স্কুলে ছাত্র-টয়লেটের দেয়ালজুড়ে আকাঁ একটা পানপাতার ভেতর শিউলি আপার নামের শেষে যোগচিহ্ন দিয়ে জয়নাল স্যারের নাম লেখা। টয়লেটে ঢুকে প্যান্ট খুলে বসতেই দরজার মধ্যে যা লেখা দেখা যাবে পৃথিবীর কোথাও এমন উষ্ণ স্বাগতম কেউ কাউকে আগে জানায়নি। ত্যাগ, নিমগ্ন নগ্ন ধ্যান আর শান্তির এমন বাণী কেউ প্রচার করেনি। গত শীতে সেন্ট মার্টিন শিক্ষা সফরের সময় বোট থেকে নামতে শিউলি আপাকে হাত ধরে সাহায্য করেছিলেন জয়নাল স্যার। ছাত্রদের মধ্যে সংবাদটা আলোর গতির মতো দ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছিলো। জয়নাল স্যারের বেতের ব্যবহার যতটা আকস্মিক, শিউলি আপার রূপের আঘাত ততটাই ভাবনায় রাখে ছেলেদের।
বিপত্তি ঘটে গেছে সেদিন যখন জয়নাল স্যার ভুল করে কিংবা জরুরি সমাধানে ছাত্র-টয়লেটে ঢুকে গেছেন। ট্যাপ ছেড়ে বদনাটা ট্যাপের নিচে রেখে দেখলেন পানি তীব্র গতিতে এলোমেলো ছুটছে। পানি বদনায় না পড়ে মেঝেতে ছিটকে মুহম্মদ জয়নাল আবেদিনের প্যান্টের তলা আর জুতা ভিজিয়ে দিলো। ট্যাপ বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন ট্যাপের মাথাটা খুলে তার হাতে চলে এসেছে। পানির স্রোত এবার উপরের দিকে। জয়নাল আবেদিন মাথা নিচু করে দেখলেন কমোডের ভেতর ভাইবোনের মতো জড়াজড়ি করে দুই টুকরো পায়খানা ভেসে আছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক আনসারুল হককে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। আজ তার বোর্ড মিটিং। শোনা যাচ্ছে শিউলি আপা স্কুল থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছেন। বাইশজন খেলোয়াড়ের ফাঁকা জায়গায় ফুটবলটা যেমন ছুটে বেড়ায় আর উত্তেজনা ছড়ায়, এইরকম বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মতো শূন্যতা আর টানটান আগ্রহ ছাত্রদের মাঝখানে এসে পড়ে, বিশেষ করে ব্যাকবেঞ্চিদের মধ্যে। যেন এটাও একটা জোকস্, শেষ হওয়ার পর মুহূর্তে ওরা সবাই হাসাহাসি করে একজন আরেকজনের গায়ে পড়তে থাকবে। মাধবদী মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের কোন অনুভূতিই গোপন রাখতে পারে না।
মাধবদী মাধ্যমিক স্কুলের গণিতের সিনিয়র শিক্ষক জয়নাল আবেদিনের হাতে চাবুকের মতো বেতের মার সবচেয়ে বেশী পিঠে নিয়েছে যে ছেলেটি সে দশম শ্রেণীর ছাত্র জহির। গত বছর বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে সে সরকারি মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। স্কুলের অপরাধ সম্পর্কিত এমন কোন ঘটনা নেই যেখানে তার উপস্থিতি নেই। অনেকটা পরম্পরা রক্ষার্থে তদন্ত কমিটির লিস্টে অবধারিত প্রথম নামটি হল জহিরের। জহিরের নাম থাকলে তদন্তে কোন ভুল আছে এই কথা অন্তত কেউ বিশ্বাস করবে না।
