ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়েছিল হুমায়ুন। সাধারণত সে ভিড় ভাড়াক্কা এড়িয়ে চলে। এটা তার স্বভাব। অথচ আজকাল দিন এরকম যে ভিড়ের হাত এড়িয়ে চলা বড় মুশকিল। পুরো শহরটাই মনে হয় যেন ভিড়ের পদ্মপাতার ওপর ভাসছে।
ক্রমাগত নড়ে চলেছে অগুনতি মানুষের মুখ। নড়ে চলেছে মানুষের চালিত গাড়ি। অথচ হুমায়ুনের স্বভাবের ভেতরে ছেলেবেলা থেকেই নির্জনতা তার দাঁত বসিয়ে রেখেছে। সে দাঁতের কামড় বড় গভীর। বাইরে থেকে অবশ্য এই কামড় চোখে দেখা যায় না। যে এর ভুক্তভোগী সে-ই শুধু জানে। এত নড়ানড়ি, এত অস্থিরতা হুমায়ুন পছন্দ করতে পারে না। তার মনের গভীরে সর্বদাই কে যেন এক উদাসী বাউলের গান গেয়ে চলেছে। সেজন্য আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজের স্ত্রীর কাছ থেকেও কথার খোঁটা শুনে চলেছে প্রতিদিন। দশ জন মানুষের ভেতরে নিজের স্বামীটিকে কে না বড় করে দেখতে চায়। কিন্তু মেহেরিনের কপাল খারাপ। এমন মানুষের হাতে তার ভাগ্যের গঁটছড়া বাঁধা হয়েছে যে কেবলি নির্জনতা খোঁজে। কোনোরকমে অফিসের কাজটুকু শেষ হলেই যে বাড়ি এসে কিছুক্ষণ নীরবে টেলিভিশন দেখে নিজের ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসে। খাবার টেবিলেই তার কোনো হুঁ হাঁ নেই। রান্না ভালো না খারাপ, কড়া না হালকা, মিষ্টি না ঝাল, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
এরকম একজন স্বামীকে কজন মেয়ে ভালোবাসতে পারে দীর্ঘদিন, যেখানে সুখি সংসারও জীবনের একঘেয়েমির হাত এড়াতে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে বসে?
আজ এভাবে সাত রাস্তার মোড়ে তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু আজ তার অফিসের গাড়ি নেই। গাড়ি কারখানায় গেছে। এবং তার বদলা অন্য কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়নি। তাই বাস বা টেম্পো বা সিএনজিই ভরসা। কিন্তু সময়টা এমন, অফিস ছুটির মুখে, কোনো গাড়িতেই সে ঠিকমতো ওঠার ব্যবস্থা করতে পারছে না। আর এমন যানজট যার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব কঠিন। গাড়ি, টেম্পো, রিকশা, ভ্যান, ট্রাক, মাইক্রোবাস মিলে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। সাতটা রাস্তাতেই একই অবস্থা। আর গরম কি! রাস্তা ফুঁড়ে যেন পিচের ফালি উঠে আসছে এখনও। দুপুরের গনগনে সূর্য রাস্তাটাকে এমন ক্ষিপ্ত করে দিয়ে গেছে যে তার রেশ এখনও যেন রাস্তা থেকে মিলিয়ে যায়নি। সাত রাস্তার মোড়ের তামার ময়ূর চারটে পর্যন্ত এখনও যেন লাল হয়ে গনগন করছে তাপে। এই অবস্থায় হুমায়ুন রাস্তাই বা কীভাবে পার হবে? এমন যদি হতো, সে এটুকু যানজট উড়ে পার হয়ে চলে যেতে পারতো, সেটাও একটা কথা ছিলো। কিন্তু সেটা সম্ভব না। যেমন সম্ভব না মেহেরিনের কথার হুল ফোটানো প্রবণতার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। কাল রাতেও মেহেরিন তার বুকে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে উঠে বলেছে, তুমি মরদ নাকি? আমার তো সন্দেহ হয়।
হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে তার শরীরটা ভালো ছিল না। মনও বিনা কারণেই ছিল মলিন। এরকম তার আজকাল মাঝে মাঝে হয়। এটা কি বয়সের লক্ষণ নাকি বায়ুরোগ সে তা জানে না। বয়স তার পঁয়ত্রিশ চলছে। সেই হিসাবে এমন কি আর বয়স। মেহেরিন তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সেই হিসেবে মেহেরিনের শরীরের ক্ষিধে অনেক বেশি। একটা বাচ্চা হয়েছে, তবু তার পরও তার শরীরের ক্ষিধের কোনো কমতি নেই। এটা কি একটা মেয়ের জন্য ভালো লক্ষণ না খারাপ তা হুমায়ুন জানে না। তবে সে কেন যেন আজকাল মেহরিনকে ভয় পায়। বিশেষ করে রাতের বেলা তার সাথে এক বিছানায় ঘুমোতে তার ভয় লাগে। কেন এই ভয়? হুমায়ুন জানে না। অথচ মেহেরিন যেদিন সকাল করে ঘুমিয়ে পড়ে সে গোপনে হস্তমৈথুন করে নিজের শরীর। কই তখন তো তার ভয় লাগে না, পুলকের কোনো কমতি হয় না! তবে কি সে সমকামী? কথাটা ভেবে মাঝে মাঝে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু না, হুমায়ুন সমকামী না। কোনোদিন না। এটা হুমায়ুনের চেয়ে আর কে ভালো করে জানে।
শুধু গাড়ির ভিড় না, মানুষের ভিড়ই বা কম কি? একটা মানুষজট বেঁধে গেছে এর মধ্যেই। কে কাকে ধাক্কা দিয়ে আগে রাস্তা পার হবে সেই মসকো চলছে। এরই ভেতরে ফকির, পাগলা, ফেরিওয়ালা, ডাববিক্রেতা তাদের রমরমা ব্যবসা শুরু করেছে। গরমে, ঘামে, চিৎকারে, গালাগালিতে নরক গুলজার। যতক্ষণ যানজট, ততক্ষণই এই অবস্থা চলবে। মনে হচ্ছে শহরের কোনো রথীমহারথী এই মুহূর্তে রাস্তা পার হচ্ছে। তার জন্য তৈরি করা হয়েছে নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন এক সড়কপথ। তিনি চলে গেলেই আবার সবকিছু সবেগে নড়েচড়ে উঠবে। সবকিছু ভীষণ সপ্রাণ ও সচল হয়ে উঠবে।
এমন সময় এক কাণ্ড ঘটল। ভিড়ের ভেতর থেকে সবুজ জামা পরা একজন মধ্যবয়সী মানুষ হঠাৎ দুহাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো হুমায়ুনের কাছে। এত কাছে যে তার নাকের গরম নিঃশ্বাস ফোঁৎ করে পড়ল হুমায়ুনের ঘাড়ে।
ঘাড়টা যেন জ্বলে গেল তার। লোকটার সঙ্গ এড়াতে হুমায়ুন সরে যাবার আগেই লোকটা তার খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ নেড়ে চোখ পাকিয়ে হুমায়ুনের চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে বলে উঠল, আপনি কে? তার কথা শুনে হুমায়ুন আরে, আরে বলে উঠতে গেল। বিরক্তি লাগল তার। এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তার ওপর লোকটাকে সে চেনে না শোনে না। কিন্তু মুখ থেকে কোনো বাক্য বের করার আগেই যেন লোকটা ভোজভাজির মতোন মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। খুব সম্ভব ভিড় ঠেলে সে ঢুকে গেল আরও ভেতরে।
অবাক হয়ে, কিছুটা বা স্তম্ভিত হয়ে হুমায়ুন দাঁড়িয়ে থাকল রাস্তায়। যেন হঠাৎ করে বাক্-রোধ হলো তার। নড়াচড়াও বন্ধ হলো। অন্যদের চলন্ত গতি থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সে। যেন তার চোখের সামনে দিয়ে রেলগাড়ি চলে যাচ্ছে। আর হুমায়ুন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে চোখে দেখছে তার চলে যাওয়া। অথচ একটু আগেই সে নিজেই এই গাড়ির একজন যাত্রী ছিল। বাজে একটা অনুভূতি হতে লাগল হুমায়ুনের ভেতরে। এই অনুভূতি বাইরে প্রকাশ করাটা কঠিন।
