চির উন্নত মম শির ।। সময়ের সাহসী পংক্তিমালা

বাংলাদেশে কবিদের সম্পর্কে একটা সাধারণ প্রচারণা আছে যে, কবিরা কলাকৈবল্যবাদের অনুরাগী। ফলে জনআকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে চান। এই প্রচারণা অংশত সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, শিল্প এবং সমাজ বাস্তবতার সন্ধি ঘটিয়ে কাব্যচর্চার দিকে ঝুঁকছেন কবিরা। ফলে শিল্পের সমাজে আপাত অচ্ছুত রাজনৈতিকতাকে বিষয় হিসাবে ব্যবহৃত হতে যেমন দেখা যাচ্ছে, জনমানুষের দ্রোহে সাড়া দেবার ক্ষেত্রেও অকুণ্ঠিত থাকছেন কবিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে খুঁজে বের করা এইসব কবিতাকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই ‘শিরিষের ডালপালা’র এই আয়োজন। শিরিষ মনে করে, বাংলা কবিতার জনমুখী প্রবণতার পুনর্নবায়নের এই ধারা সামনের দিনে আরও বিস্তৃত হবে।

সময়ের সাথে যুঝতে চাওয়া তারুণ্যের সহযাত্রী কবিদের স্বাগত।



শামীম রেজা

এ কোন শহরে আছি

 

এ কোন শহরে আছি ! মৃতেরা কথা কয় শিশুদের বিদ্রোহী ভাষায় ;
যেন জীবিতেরা, ফাঁসির দড়িতে ঝুলে নিশ্চুপ বাঁচি; এ কোন নগরে আছি …


হাসান রোবায়েত

আঠারো সাল

 

ফ্যাসিবাদের দিনরাত্রি

কোমর তোলে সাপ

দিনাজপুরে লেবুর ঘ্রাণে

অংশত সয়লাব

 

দেখার কিছু ছিলই নাতো

গুজব ছিল ঘাঁ

রক্তঘুমে জিভ দেখালো

মুসোলিনির মা—

 

আঠারো কি সাল-ই শুধু

শিমুল ফোটা বন

সারা হাওয়ায় উড়ছে ধু ধু

অজস্র অ্যাপ্রোন

 

যখন আমার

চোখের পাশে

বাড়ছে ক্ষত

ফুল তখনো

ফুটছে মাদারচোদের মতো—


সরকার মুহম্মদ জারিফ

পাকস্থলী

 

অ্যাই যুবক!
তোরা তোর বাপরে জড়ায় ধরে কান
তোরা তোর মায়রে জড়ায় ধরে কান
অ্যাই যুবক, তুই তোর ভাবিরে জড়ায় ধরে কান
তোর মসজিদের ইমামরে জড়ায় ধইরা কান

তোর আর কিছু ঠিক হবে না
কোনদিন ঘুম হবে না স্থিরতায়
তুই কান, এখনই আরামের এই দুপুরে
তুই নজরুলের কবর থেইকা
টাইলস ভাইঙ্গা আন
তারপর রাস্তায় আবার নাম

এই গুলি
গোরস্থান
ভাঙা কাঁচ
সব মিথ্যা
শুধু তোকে মাথার ভিতর যেটা কামড়াইতেছে সেটা সত্য

কামড়া,  কামড়া
তুই মাথার ভিতরের ওই জিনিসটারে কামড়া

মনে রাখ এইসব কথা
আর ‘কেউ’ এর নামতা পড়
আমার সঙ্গে বল
তোর কেউ ছিল না
কেউ থাকবেও না
কারণ তুই কেউই না।

বল আবার বল
তোর কেউ ছিল না
কেউ থাকবেও না
কারণ তুই কেউই না।

যুবক,
তোর পেটে খিদা পোষায় না, তোর ঘুম হয় না,
পেটের আজকে খাওয়ারের প্লেলিস্ট বন্ধ কর
তোর বাপরে ওরা ভাড়া করে নিয়া যাইতেছে
ঐ যে দেখ তোর মা তোরে চিনতেছে না

