কুকুরময় একপাতা ।। পিয়াস মজিদ

মহাভারত থেকে মার্কেস কোথায় নেই কুকুর?
ছোটবেলায় প্রতিকারহীন কোনো অন্যায় দেখলে মা একটি কবিতায় আশ্রয় খুঁজতে বলতেন-

কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়
তাই বলে কুকুরকে কামড়ানো কী
মানুষের শোভা পায়?

আমি আশ্রয় পেতাম এই কবিতায়। নীতিকাব্যের ঘ্রাণে ভরা এই কবিতা আজ  হয়তো আর প্রিয় কবিতাবাচ্য থাকে না। কিন্তু এই ভাবনার পিঠে প্রতিভাবনা হয়ে নীতিকবিতার পক্ষপুট থেকে কবিতায় কুকুরের উত্তরণ ঘটাতে আমার কাছে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-

আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি
তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।

বুঝি ক্রমশ মানুষসত্তার ভেতরে কুকুরের অনিবার্য অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছেন কবি। কুকুর আর তখন তাচ্ছিল্যের লাগসই উদাহরণ থাকে না। সুনীলের সূত্রে হয়ে ওঠে আমারও সত্তাসঙ্গী। অতঃপর কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর’ই আরেক কবি দীপক মজুমদার যখন তাঁর নাটিকার নাম নির্বাচন করেন- বেদনার অমল ও কুকুর, তখন বুঝি কুকুর অধিকার করে নিয়েছে বিংশ-একবিংশ শতকের মানুষের বেদনার্ত অঞ্চল। নির্মলেন্দু গুণ ভ্রমণকাহিনিতে জানান জাপানের সেই কুকুর স্মারকস্তম্ভের কথা, যেখানে মানব-মানবীর প্রেম এসে তার বিশ্বস্ততার শপথ নেয় কুকুরের বিশ্বস্ততার স্মৃতিতে। কুকুর তখন মনিব-ভৃত্যের বিশ্বস্ততার বৃত্ত ভেদ করে প্রেমের চিরন্তন পর্যায়ে উন্নীত হয়।

আহসান হাবীবের ‘ধন্যবাদ’ কবিতার পুরোটুকু উদ্ধৃত না করলে বোধগম্য হবে না কুকুর ও মানুষের জীবনের অন্তবর্তী পরিখার নিষ্করুণ বাস্তব; যেখানে কেরানি মানুষের জীবন আর মনিবের কুকুর ডলির জীবন দাঁড়িয়ে যায় শ্রেণিবাস্তবের দুই মেরুতে-

আসি তবে, ধন্যবাদ
না না সে কি, প্রচুর খেয়েছি
আপ্যায়ন সমাদর যতটা পেয়েছি
ধারণাই ছিলো না আমার-
ধন্যবাদ।
রাত বেশি এইবার চলি তবে স্যার?
আসবো না?
কী বলেন!
হুজুরের সামান্য কেরানি-
দয়া করে ডেকেছেন
এ তো ভাগ্য বলে মানি।
খেটে খুটে?
সে কি কথা?
নিজের বাড়ির কাজ, আর
খাটবো না? চুপ করে খেয়ে যাবো স্যার?
চলি তবে। কী যে মজা,
সত্যি স্যার মজার ব্যাপার।
এমন মজার কথা এর আগে শুনি নাই আর!
চিঠি পড়ে ভেবেছি,
ডলি বুঝি আপনার মেয়েদের কারো ডাকনাম।
তাই তো সামান্য কিছু চকলেটও কিনে আনলাম।
এসে দেখি-
তাই নাকি?
চকলেটও খায় নাকি ডলি?
হতে পারে, সে যাকগে, সত্যি কথা বলি
ডলি নাম কুকরছানার
আর তার জন্মোৎসব,
সত্যি এক ইউনিক ব্যাপার।
সত্যি নাকি,
ও দেশের ঘরে ঘরে ঘটে থাকে এটা?
তাহলে বলুন তো এমন নিখুঁতভাবে সেটা
এ দেশে আপনি ছাড়া কে আর দেখালো?
অনেকেই?
হবেও বা, সে সব কী জানি?
আপনার অধীনস্থ জনৈক কেরানি-
দয়া করে ডেকেছেন বলে
তবেই না জানা গেলো, তেমন না হলে
এও তো আমার পক্ষে জানা
সম্ভব হতো না স্যার-
সত্যি স্যার কুকুরের ছানা,
তার জন্মদিনে এত খরচের হাত-
দু’হাজার? তা হবে না?
ও ব্যাটার বাদশাহি বরাত!
হাসবো না?
সে কি স্যার, এমন খুশির দিন আর
আমাদের এ জীবনে বলুন তো আসে কতবার?
চোখে পানি?
না না স্যার, ও কিছু না
কী জানেন? খেয়েছি এমন
শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
তা হলে এখন-
রাতও হলো আপনারও বিশ্রাম নেবার
সময় হয়েছে,
আজ  আসি তবে স্যার!

… মানুষের মধ্যে কুকুর-দর্শন, হেমাঙ্গের ক্ষেত্রে এটা একটা অবসেশনে পরিণত হয়েছে। কেউ জানে না, টেরও পায় না কিছু, কিন্তু মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালেই, সে বুঝতে চেষ্টা করে, এ আবার কী রকম কুকুর, কতটা কুকুর। আর, এর জাতটাই-বা কী!
(মানুষ ও সারমেয়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়)

এভাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো কুকুর সম্পর্কে দুটো একটা কথা, যা আমি জানি তা ব্যক্ত করতে গিয়ে দেখি প্রিয় অভিশপ্ত কবি মহান র্যাঁবোকে, নিজের একটি কবিতায় জপতে, আমার কাঙ্ক্ষিত নরকের ঋতুতেও ভাষার ছলনে ঢুকে পড়েছে প্রিয় সেই সারমেয়-

‘জীবন ছিল কুকুরের পরিভাষাময়।’

শেয়ার