কাজল শাহনেওয়াজ আশির দশকে আবির্ভূত স্বতন্ত্র ভাষা ও স্বরের কবিদের একজন। কবিতার পাশাপাশি বাংলা ছোটগল্প তাঁর কলমে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। চল্লিশ বছরের সক্রিয় লেখকজীবনে তিনি সবসময়ই আধুনিক, অর্থাৎ তিনি নিজেকে সর্বদাই সময়োপযোগী রেখেছেন, তাঁর লেখায় সেই সাক্ষর পাওয়া যায়। কাজল শাহনেওয়াজকে চিরতরুণ কবি-গল্পকার বললেও অত্যুক্তি হবে না। সম্প্রতি এই কবি’র সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলাপ করেছেন শিরিষের ডালপালা সম্পাদক রুহুল মাহফুজ জয়।
হাঁটাপথের ঝগড়ায় অলস দর্শক হই দু’-একটা চেতনাবাজ শব্দের লোভে। বাক্যাংশের সন্ধানে। টুকরা গল্পের খোঁজে।
রুহুল মাহফুজ জয়:
কাজলদা, নিশ্চয়ই ভালো আছেন। আপনার দ্বিতীয় জন্ম ও মানস তৈরির স্থান কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ, ভুল বললাম? ময়মনসিংহ আর কিশোরগঞ্জ আপনার কবিতা, গল্পে কী কী দিয়েছে?
কাজল শাহনেওয়াজ:
বিক্রমপুরে আমার শারীরিক জন্ম হলেও, প্রাথমিক বিকাশ হয় ফরিদপুরের বিভিন্ন আধা মফস্বল থানায় (এখন উপজেলা)। বয়ঃসন্ধি সময় একটা নতুন শহর পাই, যার নাম কিশোরগঞ্জ। এখানেই পাই আমার পাঠকক্ষুধা মেটানোর বইয়ের ভাণ্ডার। পাই সাহিত্যের সঙ্গ, হয় আড্ডাবাজির হাতেখড়ি।
কিশোরগঞ্জ শহরে দেখা হয় আমার প্রথম প্রেমের সাথে। টের পাই জীবনের বসন্তকাল, শিমুল তুলার ওড়াউড়ি। কোকিলের চোখ লাল করা দিনের সাথে দেখা হয় কিশোরগঞ্জের পথে পথে। কবিতা, প্রথম লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা, প্রেসের ট্রেডল মেশিন, মধ্যরাত অবধি চাঁদে পাওয়া তরুণের শহর জুড়ে পদপাত।
আশির দশকের প্রথমেই গেলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। পেশামুখি কারিগরী বিদ্যায় মন না দিয়ে ময়মনসিংহ শহরের তাজমহল রেস্তোরাঁয় আড্ডা দেয়া শুরু করলাম। কাচিঝুলি, সাহেব কোয়ার্টার, কেওয়াটখালি শ্মশান ঘাট, সত্তর ফকিরের গাঁজার আড্ডায় ক্লাশ শুরু করলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অনিলের সাথে কলকি টানা শিখলাম। মেশিনশপ থেকে বের হয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকি দল বেঁধে।
বাবার মৃত্যু ও প্রেমে বিচ্ছিন্নতার পর শুরু হলো গল্প লেখা। জীবনটাকে দেখতে থাকলাম অস্তিত্বের সংকটে, ক্রিটিক্যাল ভাষায় লিখতে থাকলাম।
জয়:
প্রকাশের ৩৪ ও ৩০ বছর পর আপনার দ্বিতীয় কবিতার বই জলমগ্ন পাঠশালা এবং প্রথম গল্পের বই কাছিমগালা পুনঃপ্রকাশ হলো গেলো বছর। এত বছর পর বই দু’টির নতুন ক’রে প্রকাশ হওয়ার ব্যাপারটা যদি শেয়ার করতেন, সমগ্র প্রকাশ হবার পরেও নতুন ক’রে প্রকাশ করার কারণ কী?
কাজল:
৮০ দশকের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার কিছুদিন আগে কবিতার ও ৯০-এর প্রথমে গল্পের বই করার ও প্রেসের ট্রেডে উত্তেজনা দীর্ঘদিন উপভোগ করেছি। বই দু’টা প্রকাশমাত্রই সবার নজর পায়। নতুন ভাষা, কবিতাকৌশল, গল্পবুনন সবাইকে আগ্রহী করে তুলেছিল। সেটাই দীর্ঘদিন পর ২য় প্রকাশে পেলাম মনে হয়। চেয়েছিলাম পরখ করে দেখতে – ৩০ বছর ধরে সাহিত্যপাঠ কতদূর আগালো। একটা মিশ্র অনুভূতি পেলাম। দেখলাম সমকালীন বন্ধুরা প্রায় সবাই খুলে যেতে যেতে প্রায় ধূলা হয়ে গেছেন। পরবর্তীকালের লেখকেরা অনেকেই মনে রেখেছেন। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম, ৩০ বছর পরের পাঠকেরা ঠিকই পাঠ করে আনন্দ পাচ্ছেন, বিস্ময় পাচ্ছেন।
জয়:
এটাই মনে হয় লেখার সার্থকতা। শুরু থেকে আপনার কবিতা বিজ্ঞানমনস্কতার দিকে ঝুঁকেছে, এর কারণ কী? আপনি রোবটিক্স-জাতীয় শব্দ কবিতায় ব্যবহার করেছেন ৮৩-৮৪ সালের দিকে, সচেতনভাবেই?
কাজল:
সচেতনভাবেই। বরং বলা যায় অতিসচেতনভাবে।
আপনি তো জানেন, পঞ্চাশ দশকেই সোভিয়েতরা সাইবারনেটিক্স নিয়ে দারুণ সব গবেষণা করে ফেলেছে। সেসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমি সত্তরের শেষে, তখন আমি বারো ক্লাশের ছাত্র, কিশোরগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরিতে সেইসব বইয়ের স্বাদ পাই। আমার মনে হতে থাকে, এই সেই বিদ্যা, যেটা হয়তো ভবিষ্যত শাসন করবে। তারপর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার চতুর্দিকে ব্যবহারিক বিজ্ঞানের নানান কিছুর চর্চা হতে দেখলাম। আমার মাথায় নেচে উঠলো ধাতব বস্তু, অণু-পরমাণুর জগৎ।
১৯৮৩-তে প্রথম প্রেমে পড়ার পর, যেহেতু তা ছিল না প্রচলিত সমাজসম্মত – বন্ধুদের কাছে, পরিচিতদের কাছে দরকার ছিল তা গোপন করার। তখন আমি এক রকমের সাংকেতিক উপমামণ্ডলি ব্যবহার করতে শুরু করি প্রেমের কবিতা লিখতে। আমার বিচ্ছেদ বেদনা ছিল অপ্রচলিত, তা প্রকাশে দরকার হয়ে পড়লো আরেক অচেনা রকমের কাব্যভাষা।
জয়:
আপনার ক্যাম্পাস-জীবনের প্রেমটা ক্যানো প্রচলিত সমাজসম্মত ছিলো না?
