লেয়ার ছিলো কোমল দুটি চোখ
(আদিপুস্তক)
…আর শীঘ্রই তারা দেখলো তাদের চোখ কতটা অবারিত, আর মন/ কতটা অন্ধকারে
(প্যারাডাইজ লস্ট)
মনে আছে, ডাক্তার যেদিন আমাকে এলার্জির ওষুধের সাথে একটা চশমাও লিখে দিছিলেন, অন্যদের চেয়ে আমাকে আলাদা করে এমন একটা জেনেটিক বিকৃতি শরীরে খুঁজে পেয়ে আমার কী শিরশির অনুভূতি হয়েছিলো! এমন না যে চশমা পড়া লোকের সংখ্যা ক্লাসে কম ছিলো, কিন্তু তারপরও সেই ‘এলিট’ ক্লাবের সদস্য হতে পেরে আমি খুশি হয়েছিলাম। কারণ তখন তো আমরা বড় হওয়ার শর্টকাট খুঁজছি, আর কে না জানে আলাপ-আলোচনা থেকে ছোটদের বঞ্চিত করার মতো পারস্পরিক অভিজ্ঞতাই আমাদের বড় করে তোলে। এদিকে আমার গায়ের রঙও কালো, ইছমত আপাকে ইফতেখার ভাই যেরকম আদর করে ‘ময়লা’ বলতো, ঠিক তা না, আবার ‘কালো করে’ যাকে বলে তাও না, শুধু কালো বা কালা। যদিও এই অঞ্চলে গায়ের রঙের কারণে বিয়ে পিছিয়ে গেলেও চাকরী হচ্ছে না এমন শোনা যায় না, তবে কালোকে সকলেই শনাক্ত করতে পারে।
এই শনাক্তকরণ পদ্ধতি সম্ভবত দুই দিকেই কাজ করে। তোমার হয়তো মনে আছে—ফ্রেশারস রিসেপশানে যখন নিজেদের সম্বন্ধে ক্লাসের সামনে দাঁড়ায়ে আমাদের কিছু বলতে বলা হলো, তখন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই আমরা পাসপোর্ট অফিসে ফর্ম ফিলাপের মতো বাবা-মা-ভাই-বোন-বাড়ি-ঘরের নাম একে একে এসে বলে যেতে লাগলাম। কিন্তু ক্লাসের ভিতরই আরেকটা দল ছিলো যারা এই গৎবাঁধা উত্তরের সামগ্রিক মূর্খতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলো। ওরা জানতো কিভাবে নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলতে হয়—উঁচু নিচু স্বরের তারতম্য, লোকাল উচ্চারণের মার্জনীয়তা, কাঁধ আর হাতের কতটুকু ওঠা-নামা বেশতি ও ঘাটতির মাঝামাঝি থেকে তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে। সেদিন তাদের বাচনিক উৎকর্ষে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম, টিচাররা তাদের বাহবা দিয়েছিলেন। শ্রম তো তখনই প্রশংসিত হয় যখন তাকে শ্রমবিমুখ বলে মনে হয়। কিন্তু সেদিন এ প্রদর্শনী উপভোগ্য হলেও আজকে মনে হয় এর ভিতর নিশ্চয়ই অশ্লীল কোনো ব্যাপার ছিলো। তাদের যোগ্যতা আমাদের সব সাধারণ আর গৎবাঁধা উত্তরকে নীচু চোখে দেখছিলো। আর সেদিন আমাদের সবার সাধারণ হওয়ার ‘ইচ্ছা’ কিংবা একে একে সবার একই সাধারণ উত্তর দেয়া সম্ভবত কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিলো না। বরং গভীরভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো ওই অশ্লীলতাকে শনাক্ত করা।