এদিকে বলে দিছে নদীরা
তোর লাশ ওরা ভাসাবে না

যুবক
তুই তোর বাপরে ডাক দিয়া আইনা ভাঙ
তোর দুলাভাইরে ডাক দিয়া আইনা ভাঙ
কথা দে সিনেমায় নায়িকার নত যেটা তুই
রাখবিই রাখবি, বল, কোনদিন
আর কিচ্ছু জোড়া লাগাবি না
আমার ছায়া ছুঁইয়া ক

তুই ভাঙ
ওই বাসাটা কারা করছে তুই জানোস
তুই উন্নয়নকে অসহ্য কইরা তুল
তুই কারো পোষ্য হইস না
অবৈধ হয়ে ওঠ, সবাইকে অবৈধ বানা।

তোর বুদ্ধির কোন দরকার নাই
তোর চেতনার কোন দরকার নাই
আরো দরকার নাই আত্মসম্মানবোধ
তোর দরকার একটা আঠালো ঠাসানো
পাকস্থলী,

যুবক তুই পাকস্থলীপ্রধান ইতিহাসহীন হইয়া উঠ
ফজরে খেকশিয়ালের পরিতাপ নিয়া ডাক
বিলাপ কর, বাচ্চাদের হকিস্টিক কিনা দে
এনার্জিসূচক জড়বস্তময় পৃথিবীর
একদিক থেকে কামড়া
তোর আছে
তোর শুধু আছে পাকস্থলী
আর….
পাকস্থলীতে কাঁচ ভাঙার শব্দ।


জহির হাসান

এই দ্বীপের কান্না

 

এই দ্বীপের কান্না বাতাস মুছতে পারে না।

তাই এই দ্বীপে কেউ কান্দে না!

 

রাতের আকাশ

তারার আলো ঝরায় দ্বীপের গাছের পর

যেন ঝড়ে ঝরা আম তারা।

 

সাগরের পানি ঢেউ পাঠায়

মুছতে বস্তুগের কান্দন!

 

মেলা জাহাজ আসে।

তারা এই দ্বীপ চোখে দেখে না!

 

কান্না বোঝাই করা যায়

এমন জাহাজ সাগরের মাঝখানে ভাসি উঠো!

 

আমার কন্যার মতো বাড়ি উঠো তরতরায়ে

নীরব ছায়াগুলিন ঐ গোপন ঝাউগুলির

আমাদের মুখের কুঞ্চিত ছায়া স্যানে গিয়া যেন লুকাইতে পারে!


হিজল জোবায়ের

কুর্মিটোলা

 

যে বোঝা ভর করেছে
আমাদের ঘাড়ের ওপর,
এ বোঝার ওজন কতো?

আনো দেখি ক্যালকুলেটর।

মাপো দেখি দোলন কাল এর,
এ দোলে কোন দোলনে?
এতো ঝাঁকি তাও পড়ে না
এতো এতো আন্দোলনে

এ বেতাল ভূতের মতো
উঠেছে, নামবে না কি?
নামবে সময় হলেই,
ঝাঁকি দাও, জোরসে ঝাঁকি!

ফেলে দাও পাথরভার এ
ফেলে দাও কুর্মিটোলায়,
যেখানে লড়াই করে
ছাত্র এবং ঠোলায়

পুলিশের লাঠির বাড়ির
সামনে বুক চিতিয়ে
এ পাথর উঁচিয়ে ধরো
সমস্ত শক্তি দিয়ে

না হলে মরতে থাকো
চাপা খেয়ে চাকার তলায়,
শহরের লোকাল বাসে
দেদারসে কুর্মিটোলায়।


যিয়াদ বিন সাঈদ

মিছিলে তোমার ছেলে

 

আম্মা, ঘুমোবার ফরশ কি হলো তবে পথ
তবু কেন যেতে দিতে তোমার দ্বিমত
বেলা বারোটার রোদে
প্রতিবাদ প্রতিরোধে
যারা গায় নির্ভয় সাম্যেরই গান,
বুকে মুখ ফুঁকে দিয়ে
ঝঞ্ঝায় ছুটে গিয়ে
তারাই তো দিবে মা, হকের আজান
জয় হবে নিশ্চিত, বুকে মুখে হচ্ছে শপথ
তবু কেন যেতে দিতে তোমার দ্বিমত!  