কাজল:
এই প্রসঙ্গে আমি আমার একটা কবিতার পটভূমি বলি। ‘লোরকার অসতী নারী’ নামে ১৯৮৩ সালে একটা কবিতা লিখেছিলাম, বলা যায় তা যেন ছিল আমার প্রথম পাপ।
৪১ বছর আগে ১৯৮৩ সালে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে মিলিটারিরা বের করে দেয়। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্ররা সামরিক শাসকদের প্রণীত শিক্ষানীতি বাতিলের জন্য সচিবালয় ঘেরাও কর্মসুচী নিয়ে অগ্রসর হবার পর ছাত্রদের উপর গুলি চালালে জয়নাল, জাফর, দীপালী সাহাসহ অনেকে নিহত হয়। দেশের সর্বত্র ছাত্ররা প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুল হক হলের ১৩৫ নং রুম থেকে দেখি ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বের হয়েছে। পরদিন সকালে গার্ড বাহাদুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি হলের গেটে এলএমজি ফিট করে মিলিটারি দাঁড়ায়ে। তারা রুমে রুমে ঢুকে আমাদের জোর করে হল থেকে চলে যেতে বলে। আমরা ছাত্ররা হুড়মুড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস দিয়ে ময়মনসিংহ শহরে যেতে থাকি, সেখান থেকে বিভিন্ন দিকের ট্রেন ধরতে হবে। বাসের ভিতরে থেকেই সবাই সামরিক শাসনবিরোধি স্লোগান দিচ্ছিল।
সামরিক আদেশে ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’-এ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিলে কিশোরগঞ্জে বাসায় ফিরে আসি। তখন একদিন এক নারী আমাকে আকৃষ্ট করে। তাঁর সাথে আড্ডা হতে শুরু করে। ড্রয়িংরুম থেকে আমরা হাঁটতে শুরু করি পথে-ঘাটে।
কবিতার প্রবল জোয়ার চলছে আমার তখন। যা পাই, তাই পড়ি। একদিন শুরু করি লোরকার কবিতা, কার অনুবাদে যেন। পড়েই মাতোয়ারা হয়ে যাই তাতে। মাথায় জ্বলতে থাকে আগুন, লোরকার ইমেজের ভিতর ঢুকে পাগল হয়ে যাই।
এদিকে বাসার কাছে এক প্রাচীন ভূস্বামীর বাড়িতে ক্ষেত থেকে আনা কুশাইরে শুরু হয়েছে রাত-দিন আখমাড়াই। বাতাসে রসের ঘ্রাণ, উঁচু গাছগুলিতে মুহুর্মুহু কোকিলের ডাক। মাড়াইকলে দুটো লোহার সিলিন্ডারের ভিতর দিয়ে আখ চিপে ইক্ষুরস গড়ায়ে পড়ে।
একদিন সেই নারীকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাই তেপান্তর। হঠাৎ দেখি তাঁর শাড়ির প্রান্তজুড়ে প্রেমকাঁটার ঝাঁক। পায়ে শে সেদিন আলতা পরেছিল, মনে হলো যেন কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। আমার কাছে কোন ডেটল নাই, হতভম্ব হয়ে দাঁড়ায়ে পড়েছি। সেই নারী ছিলেন একজন বিবাহিত।
লোরকার কবিতা পড়ে নিজেকে কোন গভীর পাপে সমর্পণ করতে ইচ্ছা করতো। বাসায় ফিরে এই কবিতা লিখেছিলাম সেদিন। কোন রকমই এটা প্রেমের কবিতা নয়। এটা আমার প্রথম পাপের কবিতা। শে যেন ছিল লোরকার অসতী!
কবিতা না সেই প্রেম – কে ছিল আমার পাপ, তা আজো সমাধান করতে পারি নাই।
জয়:
আচ্ছা, আচ্ছা! বয়স ষাটের পরও আপনি লেখায় সক্রিয় এবং পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনগুলি মেনে নিয়েই আপনার টেক্সট সময়কে ধারণ করে, আপনার মধ্যে নতুনত্বকে সাদরে গ্রহণ করার ব্যাপারটা আছে। নিজেকে তরুণদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?
কাজল:
আমিতো জীবনের কখনোই সংসারযাপন করি নাই। আমার চিন্তার জীবন প্রথমেও ছিল কবিতাকেন্দ্রিক, শেষেও তাই। পেশাজীবন বা সংসারের স্বামী বা পিতা-জীবনেও তার ব্যত্যয় হয় নাই। সারাক্ষণ সাহিত্যের খুঁটিনাটি নিয়ে থাকতাম। পেশাগত জীবনে বেছে নেই কম্পিউটারভিত্তিক এডভান্স ড্যাটা ম্যানেজমেন্ট। জিআইএস। প্রোগ্রাম কোডিং। যাতে দরকার হতো সীমাহীন গাণিতিক লজিক ও কল্পনার খেলা। এইসবের সাথে কবিতার বিয়ে করিয়ে সংসার করেছি।
লেখার প্রয়োজনে দরকার ছিল নিজস্ব একটা জীবনযাপন। সবকিছুকে নিজের শাসনে রাখার জন্য তাই একসময় দীর্ঘকাল হার্ডড্রাগ নেশার ভিতর দিয়ে গেছি। ঢাকা শহর তো স্বৈরশাসনের সময় ড্রাগের স্বাধীন রাজ্য ছিল। পুরা শহরটাই ছিল গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিলের। মোড়ে মোড়ে, বস্তিতে বস্তিতে, বাজারে বাজারে ছিল স্পট। যখন-তখন স্কোর করা যেত। তখনই আমি আমার বেশির ভাগ গল্প লেখার কাজটা করেছি। হার্ডড্রাগের জন্য দরকার হতো তরুণদের সাথে দলবেঁধে থাকা। তাদের সাথে ওঠা-বসা। তাদের ভাষা, তাদের দেহভঙ্গি, তাদের ক্রোধের সাথে চলা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এই চর্চার শুরু। বিচিত্র মানুষের সাথে সিরিয়াস সময় যাপন, দিন-রাতের ক্ষণসমূহকে তছনছ করা। নিসর্গের আগাপাশতলা চেটেচেটে ভোগ করা। কোথাও একবিন্দু মাধুরীর দেখা পেলে ভিখারিনীর স্বভাবে তার সাথে লেপ্টে থাকাটা ছিল অবধারিত!
জয়:
এত বছর পরে লেখার জন্য হার্ড ড্রাগ নেওয়ার ব্যাপারে কী অনুশোচনা হয় বা এরকম মনে হয় কী, এর আসলে কোনো দরকার ছিলো না?
কাজল:
না না তা কেন? আমি তো এভাবেই আমি হয়েছি, এসব নিয়ে। আশির দশকে ঢাকায় জনপ্রিয় ছিল তিনটা মুডচেঞ্জিং দ্রব্য। ভারতবর্ষের গর্ব সুপ্রাচীন সিদ্ধি বা গঞ্জিকা, শত বছরের পপিজাত সিনথেটিক হেরোইন আর নতুন প্রচলন কফসিরাপ ফেন্সি।
প্রথমটার বর্তমানে আমাদের দেশে মাজুল অবস্থা। সাধু-সন্ন্যাসী ছাড়াও ভবঘুরে, চোর-ছ্যাঁচরারা সেবন করে বলে উচ্চ আসনে থাকার পরেও গাঁজার নামে অনেক অপবাদ। তাছাড়া সরকার একে একটা ধূসর জায়গায় রেখে দিয়ে আইনশৃঙ্খলার কাজে ব্যবহার করে। একসময় সর্বরোগের জনপ্রিয় ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হেরোইন ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যরা নতুন করে খুঁজে পায়। এটা ছিল আফিংয়ের একটা সন্তান কিন্তু হাজারগুণ তীব্র। আশির দশকে ঢাকা ও কলকাতা শহরে ছিল শিল্পী, সাহিত্যিক, তরুণ সমাজে আধ্যাত্মিক প্রেরণা। আমি এর প্রেমে পড়েছিলাম। পাশাপাশি কাশির ওষুধের কোন স্পিরিচুয়ালিটি নাই, নিছক একটা স্যাড ইউফোরিক জার্নি দেয়।
ড্রাগের কার্যকারিতা অপরিসীম, বলা হয় অতি-ব্যবহারেই সমস্যা। তা না হলে আমি আমার স্মৃতিশক্তির এই পরিমাণে ব্যবহার করতে পারতাম না বলে মনে হয়। ড্রাগ নিয়ে স্মৃতির টাইম ট্রাভেল অনেক করেছি। নিজেকে স্লো মোশনে চালানো, ফর্মুলা ওয়ানে চিন্তার গতিকে ওঠানো, জগতের সকল মেটাডাটার জটিলতায় শান্ত নৌকা চালানোর শক্তি কই পেতাম?