সময়টা তখন বিকেল। অনেকেই ঘরে ফিরে যাচ্ছে। অনেকে বা কোনো না কোনো কাজে যাচ্ছে। রাস্তাতো মানুষের জীবনের দিকনির্দেশনার কাজ করে মানুষের অলক্ষ্যে, হুমায়ুন এখন ভাবল। সেই মতো তার দিকনির্দেশনাও ঠিক ছিল রাস্তায়, কারণ সে জানত সে বাড়ি যাচ্ছে। সেই বাড়ি যেখানে আছে তার স্ত্রী মেহেরিন। আছে তার দেড় বছরের ছেলে ইমতিয়াজ। মেহেরিনকে বিয়ের আগে চোখে দেখেনি হুমায়ুন। দেখার সম্ভাবনা কম ছিল। তবে মেয়ের ফটো সে দেখেছিল। সেই ফটো দেখে তার মনের ভেতরে এক ধরনের গা শিরশির আনন্দও হয়েছিল। বিয়ের আগের রাতে মা তাকে বলেছিলেন, একখান টুকটুকে বউ এনে দিলাম তোর হাতে, হুমায়ুন। বউকে যত্ন করিস বাবা। আর বিয়ের রাতে বউ বলেছিল, আমার গায়ে বেশি হাত দেবেন না, গায়ে হাত দেওয়া আমি পছন্দ করিনে। কিন্তু তার পরেও সাহসী হয়ে স্ত্রীর শরীরে হাত রেখেছিল হুমায়ুন। তার শরীরের কুমারীত্ব ভেঙেছিল। তারপর কী যে হলো, কী যে হয়ে গেল, তার যথাযথ ব্যাখ্যা হুমায়ুনের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। যেন ঘুমন্ত বাঘিনীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল হুমায়ুন। মেহেরিন তার শরীরের দাবি নিয়ে হাজির হতে লাগল প্রতি রাতে। প্রথম প্রথম সে তাল রাখতে পেরেছে। কিন্তু কিছুদিন ধরে পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একটা ক্লান্তি এবং পুনরাবৃত্তির ঘটনায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল সন্তান হবার পরে মেহেরিনের ভেতরে হয়তো পরিবর্তন দেখা যাবে। কিন্তু তার কোনো নিশানা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এটা হুমায়ুনের জন্য একটা ভাবনার বিষয় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু ভাবনাটা গোপন। এবং কিছুটা বা অপরাধবোধের সাথে সম্পৃক্ত।
আপনি কে? কথাটা তার বুকের ভেতরে যেন জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল। তাইতো, হুমায়ুন আসলেই কে? সে কি ভার্সিটি থেকে এমবিএ পাশ করা, একটা দেশি ফার্মে চাকরি করতে ঢোকা মাঝারি গোছের একজন বিবাহিত অফিসার, যে নাকি এক সন্তানের জনক ও মোটামুটিভাবে সুখি একটি পরিবারের প্রতিভূ নাকি তার আরও একটা পরিচয় আছে যে পরিচয় এসব পরিচয়ের চেয়েও আরও বেশি দরকারি এবং মূল্যবান ও বিশেষ একটি সজ্ঞায় সজ্ঞায়িত। অথবা সে পরিচয় জটিল কোনো অঙ্কের মতো ধাঁধা সৃষ্টি করতে সক্ষম যা অস্তিত্বের নিগূঢ় কোনো কুহেলিকার জড় ধরে টান দেয়। অথবা সে সৃষ্টির আদির এককোষি থেকে বহুকোষির কোনো নিমজ্জিত সত্তা। বহু প্রাকৃতিক দর কষাকষি এবং ভাঙচুরের ফলে বর্তমানের এই রূপান্তর।
কথাগুলি এই মধ্যবিকেলে যেন পাথরের চাঙড় ভাংতে লাগল তার মাথার ভেতরে।
কি বিচ্ছিরি সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটছে আজকাল। সমস্ত শহর যানজটের থাবার ভেতরে জিম্মি হয়ে ধুঁকছে। ধুলো, রোদ, মুখ খারাপ, ঘুষাঘুষি, মল্লযুদ্ধ কোনোকিছুই যেন যানজটের নিরসন করতে সক্ষম নয় বা হচ্ছে না। ধারা পাল্টে যাচ্ছে জীবনের। দর্শন পাল্টে যাচ্ছে। কর্মযজ্ঞের যোগ-বিয়োগ পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ যেন নিজের ভেতরে নিজেই বন্দী হয়ে যাচ্ছে। মানুষের চারপাশে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য সব খাঁচা, সেই খাঁচায় বন্দী হয়ে যাচ্ছে মানুষ। মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সবকিছু যেন ঘটছে।