তানভীর হোসেন

একটা শিশু

 

একটা শিশু      ঘুমায় যখন
চাঁদের মতো      ছড়ায় নিয়ন
জগত থেকে     হারায় তখন
সকল জরা       চোরের মতন

আমি তাহার     ঘুমের পাশেই
জেগে রাতের    নীরব তারায়
কী যেন এক     গানের ভাষায়
খেলছি জুয়া     জোকার তাসেই

একটা শিশু       যাদুর ভাঁড়ার
হারছি তবু         হুঁশ নাই আর
হারার শেষে      শিশুর হাসি
ভুলিয়ে দেবে     বিষের বাঁশি


সাখাওয়াত টিপু

ঈগল কাহিনী

 

খুন হয়ে গেছি খুব নিরবতায়, নৈঃশব্দ্যে
কোথাও কোন পাতাও নড়ছে না তাই
বাতাস যে বৈবে তারও আশংকা নাই
তেলাপোকাও আজ বকছে দেদারছে
কেন আমি বেঁচে আছি শীর্ষাকাশে!

হিংসার দেশে বেঁচে থাকা মানে আপনি ঈগল
নাক দেখলেই বোঝা যায় তার শিকার পদ্ধতি
কখনো সে উড়তে উড়তে শিকার করে না!

ঘৃণাদের দেশে বেঁচে থাকা মানে আপনি বাতাস
ঝাউবনে শনশন, শালবনে ভেসে যাওয়া লাশ
যেদিকে যাবেই একাই অথচ কেউ দেখবে না হাহুতাস

সে কারো প্রতিদ্বন্দ্বী না, এমনকি ধূলিকণাও না
তবুও ঘায়েল করা হবে ধারালো শাবলে, শানে
আপনার কান ফেটে যাবে সেইসব নিষ্ঠুর গানে।

মৃত্যুর পরও ঈগল হয়ে আমি থাকবো আকাশে
আমার নৈঃশব্দ্যের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে মুখে
যেন তারাটির পর মৃদুলস্য তারাটিও ক্রুর হাসে!

৬/৬/২০১৮


আশরাফ জুয়েল

 

কে হে তুমি বালের সুশীল? গণদুর্ভোগ চোদাও…
ফাটবে একদিন জানি, ফাটবে তোমার ভোদা-ও


সৈকত দে

একটি অরাজনৈতিক প্রেমের কবিতা

 

উফ বাইশে শ্রাবণ!

বৃষ্টিতে পুরো ভেজা, যদি কিছু দেখা যায়
তুমি ঝুঁকে থেকো না বারান্দায়

জানি, পয়সা পড়ে গেলে তুলে নাও না আর!

নড়ে-চড়ে কেওকারাডং
ঘন্টা বাজে ঢং ঢং ঢং
কাপ ডিশ জেগে ওঠে, বাংলা ভাষার কবি রাণা রায়চৌধুরীর আত্মা ও আকাঙ্ক্ষা সমেত

মেজর কবি নাই আর
সব মেজর জেনারেল
জেনারেলই, প্রচারের জোরে মেজর

উফ বাইশে শ্রাবণ!
দুহাজার কিলোমিটার স্পিডে ছুটে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোটরবাইক ভটভটহীন

এই জনপদে কিছু ঘটেনি
রক্ত ঝরেনি
সরকার ভালো

কম বয়েসিদের নড়ে চড়ে বেশি
বড়োদের ধীরে
কেওকারাডং
ঘন্টা বাজে ঢং ঢং

তুমি ওইভাবে ঝুঁকে থেকো না
বৃষ্টিতে সব ভিজে যায়

রাগ ও রাজনীতির রক্ত ধুয়ে যায়।

। বাইশে শ্রাবণ ১৪২৫।


নৈরিৎ ইমু

বাঙলার আঠারো

 

উড়তেছে ওই পতাকার মত
রক্তমাখা শার্ট
বাংলার বুকে আঠারো যত
উজ্জ্বল সম্রাট
একজন নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে ওরা
অতিথি পাখির মত
বিলিয়ে দিয়েছে মমতার চিঠি
অক্ষরে অক্ষত
যা কিছু দেবার দিয়েছে তারা
রাজপথে শিখিয়ে
মানুষ কেবল (হাহা) সমুদ্র দেখে
নিরাপদে দূরে দাঁড়িয়ে