জয়:
এত বছর পরেও আপনার কবিতা, গল্প নতুনতর পাঠকেরা গ্রহণ করছে, ব্যাপারটা আপনাকে তৃপ্ত করে নাকি নতুন কিছু করার চ্যালেঞ্জ দেয়?
কাজল:
বহুদিন হলো, কোন আড্ডায় যাই না, কারো সাথে সশরীরে দেখা হয় না। ঘরেই থাকি। খুব একটা ইন্টারেকটিভ কমুনিকেশন করি না। বেশিরভাগ সময়ই যায় পিডিএফ পড়ে, সিনেমা দেখে। আর এর মধ্য দিয়ে চিন্তা করি। হাঁটি অচেনা মানুষদের ভিড়ে। কথা বলি গলি থেকে মহল্লার চালাক দোকানি আর ভবঘুরে মানুষের সাথে। রাস্তার ভ্যানয়লার খুচরা আলাপে কান পেতে থাকি। হাঁটাপথের ঝগড়ায় অলস দর্শক হই দু’-একটা চেতনাবাজ শব্দের লোভে। বাক্যাংশের সন্ধানে। টুকরা গল্পের খোঁজে।
পাঠক বা সমালোচক কারো সাথেই দেখা হয় না। জানি না আমার সাহিত্য কার কাছে কেমন করে যাচ্ছে। কেউ কি বমি করছে ঘৃণায় নাকি নাক শিটকাচ্ছে কে জানে? তবুও হঠাৎ কখনো-সখনো কোনো এক তরুণের কথা কানে এসে যায়। সে বলে, আপনার কথা বুয়েটের হলে এক বড় ভাইয়ের কাছে শুনলাম। একজন ঢাকা থেকে বহুদূর থেকে বলে, আপনার কবিতাসমগ্র আমার বালিশের পাশে রাখিছি। একজন বলে গল্পসমগ্রের সব গল্পই আমার মাথায় বাসা বাঁধছে। শুনে ভাবি: এটা কি কৌতুক নাকি ভালবাসা?
জয়:
চল্লিশ বছরের অধিককাল লেখকজীবনের সবচেয়ে বড়ো স্ট্রাগল আর প্রাপ্তি কী?
কাজল:
পুরাটাই স্ট্রাগল। আমার শিক্ষাদীক্ষা, পেশা, ঘর সামলানো – সবকিছু থেকে লেখার মধ্যে থাকাটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। আপনি যখন দেখছেন আপনার বন্ধুরা চিফ ইঞ্জিনিয়ার বা মন্ত্রণালয়ের সচিব বা বড় ডাক্তার বা বিরাট প্রফেসর ভিসি বা বিরাট ব্যবসায়ী তখন আপনি দুর্বল হয়ে যেতে পারতেন লেখালেখির সাথে থাকতে যেয়ে। নিজেকে প্রায় সবকিছু থেকে প্রত্যাহার করে থাকা অতো সহজ না। ওরা যখন প্রচুর পাওয়ার প্রাক্টিস করতেছে বা ঘুষ খেয়ে খেয়ে শ’কোটি পকেটে ভরতেছে তখন তো বিষণ্ণ হয়ে যেতে পারতেনই।
লেখকের প্রাপ্তি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না। নিজের মত কিছু বাক্য লেখা, কয়েকটা উপমা আবিষ্কার, কিছু চিত্রকল্পকে উদ্ধার করা – এই তো!
ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার সাথে দেখা হয়তো হয়, পরীর সৌন্দর্য বা জিনের অদৃশ্য শক্তির পরিচয় পেতেই পারেন। দেখা হয়েছে আফ্রোদিতির সাথে বলতে পারেন। গুলে বকাওলী পরীকন্যার সাথে কয়েকদিন, রুমির সাথে কিছুটা ভ্রমণ, জরথুস্ত্রের কালে আগুনের প্রেম শেখা এসব হয়েছে।
জয়:
‘শুদ্ধপাপী গোষ্ঠী’ আর ‘না’ সম্পর্কে বলবেন, প্লিজ?
কাজল:
৫০ দশকে ‘হোলি বার্বারিয়ানস’ নামে একটা সাহিত্য ধারা হয়েছিল নিউইয়র্কে, বিট জেনারেশনের সময়, ব্যক্তিগত বন্ধুমহলে। সেটা থেকে আমি শব্দটা বানাই, ‘শুদ্ধপাপী গোষ্ঠী’ নামে। আমরা চার অসম বয়েসি কবি-বন্ধু মিলে ১৯৭৮/৭৯ সালে ‘না’ নামে এই গ্রুপ থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন করি। আমরা ছিলাম কিশোরগঞ্জ শহরে একেবারে ছন্নছাড়া কবি। সারাদিন ঘুরে বেড়াই, রাত-দুপুরে রাস্তায় রাস্তায় আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা চিৎকার করে পাঠ করি। আমাদের এক বন্ধু বিপ্লব নিয়ে মত্ত, একজন লাজুক প্রেমিক, একজন তীব্রম্লান সংসারের গ্লানি রচনায় আর আমি সাহিত্যপড়ুয়া অনেক কিছু। আমাদের চারজনকে নিয়ে অগ্রজ কবি-বন্ধু কবিতা লিখেছিলেন:
‘রিপন মানে কি যেন কি যেন কী
রফিক মানে রোদপোড়া ভোর
মোসাদ্দেক আম্মাগো ডিমটা পড়ে গেল চামচ থেকে
কাজল মানে এভাবে ফোটে ফুল, ভোর ও চন্দন’
রক্ষণশীলদের দুর্গে আমরা হানা দেই ছাপার অক্ষরে। পার্টিবিপ্লবীদের ব্যঙ্গ করি। চোখ ভরা মাথা ভরা কবিতা, সবাই আবার বিদ্যা-বুদ্ধিতে তুখোড়!
জয়:
কবি রিফাত চৌধুরীর সাথে আপনার বন্ধুত্ব সম্পর্কে জানতে চাই। অভিনেতা হ’তে গিয়ে কী ওনার কবিত্বের ক্ষতি হয়েছে?
কাজল:
রিফাতের সাথে আমার ব্যক্তিগত সখ্য আর লিপ্ততায় অনেক মিল ছিল, কিন্তু আমাদের কবিতায় কোন মিল নাই। ও সজ্ঞা থেকে লিখতো, আমি লিখতাম বৈদগ্ধ থেকে। আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষা লোন করে বলা যায়, ও ‘প্রতিফলনে’ বিম্বিত আর আমি প্রতিসরণে ‘বিদীর্ণ’।
কবিদের জীবন খুব বাঁধনছেঁড়া হতে হয় মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকে ভাবুন, কাজী নজরুলকে ভাবুন, জীবনানন্দকে ভাবুন, আল মাহমুদকে, শামসুর রাহমানকে, বিনয়কে ভাবুন তো! কতো রকমের জীবন। কেউ ক্ষমতাচর্চায়, কেউ সামরিকতায়, কেউ অধ্যাপনায়, ছোট চাকুরিতে শুরু করে পত্রিকা সম্পাদনায়, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। র্যাবো তো কফির যাচাই করতে আফ্রিকায় গেছিল, অস্ত্র চোরাচালানিও করেছে।
রিফাত অভিনয়ে ছোট ফুল হয়ে ফুটতেই পারে। তাতে তো সমস্যা দেখি না। তবে ওর কবিতা লেখা কমানোর সাথে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রের কষাঘাত বা পেশা কোন ব্যাপার না বলে মনে হয়। কবিতাই হয়ত মুখ লুকাইছিল। তখন হয়তো ও শুধু নিজের জন্য লিখতো।
আবার কবিতা আসবে ওর। যতদিন বেঁচে থাকবে আমাদের আশা শেষ হবে না। কারণ একদা ও অনেক আশ্চর্য নতুন কবিতা আমাদের জন্য লিখেছিল। ঙ্রো সা
জয়:
আশির দশকে কবিতায় লেখা আপনার অনেক কথাই এখন আমরা বাস্তবে হ’তে দেখছি। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের যুগ-ও চলে এলো। এতে কী সাহিত্যের স্পিরিচুয়ালিটি নষ্ট হবে, নাকি নতুনরকম সম্ভাবনা তৈয়ার করবে?