হুমায়ুন সাত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। চারদিকে এত অস্থির এক উত্তেজনা। এত লোকজন। এত গাড়ি। এত রকমের হত্যা এবং আত্মহত্যা। এত রকমের মুখখিস্তি। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের এত রকমের ঘাম এবং সেই ঘামের ভেতর থেকে এত রকমের দুর্গন্ধ। রাস্তার ধারেই বিরাট এক ডোবা পচা নারকোলের খোসা বুকে ভাসিয়ে নিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে হুমায়ুনের মুখের দিকে। যেন বুক চিতিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ুনের মজা দেখছে। অথচ হুমায়ুন এখন মজার ভেতরে নেই। হুমায়ুন এখন গভীর এক চিন্তায় ক্রমশ নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছে। হুমায়ুন জানে সে দেখতে ভালো না। কোনোরকমের চলনসই গোছের চেহারা তার। লেখাপড়াতেও হুমায়ুন চলনসই। বাল্যজীবনে খেলাধুলাতেও তাই। এমনকি হুমায়ুনের কোনো বাল্যপ্রেমও নেই, যা নিয়ে সে নিভৃতে কখনো আপন মনে জাবর কাটতে পারে। সেই হিসেবে, হুমায়ুন একেবারে যাচ্ছেতাই গোছের একজন মানুষ। তার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এমনকি প্রতি শুক্রবার মসজিদে যায় যেসব লোক তাদের ভেতরেও হুমায়ুন পড়ে না। কারণ সে কোনোদিন মসজিদে যায় না। তার কোনো দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাসও নেই। সে যেন এ সমাজের এক আগাছা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনো এদিক, কখনো বা ওদিক। তার বন্ধুবান্ধব? সেদিকেও হুমায়ুন খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। সে জানে তার অফিসের বহু অফিসার অবসর সময়ে মদের বোতল খুলে বন্ধুদের সাথে হৈ-হল্লা করে, কিন্তু হুমায়ুনের এদিকেও ল্যাকিং। অবশ্য ল্যাকিং বলতে কি বোঝা যায়, সেটাও জানতে হবে। হুমায়ুন নিজে কখনো এটাকে তার চরিত্রের ঘাটতি বলে মনে করে না। তার কোনো বিশেষ বন্ধু নেই, এটা যেরকম সত্যি, তেমনি তার কোনো শত্রুও নেই, এটাও সেরকম সত্যি।
কিন্তু এখন? হুমায়ুনের মাথার ভেতরে সন্দেহ দোলা দিতে লাগল। নাগরদোলার মতো দোলা। উঠছে, নামছে। আবার উঠছে নামছে। এই পৃথিবীতে কোন মানুষ শত্রুহীন? আর কোন মানুষই বা বন্ধুহীন? সব শীতলপাটির বুননের মতো একের পর এক, একের সাথে এক। হুমায়ুন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। এখন সে ভাবতে ভাবতে রাস্তার একটি কোণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হুমায়ুনকে বিশেষ কেউ নজরে আনছে না। নজরে আনুক এটা সে তেমন চায়ও না। তাকে এখন সে খুব মনযোগের সাথে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে, সেটা হলো, আপনি কে?
এই পৃথিবীর সবকিছু রহস্যময়। সবকিছু পর্দার আড়ালে ঢাকা। মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ, সংসার সবকিছু একটা জালের আড়াল থেকে যেন কাজ করে যাচ্ছে। সবকিছু একটা ধূসরতার প্রতীক। নিজের বোধের ভেতরে যা কিছু সঞ্চারিত হয়, তার ভেতরেও এক ধরনের অস্পষ্টতা যেন ঘিরে ধরে আছে নিজেকে। হুমায়ুনের নিজের ব্যাপারেও যেন তাই। সে রোজ অফিসে যায়, কাজ করে, মানুষের সাথে কথা বলে, ঘরে ফিরে যায়, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, বাচ্চা কোলে নেয়, বাচ্চার মুখ চুম্বন করে, হাসে, ভাত খায়, ঘুমোয়; এতসব কাজ করে অথচ সবকিছুর ভেতরেই এত রকম আর এত ধরনের অস্পষ্টতা যা বলে শেষ করা যায় না। যেন একটা খোলসের ভেতরে থেকে রুটিনমাফিক এতগুলো কাজ সে সম্পন্ন করে চলেছে সারাদিন। যেন সে আদতেই একটা কচ্ছপ। মানুষ কচ্ছপ। বাইরে তার খুঁড়ে তোলা অলঙ্ঘনীয় প্রাচীরের সীমানা, সেই সীমানা কেউ অতিক্রম করতে পারে না। মৃত্যু হয় মানুষের, কিন্তু সীমানা ডিঙানো হয় না। হায়, মানুষের জীবন কেন এমন?