জুয়েল মোস্তাফিজ

হোয়াট অ্যা পেয়ার অভ ব্লাডেড শুজ

 

এক জোড়া জুতার ভেতর, এক জোড়া জুতার নিচে, আহা এক জোড়া জুতার কি লাবণ্য…
 
খালি পায়ে হেঁটে চলা বাংলাদেশ। আব্বু-আম্মু করতে থাকা রক্তের ফিনকি। কাঁদছে সহপাঠী হারানো স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড…
 
রাজপথে বইছে বাজপাখির পালক। তার নখ থেকে আপনার নাক সাবধান। ওরা লাল পিঁপড়া, আপনার পাকা পেঁপে কেটে কুটিকুটি করে দেবে…
 
ওরা উত্তাল চক ডাস্টার। আপনার কপাল মুছে দিয়ে
লিখে দেবে দিয়া-করিমের নাম। আহা এক জোড়া জুতার কি লাবণ্য…
 
খালি পায়ে হাঁটছ বাংলাদেশ। তোমার পায়ের মাপে রক্তমাখা এক জোড়া জুতা এনেছে তোমারই শিশু সন্তান…

চাণক্য বাড়ৈ

ফুলের ডাক

ফুল ফুটেছে শহরজুড়ে
ফুল দেখি ওই, ভুল কি?
কিশোরী আর কিশোরেরা
বারুদজ্বলা ফুলকি!

সহপাঠীর রক্ত মেখে
লাল হয়েছে রাস্তা
খুনের বিচার হতেই হবে
জীবন তো নয় সস্তা।

সড়কে দাও নিরাপত্তা
তালবাহানা নয় কোনো
পাপড়ি যেন না ঝরে আর
লক্ষ ফুলের ডাক শোনো।


সানোয়ার রাসেল

ফটাস ফটাস
 
খোলস ফাটাতে হয়
শামুকের
খোলস ফাটাতে হয়
ফটাস ফটাস করে
খোলস ফাটাতে হয়
ধৈর্য্য ধরে
নিয়ম করে
জোগাড় করে
ফাটাতে ফাটাতে ফাটানোর নেশা ধরে
ফাটাতে ফাটাতে একঘেয়েমির বিরক্তি ধরে
তবু
শামুকের খোলস ফটাস ফটাস করে
ফাটাতে হয়
নরম শম্বুকমাংস
ঘিনঘিনে থকথকে
হাতাতে হয়
হাঁস পালতে গেলে
 
আমি পালি হাঁস
শামুকের খোল ভাঙি
ফটাস ফটাস…

মাজুল হাসান

আমার এভারেস্ট

 

ঘুমাতে পারছি না, চোখ বুজলেই কে যেন কলার চেপে ধরছে…

আমি তো এক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আকাশে, বিদ্যুৎলতায়
দ্যাখো এখনও মাদুলি, প্যাপিরাস, মেঘলিখন আমার শরীরে
রংধনুতে কোনো কালো নেই, তবু ক্যানো এই ব্ল্যাকাউট? নির্মম?
আমি তো আরেক হাত প্রথিত করেছিলাম পাতালে, পদ্মঘুমে, চূড়ায়
এই শহরই আমার এভারেস্ট, চিরহরিৎ, ঘর্মাক্ত, প্রিয় লেভেরিন্থ
লোমওঠা নেড়ি কুকুরটাকেসহ আমি ওকে ভালো পেতাম, ভালো পাই
বিমানবন্দর শুয়ে আছে রানওয়ে সমেত, নাভির মতো পোতাশ্রয়
সন্নিকটে সমুদ্রবন্দর; তবু আমি তো পালিয়ে যাইনি নীলের অপারে

এখন ভয়ে চোখ খুলছি না, তাকালেই কেউ যদি কলার চেপে ধরে…


চঞ্চল বাশার

শবগাড়ি

 