কাজল:
কবিতায় প্রফেসি একটা ইনহ্যারেন্ট গুণ। বিগত এক সময়ের উপলব্ধি পরবর্তী সময়ে মিলে যেতেই পারে। মিলে গেলে আমরা চমৎকৃত হয়ে বলে ফেলি, দেখেছো লেখক কত স্পিরিচুয়াল, কত দার্শনিকতা তাঁর। কিন্তু তা হয়তো এক হাজার লাইনে একটা মিলে যাওয়া। তবে অনেক কিছু মিলিয়ে দেখার আনারস চোখ কারো কারো থাকে। সেরকম কাউকে পেলে উল্লসিত হওয়া যায়।
এআই্ – সময়ের ধারাবাহিকতায় আগমন করেছে, এটা চাকা আবিষ্কারের মত একটা ঘটনা। সভ্যতা এভাবে যতদিন চলবে, এরকম চলতেই থাকবে। আরো আরো নতুন ধারণা আসবে। তবে যে আমরা চতুর্থ মাত্রার জীবনে সাবলীল হয়ে যাবো, পঞ্চম মাত্রার জীবন আমাদের কাছে আসবে, তখন হয়তো আবিষ্কারের এই লিনিয়ারিটি থাকবে না। লাফায়ে লাফায়ে উদ্ভাবন হবে।
কবিতা একসময় থাকবেই না, এটা বলা যায়, এই ফর্মে। যত অধিক মাত্রায় মানুষ উন্নিত হবে, কবিতা পিছিয়ে থাকা জন্তুর মতো ততোই অপসৃত হতে থাকবে।
জয়:
নানারকম তথ্য-প্রযুক্তির যেরকম বিকাশ হচ্ছে, একশ বছর পরেও কী মানুষের আবেগ বেঁচে থাকবে, নাকি নতুনরকম ডাইমেনশন তৈয়ার হবে?
কাজল:
কবিতা বলতে আমি মানুষের আবেগ-অনুভূতিও বোঝাতে চাইছি। কবিতা তো দীর্ঘকাল থেকেই ‘আবেগ-অনুভূতি’র মা জননী। মানুষ যদি না ভার্সন.২ না হয়ে যায়, এই ডিএনএ’র ব্যাপক রুপান্তর না হয়ে ততদিন কবিতা এরকমই থাকবে। তারপর বদলাইতে পারে।
জয়:
আপনার একমাত্র উপন্যাস ‘শে’; এই উপন্যাসে দেখা যায় নায়িকার আত্মা নাই কিন্তু প্রেম আছে। এখন দুনিয়ায় প্রেম, আত্মা দুই-ই তো উবে যাচ্ছে। সাহিত্যিকের তো অনেক কাজ করার জায়গা আছে, নাকি?
কাজল:
‘শে’ হচ্ছে এক পোস্ট উপন্যাস। উপন্যাত্তোর উপন্যাস।
এটা লিখতে আমি ফেসবুক ও গুগলের কয়েকটা টুলের ব্যবহার করেছি।
কখনো ভয়েস টু টেক্সট মানে মুখে বলে বলে টাইপ করেছি, কখনো হাতের লেখা স্ক্যান করে টেক্সট বানানো হয়েছে। বেশিরভাগটা কী-বোর্ডে একটু একটু করে।
ফাস্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতা জোড়া দিয়ে দিয়ে গল্পটার কোষ গঠন। প্রতিটা লোকেশন প্রতিটা সিচুয়েশন রিয়াল লাইফের। টাইমলাইন খেয়াল করতে হবে। একদিকে বিডিআর কিলিং হচ্ছে ২০০৯ তে – কেউ বলছে মিউটিনি কেউ বলছে রেজিম চেঞ্জের ধোলাই। সেদিনই ফেব্রুয়ারির ২৫শে’র গরমে দুপুরে ঘামতে ঘামতে দেহ সংগম করছে এক জোড়া নারী-পুরুষ; প্রেমহীন। তৈরি হচ্ছে সম্ভোগের তালিকা। দেশ যখন তীব্র উৎকণ্ঠায়, তখন কারা এমন বিভৎস আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল?
সত্যিকারের ড্রাগ রিহ্যাবের ক্রাইম সিন ঢুকে পড়েছে উপন্যাসে। রিয়াল কিন্তু সব মিলিয়ে মনে করি এটা একটা সাহিত্যকর্ম। হয়ত বাংলা ভাষায় পাঠকরা অভ্যস্ত নয় বলে টের পায় নাই।
ড্রাগের দুইটা চেহারা একটা মেরে ফেলে আরেকটা জাগায়া তোলে। শেষের পথে সবাই যাইতে পারে না, কিন্তু শুরুতে একটা ইশারা পায় সবাই। চমকে চকিত চাহনি, স্বর্গীয় অনুভূতি। কিন্তু পথের শেষে দ্যাখে যে শে কুহকিনী! মায়া কিন্তু নরকের পথে!
আর কেউ কেউ সারা জীবনে ড্রাগের ড্রিমি পথে কুড়ায় কুরোসাওয়ার ড্রিম, দালির দুষ্ট কল্পনা।
‘শে’ সর্বনাম নিয়ে সম্প্রতি নানান কথা উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলাপটা আপনার পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি:
‘শে’ সর্বনাম কেন লিখছি?
আমার পোস্ট ও কবি মজনু শাহ’র পেজে এ লেখাটা শেয়ারড হবার পর অনেক কমেন্ট/মন্তব্য আসছে। দেশের বাইরেরও অনেক বন্ধু পরিচিত এমনকি জ্ঞান-গর্বে-স্ফীত উন্নত মানের রকবাজদেরও উপস্থিতি সেখানে। মনে হলো আমার কিছু সামান্য কথা বলা দরকার। তাই এই কথাগুলি বলছি।
গদ্য লেখা শুরু করার সময় খেয়াল করলাম, কোন গল্পের ব্যক্তিকে প্রথমবার উল্লেখ করার পর যখন পরবর্তীবারে তাকে উল্লেখ করতে হয়, তাকে আবার পরিচয় দিতে হয় ‘সে’ বলে। কিন্তু বুঝতে পারলাম, আমাদের ভাষায় ব্যক্তির জন্য সর্বনাম ব্যবহারে কিছু চিকন ফাঁক আছে। ব্যবহার করা যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে ব্যক্তির জেন্ডার হারায়ে যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে পুরুষটাকে সহজেই চেনা যায়, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে সর্বনামে স্পষ্ট বোঝা যায় না তাকে। একটা ওয়াইড মেল গেইজ এখানে কাজ করে। যা কিছু সব পুরুষ। তখন আমার মনে হলো, আচ্ছা, বাংলায় তো কয়েকটা ‘স’ ‘শ’ ‘ষ’ আছে। ‘সে’ কে বিস্তৃত করে জেন্ডার আরোপ করে দিলে সমস্যাটার সমাধান হয়।
কিন্তু পৃথিবীর প্রাচীন কোন কোন ভাষায় এই সমস্যা নাই। ইংরাজিতেও নাই। তাই তাদের বাক্যে ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট, গদ্য গঠন সাবলীল। ঝঞ্ঝাটমুক্ত।
কিন্তু জেন্ডার সচেতন হবার এই দিনে বিভক্ত সর্বনাম বিভেদ তৈরি করতে পারে। কাউকে কাউকে সংক্ষুব্ধ করতে পারে। তাও মনে হলো।