কালোরও বর্ণ আছে। হাবশি গোলাম, আবলুস কাঠ, বিদ্যুৎকালো নিমের মাজন, আর তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে নিশ্চয়ই সমবর্ণের না, রকমফের আছে। আমি এখানে বর্ণপ্রথার প্রতি কোনো প্রকার ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছি না—সে সম্বন্ধে তুমিই ভালো জানো (জীবনানন্দ নাকি একবারও জলের সঙ্গে পানি মেশান নাই!)। কিন্তু কালোর এত আলোড়ন চারদিকে থাকা সত্ত্বেও কালোকে যে আমার বর্ণহীন মনে হয়– তা শুনে তুমি সেদিন বিরক্ত হয়েছিলে। ভুল বুঝো না প্লিজ, ‘কালো হরিণ চোখ’ এর প্রতি যে এ অঞ্চলের লোক একটা কাল্টের মতো অনুরক্ত, সে সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল। একটা গোপন তথ্যের মতো সমগ্র জাতির এই প্রকাশ্য কামনা কাড়ার সাধ্য আমার নাই। কৃষ্ণকলির চোখের ওপর যেই কামনার ভার কবিদেব ফেললেন তাতে তিনি একটা অন্ধকার জাতির শরীরে দান করিলেন—দীপ্তিমান চক্ষু। তাদেরকে মুক্ত করলেন তাদের শারীরিক কামনা থেকে উদ্গত অপরাধবোধ থেকে।
এমনটা যে আমার সবসময়ই মনে হতো—তা না। সমস্ত চোখের আলোয় লোকারণ্য হয়ে থাকা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমারও মনে হতো ‘শুধু অন্ধকার’। তুমি হয়তো ভাবতে পারো এ আমার চোখের দোষ—আমার চশমা তো সার্বক্ষণিক তার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। “চশমাপড়ুয়ারা বেশিই দেখে!” তুমি সেদিন আচানক ক্ষেপে গেলে। তোমার মনে হয়েছিলো আমি দেখছি না তোমাকে। দেখিও নাই কোনোদিন। আজ অবধি আমার চশমা তোমাকে প্রতারিত করে এসেছে। আর অন্য চোখের মতো তোমাকে দেখে ফেলছে, লঙ্ঘন করছে। সেদিন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলাম, সামান্য দৃষ্টি রেখে আমি আবার উজ্জ্বল, চক্ষুষ্মান, প্রতিশ্রুতিময় দর্শনের দিকে ফিরে যাবো।
যে প্রতারণার ভার তুমি আমার দৃষ্টির ওপর চাপালে সে চশমার ওপর আমার কর্তৃত্ব বা কতটুকু? এ কথা সত্য যে চশমাপড়ুয়া মাত্রই জানে, চশমা একটা আলাদা সত্ত্বা—সে তার নাকের অগ্রভাগ থেকে জাহাজের নাবিকের মতো তার চোখগুলিকে পরিচালনা করে। যে কম্পাসের কাঁটার মতো সর্বদাই তার চোখকে বলে—দেখো। কিন্তু চোখ তো খুব দ্রুতই চশমাকে এই নেতৃত্ব থেকে অপসারণ করে ফেলে, তার থেকে দেখার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। তার দোষ? সে বিভ্রান্তিকর, বাস্তবতার ভ্রম তৈরি করে মাত্র। কিন্তু ভ্রমকে দোষারোপ করে বাস্তবতাকে কি তুমি ছাড় দিতে পারো-
তথাপি এসব ফালতু আলাপ—বেহুদা। আমি তত্ত্বতাবিজের কারবারি না। আর এসব কিছু জরুরীও নয়। কারণ এর মধ্যে যে অলঙ্ঘনীয় সত্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় তা হলো—চশমা তার মালিককে প্রতি মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করে। ইতিহাস মানুষকে বিভ্রমের সাথে বসবাস করতে শেখালেও অন্যের দৃষ্টির সামনে সে বরাবরই দূর্বল, হীন। সেজন্যই সর্বদ্রষ্টা সাত আসমানের উপরে থাকেন। মেনে চলেন কঠোর পর্দাপ্রথা। (ক্যামেরায় তাদেরকেই সবচেয়ে খারাপ দেখায় যারা জানে যে ছবিতে তাদের খারাপ দেখায়)। প্রথমবার চোখে দেওয়া মাত্রই সে বুঝতে পারে যে চশমা যতটুকু তাকে দেখায়, তারচেয়েও অনেক বেশি তাকে দেখে। চোখ কোনো ভাবেই চশমার এই নির্দয় দৃষ্টি এড়াতে পারে না। মুনকার নাকিরের মতো চশমার অস্তিত্ব তার দুইচোখের সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নেয়—চোখের প্রতিটা নড়নচড়ন সে নিখুঁতভাবে ম্যাপের মতো এঁকে ফেলে।