গুম গুম, আন্ধার, পিচ্ছিল , পিচকালা রাত
বুক বরাবর, পেট বরাবর চালাও করাত
ডাকু ইঞ্জিন-কাঁটা, পিস্টন ঘুরে ঘুরে যাক
বোবাধরা মুখে, লালাথুতু মেখে দিচ্ছে কে হাঁক?
“চালাও চালাও চালাও চালাও চালাও করাত”
করাতের নিচে কাটা দেহ, হাসে দস্যু-কিরাত!
বজ্রভীষণ গর্জনে ফাটে তামাম দুনিয়া
বুনো শার্দুল যত বেরিয়ে এসেছে গর্ত ছাড়িয়া
রে হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া হু করুণ আর্তরব
যেন শত শত বোবা জন্তুরা করছে প্রসব!
কাদাকর্দমমাখা গায়ে যত পামরের দল
টানে শবগাড়ি, ধু ধু নিঃসীম পথে অবিরল
পিছনে পিছনে ছুটছে রাতের অলীক বাদুড়
শূন্যে বাতাস ঝাপটায় আর বাজছে ঘুঙুর—
অযুত লক্ষ অর্বুদ-কোটি খল-সন্তান
হাতে ভর করে হাঁটে,কাঠের আকাশে চাকু দেয় শান
কূট-ঈশ্বর! সাধু আর শয়তানে করে সহবাস
ওরে সোনা, চুপ! কোন কথা নাই শুধু চাপা-ফিসফাস—
গুম গুম, আন্ধার, পিচ্ছিল , পিচকালা রাতে
বুক বরাবর, সিনা বরাবর কাটো শখের করাতে


সৈয়দ সাখাওয়াৎ

ঝরো, এই বর্ষার দিনে

 

ঝরো, এই বেদনার দিনে এক আকাশ-কুসুম
ঝরো বিপণ্ণ দিনের হাওয়া ভুলে শীতার্ত ঘুম
ঝরো সকল হত্যার কালে প্রহসনের তালিকা
ঝরো কাঙ্ক্ষিত স্বরের সাথে ঊর্দ্ধ বালক-বালিকা
ঝরো সকল মনের ঘৃণা ও নিদান সিন্ধু পাড়ে
ঝরো এককোষী মন, ঝরে পড়ো বিভিন্ন আকারে
ঝরো আমি আর তুমি, বলো সুরে আমাদের কথা
ঝরো বসন্ত দিনের দ্বিগুণ হওয়ার সখ্যতা
ঝরো প্রেম ও পুণ্যের সাথে, যেন দূরাগত হয়
ঝরো ভবিষ্যত কথা, যেন দূর হয় সব ভয়


সালেহীন শিপ্রা

ত্রস্ত সময়

 

হায়েনার হা-মুখের ভেতর

আটকে পড়ে কী দেখতে পায় ত্রস্ত সময় !
গলার দিকে গাঢ় ছায়া

গুম হয়ে যায় পাখিরা অই লকলকানো অন্ধকারে

জংলাপাশে ব্যক্তিগত রক্তমাখা পালক কিছু

ফের পাওয়া যায় ।
আলোও আসে

ধারালো দাঁতের ফাঁক গলে

বাতাস সাথে

মাংশ পঁচা গন্ধমাখা ।
ত্রস্ত সময়

দেখতে কি পায় বন্ধ চোখে !


মৃদুল মাহবুব

যে‌কোন মুহূ‌র্তে বিপ্লব ঘ‌টে যেতে পা‌রে

 

আমার বন্ধু‌দের কেউ কেউ গে‌ছে সুন্দরবন, নরম মা‌টি‌তে বা‌ঘের থাবার কোমল ছাপ গুন‌তে, তা‌দের সা‌থে আ‌ছে উজ্জ্বল ডিএসএলআর, জোছনার ফ্ল্যাশ, তারা খাঁটি মধু নি‌য়ে আস‌বে ফেরার প‌থে।

না‌সির বন্ধু আমার, বিশ টন ট্রাকের গিয়া‌রে হাত রা‌খে, স্মার্ট‌ফোনে ফুল ভ‌লিয়্যুম ঐ‌হিহ্যহীন হিন্দি গান শো‌নে, ভোররা‌তে দাঁ‌ড়ি‌য়ে আ‌ছে আ‌রিচার ঘা‌টে গরুর চালান নি‌য়ে, ওপারে যা‌বে, দুস্তর পারাবার হে।