যারা গদ্য লেখেন না কিন্তু জেন্ডারভক্ত পাহারাদার, তাদের কাছে ‘শে’ সর্বনামটাকে নারীর ক্ষেত্রে ব্যবহার আরোপিত পুরুষালি আচরণ মনে হতে পারে। গদ্য লেখক জানেন একজন নারীর উপস্থিতি বর্ণনা করতে বাংলা ভাষায় কত কায়দা করতে হয়। কারণ আমাদের ভাষা দাঁড়ায়ে আছে পুরুষ অরিয়েন্টশনে বা গেইজে। এটা এড়াবার জন্য কিছুই করার নাই। বিকল্প দরকার। আপনি চেঁচাবেন কিন্তু কাজ হবে না।
কিন্তু আপনি পুরুষ গেইজ উপভোগ করবেন। প্রায় একই রকমের শারীরিক সৌন্দর্য থাকা সত্বেও পুরুষ বর্ণনার ফলে বানানো নারী নিজের দেহকে অপূর্ব সুন্দর বলে মেনে নেবে আর তারপরও পুরুষের বানানো ভাষা-কাঠামোকে এড়ায়ে যাবে কিভাবে? তাকে ‘সে’ সর্বনামে একটা ‘দ্বিতীয় সে’কে মেনে নিতেই হয়।
হিজরা, ট্রান্স, গে সব ব্যক্তির জন্যই সর্বনাম বানানো দরকার, যাতে বর্ণনা করতে সহজ হয়। তার পরিচয় নির্দিষ্ট হয়।
কেউ কেউ বলছেন পুরুষকেই ‘শে’ বলা হোক। হতে পারে। তবে জগতে মেল গেইজের ভাষায় পুরুষই স্বাভাবিকভাবে আগে জায়গা নিয়ে আছে। গদ্যে, পদ্যে, মহাকাব্যে। ‘শে’ প্রয়োগের আগে যদি বলতেন, তর্ক হোত, তারপর দেখা যেত কী করা যায়।
জগতের মেল লেখক কতজন? তাদের জন্য ভাষার গেইজ বদলাতে পারবেন? পুরা ভাষাটাকে তাহলে যে ওলট-পালট করতে হবে। পুরুষ ‘সে’ সর্বনামকে ‘শে’ বানানো খুব সহজ না। নারী ‘সে’ সর্বনামকে ‘শে’ বানানো যত সহজ। উল্টাটা চেষ্টা করে দেখেন।
তবে যাই করেন আমি এভাবেই লিখব। এতে লিখতে আমার সহজ লাগে, সাবলীল লাগে। দরকার হলে প্রতিটা লেখার সাথে টিকা দিয়ে দিব। ‘এই লেখায় শে মানে স্ত্রীবাচক ‘সে’ সর্বনাম’।
ঢাকার সিনেমা জগতে চলচিত্র আন্দোলনের গুরু খসরু ভাই অতি জেন্ডারবাদিদের বলতেন **বাদি। আমরা আর সেই শব্দ ব্যবহার না করি।
জয়:
আশা করি ‘শে’ সর্বনামটা গ্রহণযোগ্য হবে। আমি নিজে এটিকে গ্রহণ করেছি। আপনি সবসময় মিডিয়া, দৈনিক পত্র-পত্রিকা থেকে দূরে থেকেছেন, আপনার লেখা প্রকাশ হয় না বললেই চলে। এটা কী ইচ্ছাকৃত নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
কাজল:
লেখার শুরুতে যাদের সাথে মিশেছি তাদের কেউ মিডিয়া হাংরি ছিল না। লেখাকে এক প্রকার ধ্যানের জায়গা থেকেই দেখতে শিখেছিলাম। প্রকাশের আগে অপেক্ষা করাটা ছিল চল। সেভাবেই পত্র-পত্রিকার ক্ষমতাকে সন্দেহ করেছি।
বিকল্প হিসাবে লিটল ম্যাগাজিন বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু নিজের জীবনযাপনে খুব একটা সাংগঠনিক প্রতিভা দেখাতে পারি নাই, তাই বিকল্প মাধ্যম দাঁড়ায় নাই। পরিকল্পনা করেছি বিস্তর কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয় নাই। একসময় দেখলাম যাদের নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাদের নিয়ে কোন আন্দোলন করা যায় না। বেশিরভাগই বাউল। স্পিরিচুয়াল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতা নাই। কেবলি প্রাতিষ্ঠানবিরোধী, সৌখিন।
ততদিনে অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে পত্র-পত্রিকার প্রতি। অচেনা হয়ে গেছে সম্পাদকেরা। খুব একটা কেউ কাছে এসে ডাকে না। দেখি সবাই চায় তার দরবারে মোমবাতি জ্বালাই। ওসব আমার পোষায় না। লেখক হিসাবে আমার একটা ইগো আছে, সেখান থেকে বের হতে চাই না। জানি আমার শক্তি আমার লেখায়। আর কিছুই আমি করবো না, আমার সেই দক্ষতা থাকলেও।
জয়:
গল্পকাররা আপনাকে ‘কবি’ আর কবিরা আপনাকে ‘গল্পকার’ হিসাবে পরিচিত করতে চায়! এই ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে চাই।
কাজল:
গল্পকারেরা ‘হেন গল্পসংকলন’ ‘তেন গল্পসংকলন’ করেন। বসে বসে দেখি। অনেকেই বাংলা সাহিত্য ঠিকমত পড়েন নাই, তাদের গল্প পড়লে বোঝা যায়। মনে হয় গায়ের জোরে গল্প লিখে যান। কাহিনি বর্ণনাকারক মাত্র। তাদের কোন ইনসাইট নাই, দূরদৃষ্টি নাই। কিন্তু সম্পাদক! এসব তো আছেই।
কবিরা যেন ক্লাব করেন। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন কে কাকে ল্যাং মেরে গদি নেবেন, পুরষ্কার নেবেন। কবিতার হৃদপিণ্ডের ঠিক জায়গাটাই চেনেন না। হয়তো আড়ালে থাকেন মহৎপ্রাণ কবিরা, তাদের সাথে ক্বচিৎ দেখা হয় আবার হয় না।
আমাকে এড়ায়ে থাকতে চান অনেকেই। সময় নাই তাদের মর্মবস্তুকে ভালবাসার। গদ্য ও কবিতা দুইটা মাধ্যমেই আমার যাতায়াত আছে দেখে কেউ কি হীনমন্যতায় ভোগেন? জানি না। আমিতো অহংকারী নই, তবে আড়ালপ্রয়াসী। তাতেই হয়তো দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। এড়াতে পারেন না আমাকে, আবার আলিঙ্গনেও নরোমতা পান না।
তাই হয়তো ক্যারম খ্যালেন কবিরা, সরিয়ে দেন গদ্যকারের ফুটায়। আর গদ্যকারেরা টোকা মারেন কবিতার দিকের গাব্বুতে।
জয়:
আপনার নিজস্ব বানানরীতি আছে, এ নিয়ে স্ট্রাগল করতে হয়েছে? বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আপনার কী কোনো প্রস্তাবনা আছে?