স্বস্তির বিষয় এর প্রতিকারও আছে, আর চোখ সহজেই তা খুঁজে পায়। কারণ চশমার মতো চোখেরও দৃষ্টি আছে। এবং তা বহুগুণে শক্তিশালী। সে বেছে নেয় পৃথিবীর সমস্ত দৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম পন্থা—সে ভান করে যে দ্রষ্টার অস্তিত্ব নাই। “মঞ্চে উঠার পর চোখ থাকবে মাথার ওপর!” চোখ তখন আবার তার পূর্ণ রূপে উদ্ভাসিত হয়—আর কখনো চশমার অস্তিত্বের বৈধতা স্বীকার করে না, বা করলেও তার থেকে দেখার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। (ঘুমন্তপুরীতে হানা দেয় রাজকুমার, আয়নার জাদু ভেঙ্গে যায়…)
কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে কী হয় যারা চশমার দৃষ্টির কাছে হেরে যায়, তার মুগ্ধতার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়? (চশমার মুগ্ধতাই চোখকে সুন্দর করে তোলে)। তারা এমন এক সর্বদ্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় যার নিজস্ব কোনো চোখ নাই (সে তোমার চোখ ব্যবহার করে), নিজস্ব কোনো আরশ নাই (সে তোমার মাথায় আসন পাতে)। যে এক দুর্বল খোদা। পরম চৌকিদার। নিতান্ত কারারক্ষী। খোদার নিরানব্বইটা কাজের মধ্যে তার কাজ শুধু একটাই: দেখা। আর কোনো শক্তি নাই তার। এবং তার পক্ষপাতও স্পষ্ট। সে সবচেয়ে বেশি তোমাকেই দেখে। তুমিই তার সাবজেক্ট, অবজেক্ট, প্রতিপাদ্য।
এই বশ্যতা ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। কারণ তাদের এই মুগ্ধতা তো পারষ্পরিক। (চোখের হীনমন্যতাই চশমাকে সুন্দর করে তোলে)। [খোদার পক্ষপাতকে পুণ্যবান কদাচিৎ অস্বীকার করিয়া থাকে। কিন্তু সে ইহা ভুলিয়া যায়, যে খোদা পূণ্যবানের প্রতি আসক্ত সে খোদা পাপীদিগের প্রতি সমভাবে নিরাসক্ত।] মানুষ নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্য চোখের তালাশ করে, আমরা তাকে তার জৈবিক ও সামাজিক জরুরত বলে মেনে নেই। কিন্তু এ-স্থলে আসমানি নুরের বদলে সে বেঁছে নেয় সার্চলাইট। এক বধির, মূক, অনুভূতিহীন খোদা, যার সিসিটিভির রাডারে সে সার্বক্ষণিক অপরাধী হয়ে পড়ে।
আমি সেসব অলক্ষিত দৃষ্টির কথা জানি যাদের নাই কোনো প্রতিভা বা গাঁথুনি, যারা শুধু প্রবল স্মৃতির জোরে যারা চিনে ফেলে অন্ধকারে পায়ের ছাপ, মলমে সেড়ে ওঠা মুখ, জলস্রোতের ওপর ছায়া (যে একটু আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো) আর তুমি যেভাবে এক চোরা চাহনি খরচ করে আমাকে আবদ্ধ করে ছিলে। বোকা ছেলে, ভেবেছে যে কবিতা লিখে বেহেশতে ঢোকার টিকেট পেয়েছে! কিন্তু তুমিও তো ততখানি মুগ্ধ ছিলে যতখানি আমি দেখেছি। আমার চশমা সাক্ষী!