সেই জহিরের প্রিয় যন্ত্রটির নাম হলো বাইনোকুলার। জহির এই মুহূর্তে তার বাইনোকুলারের ফিতা গলায় ঝুলিয়ে তার বাসার বারান্দায়। ক্ষিপ্রতার সাথে সন্ধ্যাটা রাতের দিকে বেড়ে চলেছে, শিউলি আপা কখন তার বারান্দায় আসবেন, আউটসুইং স্পিন বলের মতো ঘূর্ণনরত ফাঁকি বাতাসের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। জহিরের চোখে রুফ-প্রিজম বাইনোকুলার দেখে যে কেউ ভাববে সত্যিই সে একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। শিউলি আপা বারান্দায় কাপড় নাড়তে এসেছেন। দুটি গোল কাঁচের বৃত্তের মধ্য দিয়ে জহির দেখছে একটি রাতের মহান প্রকাশ। ব্লাউজ ফেটে বাইরের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুটো স্তন, চোখের মধ্যে একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা গড়ে তোলে। একটা শান্ত প্রতিবেশী সুর এ বাড়ির সঙ্গে ও বাড়ি মিলে গেলো। শিউলি আপা ভেতরে যাচ্ছেন আবার আসছেন, এর মধ্যবর্তী সময় নীরবতায় ভরে যায়।
কোন ঘর, কোন ধর্মের তাড়নায় শিউলি আপা তার এই রূপ মুক্ত না করে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন। কোন নৈতিক কুয়াশা তার সুঠাম বুক আর পেশল সুগোল হাতের মাংসের ভেতর আকাশে অনন্তকালের জন্য ভ্রমণ করে যাচ্ছে। সুতির শাড়ির শিথিলতায় তার কোমর একটা শিল্পকর্ম হয়ে উঁকি দিয়ে থাকে। একটা বন্ধুত্ব, পছন্দ, আর ঘৃণার মুহূর্ত তৈরি করে যায়। জহির তার তুলি একবার নীল রঙের ডিব্বার ভেতর, একবার লাল, গোলাপি আর বাদামির ভেতর চুবাতে লাগলো। জহির দুটো ঢেউ এঁকে দিলো। তার সামনে জীবন্ত হয়ে কাঁপছে তার নিজের আঁকা এক নারী, ইংরেজির শিক্ষক, গত বছর তাকে শোচনীয়ভাবে যে ফেল করিয়ে দিয়েছিলো। তার স্তন সংগতিপূর্ণ আকার নিয়ে ব্রায়ের ভেতর জেগে থাকে পাহাড়ের শীর্ষ হয়ে, জলরঙের শিল্পীর কাছে এই ঢেউ যতটা উঁচু, প্রকৃত সাঁতারু জানে এই ঢেউ কতো দুর্দান্ত। অভিযাত্রী কেবল জানে, চড়তে গেলে পাহাড় দু’ভাগ হয়ে যায়।
তবু ঝুঁকি নিচ্ছে জহির। ক্রমাগত শিউলির শরীরে তুলির আঁচড় দিয়ে যাচ্ছে। রাতের ক্যানভাসের ওপর দুটো স্তন রঙের প্রাণ পেয়ে গোলাপি বোঁটা নিয়ে দপদপ করে জ্বলে উঠলো। শিউলি আপা যখন পেছন ফিরে ব্লাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখেন, তার ব্লাউজের স্ট্রিপ থেকে বের হয়ে আসা হাতের নরম মাংসের ভেতর নীল শিরা একটা চলন্ত দাগ হয়ে পুরো ক্লাসে লাস্টবেঞ্চ পর্যন্ত থেমে গিয়েও জ্বলতে জ্বলতে আতশের মতো নাচের দোলন পাইয়ে দেয়। শাড়ির আঁচল বারবার টেনে এনে পেটের ওপর, কিন্তু এই আকার কেবলই ঢাকনায় ঢেকে যায়! ক্লাশজুড়ে অবিরাম সংঘর্ষ জাগিয়ে তোলে, আহ্বান জানায়, যেখানে প্রত্যেকে পরাজিত হতে বাধ্য। ব্যাকবেঞ্চে বসে সঙ্গপাঙ্গদের মুখঢাকা হিহি হাহা’র মাঝে জহিরকে মনে হয় সে একটা ঘুরে বেড়ানো আত্মা যার কবর ঠিকমতো দেয়া হয়নি।