কাজল:
একসময় বাক্যগঠন নিয়ে তীব্র খেলা করতাম। মাথার ভিতরের সবটুকু চিন্তা ভাষায় যথাযথ ট্রান্সফারের জন্য যত রকমের কাজ করা যায় তা করতাম। তাতে কয়েক লেয়ারের উপমা, মাল্টিডাইমেনশনের চিত্রকল্প, হাইপার লেভেলের সময়ের খেলা ব্যবহার করতাম। নতুন নতুন বানান হয়ে যেত, প্রচলিত শব্দকে মুখের উচ্চারণের আঞ্চলিকতা দিয়ে অন্য মাত্রা দেবার চেষ্টা করতাম। বাক্যের নানারকম সংকোচন করেছি।
এইসব করতে গিয়ে পেয়েছি অনেক সূক্ষ্ণ মেজাজের পাঠকের ভালবাসা। স্পর্শকাতর পাঠকের প্রশংসা, নীরব গোপন প্রশ্রয়। অল্পবয়সে পেয়েছি জ্যেষ্ঠদের পিঠচাপড়ানি।
তবে হয়তো প্রচলিত গড়পড়তা পাঠকের দেখা পাই নাই।
আমার চেষ্টা ছিল, আমার লেখা পড়ে যেন পাঠক নতুন কিছু পায়। নতুন আবিষ্কারের, উদ্ভাবনের শিহরণ পায়। কিছু একটা বাংলা ভাষার অভিজ্ঞতায় যোগ হয়।
সেসব হয়েছে কীনা জানি না।
আবার যখন ২০২০+ এ এসে দেখি তরুণরা আমার রচনা পড়ছে, তখন নিশ্চিৎ হই, সব বুঝি বৃথা যায় নাই। কিছু একটা যোগ করার চেষ্টা আমি যে করেছি, তাতে কেউ না কেউ সায় দিচ্ছেন।
জয়:
আর্টকে আপনি কীভাবে ধরেন বা সৃষ্টিপ্রক্রিয়াটা কেমন? আর্টকে বাঘের মতন ধরার একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন একবার।
কাজল:
আর্ট তো বাঘ ধরাই। মনের বন্য জন্তু পোষ মানানো।
জয়:
স্পর্শকাতরতা, সংবেদনশীলতার বাইরে গিয়া কী সাহিত্যিক বা আর্টিস্ট হওয়া যায়? সাহিত্য বা আর্টের নির্মাণ কী খেলাধুলা প্রক্রিয়ার মতই মনে হয়?
কাজল:
আর্ট একটা জটিল প্রকৃয়া। স্পর্শকাতরতা, সংবেদনশীলতা তো থাকতেই হবে, তবে তা হচ্ছে শুরুর প্রথম ধাপ। এরপর দীর্ঘ পাঠ, অনুশীলন, ধ্যান দরকার। দরকার সমাজের এটাচমেন্ট ও রাজনৈতিক দৃষ্টি। তারপর এক সৃজনশীল অটোমেটিক অর্গানিকতা, একটা উন্মার্গ মারাত্মক পরিস্থিতি।
জয়:
সাহিত্যে যৌনতার ব্যবহারে আমরা তেমন পটু হয়ে উঠতে পারি নাই, নানারকম ট্যাবু আর লেখকের সেলফ সেন্সরও কাজ করে। এই সেন্সর, ট্যাবু বিষয়ে আপনার কী মত?
কাজল:
যৌনতার ব্যবহার আসে অভিজ্ঞতা থেকে। আমাদের এই জবুথবু সমাজের অনেক ট্যাবু তা প্রকাশ করা থেকে আড়ষ্ঠ করে আগলায়ে রাখে।
অভিজ্ঞতাকে পরিপাক করে ভিটামিন বানাতে হলে ট্যাবু ভাঙতে হয়। লেখককে ব্যক্তিগত জীবনে সাহসী হতে হয়। অভিজ্ঞতার সংসারে পৌরাণিক বীরদের মত বাধনহারা হতে হয়। হতে হয় ভাষার সংসারে দু:সাহসী অভিযাত্রিক।
আপনি পর্ন পড়বেন সমকালের যৌনতা বুঝতে, আপনি প্রেম করবেন সঙ্গীর শরীরকে আবিষ্কার করতে। আপনাকে সমাজের গোপন যৌনতাগুলি জানতে হবে। জানতে হবে ক্ষমতার হিংস্রতার সাথে কীভাবে মার খাচ্ছে মানুষের মন। তাহলে যৌন বিষয় লিখতে পারবেন সাবলীলতায়। রসাত্মকভাবে।
জয়:
গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক সেন্সরশিপও তো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, বই নিষিদ্ধ হওয়া থেকে বইমেলায় প্রকাশকের স্টল না পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, আবার ধর্মীয় মোল্লাদের কারণেও লেখকরা আক্রান্ত হচ্ছেন—এত সেন্সরশিপের ভিতরে লেখক কী গ্রেট কিছু লিখতে পারেন?
কাজল:
এগুলি তো পার্টিরাজনীতির সারফেস লেভেলের কর্মকাণ্ড। আপনি সেন্সরশিপ, সার্ভেইলেন্স বানিয়েছেন প্রথমে ব্যক্তি পরে দলকে শায়েস্তা করার জন্য। লেখক তো এসবকে এড়ায়ে যাবার টেকনিক বের করতে সক্ষম। সে যদি লিখতে চায় তো লিখতে পারবেই। কেউ আজকে লিখে সোশাল মিডিয়ায় ছড়ায়ে দেবে, কেউ তার হার্ডডিস্কে পাসওয়ার্ড দিয়ে লুকায়ে রাখবে। কিন্তু তা অগ্নিশিখা – জ্বলবেই তা জ্বলবে। গ্রেটনেস আপনার লেখার শক্তিতে। লেখার যাদুতে।
জয়:
আপনি গল্পকার হিসাবেও বেশ খ্যাত, তারপরও খুব কম গল্পই লিখেছেন, মাত্র ২৩/২৪টা। কেন?
কাজল:
গল্প লেখার জোয়ার আসার জন্য অপেক্ষা করি। একসময় লিখেছি, তারপর সে জোয়ার মরা কাটালে চলে গেছিলো। আবার এখন তা আসবে মনে হয়। বেশ কিছু নতুন গল্প দিব্যচোখে দেখতে পারছি, এই জোয়ারে লিখব। আমাদের দেশের ইতিহাসের ভিতর দিয়ে কিছু অচেনা মানুষকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, তাদের আঁকব।
জয়:
আপনি একসময় দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে লিখতেন! সেই গল্পটা জানতে চাই।
কাজল:
সে ছিল এক ঘোরগ্রস্ত কাল। ড্রাগের জার্নিতে সারারাত কাটতো। একটু একটু করে সেবন, কয়েক লাইন লেখা। কয়েক মাস ধরে একটা গল্প লিখতাম। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা লাইন, প্যারা – মাথার ভিতর থেকে চোখের পথ ধরে আমার আঙ্গুলে জন্ম নিতো আর তা কখনো কলমে কখনো কী-বোর্ডে নেচে যেত। পুরা ব্যাপারটা করতাম দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে। সময় যে নাই, দ্রুত করতে হবে- দ্রুত। কিন্তু তা ছিল অনেক ধীর একটা চেষ্টা। পৃথিবীর সবচেয়ে ধীর কাছিমের পিঠে চড়ে। নিশ্চুপ শামুকের সাথে লেখার যাত্রা।
জয়:
কাজলদা, দশক ধরে ধরে দেখা যায় সাহিত্যে গ্যাঙ আসে, গ্যাঙবাজি হয় প্রচুর। সেসব গ্যাঙ কাউকে কাউকে ওঠাতে চায়, কাউকে কাউকে লোপাট ক’রে দিতে চায়। এখন এই উন্মুক্ত মিডিয়ার যুগে এসব গ্যাংবাজি ক’রে কাউকে ওঠানো বা লোপাট করা যায়? আনস্ট্যাবিলিটির সাথে এই পেশীশক্তিকালচারের সম্পর্ক কেমন?
কাজল:
এই জিনিসটা বুঝি না কিছুতেই আমি। ওরা এত সময় পায় কী করে? কখন করে এসব? কত বয়সে?
জয়:
আমিও বুঝি না! এসব করতে গিয়ে লেখা আর ধ্যানের সময় কখন পায়! যুদ্ধে থাকলে তো কৌশল তৈরিরও রাস্তা তৈরি হয়…
কাজল:
কিসের যুদ্ধ? কিসের কৌশল?