বন্ধু ‌বাপ্পী, সে সেতু ভব‌নের ই‌ঞ্জি‌নিয়ার, স্পিড‌বোটে ঘো‌রে ব্রি‌জের পিলা‌রের নিচ দি‌য়ে, কত পা‌নি ব‌য়ে যায়, কত মা‌টি ক্ষ‌য়ে যায়।

‌আ‌রো এক বন্ধু শহীদ মিনা‌রে দাঁড়া‌নো খা‌লি পা‌য়ে, অপুষ্ট দীপ্ত বুক, কাকতাড়ুয়ার মত দুর্বল, অভয়, কাক তাড়া‌বে আজ।

অদূ‌রে বুটপা‌য়ে জনবান্ধব পু‌লিশ, লা‌ঠি ও বন্দুক, প্র‌তি‌রোধ, স‌জ্জিত ক্যা‌মেরা, লাইভ চি‌কেন, মোরগ ও মুরগীর ডা‌কে মুখ‌রিত পর্দায় মেকাপঘসা জা‌তির বি‌বেক।

আর এখন, এমন অসহায়, ‌যে‌কোন মুহূ‌র্তে সুন্দরবনে বা আ‌রিচার ঘাটে বা সেতুর নি‌চে বা শহীদ মিনা‌রে বা মি‌ডিয়ার বে‌ডরু‌মে ঘ‌টে যেতে পা‌রে সন্ত্রাসী বিপ্লব। দু‌নিয়ার প্র‌তিটা মানুষ যেকোন মুহূর্তে পোষাক বদ‌লে, যে যার জায়গায় দাঁড়া‌তে পা‌রে সৈ‌নি‌কের বে‌শে, বন্দুক, কার্তুজ, বে‌নেট ছাড়াই।


রুহুল মাহফুজ জয়

ফুলের কথাবলি
 
ফুলের কাছে এসে সমগ্র বসন্ত ঝরে যাবে একদিন
সেদিনও তুমি রুহুল, টিউন করে যাবে ভাড়াবাড়ির সুর
সংসারের মস্তক থেকে ঝুলে পড়বে তিনটি সুনিপুণ বেণী
যেখানে শুরু ফুলের কথাবলি, তারই পাশে মায়ের মনে
দোপাট্টা দোলাবে হাওয়াদল—
           নাচিবে বউ গাইবে তুমি
           আগন্তুক নাড়িবে কড়া
           বসন্ত যাবে ঝরে ফুলের কাছে এসে
 
 
‘এখানে ফুলেতে বসে না মৌমাছি—অনুমতিহীন
তুই রুহুল, কোন বাঞ্চোদ গাইছিস সুরে, নাচাইছিস বউয়েরে!
অনন্ত গহ্বর দুয়ারে, উঠে যা—
                                  গান গা, গিয়া পরপারে।’
 
 
হায় রুহুল! তোমার মৌমাছির সাথে বহু আলাপ
               অদিতির রয়ে গেছে বাকী!

মোস্তফা হামেদী

হাওয়ার পাল

 

তুষের মতো ঝরছে মেঘ
আকাশে কেউ ঝাড়ছে চাল
পাতার পাড়ে ভীড়ছে এসে
রুদ্র কোনো হাওয়ার পাল

নাচছে তারা ফিনফিনিয়ে
ফিঙের মতো হিনহিনিয়ে
গাছের শাখা ঝনঝনায়
শুকনা পাতা ঝরঝরায়

গাছটি বুড়া কেমন ঢুলে
দেখায় তারা দুচোখ খুলে
মাথায় কারা লবণ থুয়ে
বরই খেয়ে ফোলায় গাল

বাগিচা জুড়ে ছড়িয়ে আছে
ভিতর ফাঁপা নকল ছাল
সায়র থেকে লাফিয়ে এলো
কঠিন রাগী হাওয়ার পাল

চাকুর মতো চিকন রোদে
খুঁচিয়ে তোলে ঘাসের ঘ্রাণ
বনানীটাকে জাগাবে বলে
মারছে জোরে হ্যাঁচকা টান

কড়াৎ করে গাছের ঘাড়
ভাঙছে দেখ তুমুল ঘায়
ফ্যাফসা মাথা উপড়ে পড়ে
ধুলায় ভরা দ্রোহের পায়