(মানুষ তাকে দেখার জন্য চোখের তালাশ করে।) সেদিন নূরে আলমকে দেখলাম দোতলাবাসের বিপরীত সারিতে তিন সিট পেছনে বসা এক সুন্দরীকে গোপনে পরখ করে দেখতে। বাসের ঝাঁকুনির রিদমে ওর চোখের সাথে ওর মুখ একটু একটু ঘুরে যাচ্ছিলো, সার্ফার যেমন তার খেল দেখানোর জন্য ঠিক ঢেউ-এর অপেক্ষা করে, নূরে আলমও অপেক্ষা করছিলো কখন এক প্রসন্ন ঝাঁকুনি তার মুখ সে সুন্দরীর মুখ বরাবর করে দিবে। কিন্তু সে কী জানতো সুন্দরীর মুখ দেখার জন্য সে তৈরী থাকলেও তার চোখ দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না! কারণ দ্বিতীয়বার নুরে আলমের মুখ ঢেউ-এর দোলের সঙ্গে সমান্তরালে চলে আসলে তার চোখ সুন্দরীর চোখ বরাবর একই সরলরেখায় যুক্ত হয়ে যায়, ফোটনের বিনিময় ঘটে। হাঙর দেখার মতো চমকে ওঠে সে। (পাতালকন্যা মণিমালা নয়, সর্পকুমারী!) যেনবা গোলাপী ডলফিনের বদলে দাঁতাল হাঙর! অথবা দাঁতাল ডলফিন। অথবা কখনো ডলফিন কখনো হাঙর! শ্বেত সরোবর ভাবিয়া নূরে আলম আজ অগাধ জলে। আঁতকে উঠলাম আমি!
বিপদসঙ্কুল নূরে আলমের ওপর তার মায়ের কিরা ছিলো। না হয় এ বিপদ থেকে কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারতো না। মাকে স্মরণ করেই হয়তো সামান্য শক্তি খরচ করে বেধরক টার্ন নিতে পারে সে। তার মুখ ঢেউ-এর গতিবেগের অনুকূলে চলে আসে। তারপর মাথা নিচু করে তীরের দিকে প্রবলভাবে সাঁতার কাটতে শুরু করে সে। এখন চোখ তাকে দেখছে না, সে চোখকে দেখছে না। তীর বেশি দূরে নয়। বাস ফার্মগেট প্রায় পৌঁছে গেছে।
কিন্তু ভুলটা ভাঙতে দেরি হলো না তার। বুঝদার ছেলে নূরে আলম, খুব বেশি দূর সাঁতরে যাওয়ার আগেই বুঝতে পারলো, এ হাঙর সম্ভবত সে হাঙর নয়। অথবা সে হাঙর ছিলো কিন্তু ক্ষুধার্ত ছিলো না। অথবা তার দাঁত ছিলো কিন্তু তাতে ধার ছিলো না, অথবা সে গোলাপী হাঙর, অথবা সে গোলাপী ডলফিন, মীন নয় ম্যামাল, নূরে আলমের মতো স্তন্যপায়ী, মায়ের দুধ খায় (যা তোমাকে খায় না, তা তোমাকে কেবল ক্ষুধার্ত করে)। আর নূরে আলম মাত্রই ভুল—হঠাৎ এ গভীর সত্য উপলদ্ধি করে নূরে আলমের নোয়ানো মাথা আরো নত হয়ে আসে। পিঠ বেয়ে নামা ঘামের সারি, হঠাৎ নিভে যাওয়া মোমের গলিত লাভার মতো ক্রমাগত ঠান্ডা হয়ে দানাদার ক্রিস্টালে পরিণত হয়। দুই তীর থেকে সমান দূরবর্তী নূরে আলম সুনিশ্চিত দ্বিধায় কঠিন বরফের মতো নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে।
[খোদার ক্ষমতা অসীম। ঘামের গ্লেশিয়ার সম্পূর্ণ গলে যাওয়ার আগেই তিনি বাসকে জ্যামের মধ্যে আটকে দিলেন। সুন্দরী পেছনের কুরসীতে সমাসীন। অতএব এভাবেই খোদা তাকে শোধরানোর সুযোগ দিলেন। নিশ্চয়ই তিনি অসীম দয়ালু, ক্ষমাশীল।]