জয়:
হয়ত ল্যাং মেরে মেরে টিকে থাকার, পুরস্কার বাগানোর। হা হা হা
আশির দশকের কবিদের নিয়ে একটা কমন অভিযোগ আছে—তারা কবিতাকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। এই অভিযোগ নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
কাজল:
আশির দশকে দেখেছি প্রাক্তন বিপ্লবীদের গার্মেন্টস ব্যবসায়ি হতে, এনজিও দিয়ে সমাজের সেবা করতে। কবি/লেখকরা তখনই প্রথম সমাজের এইসব লোকদের কাছে যাওয়া শুরু করলো মনে হয়। সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতি যেভাবে সরে গেছিল শিল্পীরাও তাই। কিছু উচ্ছিষ্ট ভোগের ট্রেনিং, কিছু রাজনীতির খেলা – দলবদলের ভাওতাবাজি। আশির দশকেই সমাপ্ত হয়েছে সাহিত্যের ধারাবাহিকতা। আত্মবিশ্বাস, পড়াশোনা, লাইব্রেরি।
জয়:
সাহিত্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারাবাহিকতা থাকে, নতুনরকমের সাহিত্য তৈয়ার হবার পেছনে লক্ষ্মণগুলা কী কী, মানে নতুন ধরনের সাহিত্য চেনার উপায় কী কী?
কাজল:
সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু বলি।
এই সময়ে দেখছি বেশ চালাকির ভাষা, সফট টোন, প্রাচীন প্রেমের সরল নবায়ন, কিছুটা নয়ালিবারেল জীবন যাপনের চিত্র –নতুন জেনারেশনে এই ধরনের সাহিত্যই চোখে পড়ে। কিন্তু একটু ভিতরে গেলে দেখেছি আগের জেনারেশনের কবিতাগুলির অতৃপ্ত বাসনাগুলি, অচেনা রূপকল্পগুলির মীমাংসা করতে আসছে বর্তমান কাল। আগামী দিনের কল্পনা দেখতে পাচ্ছি। শরীরি তৃপ্তি প্রধান হয়ে গেছে, যৌনতার বিস্তার হচ্ছে। স্বপ্ন আছে ক্যারিয়ার পন্থি। হতাশাকে কার্পেটের নিচে লুকাইয়া রাখতেছে। জীবনের গভীর বিষাদ থেকে পালায়ে যাবার জন্য ডানা মেলে দিচ্ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। চিরায়তকে ভুলে যাবার প্রাণপন চেষ্টা। শুধু মাইগ্রেশন। সরে সরে চলে যেতে চায়। দেশের ভুগোল শুধু পণ্যের জিআই সনদের জন্য।
কবিতা নতুন ধরন কী?
এক কথায় বলা যায় কবিতার নতুন ধরন হচ্ছে চলতি বিষয়কে একটা নতুন সেটিং-এ লেখা। সেই সেটিং-এর মধ্যে আছে সময়ের মেটা ন্যারেটিভকে ধরা। রাজনৈতিক চেতনার আপডেট, বুদ্ধিবৃত্তির নয়া যাত্রার সন্ধান।
জয়:
কাজলদা, আপনার একটি বই ‘একটা পুরুষ পেপে গাছের প্রস্তাব’, এটা কী পুরুষের পলায়নপরতা, দায় স্বীকার, অভিমান নাকি বিদ্রুপ?
কাজল:
বইটা ছিল বিদ্রুপ, মকারি, মশকরার রসে জারিত। ছিল বানানকে শিথিল করার চেষ্টা। কয়েকটা জ্বলজ্যান্ত আগুনে পোড়ানো বিষয়কে তুলে আনা। সমকামি বা সমপ্রেমের রোমান্টিক আকর্ষণকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। পুরুষকে শুলে বসায়ে দিছিলাম। তাকে সামনে রেখে গরুর গোস্ত কোরবানি থেকে শুরু করে গার্মেন্টস ভেঙে পড়ার মধ্যে যে সরল রেখাটা আছে, তা যে আসলে পুরুষই তা বুঝায়েছিলাম কবিতায়। সরাসরি বলি নাই, তা ছিল কবিতা-উপায়ে, হিডেন, আন্ডার লাইং। আমাদের জাতীয় জীবনে সাফোকেটিং সময়টার শুরু তখন, সেই চিহ্ণ আছে ‘পুরুষ পেপে…’ তে। আবার পুরুষ গাছে ফুল ফুটবার কথাও আছে।
জয়:
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি ভাষায় সাহিত্যচর্চা বেড়েছে, কলকাতামুখী সাহিত্য থেকে দেশের দিকে ঝুঁকেছে। এতে মুসলমান সংস্কৃতির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে লেখায়, আবার বানানের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যও চলছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
কাজল:
এই ব্যাপারটা কেবলই শুরু হয় নাই। এটা আমাদের মনের গভীরে বহুদিন ধরেই চর্চিত হচ্ছিল। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গীয় মানুষেরা একই সাথে আনন্দ ও বেদনা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। তবে তা ছিল অসম্পূর্ণ। জাতি হিসাবে নিজেদের পরিচয় স্থাপন জরুরি ছিল আমাদের, যা অখণ্ড বাংলায় কখনোই সম্ভব ছিল না। ১৯৭১-এ নিজেদের মানচিত্র পেয়ে তার কিছুটা পূর্ণতা পেয়েছে।
সংস্কৃতভিত্তিক বাংলা থেকে আমাদের পদ্মা-যমুনা-মেঘনা-তিস্তা-কুশিয়ারা বিধৌত ভূখণ্ডে আলাদা একটা বাংলা ছিল। সেটার উৎস প্রাকৃত থেকে। চর্যাপদ থেকে। বা আরো প্রাচীনতা থেকে। আরাকানের রাজসভা থেকে সেটার বিকাশ। আরবি-ফার্সি-মুণ্ডা-সাঁওতালি-প্রাকৃত ভাষার মিশ্রণ শক্তিতে। মুসলমানত্ব একটা সাংস্কৃতিক কন্টেইনার। বাংলা ভাষার সাথে এর সম্পর্ক শিকড়ের। আধুনিকতার, গ্লোবালাইজেশনের। সুফিদের হাত ধরে বাংলা পেয়েছে চিন্তার নতুন ডাইমেনশন, পেয়েছে কৃষি-ব্যবস্থার রূপান্তরের শক্তি, সেচের মহিমা।
মুখের ভাষার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধর্ম পুরাতন ধর্ম ও রাজনীতিকে সরায়ে দিয়েছে। সমাজের রূপান্তরে ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবী মানুষের খোলা মনকে বুঝতে পারছে।
শুধু বানান নয়, উচ্চারণও বদলাচ্ছে। নতুন নতুন এক্সপ্রেশন, ভাষার নতুন মিশ্রণ হচ্ছে। যেভাবে ধনী ও গরীব, ক্ষমতাবান ও প্রলেতারিয়ানের ফাইট হচ্ছে, ভাষাও সেভাবে বদলাচ্ছে। গণতন্ত্র বদলাচ্ছে। ভোটশক্তি বদলাচ্ছে। জিও পলিটিক্স বদলাচ্ছে।
জয়:
এ সময়ে যেসকল তরুণ লিখছে, যাদের বয়স তিরিশের কম, তাদের লেখা পড়েন? কাদের লেখা ভালো লাগছে? এই সময়ের তরুণদের লেখার বিশেষ কোনো দিক খুঁজে পেয়েছেন?
কাজল:
পড়ি তো। সোশাল মিডিয়া আমার মত ঘরবাসিকে দিয়েছে অবাধ মেলামেশার ক্ষমতা। আমি তো ফুলটাইম পাঠক। কাগজের বই সাজায়ে রাখছি, কখনো কখনো ধুলা ঝাড়ার জন্য খুলি, কিন্তু পড়ি ডিজিটাল মিডিয়ায়।
গ্রেট মাস্টার-রাইটারদের সাথেই পড়ি বাচ্চা সদ্য ফোটা কুসুমকলি ডিমডিম তুলতুলে মিষ্টি ও ঝাঁঝালো কবিদের কবিতা, লেখকদের গদ্য। পড়ে উদ্বেলিত হই, রাগ করি আবার শিখিও। দেখি তিরিশ বছর আগে আমি যেভাবে উন্মাদ হয়ে সাহিত্য করতাম ওরাও সেরকম। কেউ বিবাগী, কেউ পড়ুয়া।
যাদের পড়ি, তিরিশের কম বা বেশি তরুণ কবিদের কিছু নাম:
বায়েজিদ বোস্তামী, রুহুল মাহফুজ জয়, নকিব মুকশি, রুম্মানা জান্নাত, হাসনাত শোয়েব, মীর হাবীব আল মানজুর, হাসান রোবায়েত, জাকারিয়া প্রীণন, কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ, রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা, মাশিয়াত জাহিন, আবির আবরাজ, হাসিন এহ্সাস লগ্ন, কাজী ওয়ালী উল্লাহ, কাউকাব সাদী প্রমুখ।
জয়:
আমাদের কবিতায় নগরজীবন খুব কম, এখনও আমরা গ্রামের নৈসর্গিক ব্যাপারগুলায় বুঁদ হয়ে থাকি। এটা কেন হচ্ছে?