মাজহার সরকার

শিশুর লাশ কাঁধে নিয়ে

 

দুই হাত বাঁধা থাকলে আসলে এখন কোনো সমুদ্র আঁকা সম্ভব নয়

নির্বাসিত অরণ্যে বসে দেশপ্রেমের কথা যে বলে তাকে প্রথমে একটা লাথি দাও, তারপর বিনয় করে রাজপথে আসতে বলো

আজ এই বেদনার বিচ্ছেদে এই জুতো জোড়া আমি আমার দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি

যেন যখন-তখন কেঁপে উঠতে পারি

আর এর দুটো রক্তাক্ত ফিতে আমাকে একটি সমুদ্রের কথাই মনে করিয়ে দেবে

কিন্তু নিছক সমুদ্র রচনা আমার উদ্দেশ্য নয়, কারও মনোরঞ্জন আমার অভিপ্রেত নয়

ওরা আসলে বলেছিল সভাপতি-সম্পাদক চোদার টাইম নাই, মানুষের বুক থেকে পদবি ছিঁড়ে নিয়ে ওরা পায়ে পিষেছিল

এই জুতো জোড়া তাই যুগল অন্তর্দাহের কারুকাজ

তারা ঈশ্বর ও নারীর মতো রক্তের গাঁথুনিতে উজ্জ্বল সেই ধমনীগুলোকে

বারুদের মতো জেগে ওঠা সাহসী গর্জনগুলোকে

চিরকাল মানব-মানবীর দ্রোহতৃষিত ঠোঁটে তুমুলভাবে কাঁপিয়ে তুলে বলেছিল

ক্ষমতা চোদার টাইম নাই।

আজ থরোথরো কেঁপে ওঠা বালক-বালিকার বুক মুখ ক্ষোভে অপমানে কেবল নিরাপদ মৃত্যুর দাবি নিয়ে বিড়বিড় করে ওঠা অসংখ্য শব্দের বুদবুদ সদম্ভ চিৎকারে

এই জুতো জোড়া তাই আমি আমার দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি

যেন দেখামাত্র আঁতকে উঠতে পারি

কিন্তু জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হয় আর একটি কফিনকেও আমি স্থান করে দিতে পারবো না এই মাটিতে

যদিও কবর খোদক হিসেবে আমার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে

আজ থেকে লাশ না পুঁতে

আমি কাঁধে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াবো

উন্মুক্ত গর্জনে হোঁচট খাবো, আমি যাবো তাদের কাছে যারা চাষ করেছে লাভজনক দালালবৃত্তি

একটি হাস্নাহেনার চারা দিয়ে যাকে একদিন বলেছিলাম সুবাস ছড়াতে

তাদের আজ উপহার দেবো লাশের দ্রোহবীজ

টকটকা শিশুর এক একটি লাল জিভ।


ফারাহ্ সাঈদ

যুদ্ধে যাচ্ছো যাও 

 

এভাবে থেমো না ওভারব্রিজ
সন্দেহভাজন দুটো ঝুঁকি ঘুরঘুর করছে
একটি দুর্ঘটনা হেসেখেলে ঋতুবতী হোক
এটাই কি চাও তুমি?

আমাদের রোলকল হচ্ছে
দোতলা
বারোতলা
তেতলা
উঠে দাড়াও কমরেড!
লুকায়িত জলছাপ
যাবতীয় ফ্লোরপ্ল্যান
আর
পাণ্ডুলিপির ক্ষরণ বুঝে নাও।


সারাজাত সৌম

কাঁকাল

 

আমার ছোট্ট সুপারি গাছ—
তুমি আনন্দ, যখন দুলিয়ে দাও শরীর
মাটি থেকে আকাশ
ওই মেঘ—বজ্র শুনি, কি আনন্দ

ছোট।  বলো, ছোট্ট কোথায় গাছ

তীব্র কিশোর, মায়ের থেকে দূরে
যখন পাথর হয়ে রাস্তায় নামে
যেন এই প্রেম, ঝড়ের পূর্বাভাস—
শহরের যে কোনো এভিনিউয়ে

পোশাক ছেড়ে যাচ্ছে কে!

