অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে
অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে; দাঁড়িয়ে আমার জন্য
এক ঝুড়ি ক্লান্তির ঝরা ফুল নিয়ে
আমার অলসতা দেখে নিরলসভাবে জড়ো হচ্ছে-
সারি বেঁধে ঘেরাও করার প্রস্তুতি নিচ্ছে;
আমি আমার ক্লান্তিগুলোকে জোড়ালো হতে দেখছি
আমাকে জোছনার শীতল ছায়ায় ম্লান করে দিতে…
অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে; দাঁড়িয়ে আমার জন্য
এক ঝুড়ি ক্লান্তির ঝরা ফুল নিয়ে।
আমি এমনই
আমি এমনই…
আমি আমার ছায়ার পেছনে হাঁটি
হাঁটতে হাঁটতে জীবনের পায়ে পা লাগলে
দেখি বিস্ময়ে বিস্মিত আমাকে
আমাকে দেখি স্পষ্ট মৃত্যুর প্রতিবেশী
দেখি নদীর পাড়ভাঙা রাতের
স্যাঁতস্যাঁতে জোছনার শীতল তুষারে
ঢেকে দেয়া অপমৃত্যুর ক্লান্তি…
আমি এমনই…
আমি আমার ছায়ার পেছনে হাঁটি।
আমি এমনই-২
কী অদ্ভুত!
আমি আমার হাতকে বলছি-
তোমাকে দিয়ে আমি আর কিছুই স্পর্শ করব না
আমি আমার পা’কে বলছি-
তোমায় ভর করে আমি আর কখনোই হাঁটব না
আমি আমার চোখকে বলছি-
তোমাকে দিয়ে আমি আর কোনো দৃশ্যই দেখব না
কী অদ্ভুত!
আমি আমার হাতকে বলছি…।
আমি এমনই-৩
আজ ঘুমোতে যাবার আগে, সব ঘুম ঘুমিয়ে গেল
জানো মন, আমি বুঝি ঘুমোনোর জন্য নই
একদিন অশোক এসেছিল তৈমুরের তড়িঘড়ি সাহস
এঁকে দিতে আমার হাতের ময়দানে…
বললাম, নারকেল পাতার মতো সরল-সবুজ আমার বিশ্বাস
আমি কোন বুশ হিটলার হালাকু মুসোলিনি মানি না
…আজ ঘুমোতে যাবার আগে সব ঘুম ঘুমিয়ে গেল।
শৈশব
তোকে দেখি না কতোদিন…
তোর নাম বারান্দার সামনের ডালিম গাছের
ডালে বসে উড়ে যাওয়া দোয়েল পাখি…
তোর নাম শেষ বিকেলের অশ্রুর মতো
ঝড়ে পড়া ক্লান্তির হাসি
তুই ছুটে বেড়াতিস আমাদের শৈশবের
ধুলোমাখা পায়ের ছন্দে তাল মিলিয়ে
… খেলতিস ফুটবল ক্রিকেট।
তোকে দেখি না কতোদিন
তুই’তো শিশির ফোঁটা; সমুদ্র পেটে নিয়ে চেয়ে থাকতিস।
না, সকাল-বিকেল চারাগাছে পানি দিতিস
তুই ছিলি চারাগাছ, শীতের সবজি-স্বজন।
না না! তুই ঘুড়ি উড়াতিস আকাশে
অথবা ছিলি সুতাভর্তি নাটাইয়ের চালক…
কিংবা তোরই নাম ঘুড়ি উড়ানো সেদিনের বিকেলবেলা।
তোকে দেখি না কতোদিন…
যখন, আমি আমার নিঃসঙ্গতার
মাঝে মাঝে ভাবি ক্লান্তির হবো,
সময়ের কাছ থেকে চেয়ে নেব নিজের জন্য একটু সময়
পরিচিত এই আলো-অন্ধকার থেকে ছুটি নিয়ে
ছুটে যাবো অন্য কোথাও;
যাবো একটু সময়ের জন্য
অথবা হাজার হাজার বছরের জন্য,
লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে।
কিংবা সময়গুলোকে মুক্ত করে দেব,
আমার জন্য অথবা আমি সময়ের জন্য
কোন অপেক্ষায় দণ্ডিতের হয়ে থাকবো না
মাঝে মাঝে ভাবি ক্লান্তির হবো…
সময়ের কাছ থেকে চেয়ে নেব নিজের জন্য একটু সময়।
মায়ের জন্য কবিতা
একটি কবিতা লিখে দেব
এমন কথা মাকে আমি দিইনি
… যদি লিখতে না পারি
বলিনি আমাকেও এই ভয়ে।
সংকোচে মোড়ানো বিষয়টি
নিঃসংকোচে কাছে এলো
আর গেলোও না তার কোনো ঠিকানায়