কাজল:
আমাদের মনো শহরটার বয়স তো খুব বেশি নয়। পঞ্চাশ দশকের কবিরা প্রধানত বই পড়ে নাগরিক। তাই সেটা একই সাথে লন্ডন ও নিউইয়র্কে ঘুরতো না হয় কলকাতায় গোত্তা মারতো।
আশির দশক থেকে আমরা প্রথমে সিটি পরে মেট্রো শহরে প্রবেশ করেছি। তারপর সারাদেশ থেকে অসংখ্য বৈচিত্র নিয়ে এসেছে অনেক ভাষাভঙ্গি, খাদ্যাখাদ্য। আঞ্চলিক অভ্যাস আর খাদ্য হচ্ছে নতুন ভাষাবাহক, অর্থনৈতিকতা হচ্ছে নিয়ামক। আশি থেকেই ঢাকা শহরের পুরানো অভ্যাস রাস্তাঘাট দালান আকাশরেখা রান্নাবান্না লোপ পেতে থাকে। বদলাইয়া যায় ৪৭-এ দেশভাগের সুবিধাপ্রাপ্ত পশ্চিম বাংলা থেকে আগত অধিকাংশ ঢাকার এলিট ও মধ্যবিত্ত – ভাষা আর গরীব সাহেবিআনা। এসে উপস্থিত হয় লঞ্চে আসা বরিশালের চিংড়ি মাছ, রংপুরের ঝাল, কিশোরগঞ্জের চ্যাপা। ঢাকার রাস্তাঘাটে প্যাক প্যাক ঘ্যাচর ঘ্যাচ মিচ মিচ করতে থাকে নানান বুলি। উজান আর ভাটির টানে কথা বলা। ছোট্ট দেশ কিন্তু অনেক মানুষ।
কে না জানে, ভূমি নয়, মানুষই সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করে। তাই কতো রকমের ফোকে ভরে ওঠে নয়া আর্বানতা। নতুন এক প্রকার গরীব নগরায়ণ হয়েছে আমাদের।
জয়:
ইদানীং মনে হচ্ছে কবিতা অলঙ্কার থেকে মুক্তি চাইছে; উপমা, চিত্রকল্পকে কবিতা থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন অনেকে। এই প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
কাজল:
দেখেন, রবীন্দ্রনাথ ১৬০ বছরেরও বড়, জীবনানন্দ ১২৫ বছর! শামসুর রাহমান ৯৫, আল মাহমুদ ৮৭। কবিতা কি এখনো বসে থাকবে ওদের হাতে? উপমা তো সমসাময়িকতা থেকে উদ্ভব হয়, চিত্রকল্পও তাই। অনুরূপতা ছাড়া আরো কত রকমের উপমা সৃষ্টির পথ হয়েছে। সব কিছু বদলায়। হয়তো শক্তিমান কবি সর্বদা জন্মায় না। সাহসী কবি জন্মায় না। তবে কবিতা তো লেখা হয়।
জয়:
আর কবিতার নাম, বইয়ের নাম, কবিতার ভিতরে ইংরেজি শব্দের ব্যবহারকেই বা কীভাবে দেখেন? অনেকেই ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেন না।
কাজল:
কবিতার নাম বা বইয়ের নাম আমি নিজেও অনেক রকম দিয়েছি। আমার দেয়া নামের ধারা অনেককে প্রভাবিত করেছে আশা করি, যেমনটা আমি নিজেও হয়েছি।
বিভিন্ন ভাষার শব্দ ব্যবহারে কোনই সমস্যা নাই। যদি না তা
১. অল্পবিদ্যার প্রকাশক হয় – তাহলে নামটাকে মনে হবে হাস্যকর
২. অপ্রাসঙ্গিক হয় – তাহলে তা বোকামি মনে হবে
৩. অতিরিক্ত বিদেশি ট্রেন্ডি হয় – তাহলে তা সেই দেশের অনুকরণ মনে হবে। বা ন্যাকা মনে হবে।
জয়:
একমত। সাহিত্যপুরস্কার নিয়ে আপনার ভাবনা কী? এখনও কবিতা বা গল্পে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি আপনাকে!
কাজল:
ছোটবেলা দেখেছি আমার প্রিয় কবিরা এ শহরে আন্ডারগ্রাউন্ডেড। তাদের কে তো পুরষ্কার দিতে দেখি নাই একাডেমিকে। পরিস্থিতি এখন আরো খারাপ। দুর্দশাগ্রস্থ বাংলা একাডেমিতে গেছি শুধু বইমেলায় দেখা সাক্ষাতের জন্য। মাঝে কিছু বই কিনতে ওদের বিক্রয়কেন্দ্রে গেছি। তবে মনে হয় আমি আসলে ঐ সমাজের লোক না। আমাকে কেন ওরা পুরষ্কার দেবে?
জয়:
প্রশ্নটা একাডেমির কাছেই তোলা থাক! একাডেমি পুরস্কার দিলে নেবেন, নাকি প্রত্যাখ্যান করবেন?
কাজল:
শুধু সাহিত্য পুরষ্কার কেন, জীবনের কোন পুরষ্কারই আমি নিতে চাই নাই। পড়াশোনার সার্টিফিকেটা পর্যন্ত কোনদিন ব্যবহার করি নাই। সার্টিফিকেট প্রাপ্তি আমার চলে না। আমি সেই উপনিষদের যুগে থাকি, ‘জঙ্গলে ঘুমাই-নদীতে খাই-পাহাড়ে ঘুরি’ টাইপের মানুষ। কাউকে প্রশংসাও করতে চাই না, উপদেশও দেই না। ওদের সাতে-পাঁচে-সতেরোতে আমি নাই, থাকতেও চাই না। ঐ পদার্থ হাতে নিতে চাই না।
জয়:
শেষ প্রশ্ন, নতুন কী লিখছেন?
কাজল:
জীবন যাপনে মৌলিক পরিবর্তনহেতু আমার গদ্য লেখার পরিশ্রমের প্রতি ভালবাসা এসেছে। অনেক তো বাঁচলাম। নানান বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে গেছি। শুধু সাহিত্য নয়, প্রফেশনাল জীবনও আমার বর্ণাঢ্য। সেসব নিয়ে লিখছি। কিছুটা স্মৃতি, কিছুটা উপন্যাস।
নতুন দিনের এক পশলা অবকাঠামো-উন্নয়ন-ঘটিত তানা-নানা নিয়ে কয়েকটা বড় ধরনের গল্পের কাজ করছি। ইতিহাস ও ব্যক্তির ক্রিয়া নিয়ে কয়েকটা লেখার মশলা হাতে। লিখতে চাচ্ছি শারপিন শাহ টু শম্ভুগঞ্জ মাজারে যাওয়া একটা ষাঁড় নিয়ে।
বেশ অনেক অডিও জোগাড় করেছি, পিক সংগ্রহ করেছি, এগুলি ম্যাটেরিয়াল হিসাবে কাজে লাগছে।
জয়:
খুব ভালো থাকবেন, কাজলদা। খুব আনন্দময় সময় কাটলো। অনেক ধন্যবাদ।
কাজল:
ধন্যবাদ আপনাকে।