অন্ধকার বারান্দায় ফিতাটা গলায় দিয়ে বাইনোকুলারের দুই গোলকে দুই চোখ চেপে জহির একটু নড়েচড়ে বসে। এই মনোযোগ আজ দূরে হাত বাড়িয়েছে। প্রতিটি দালানে ফ্লাটের আলোগুলোর মাঝে দৌড়ে যাচ্ছে দোলনার মতো তার চোখ। ফিরে আসছে। থামছে।
রাত বেড়েছে। একে একে নিভে এসেছে বাড়ি-ঘরের আলো। তীর্থের কাক জহির গলায় ফিতা ঝুলিয়ে তার বারান্দায়। নিজেকে সে অদ্ভুতভাবে দ্বিখণ্ডিত করে, একভাগ চলে যায় প্রতিবেশিদের জানালায়, বারান্দায়, দরজায়। তার চোখের বিশৃঙ্খল উত্তেজনাগুলো দলে দলে খোলা আকাশের খালি বাতাসে ছাড়া পেয়ে উধাও হয়ে যায়। চাঁদটা চিরদিনের মতো সূর্যের কাছ থেকে ধার নেয়া আলো পৃথিবীতে ছিটিয়ে দিচ্ছে। জহিরের বাইনোকুলার খুব আগ্রহ নিয়ে চাঁদের আলোয় ভরা ছাদে কার্নিশের ঘাসগুলোর ওপর পড়লো আর সেগুলো নড়েচড়ে উঠলো। ঠিক এমন একটি অস্তিত্ব, পৃথিবীর নীরবতার মধ্যে যার বেড়ে উঠা, বাতাসে দোল খেয়ে উঠে দাঁড়ায়।
মানুষের বসবাসের বাইরে যে ফাঁকি, যে শুন্যস্থান নিজে থেকে বড় হয় আমাদের অলক্ষে, মানুষের দুঃখগুলো আজ জাগিয়ে তোলে। পৃথিবীর প্রাণবাহী আয়তনগুলো ভেসে যায় তার পাশ দিয়ে। এই শোকের আর্তনাদ, এই রোগকে মানুষ বারবার ভালোবেসে বিশ্বাস করে। মানবিকী সম্পর্কের দিকে সে বোধের বিকলাঙ্গতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কথা বলে, কথা বলে না। জহিরের নিঃসঙ্গ মুরতির ওপর পৃথিবী তার কেন্দ্র থেকে দুঃখের ভার চাপিয়ে দিয়ে যায়।
মসজিদের মাইকে স্থানীয় কোন গণ্যমাণ্যের মৃত্যুসংবাদ একটু পর পর পুনরাবৃত্তি হয়। সন্ধ্যার শেষ ও রাতের শুরুর এই দহন, স্রোতের মতো সম্পর্কগুলো বুকের কাছে ঝরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জহির বাইনোকুলারের লেন্স দিয়ে দেখতে পাচ্ছে মানুষ তার ঘরের দিকে নিজের ইচ্ছেতে স্বতঃস্ফূর্ত হেঁটে যাচ্ছে। এই কামরার আসবাব ওই কামরায় নিচ্ছে। ঘূর্ণায়মান সিলিঙ ফ্যানের ছায়া মেঝেতে পড়ে কাঁপছে। টেলিভিশন স্ক্রিনের আলো ক্রমাগত জ্বলছে আর নিভছে। জানালার পর্দা বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। বাচ্চাদের ঘুমে রেখে স্বামী-স্ত্রী তাদের নিজ রুমে যাচ্ছে। এই অতৃপ্ত আবিস্কারের ক্ষুধায় জহির এই মুহূর্তে অন্যমনস্ক। তার দৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার আগে সে বিস্ময়াহত। সুন্দরী কমবয়সী স্ত্রী তার স্বামীর সামনে সমস্ত সৌন্দর্য খুলে দিয়ে বসে আছে।
ইঁদুরের মতো এক জানালা থেকে আরেক জানালায় জহিরের বাইনোকুলারের চোখ দুটো দৌড়ায়। সুযোগের অজস্রতায় এতো রাত, ম্যাগজিন থেকে ছুঁড়ে দেয়া বুলেট যেন মাঝপথে গিয়ে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। শিকার পালায়। স্ত্রীকে বুকে নিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়েছে স্বামী।