ভাবতে ভাবতে হুমায়ুনের বুকের ভেতরে ঠেলা দিতে লাগলো দুঃখ। একটা তাড়নার ভেতরে সে অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করল। তার শরীরের প্রতিটি খণ্ডে একটা কিছু ঢেউয়ের মতো উঠতে লাগল এবং নামতে লাগল। দুঃখ, এই দুঃখটা একটা বোধ, একটা করুণার ভেতর এই বোধের জন্ম এবং মৃত্যু। আপন মনে ভাবতে লাগল হুমায়ুন।
হুমায়ুন এখন কী করে? আপনি কে, এই প্রশ্নের উত্তর কে তাকে এনে দেবে? নাকি এটা কোনো প্রশ্নই নয়। এটা হলো শুধুই একটা মামুলি প্রশ্ন যার উত্তর কেউ শুনতে চায় না। উত্তর দিতেও চায় না কেউ যেহেতু এর কোনো উত্তর নেই। বরং এ প্রশ্নের বিপরীতে মানুষের চতুপার্শ্বে খুঁড়ে তুলেছে কেউ দেয়াল, যা অতিক্রম করা মানুষের সাধ্য নয়। রহস্যময় এক জীব হিসাবে, এই প্রকৃতির রহস্যময়তার ভেতরেই মানুষকে আয়ু-নিহত হতে হবে, হতে হবে অনন্তকালের জীবাশ্ম। এর আর কোনো ব্যত্যয় নেই। তাই এই প্রশ্নের উত্তর না জেনেই। হুমায়ুনকে চলে যেতে হবে দূরে, অনন্তের অভিযাত্রামুখে ছুটে চলে যেতে হবে একদিন। পার হতে হবে সেই দরিয়া যা পার হবার মতো যথেষ্ট দিনার তার পকেটে নেই। সে হযরত মালেক ইবনে দিনার নয় যে অসংখ্য মাছ তাদের মুখে করে স্বর্ণমুদ্রা এনে তুলে দেবে তার হাতে নৌকার মাঝির দাবি মেটাতে। কারণ সে সাধারণ একজন হুমায়ুন, খুবই সাধারণ একজন মানুষ। অলৌকিকতার চাদর গায়ে দিয়ে সে এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেনি।
হুমায়ুন ভাবতে লাগে। এখন তার চারপাশে বয়ে চলেছে জীবন এবং আয়ু হনন মৃত্যু, একইসাথে হাত ধরাধরি করে। তারা তার চোখের সামনে মুহূর্তে নৃত্যময় আবার মুহূর্তে স্থির। কিন্তু সচল। প্রশ্নের জবাব তবুও মেলে না। হুমায়ুন আর কি করে। সে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমে সে দুপায়ের ওপর দাঁড়ায়। তারপর একপায়ে। আবার দুপায়ে দাঁড়ায়। আবার একপায়ে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সন্ধে হয়। পা ব্যথা করে। তারপর আসে রাত। গুড়ি মেরে হেঁটে হেঁটে সেই রাত একসময় গভীর হয়। নির্জন হয়। সুনসান হয়। গাড়িশূন্য, মানুষশূন্য হয়। দিনের রাস্তা রাতের এই আঁধারে যেন সব হারিয়ে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। সাত সাতটি রাস্তা যেন একই সাথে সব হারিয়ে এতিম।
তখন ঘনকালো ও নিকষ রাতের ভেতরে ভিন্ন এক ধরনের সুর শোনা যায়। সে সুরের ইতিহাস হুমায়ুন জানে না। কেউ তাকে ইতিহাস বলেনি। একটা বোধের ভেতরে তার উন্মীলন ঘটে, যেন এটা ঘটার জন্যই সারাদিনের এত কর্মকাণ্ড, এত হৈচৈ, এত ঘোরপ্যাঁচ এরকম মনে হয় হুমায়ুনের। কিন্তু হুমায়ুনের দাঁড়িয়ে থাকার আর বিরাম নেই।