বিজয় স্মরণীতে বাস জ্যামে আটকে গেলে দ্বিতীয়বার তার চোখকে নিশানা বরাবর তাক করার মওকা পায় নূরে আলম। ভুল শোধরানোর জন্য কিংবা নিজেকে শোধরানোর জন্য কিংবা সে যে তার মায়েরই সন্তান তা এলান দিতে, নূরে আলম তার চোখের সঞ্চালন পূর্বের মতো আবার ছুড়ে দেয়। পেছনে। তবে এবার তার চোখের ফোকাস সে সুন্দরীর মুখের দিকে নয়, কিংবা আর কোনো সুন্দরীর মুখের দিকেই নয়। তাদের পাশ কাটিয়ে, মাথা ডিঙিয়ে, বাসের ছাদে ঠোক্কর খেয়ে, পেছনে, দূরের কোনো মাখলুকাতের দিকে। এবার তার দৃষ্টি একজন নবীর মতো সর্বত্র বিস্তৃত, সজাতিবোধে উদ্ভাসিত, ক্ষিপ্র, নিরাসক্ত ও প্রখর। মানবশিশুদের কেউ যেন তার দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত না হয় এমন উপায়ে তন্ময়ের চোখের কালো মণি ব্ল্যাকহোলের মতো সমস্ত বাসটাকে গিলে ফেলে। নেত্র নয়, এ ললাট নেত্র। শিকারীর নয়, এ চোখ ছিলো দার্শনিকের।
সেদিন যে শক্তি নূরে আলমকে পেছনের দিকে তাকাতে বাধ্য করেছিলো, সে বাধ্যতা নূরে আলম তার ব্যক্তিত্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলো। যেন এভাবে পিছনে ফিরে তাকানোই তার চিরকালের অভ্যাস, কোনো আদি ও অনন্ত রীতি। সে যে চোখ খুঁজছে তা সব সময় পেছনেই থাকে। সে নিজেকে এমনভাবে শুধরে ফেলতো যেন তাতে শোধরানোর ছাপ পর্যন্ত না থাকে। সেদিন তার চোখ তাকে পরাস্ত করলেও, তার চশমা তাকে নিরাশ করে নাই। চশমা ওর চোখের দিগন্তবিস্তৃত দৃষ্টিকে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছিলো।
বহিরাগতদের দৃষ্টি যখন আমাকে বললো—কালো ছেলে, আমার চশমা তখন আমাকে বললো, কালো না! দেওয়ালে আঁকা ছবির ওপর প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো চশমার দৃষ্টি আমার বর্ণকে মুছে দিতে চাইলো। মুছে দিলো। যে কালো রঙ আমাকে অনুরোত্তরকাল থেকে বিশেষায়িত করেছে, সেখানে রবারে ঘষে তোলা পেন্সিলের আঁক কেটে বসা পৃষ্ঠার মতো তৈরি হলো ফাঁকা জায়গা— শূন্যস্থান। কালো মানিক না, আমি ছিলাম স্রেফ কার্বন পেপার। সিভি: কপি করা। কার্বন পেপারের মতো আমার বর্ণ আশেপাশের বৈচিত্রের সব রঙের আকৃতি নিতে চাইলো, হতে চাইলো অন্য কোনো কিছুর ছাপ। আমার চামড়া পৃথিবীর সমস্ত বিচিত্র কষ্টিপাথর হতে যেয়ে কেবল ম্যানুফেকচার করলো সস্তা নকল। দুই নাম্বার।