জহির সময়ের সকাল থেকে এই গভীর রাতের দিকে ছুটে যাওয়া অন্ধকার সাথে নিয়ে প্রেমের উদ্দেশে একটি গান গায়। যদিও যে ছেলেগুলো সারাক্ষণ প্রেমের পেছনে ঘুরঘুর করে, মেয়ের পিতা-মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে-ই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে, জহির সে দলে নেই। শিউলি আপা-ই তার পছন্দের মানুষ, শিউলি আপার ক্লাসে সে সর্বাধিক মনোযোগের সাথে উপস্থিত থাকে। অথচ ক্লাসে এই জহিরকে নিয়ে হাসাহাসি হয়। রাতের গহ্বরের মধ্যে জহিরের নিরানন্দ প্রত্যাশায় রূপ নিল, দেখলো শিউলি আপার বেডরুমের আলো জ্বলছে। একটা ঢেউ খেলে গেলো, জহির বাইনোকুলারের চোখটা সেই দিকে ঘুরিয়ে নিল। বাইনোকুলারের মাথায় চরকিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জুম ও ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন ঠিক করে নেয়।
বিশালদেহী এক লোমশ ভাল্লুকের গায়ের ওপর লেপটে আছেন শিউলি আপা। ইংরেজির শিক্ষক শিউলি আপা, মাধবদীর প্রথম সীমানা থেকে শেষ সীমানা অবধি শিউলি আপার চেয়ে ভালো ইংরেজি কেউ জানে এই কথা কেউ বলবে না। কিছু বছর আগেই কেবল পুরো এলাকায় সাড়া ফেলে ভালো নম্বরপত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে এসেছেন শিউলি আপা। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছায় নিজ জন্মস্থানে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন। তার বাবাও এলাকার মান্যবর, প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এই মাধবদী গার্লস কলেজের সাবেক কৃতী ছাত্রী শিউলি আপাকে ভালবাসতো যে ছেলেটি সে কিছুদিন আগে মারা গেছে। জ্যোৎস্নার রঙের মতো গায়ের ঔজ্জ্বল্যের সে ভাইটি কখন যে ছিটকে গেছে জীবন থেকে! শিউলি আপা উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে যাওয়ার পর কিছুদিন দেখা গেছে তাকে মাধবদীতে। মাথাভর্তি চুল, ঝোলা লাল শার্ট পরে চায়ের দোকানে বসে একটার পর একটা চা আর সিগারেট খেতো। তারপর কিছু বছর লাপাত্তা, তারপর কোথায় থেকে কারা কিছু অপরিচিত মানুষ তার লাশটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। শিউলি আপার বাবার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল সে।