বলো, ওখানে কে—
বাদুর—ট্যাঙ্ক, ঘুমন্ত হাঁস
আর পুকুর ঘাটে আম্মার ছবি

সেও কি আনন্দ
হলুদ ব্যাঙ ডাকছে ভীষণ
বৃষ্টি হবে ভারী

এসো প্রাণের রাখাল—

কাঁকাল ধরেই এসো
আমরা নাচতে নাচতে রাস্তায় নেমে পড়ি।


শামশাম তাজিল

বিরুদ্ধ বায়ু

 

প্রহসনের হাসির ভেতর নাফরমানির চাল,
লোক ঠকিয়ে আসছে শুধু, আরও চিরকাল 
ভুলিয়ে রাখার বটিক তারা গিলিয়ে দিতে চায়,
ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েও পাবে না তারা ঠাঁই! 
হাসতে শিখে গেছে মানুষ, মৃত্যু পরাঙ্মুখ;
ভয়ের ঘোড়া দাবড়ে এখন বাড়িয়ে দেয় বুক।
বুকের মাঝে হৃদয় থাকে কিসের তবে ভয়?
আন্দোলিত শিশুর হাসি দেখেনি পরাজয়। 
মরণ খুঁজে নিতে যুবক শিখছে প্রতিদিন, 
অমরত্ব নিজেই মরে শুধবে মৃত্যু-ঋণ। 
জীবন ফেরি করছে হাতে, মরণ জুতার নিচে
ফেলে এসে হচ্ছে জড়ো পরস্পরের পিছে।

তারাই আশার আগুন জ্বেলে প্রদীপ হয়ে জ্বলে;
বাংলা এবার বর্তে যাবে, এমন শিশু পেয়ে।


মহিম সন্ন্যাসী

উপলব্ধি

 

তোমরা সেই ছোট্ট আবাবিল পাখিগুলো নও?
তোমরা কি এইভাবে দল বেঁধে একদিন
আবরাহার মস্ত হাতিদের ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দাওনি?

আমি তোমাদের চিনতে পেরেছি শেষে।


সাজ্জাদ সাঈফ

মিছিল

 

ঐ যে ঘাস থেকে
উঁচু করে আছে মাথাটি
শান্ত সুবোধ সাপ
ঐ যে আলের ধারে কলমি পেচানো ডোবা
এর সব‌ই আপাত শান্ত, আর আমাদের মগজটাই বিগড়ানো, আমরা শুধু শুধু ছোবল দেখছি
আর খেলতে গিয়ে মালতীর ছেলের পড়ে যাওয়া দেখছি ডোবায়, বিগড়েছে ষোলো কোটি মাথা
আর তাতেই মিছিল-মিটিং আর ধরপাকড়;
এইভাবে প্রণয় ভুলে গেলে চলে?
এইভাবে তামাশা?

ভাটার ধোঁয়া এসে কালো করে দিচ্ছে স্কুল
আমাদের বাসাবাড়ি লাগে
সাথে প্রশস্তির বনফুল
সাথে মিছরির ছুরি!

একটু ঝিমিয়ে ফের চোখ তুলে বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখছে দেশ, তার হাত কাঁপা কাঁপা, পার্কিনসন্স?
নাকি নার্ভাস ফর্টি?

ঢাকায় শিশুদের ভর করেছে মিছিল
প্ল্যাকার্ড লিখেছে কে, এতো গালাগাল?
অথচ রক্তটা শিশুতোষ, পুলিশের লাঠি
বাস শ্রমিকের মাইর, সব মিলে ষোলো কোটি
বিগড়ানো মাথা, যেনো কেউ ঘাসের মধ্যে ঢিল মেরে
ফুঁসলে দিচ্ছে সাপ, অনন্ত হতে রাহু
করোটির ভিতর এসে সেদ্ধ করছে স্নায়ু!

বাসের ধাক্কায় একটা নক্ষত্র
বাসের ধাক্কায় একটা ছায়াপথ
বাসের ধাক্কায় একটা বিভার প্রণালী
নিঃস্ব হলো, কারো গলায় আটকালো না ভাত?
কারো চোখে ঝাঁপসা হলো না আলো?
হে মাননীয় সংসদ!

শেয়ার