একটি কবিতা লিখে দেব
এমন কথা মাকে আমি দিইনি তো কখনো’ই
মায়ের জন্য কবিতা-২
আমারও মাকে খুব মনে পড়ছে
অনেকগুলো ঝরেপড়া মুখরতা পরে
সেদিন মা বসে ছিলেন চৈত্রের বারান্দায়
অভ্যেসের হাতপাখার বাতাসে
বয়সগুলোর উড়ে যাওয়া ধানের চিটায়
হাতির চোখে মিটিমিটি তাকাচ্ছিলো
মা’র সময়।
একটার অজুহাতে দশটা কথা বলতে চান
মা’র কথাগুলো ভালো লাগতে পারতো
অজুহাতগুলোর সামাজিক কাঁদামাটি
আমি এড়াতে না চাইলেই
প্রতিরাতের স্বপ্নে ধোয়া ধবধবে সাদা দিনটিকে
ইস্ত্রি করে আমি নিয়ে যাই, অধিক দামের আশায়
কোনো সওদায় ভালোবাসা নেই, স্নেহের গন্ধ নেই
দৌঁড় আর দৌঁড় কিনে কিনে
কিনতে দৌঁড়
দৌঁড়ে পা পিছলে যখন মাটিতে পড়ি
দূর্বাঘাস, গরুর চোখ, মায়ের আঁচল আমাকে ছুঁয়ে দিলে
আমি আবার হেরে যাই
পাকা পিচঢালা রাস্তা মা’র পছন্দ না বলে
আমার বোঝানো শহরের মর্মকথা
মা’র ইশারায় সরে গিয়ে
আমাকে উঠে দাঁড়াতে জায়গা দেয়।
নতুন গাছের ডাব আমি খাবো ভেবে
মা কতশত চাহনীর অপচয় করেছেন
নারিকেল গাছের শীতল পাতায়
গাছ বড় হয়ে নারিকেল হতে অনেক দেরি
আমার পঞ্চাশ টাকায় চাইলে যখন যে কয়টা ইচ্ছে
শহরেই পাওয়া যায়।
কতো বুঝিয়েছি মাকে
এইসব ইমোশনাল
গ্রামের সবুজ, ফসলের হাসি
পুকুরে ধরা মাছের লাফালাফি
মোরগের ডাক, সকালে পাখির কন্ঠের গান
বিকেলে নীড়ে ফেরা ঢেউ ভাঙা বকের ঝাঁক
আত্মীয়ের মুখ, মানুষের হাসি, জীবনের শান্ত বিকেল।
এইসব ইমোশনাল-
বাদ দেন মা, এইসব ইমোশনাল।
রাজা
‘এক দেশে ছিলো এক রাজা’
… তারপর অন্ধকারের শব্দ থেমে গেল
জোছনায় ধোয়া শীতল বাতাসে
গল্পগুলো কান পাতলো ইতিহাসে।
দাদু ঘুমোচ্ছে
আর গল্প বলে যাচ্ছে তাঁকে
দাঁড়ানো হাতের মুঠোয় পাখাটি ঘুরছে
ঘোড়া উড়ছে,
সাদা সাদা মেঘের কেশরে
ঝরছে মৃত্যুর তুষার…।
প্রচন্ড গরমকেও মৃত্যু শীতল করলো
অনেক ঘোড়া চলে গেল রাজত্বের ধুলো উড়িয়ে
সবাই ঘুমিয়ে গেল
পৃথিবীতে শত-সহস্র ঘুমের আস্তরণ শেষে
দাদুর মৃত্যুর পরেও-
… এক দেশে রাজা একজনই রয়ে গেল।
পাখি
মৃত্যুর হৃদয়ে সূর্যাস্তের লাল দাগ নেই
নেই হারানোর চিৎকারের কম্পনও
তবু তাকে মৃত্যু বলতে
আমার অনিহাকে অদৃশ্য হুমকি আছে
আমি আজরাঈল দেখি নি প্রভু
ক্রসফায়ার দেখেছি
প্রতিটি স্বপ্নকে আতংক জাপটে ধরে ঘুম পাড়ায়
প্রতিটি ঘুম বাতাসের পোড়া গন্ধ হয়ে উড়ে যায়
প্রতিটি পাখি মানুষকে অনিশ্চিত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা শেখায়
কবি আবুল হাসানের একাকিত্বকে
আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমি একা
সেই চিৎকারে বারবার বলেছি মানুষ একা
এর পরে খেলতে গিয়ে আমি যতোবার জিতেছি হেরেছি
বা খেলতে পারিনি, ততোবার জেনেছি আমি একা।
এখন আমি একা বললেই তা সত্যি হয়ে যায়
এর আগে জানা আমার বিশ্বাসের একারা
আমার সঙ্গে একাকিত্ব ঘোষনায় একত্রিত হয়।
আমি একা বললেই তারা জড়িয়ে ধরে বলে-
তুমি কেন মাঝে মাঝে হারিয়ে যাও!
জুননু রাইন ।। জন্ম ৫ নভেম্বর ১৯৮২, ভোলা ।।