আজ শিউলি আপা, অল্প আলোতে প্রশস্ত এক ভুঁড়ির ওপর শুয়ে সাড়া দিয়ে যায়। শিউলি আপা এক পাতলা কুয়াশা, মানুষের সব প্রচলিত প্রথা ও তার জ্বলন্ত কামনার ওপর চড়ে বসে আছে। এই ভঙ্গিতে সে ইংরেজির শিক্ষক হোক কিংবা ধর্মের শিক্ষক, মেয়েদের ঠিক উপযুক্ত কাজটি হলো তার উল্টোদিকে থাকা পুরুষ সঙ্গীকে সাহায্য করা। শিউলি আপা তার স্বামীর কামনার ঊরুতে, খোলাসা পাঁজরে স্বস্তি এনে দিতে ও স্ত্রীর প্রতি অধিকার বজায় রাখতে সাহায্য করছেন। স্বামীর শক্ত পেশল মাংসের সাথে লেপটে শিউলি আপা তার ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখেছেন স্বামীর বুকে। প্রাচীন কোন চিরন্তন কুমারী শিউলি আপা ডজনখানেক বার পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরেছেন, ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। আজ এমন এক তুচ্ছের লিঙ্গ মুখে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুষছে সে, আদর করছে।
লোমখাড়া বেড়াল আদুরে আহ্লাদিত শিউলি আপার শরীর কিছুকালের জন্য ক্ষীণ হয়ে অনস্তিত্বে ডুবে গেছে। সংসারের দুই প্রতীক- স্বামী ও স্ত্রী। বয়ে যাওয়া বাতাসটা চিরুনি দিয়ে যাচ্ছে তাদের ঘরের মুহূর্তগুলোকে। জীবন বিস্ময়ের, বৈচিত্র্যের। এক সমৃদ্ধ পরম্পরার ভেতর আরও একবার অতিকায় দানবের শুক্রস্খলন পেটভরে নিল শিউলি আপা। এমন লোকটা তার স্বামী, তাকে দেখলে জহিরের মনে হয় সে তার বিপুল নির্বুদ্ধ শরীরটা দিয়ে সভ্যতার গতি আটকে রেখেছে। অথচ শিউলি আপার সন্তান হলে সেই পিতৃত্ব পাবে। জহিরের বাইনোকুলার যে পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতর ঢুকেছিল সেটা এখন কাঁপছে। পৃথিবীতে এই আশ্চর্য, সঙ্গম সংগতির একেবারে কেন্দ্র থেকে একটা কম্পন সৃষ্টি হয়ে জহিরের মনে এসে জানান দিলো। এ তুমি কি করলে শিউলি আপা? তোমার সমস্ত সৌন্দর্য একটা গাধাকে দিলে?
জহির বাইনোকুলার ঘুরিয়ে নিচের ফ্ল্যাটের কিচেনে এলো। দেখতে পেলো আন্টি বাঁধাকপিটা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে চুলার ওপর সসপ্যানের জলে ফেলছেন। বুকের ওপর ভারী ওড়না ছড়িয়ে তিনি তার স্তনযুগল থেকে রাত্রিকে জানালার বাইরে রুদ্ধ করে রেখেছেন। যে রাত্রি তার স্তনের রঙ কিংবা আকার সম্পর্কে সঠিক খবর পাবে না। আন্টির একটা বদ ছেলেশিশু আছে। তার পেছনে তিনি খাবার নিয়ে ঘুরঘুর করেন, ছেলেটা টেবিলের ওপর আঙুলগুলো নেড়ে ড্রাম বাজায়। জহির বাইনোকুলারের ফিতা গলায় ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো দুই তিনটা উঁচু দালানের মাঝে কাঁপা অন্ধকারের দিকে। গাছের একটা ডাল বের হয়ে এসে খালি জায়গাটা ভরাট করে রেখেছে। এই অনুজ্জ্বল অগোছালো প্রকাশের মধ্যে একটা কিছু ভেসে যাওয়া চলে যাওয়ার আকার আছে। উপরে স্থির মেঘ আর নিচে গাছের পাতাগুলো কাঁপছে।
পরদিন তদন্ত কমিটির সদস্যরা ছাত্রদের তিনটি টয়লেট পরিদর্শনে এসেছেন। বাংলা পড়ান একজন শিক্ষক পেছন থেকে সভাপতিকে বললেন, ‘স্যার, দেয়াল-সাহিত্য দেয়াল ছাড়াও গাছে, বাসে, ক্লাসের হাই বেঞ্চে লো বেঞ্চে বা ধূলাযুক্ত গাড়ির গ্লাসেও চর্চা করতে দেখা যায়।’ আনসারুল হক পেছনে ঘুরে তার দিকে দেখলেন কে কথাটা বলেছে। টয়লেটের দেয়ালগুলোতে মার্কার পেন দিয়ে হিজিবিজি লেখা, কেউ নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে মেয়ে বন্ধু চাইছে, কেউ উক্তি লিখে রেখেছে, ‘গরিবের ভালবাসার দাম নেই।’
