তারাধূলিপথ
১
ভাবছি, একদিন খুব গভীর পানিতে তলিয়ে গেলাম— তারপর, ধীরে ধীরে হিম সেই পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছি— আমার চারপাশে, নানান লতাগুল্ম, ফুলের ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে পাখিরা আমাকে দেখছে— একটু নিচেই মাছ— আমার মৃতশরীরের নিচে সাঁতার কাটছে—
সেই অনেক নদীর দূরে কোথাও একটা অশোক গাছ— সেখানে তারারা নিচে নেমে আসে— উড্ডীন তুলাগুলো আমার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছে ঝরা নদীপারের দেশে— কেউ হয়তো ওপারে আছে যে আমাকে কাঠের গোধূলি দেবে, নদীর মায়াঞ্জন দেবে—
২
ভাবছি, একদিন কামিনী ফুলের সাথে বহুদূর ঘ্রাণ হয়ে ভাঙা ঘুম আর তোমার শঙ্খরৌদ্রের নথে পুড়ে যাবো বর্তুল—তুমি কি গ্রীষ্মপাড়ের নদী! আমার অতসীগাঙের ছায়া! এ পাড়ের ধু ধু পাখি দেখো কতটা মনোলীন!
কী যে ধূলি, তৃণপথ ধরে এখনো উড়ছে সারাদিন! আমার ভেড়ার পাল, ঘ্রাণ ও গৃহের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপচয়—ফাঁকা দহলিজে এ কেমন রাক্ষস-খাখা! তবু অন্নের ভাগ থকে তারাও সরিয়ে রেখেছে কিছু পাতার শিরায়—
কোথাও তুমিও আছো ওপারে পাশার-ক্ষেত, পাখিদের মণিকণিকায়—
৩
ভাবছি, একদিন জন্মঋতুর কাছে দাঁড়িয়ে পুরনো কড়ইবনে ফেলে আসি পেতলের বাটি—ধাতব সে অনুপস্থিতির দিকে তোমাদের সৌখিন তাক ব্যবহৃত শূন্যতায় চলে যাবে দিন, পথিক-দিনের উঁচু লাল রাত্রির পাড়ে—
তার সুগোল আকাঙ্ক্ষার বেধ আমাকে নিয়ে যাবে তীরে, প্রতিরশ্মির ঢালে—পাতা ও মর্মরের দূরত্বে একটি গাছ কিভাবে ছায়া দেয় একা! দূরে, কাকাতুয়াদের গানে তোমার ওপার ভেসে আসে মাঠে—
একটা শাদা কবুতর ময়লা হচ্ছে প্রতিদিন—
৪
ভাবছি, একদিন অনেক কথার পরে আমাদের দেখা হবে জরিকাজ ভরা কোনো সন্ধ্যায়—তারপর, সিঁড়ির নিহিতার্থ জেনে তুমি ফিরে যাবে কাঠে—কী সব ছুঁতার ভরা এই রাত টিপটিপ করে গড়িয়ে যাবে বার্নিশ—শুনবে, তুলার অভিনিবেশে হাওয়ার অঙ্কুরণ ভালো হয়—এই বউলগ্রোথিত ঘ্রাণ তোমার ত্বকের পাশে ফুটে থাকে আর তিতি ফুলের রেণু সারামাঠ উড়িয়ে দাও আয়নায়—
কোথাও বাঁশির গ্লানি, অন্তরাবরণ!
সন্ধ্যার হীনপ্রভায় একটি অন্ধকার খুলে রাখে বোল শাখা-পরাঙ্মুখ কোনো বিদল ফুল
৫
ভাবছি, একদিন সরোদের নিচে আমাদের দেখা হবে মীন—দূরে, ভেড়ার পাল গুল্মসম্ভাবনার দিকে হেঁটে যায়—যার নুড়ি বহুকাল পাথর হবে বলে পাখিদের সাথে খেলেছিল ঘ্রাণ—রূপ তুমি কি তাদের কথা!
ওপারে, আমাদের ছায়ালীন প্রপাত—শুশুকের পিঠে কেমন বেজে গেল রোদ, তৃণপাখিটির স্নান—
৬
ভাবছি, এখানে বাবলার ঝাউ জুনের হলুদ হয়ে ভেসে যায়—ফাঁকা এই জল রৌদ্ররক্ত ছিঁড়ে একা চলে গেল দূরে, পোড়া গাছটির পিঠে—ভেড়াগুলো সুনসান পার হয় ঝিঁঝিটের বন—
ওপারে, শূন্যতার ভেতর তোমার আশ্চর্য চুল ঘিরে আছে নিখিল শিশুটিকে—সন্ধ্যার বাঁশি, এই রূপ-আরোহন ফেলে তাকেও নিয়ে এসো দাওয়ায়— দহলিজে, ভেড়াদের অন্নপ্রাণে—
৭
ভাবছি, একদিন শালবনে অর্ধশুষ্ক কোনো পরান্নের গায়ে মেখে দেবো হেম—যেন পত্রঝরাকাল ছড়িয়ে পড়ছে বনে—আঁধির ভেতরে কাঁপে তিতি ফুল তোমার গর্ভদিগন্তে কেমন চিরাশ্রিত ছায়া—
কাঠের শব্দব্যাপী এই লতাঘর, অপরাহ্ণের ভাঁড়ার ঘেঁষে হেঁটে যায় ভেড়া—তাদের চোখের নিচে জলগৃহ, তৃণাবৃত আকাশ—ফিরে এসো, প্রাকারকুট ঐ ঢেউয়ে—
যেন অন্নপ্রাণ হাওয়া আর বেশি দূরে নয়
৮
ভাবছি, একদিন পড়ন্ত গীর্জার সম্মুখে একটি ভেড়া ফেলে যাবে সমস্ত কথা তৃণভাব মহুয়ার কাছে— শুষ্ক সে ইঁদারার ঢাল, তামাম আওয়াজ ধরে চলে গেল রুদ্রাক্ষের বনে— হয়তো কেউ সান্দ্র পানির নিচে দেখছে ক্লান্ত শব— নদীটির পাখোয়াজ ভরা মেঘ আর রৌদ্রকাকাতুয়া নিয়ে যায় তাকে সকালের শান্ত স্রোতে—
চারদিকে জলবৃক্ষের ছায়া কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মোনামুনির পাতায়—অজস্র শূককীট দেখেছিল সূর্যানুগমন, বনান্তের তিতি ফুল নম্র আঙুলে তার ধরে রাখে তোমার ঋষভ—
এতটা মূকাভিনয় আর শতরঞ্জির কাছে আমি এক ভারাক্রান্ত সুর—অদূরে সন্ধ্যা নামে শূন্য এক সারেঙের কাঠে—
৯
ভাবছি, একদিন তরুরোহিণীর কাছে দেখা হবে তিতিফুল—বাতাস যেখানে অজ্ঞাত—স্বজন বলতে শুধু অস্ফুট ঘাম। মাঝে মাঝে আরেকটু কামিনীর দিকে গেলে দেখা যায়, মানুষের মুখের থেকেও আরো বেশি দীপাবলী ফুটে আছে মাঠে
এভাবেই সমস্ত খবর আসে বৃষ্টি ও তৃণভূমির থেকে—এমন বিস্তৃত দুপুর—ঢিল ছুঁড়লে এক ঝাঁক ঘ্রাণ একা হতে হতে ছড়িয়ে যায় তরমুজবন—
কখনো হিংসার পাশে তারারা মুখ উঁচু করে দেখে নেয় কে যেন সংসার গাইছে নিরন্ন চাপকল ধরে—
১০
ভাবছি, একদিন প্রাচীন দুপরের নিচে কয়েকটি ভেড়ার সাথে কথা হবে— নদী পার হয়ে কারা যেন চলে গেল রেলকলোনির দিকে! সেসব জানে না ঐ অমিত পিয়াল— কোথাও, হয়তো পড়ে আছে পৃথিবীর শেষ সাঁকোটির ছায়া— চাতালের জাম গাছ আমাকে ডাকছে অজস্র পত্রসমেত
ক্ষমা, এক দীর্ঘ দ্বীপান্তর—
চৈত্রমুখর নোনা হাওয়া, তোমার মলিন গীতে আমাকেও রেখো কোনো সুরে— গভীর কাঠের ভেতর যতদূর সরোদের ছায়া
শাফা
এসব কেবলই চিঠি, সফেন-উত্তর
অবশূন্যতার পাশে সৌধ নির্মান—
এবং তাদের কথা জলান্তরে, মীনে
গভীর পতন ধরে অশীতিপর হাওয়া
বলে গেল, ‘এই লিপি নিরর্থের শ্লেষ’
অহেতু তামাশাবোধে নৈশ প্রহরীরা
কুচি কুচি হুইসিল ফেলছে নীহারিকা
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
তবু কি আসবে কেউ ত্রস্ত সে হাওয়ায়—
দুপুরের সাইকেল পাতার ঝরা দিনে!