খোদার দুনিয়ায় রঙ অসীম। কিন্তু কার্বনপেপারের কালি সসীম। বহু ব্যবহারে জীর্ণ দেহে শীঘ্রই নানা রোগ বাসা বাঁধে। পলেস্তারার মতো নানা স্থানে বর্ণ খসে পড়তে থাকে। নাম-নিলে-বিয়ে-হবে-না জায়গায় ঘা হয়। চামড়া কুঁকড়ে যায়। রক্তক্ষরণ হয়। মাংস কুড়ানিরা আসে সিমেন্টের বস্তা হাতে। বহু রঙ লেপন ও মোছনের পুনঃপুন প্রয়াসের ধকলে শরীর কমজোর হয়ে পড়ে। পূর্বের এলার্জিগুলা আগের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। অর্থাৎ ফলস্বরূপ যা হয়, আমার শরীর যেকোনো নতুন রঙের গন্ধ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে (বাজারে নাকি নতুন প্লাস্টিক পেইন্ট আসছে, সম্পূর্ণ গন্ধমুক্ত?) এবং ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের মতো, এক কালো অতীতের নিদর্শন হয়ে থাকে। আমার শরীর আশেপাশের সমস্ত রঙ ঝেড়ে ফেলে সেই আদিম আকৃতিতে পরিণত হয় যার সামনে রঙের তুলি হাতে অমীমাংসিত খোদা বসেছিলেন দোদূল্যমান চিত্তে। যার গায়ে তখনো একটি আঁচড়ও পরেনি। নব্য নির্মিত ফসিল। তখনো বর্ণহীন।
যে শরীর আমাদেরকে এক করে আর স্মৃতি আলাদা, সে সুগভীর পরিখার পতোন্মুখ গভীরতা যদি কালো হয়, সাদা হলো তার বিপরীতমুখী উচ্চতা। এ এক মন-খারাপ-করা ছবি, আনমনা। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। বিভাজন আছে কিন্তু বৈচিত্র নাই। ছবিতে তুমি আছো, আর তোমার সমস্ত বর্ণ, গন্ধ আর দেহ আছে, আর আমি আছি, আমার চোখ আছে, আর আছে আমার চশমা। বর্ণময়তা যদি জীবনের বিচিত্রতার স্মারক হয়, বর্ণহীনতা হয়তো কেবলই একাগ্রতা। সাদা ও কালোর পারস্পারিক একাগ্রতা। চশমার প্রতি আমার, আমার প্রতি চশমার অভিনিবেশ। যে গভীর মনোযোগ পিয়ানো তার পিয়ানিস্টের কাছে দাবী করে কঠিন কোনো স্বর তোলার সময় যেন সে কোনোভাবেই দর্শকদের দৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত না হয়ে পড়ে। তারপর সাদাকালো স্বরের যে নিখুঁত শরীর ডেভিডের সুরের মতো তোমার দেহ ছুঁয়ে যায় তা পর মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় শূন্যে—বাতাসে। বর্ণহীনের কোনো দেহ থাকে না আনমনা। কৃষ্ণকলিকে লোকে যতটা তার চোখের মধ্যে পায় ততটা কি তার দেহের মধ্যে পায়? সে একটা চোখ, আনমনা। আর আমি—শুধু একটা চশমা।
তুমি জানিয়েছো সবকিছু যত্ন করে ভুলে যেতে চাও। কিন্তু ভুলে যেতে আদৌ কি কোনো যত্ন করতে হয়? সব কিছুতেই খানিকটা আড়ম্বর তোমার ভালো লাগে। তথাপি ঘাটতি আমার, বঞ্চিতা তুমি। ভালোবেসে রঞ্জিত হবার অধিকার সবার আছে। আগামী জন্মদিনে যে রঙের শাড়ি পরছো, সে রঙের পাঞ্জাবি কি আমাকেও উপহার দিবে?
‘সালমা অপটিকস’ থেকে নতুন চশমার অর্ডার দিয়ে বাসায় ফিরেছি। ব্লু ফিল্টার। দোকানি বললেন সেটা নাকি আমার নিঃশোষিত চোখগুলিকে উপরন্তু ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে।
তাহমিদ রহমানের জন্ম ১৯৯৯ এর সেপ্টেম্বরে। বড় হওয়া ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেন। কবি। অনুবাদক।