এরপর তার চোখের সামনে ঘটে সেই অঘটন। অঘটন না বলে অলৌকিক বলাটাও কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাতের অন্ধকারে সাত রাস্তার মোড়ে লাফিয়ে নামে মৃণাল হকের চারটে ময়ূর। এতক্ষণ তারা আইল্যান্ডের উপরে স্থির হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। এরকমই থাকে তারা দিনের পর দিন। কিন্তু রাতের আঁধারে যে তাদের চেহারা পাল্টে যায়, এ খবর হুমায়ুনের জানা ছিল না। ময়ূর চারটে, চারটে পুরুষ ময়ূর রাস্তায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুরু করে নাচ। পেখম মেলে ধরে তারা নাচ করে। আর কী তাদের পেখমের বাহার! কত বিশাল তাদের সীমানা। যেন স্বর্গ থেকে হাতপাখা নামিয়ে দিয়েছে কেউ। তারা হুমায়ুনের চোখের সামনে অপূর্ব এক সবুজ এবং আরও অপূর্ব এক দ্যুতিময় নীল মেলে ধরে নাচতে থাকে। দুলে দুলে নাচে। মুহূর্তের ভেতরে যেন ভোজভাজি হয়ে যায় সবকিছু। সবকিছু হয় যেন অবাস্তব আবার বাস্তবও। সবকিছু যেন স্বপ্ন আবার সত্যিও। সবকিছু বড় মনোহরভাবে সুন্দর আবার অবিশ্বাস্য। সবকিছু যেন সবকিছু। চারপাশের বাড়িগুলোর খাঁজকাটা চমকানো নকশাবহুল জাফরি দিয়ে হু হু করতে করতে ছুটে আসে বাতাস যেন তারাও এই নৃত্যের অংশ। এরই ভেতরে অকস্মাৎ আকাশ থেকে নেমে আসে যেন সাদা, স্নিগ্ধ ও সচল একটা আলো। বাতাসের ভেতরে যেন ভেসে ভেসে নেচে নেচে আসে সেই আলো, যেন আনন্দধারার মতো সব। সেই আনন্দধারা অভিমুখে ভেসে যেতে লাগে জুঁই, যেন তার গন্ধের ভেতরেই জীবনের সার্থকতা। ভেসে যেতে লাগে দোলনচাঁপা, যেন তার শরীরের মাদকতার ভেতরেই জীবনের এক গভীর সুখ তার অনুভবের নকশীকাঁথা মুড়ে শুয়ে আছে। একি, এসব কি? মনে মনে বলে ওঠে হুমায়ুন। বলতে বলতেই যেন তার চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বুকের ভেতরটা যেন আকাশের মতো বিস্তৃত হয়ে যায়। মাথার ভেতরে উড়তে লাগে রঙিন সব বেলুন। লাল, নীল, সবুজ। চোখের ভেতরে দোল খায় পৃথিবী। পরম সুখ এবং তৃপ্তিতে পরিবেশ ভুলে চিৎকার করে ওঠে হুমায়ুন, তাহলে, এই হচ্ছি আমি। তাহলে এই আমি!
ময়ূরের সাথে সাথে নাচতে লাগে হুমায়ূনও।
ঢাকা ১৩.০৬.২০১০
আনোয়ারা সৈয়দ হক
জন্ম : ৫ নভেম্বর ১৯৪০, যশোর।
আনোয়ারা সৈয়দ হক একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক, বহুমাত্রিক লেখক। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-গবেষণা, ভ্রমণকাহিনী, শিশু-কিশোর সাহিত্য, নারীবিষয়ক এবং মনস্তত্বমূলক রচনায় অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচনা ইংরেজিসহ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর কিছু লেখা। তাঁর বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।
পুরস্কার ও সম্মাননা : রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, আবু রুশ্দ কথাসাহিত্য পুরস্কার, গীতাঞ্জলি পুরস্কার, অনন্যা শীর্ষদশ পুরস্কার, পদক্ষেপ পুরস্কার, কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, চাঁদের হাট পুরস্কার, ইউরো সাহিত্য পুরস্কার।