আনসারুল হক মুখ খুললেন এবার। বাংলার শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের ছেলেদের সাহিত্য জ্ঞান মোটেও উন্নত নয়, বাংলা বানান রীতিও শেখে নাই। মনে সাহিত্য থাকলে রবীন্দ্রনাথের মতো নৌকার পাটাতনে বসতে হয় না। টয়লেটের কমোডে বসেও সাহিত্য রচনা করা যায়।’ প্রমোশনের ঝামেলায় থাকা আরেকজন শিক্ষক মাকড়সার ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন আর দূর থেকেই বলছেন, ‘স্যার, আজ বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের টয়লেট থেকে ১৪০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে।’ কেউ তার কথায় মনোযোগ দিলো না। বের হওয়ার সময় আনসারুল হক দেয়ালে দেখতে পেলেন বড় বড় করে লেখা- ‘জহির+শিউলি’।
জহিরকে ক্লাস থেকে টিচার্স রুমে ডেকে আনলেন জয়নাল স্যার। সেদিন আর বেত্রাঘাত করলেন না। ব্যাগ চেক করে ভেতর থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে গেলেন। ছাত্রদের টয়লেট সংস্কার ও নতুন করে রঙ করার নির্দেশ এলো। জহিরকে স্কুল থেকে টিসি দেয়া হলো। ক্লাসে যে ছেলেটার পরীক্ষার খাতা পড়ে শুনিয়ে পুরো ক্লাসে হাসাহাসি ছড়িয়ে দেয়া হতো, প্রতিটি ক্লাসে যাকে নিয়ে প্রত্যেক শিক্ষক দশ পনেরো মিনিট সময় নষ্ট করতো, সে ছেলেটির জন্য ভীষণরকম সাদা শূন্যস্থান ফিনকি দিয়ে বের হলো। জহির যখন তার বাবার সাথে স্কুল গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো, তার সহপাঠীরা স্কুলের বারান্দায় জড়ো হয়েছিলো।
মাধবদী মাধ্যমিক স্কুলের গণিতের শিক্ষক জয়নাল এবার নির্ভার হলেন। তিনি আশা করেছিলেন বরাবরের মতো এবারও জহিরের বাবা জহিরকে নিয়ে তার বাসায় নিয়ে আসবেন ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু না, কেউ আসেনি। দুই কন্যাসন্তানের জনক জয়নাল আবেদিন সেদিন সন্ধ্যায় তার বাসার বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন আর গাইড বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছেন। কী ভেবে তিনি চেয়ার ছেড়ে ভেতরে গেলেন আর বাইনোকুলারটা সাথে নিয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসলেন। আরামে পা দুটো সামনে ট্রে-টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। ফিতাটা গলায় ঝুলিয়ে বাম হাত দিয়ে বাইনোকুলার চোখে ধরলেন মুহম্মদ জয়নাল আবেদিন। আর ডান হাতে বেশ আত্মতৃপ্তি নিয়ে দুই ঊরুর মাঝে লিঙ্গসহ লুঙ্গিটা গুঁজে ধরলেন।