যাত্রাঃ পৃথিবীর পথে, এরপর আরো বহুদূর
বিশ্বস্ততা ও ক্ষমাশীলতা, এই দুটোর বাইরেও কনফুসিয়ান দর্শনের কেন্দ্রে আছে আরেক শব্দঃ মহত্ত্ব। কনফুসিয়াসের শিষ্য Fan Chi একবার তার শিক্ষককে সসম্মানে প্রশ্ন করেনঃ ‘মহত্ত্ব কী?’ শিক্ষক দুই শব্দে উত্তর করলেনঃ ‘মানুষকে ভালোবাসা’। মানুষকে ভালোবাসাই মহত্ত্ব।
Fan Chi আবার জানতে চাইলোঃ ‘প্রজ্ঞা বিষয়টাই বা কী?’ শিক্ষক বললেন মানুষকে জানা। অন্যকে জানাই প্রজ্ঞা। অন্যকে ভালবাসা এবং অন্যের প্রতি যত্নবান হওয়াই মহত্ত্ব, এই-ই সারকথা।
তাহলে মহৎ ও ভালোবাসাময় অন্তরের অধিকারী হতে হলে আমাদের কী করতে হবে?
কনফুসিয়াস বলেনঃ ‘একজন মহৎ মানুষ নিজের মতের পেছনে যেভাবে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ান, অন্যের মতেও সেভাবে তাদের দাঁড়াতে সমর্থন দেন। নিজে যেখানে পৌঁছাতে চান অন্যকে সেখানেই নিয়ে যান। হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তার থেকেই তুলনাময় জ্ঞান নিতে পারার পদ্ধতিই আসলে মহত্ত্ব। (Analects VI)
আপনি যদি নিজেকে তুলে ধরতে চান তাহলে, অতি সত্ত্বর অন্যদেরকেও কীভাবে তুলে ধরতে হয় তা শিখুন, যদি আপনাকে নিজের অভীষ্ট বুঝতে হয় তবে অন্যদের অভীষ্ট বুঝতেও তাদের সাহায্য করুন। এটা নিজের আশেপাশের ছোট ছোট বিষয় দিয়েই বুঝতে শুরু করা যায়, নিজেকে যেভাবে ভজেন সেভাবেই অন্যদেরকেও ভজে। এই হচ্ছে মহত্ত্ব ও ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে বাঁচার উপায়।
জীবনে আমরা যে কেউ অকস্মাৎ কর্মহীনতা, বিবাহবিচ্ছেদ, বন্ধুর বেইমানি, অথবা নিকটজনের দ্বারা পরিত্যক্ত হতে পারি; এবং এটাকে আমরা খুব নগণ্য বা খুব সাংঘাতিক কিছু ভাবতে পারি- এগুলোর কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই।
কথার কথা যদি আপনার কোথাও এক ইঞ্চি কেটে যায় তা কী গুরুতর আঘাত না সামান্য কোন আঘাত? এক আদুরে, সংবেদনশীল বালিকা হয়তো এ নিয়ে সারাটা হপ্তা গাঁইগুই করে যাবে, কিন্তু একজন পরিণত শক্ত ব্যক্তি হয়তো ‘কোন ক্ষণে কাটা আর কোন ক্ষণে তা আরোগ্য’ এরদিকে ভ্রুক্ষেপই করবে না।
তো আমরা কোন আদুরে বালিকার ভূমিকা নেবো, না কোন শক্তিমত্ত যুবার- তা পুরোদমে আমাদের উপরই বর্তায়। যদি আপনার সীমাহীন বড় একটা মন থেকে থাকে, আপনি বিষয়বস্তুকে তার যথাস্থানেই নিরূপণ করবেন।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে একটা গল্প ভাবতে পারি, যা ছিলো একজন রাজাধিরাজকে নিয়ে যিনি প্রতিদিন তিনটি প্রশ্ন নিয়েই মেতে থাকতেনঃ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা কে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই বা কী? কোন কর্মের জন্য নির্ধারিত সর্বোত্তম সময় কোনটা?