চিরনীল ডাকে তার সৌরপশুদের
ঘরে নেই কোনো জন— একলা চৌকাঠ
অকস্মাৎ এইখানে দোলায় ভয়বিভা
ক্রমাগত ভাঙে নীল শূন্যে বেশুমার
ঠুমরি ফুলের নিচে রাত্রি অবসান—
করোটির ফাঁপা চোখ হায় সে ম্রিয়মাণ
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
ছায়াদূর আধোলীন ক্লান্ত পাতাটিও
পথিক-দিনের কথা ভাবছে দুপুরের
কতকাল ধরে মথ শুনেছে কড়িকাঠে—
পুড়েছে সেসব চিঠি আতসি কাচ ধরে
নদীতীর থেকে রোদ এখনো হাওয়া নিয়ে
ছুড়ে দেয় যত ভান লেখার-অভিবেশ
এখানে কাগজ শাদা ঢেউয়ের সার্কাস
ভাসে শ্বেত চরাচর বিরহে সারাদিন—
বাজিতে উড়ছে যেন দুঃস্থ গিরিবাজ
ফুলে ওঠে সূর্যে তার কেশর সাবলীল
শাফা, দূরবনপ্রভা—ফি-আমানিল্লাহ—
আমার প্লিহার খাদে ভীষণ চাঁদ উঠে
ডুবে যাচ্ছে প্রতিদিন রুধিরতন্দ্রায়
সেখানে জোছনা এসে কোষের ফাঁকে ফাঁকে
জ্বালায় বুদ্বুদ তার, প্রচল গৌরব—
অথচ যে হাওয়া দূরে কাঁপায় গমশীষ
ঝন ঝন বেজে চলে লুপ্ত মুদ্রায়
অনেক কালের আগে মৌন কাটাবনে
কী এক চিঠি ফেলে কাহার চলে গেলো
তখন দুপুর এক নিরুত্তর ধাঁধা
কিছু কিছু ফুল যেন ঝরার ভালো লাগে—
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
দাঁড়াও এখানে এই শৈলজাগরণে
অ্যাসিডের বিবমিষা মউল-প্রান্তর
যেভাবে নামায় হেম ঘূর্নমান শোক—
একটা ময়লা হাঁস পালক ঝারলেও
কেমন সৌন্দর্য নুয়ে পড়ছে সন্ধ্যায়
ছোট ছোট ঘাম নিয়ে ঠোঁটের শীত গলে
উড়াল দিয়েছে তারা ক্লান্ত চারিদিক—
মাঝরাতে একা গ্লোব চাকার বেধ ঘুরে
বিষণ্ন মর্মরবোধে ফিরছে আশরীর
তবুও লেখে নি কেউ নিখিল উত্তর
আমার গলার মধ্যে বৃষ্টি পড়ে সাঁ সাঁ
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
এসো লিপি, মাহুতের চাঁদার কৌশলে
যেন নিমফল অতি লাবণ্যের ধাঁধা,
হাতির পেরোনো গ্রাম, ছায়ার অনায়াসে
ভুলে যায় বীতশোক কখনো সূর্যের—
নেমে এসো অবদাহ ঘুমের বুদ্বুদ—
পথ তুমি ফেলে রাখো— বেলায়, মূলরোমে,
মাছ-শিকারের হেতু জালের সূক্ষ্মতা
মেনে, ফিরে এসো সম্মোহিত কাঠে
পানির গভীরে কার হর্ম্য-মন্দির
একে একে খুলে দেয় সুরকি-বিস্ময়
প্রাকারবহুল এই পাথর-ঘাগরায়—
বলো, আশৃংখল ভাষা চিঠির সংকেত
তুমি কি রুটির চেয়ে সুগোল বিষ তার!
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
ফিরে এসো, সার্কাসের দুরূহ সজ্জায়
ভরামুখ লোকটির ফুলেল শ্বাসনালী
পেঁচিয়ে ধরছে ঝাঁক মাছের নিঃশ্বাস
পাথরে যতটা উট দেখেছি কুঁজো ছায়া
ক্ষয় হয় শুধু যেন আভূমি মর্মের
তোমার লিখন সুর আমাকে শুনিয়েছে
এই গান ধুনুরি ও দূরের পাহাড়ের—
নিরর্থে তোমাকে ডাকি তামাশা-কৌশলে
হাওয়ানো দুপুর সে-ও ছোবলে মিতবাক
করতলে ভাষা নিয়ে তুমি কি দাঁড়িয়েছো
ক্রমশ কাফের যেন জহরে অধিকার!
চাঁপার গভীরে শুয়ে আমূল চিতাবাঘ
কথোপকথন ভাবে গরল আমাদের—
রঙ করা বসন্তের ভেতর কাক ওড়ে
শাফা, দূরবনপ্রভা— ফি-আমানিল্লাহ—
লেখার নিকটে ছিল ধ্বস্ত ডাকঘর
নিচে পড়ে থাকা বালি, প্রাংশু অয়োময়
সেদিন জাগে নি কিছু হা-ঘরে খালাসির
খোলস পাল্টালে সাপ ভিন্নভাবে হাসে—
এ ভাষা দুধের সর: ফলিত বক্রতা
এখন পাথরে দূর ভীষণ মনিকাচ
এত এত বৃষ্টি পড়ে ফুরিয়ে যাবে নীল
এসব কেবলই চিঠি, সফেন-উত্তর
শাফা, দূরবনপ্রভা—ফি-আমানিল্লাহ—
সম্পাদকীয় দ্রষ্টব্যঃ শাফা কবিতাটায় ছন্দের এক অভিনব ব্যবহার আছে। কবিতায় একই লাইনে অক্ষর ও মাত্রাবৃত্তের সফল প্রয়োগ এই প্রথম। যে কারণে বলা যায় হাসান রোবায়েত নতুন একটি ছন্দ আবিষ্কার করেছেন। ছন্দটির নাম কি দেয়া যায় — অমাবৃত্ত?
হাসান রোবায়েত
জন্ম: ১৯ আগস্ট, ১৯৮৯, বগুড়া।
প্রকাশিত বই: ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে (২০১৬, চৈতন্য)
ইমেইল: hrobayet2676@gmail.com