লেজ সাপ অথচ চেতনা পাখি, কী তুমুল আকাশউড়ান!শরীর সেখানে বাধা নয় কোন।
আমরাই দেহজ শ্রীগীতে লিখে রাখি বিষমন্ত্র,মৎস্যগান,শীত শীত তক্ষকের সুর। জানালায় বসে এসে সমোষ্ণশোণিত এক আক্ষেপের হরবোলা পাখি।
রাত্রির সাথে ঝিঁঝিঁর বেহালা আর সারাদিন শ্বেতাশ্বের ধ্বনি।

 

একটি বিচ্ছেদ

নকশি কাঁথার দ্বীপে নীল ঘোড়াটির সঙ্গে আমার আলাপ।আমি জিজ্ঞেস করলাম তার অনন্তে কতগুলি তন্তু আছে, সে জানতে চাইল আমার শেকড় কতটা বালিতে আর কতটা আকাশে। তারপর আমরা সূচ পরানো সুতায় নিজেকে জড়াতে জড়াতে পরস্পরের ঠোঁটে চুমু খেলাম।সেটি একান্তই পরাবাস্তব এবং সামাজিক চুমু।
সেখানে অমোঘ কোন মনখারাপ ছিল না।
ধীবর গোষ্ঠীর কেউ মাঝখানে যোগ করল ঢেউ; আমরা তরঙ্গের সাথে উড়তে উড়তে মাছ আঁকলাম।সোনালি আঁইশের মাছ।তার সাথে জল।জলের সাথে ভীষণ অন্তরঙ্গ সবুজ মলাটের বিবিধ মৌনতা।আমরা একসাথে এক আলোকবর্ষ হাসলাম।

সুতো শেষ।এক হঠাৎ টানে ছিঁড়ে গেল আমাদের অন্তর্লীন নীলনকশা।

শেয়ার