এই তিনখানি প্রশ্ন তিনি তার অমাত্য ও সভাসদদের উদ্দেশে রাখতেন, কেউ কোনো সদুত্তর করতে না পারায় তিনি মুষড়ে পড়তেন নিয়ত। একদিন তিনি আম-মানবের ছদ্মবেশে বাইরে চলে গেলেন এবং দূরে কোথাও এক বৃদ্ধের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। রাত বাড়ল, মধ্যযামে তিনি বাইরে অপরাধের শব্দ-গোলযোগ শুনতে পেলেন এবং দেখলেন এক রক্তমাখা মানুষ ঐ বাড়িটিতে এসে পড়েছে। সে লোকটি বলছিলো আমার পেছনে মানুষ আছে, তারা আমাকে বন্দী করবে। তখন বৃদ্ধ লোকটি সেই লোকটিকে বললোঃ ‘আমার এখানে লুকিয়ে পড়ো’, আর তাকে আশ্রয় দিলো সেদিন।
রাজার সেদিন শংকায় আর ঘুম আসছিলো না, সে দেখলো সেনারা ষেই পথেই হন্তদন্ত বেশে তাড়া করে আসছে। সেনারা বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে সে কাউকে এ পথে আসতে দেখেছে কীনা? বৃদ্ধ জানায় না, কেউ আসেনি এদিকটায়। এরপর সেনারা চলে গেলে বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় সেই আশ্রয়প্রাপ্ত পলায়নপর লোকটা। বৃদ্ধ তখন ঘরে ফেরে ও ঘুম দেয়। পরের দিন রাজা বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে কেন সে ঐ লোককে আশ্রয় দিতে ভয় পায়নি। কেন সে এই কাজে সমূহ বিপদের ভয় পায়নি। এতে তার জীবনও যেতে পারতো যে! এবং এরপর ঐ লোকটিকে তার পরিচয় না জেনেই যেতে দেয়ারই কী কারণ তাও রাজা তার কাছে জানতে চাইলেন।
বৃদ্ধ লোকটি রাজাকে শান্তস্বরে বললেনঃ “ ভবে সেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যে তোমার সামনে এসে তোমার সাহায্য কামনা করে, ভবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সেই সাহায্য-প্রার্থীকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া আর এই ভবে সর্বাপেক্ষা ভালো কাজের মোক্ষম সময় যে বয়ে যায়, আজ এবং এক্ষুণি তা, লেশমাত্র কালবিলম্বে তা নয়।“
এই সেই সময়, সেই সে মাহেন্দ্রমুহূর্ত যখন রাজার কাছে দিবাজ্যোতির মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার বহুলজিজ্ঞাস্য তিন দার্শনিক-প্রশ্ন জবাব।
এই গল্পটি কনফুসিয়াস পাঠে আমাদের ফুটনোটের মতোনই কাজ করে যায়।
কনফুসিয়াস বা চৈনিক বা অন্যদেশীয় অন্যান্য মহাত্মা দার্শনিকগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি থেকে যায় এইখানে যে, তাঁরা তাদের জীবনের বাস্তব উপাখ্যান বা অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা অর্জন করে থাকেন আর ঠিক ঠিক সেসবই সত্য ও নীতিমালা আকারে মানুষে মানুষে ধারণ ও প্রবাহিত হয়।
এই সত্যগুলো কোন প্রাচীন ও পুরাকালের বিপুলা আকরগ্রন্থের মধ্যে থাকে না, যা পড়তে আতশীকাঁচ লাগবে এবং ডাক পড়বে তাবৎ সব অভিধানের- যা কীনা আমাদের জীবন উজাড় করে ফেলবে বোধগম্যতার পরিধিতে আনার কায়ক্লেশে।
সত্যেই বাস করা মহাত্মা মানুষেরা থমথমে চেহারা ঝুলিয়ে রেখে বা উদাসীন তাচ্ছিল্যে পুড়িয়ে আপনাকে বায়বীয় কথায় আক্রান্ত করবেন, তা কক্ষনোই না। তারা আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে আসেন তাদের যাপিত জীবনবোধ, মানবজন্মের শ্বাসে-শাশ্বত অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান আর যা কিছু ভালো আমাদের জন্য, পৃথিবীর বড় বড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমরা যেনো সেইসব প্রত্যাদিষ্ট সত্যের ওম টের পাই। হাজার বছর আগে থেকেও, তাঁরা যেন হাসিমুখে আমাদের পানে তাকিয়ে, যেন নিঃস্পন্দ নিস্তব্ধতায় বসে অবলোকন করে চলেছেন তাঁদের কথা ফলবান হয়ে আছে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, হয়ে আছে অমৃতসমান !
কনফুসিয়াস আমাদের নিরল সত্যের সুলুকসন্ধান দেন। যা আমাদের অন্তরতম প্রদেশ ও আত্মার নিলয়কে সুগঠিত করে। আমরা আমাদের নৈমিত্তিক জীবন যাত্রায় নিতে পারি সঠিক ও লাগসই সিদ্ধান্ত। আর এই যে যাত্রা আমরা করলাম যাকে নাম দেয়া হলো যাত্রাঃ পৃথিবীর পথে, এরপর আরো বহুদূর তার প্রথম কারিগরি হচ্ছে right attitude বা আমাদের সঠিক মনোভাব জারি রাখার চ্যালেঞ্জ।
(প্রথম অধ্যায়ের সমাপন)
প্রথম অধ্যায়ঃ তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন