কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান । বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ । তৃতীয় অধ্যায় : দ্বিতীয় পর্ব

মনোবিজ্ঞানীগণ আধুনিক মানুষের পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানকে আখ্যায়িত করেছেন-‘Non-loving behavior’ হিসেবে। এই ধারণাটি খুব নির্ভুলভাবে বিধৃত করে ভালবাসার নামে কীভাবে মানুষ তাদের কাছের মানুষের প্রতি অনুদার ও বলপ্রয়োগমূলক আচরণ করে। এই ঘটনাগুলো ঘটে মূলত স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে সর্বোপরি নিকটজনদের মধ্যে। একজন স্বামী বা স্ত্রী একে অন্যকে বলবেনঃ  ‘শুধু দেখো তোমাকে বালবাসতে গিয়ে আমি কী কী ছেড়ে এসেছি। আমি পরিবারের জন্য কত না কিছু করেছি। তাই তুমি আমার সাথে ঠিক এমনি ব্যবহার করলে ভালো হয়।’ 

     অনেক মায়েরাই তাদের সন্তানকে বলেন, দেখো তোমাকে জন্ম দেয়ার পর থেকেই আমি কাজে-কর্মে পিছিয়ে পড়েছি, আমি রূপ-লাবণ্য হারিয়েছি, আমি আমারসহ কিছু তোমার জন্য বিসর্জন দিয়েছি। তাহলে কেনো তুমি তোমার পাঠশালায় এর চেয়ে বেশি ভাল করতে পারো নি ?’

     এসবই হচ্ছে -‘Non-loving behavior’: ভালোবাসার নামে এক ধরনের জোরাজুরি, যা করা হয় আমাদের নিজেদের মন মতো করে অন্যরা যাতে আচরণ করে সেটি নিশ্চিত করার জন্য। 

আমি একবার একটা বই পড়েছিলাম কীভাবে ভালো পিতা-মাতা হওয়া যায় তার উপরে, যা লিখেছিলেন এক ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী, যেখানে লেখক কিছু মূল্যবান উক্তি করেছিলেনঃ

ভালোবাসা সর্বদাই হচ্ছে মানুষকে কাছে টানার ব্যাপার। কিন্তু একপ্রকার ভালোবাসা আছে, যার কাজই হচ্ছে কেবল দূরে ঠেলে দেওয়া- তথা বিচ্ছেদঃ যেমন সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা। শুনতে অবাক লাগলেও, প্রকৃত অর্থেই সফল পিতা-মাতার ভালোবাসা মানেই হচ্ছে সন্তানকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে স্বতন্ত্র জীবন-যাপনে যত দ্রুত সম্ভব অভ্যস্ত করে তোলা। আপনি যত দ্রুত সন্তানদেরকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে আপনার আওতা থেকে আলাদা করতে পারবেন, আপনি ততটাই সফল পিতা/মাতা।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে স্বনির্ভরতা এবং সম্মানজনক দূরত্ব ব্যক্তির আত্মসম্মানের জন্য অবশ্যাম্ভবী। এবং এই সম্মানজনক দূরত্ব এমনকি কাছের মানুষদের মধ্যেও আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে ধরে রাখা ও চর্চা করা জরুরি।

হোক তা বাবা ও ছেলের মাঝে, হোক তা মা ও মেয়ের মাঝে, হোক তা দীর্ঘদিনের স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে, একবার যদি এই সম্মানজনক দূরত্বের বিনাশ ঘটে, একবার যদি আপনি এই সীমা অতিক্রম করেন এবং পৌঁছে যান সেই স্তরে যাকে কনফুসিয়াস ‘importunate’ বা ‘বিরক্তিকর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাহলে আপনারা একে অন্যের কাছে কখনোই কার্যত স্বাধীন নন। ফলশ্রুতিতে সম্পর্কে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। অপ্রকাশ্য ক্ষতি, দূরত্ব এমনকি সম্পর্কের চিরস্থায়ী ভাঙন কোনটাই দূরে নয়।

বন্ধুদের প্রতিই হোক আর পরিবারের প্রতি আমাদের সবার জানা উচিত আমাদের পরিসীমা কোথায়। গড়পরতা মধ্যম সম্পর্কই ভালো।

তাই আমাদের কর্মজীবনে এটাই কি জরুরি যে, সাফল্যের জন্য আমাদের খুব বেশি কর্মোদ্যম হতে হবে ?

এটাই কি সত্য যে আমরা যত বেশি কাজ করবো ততই ভালো? তা আমাদের কর্তব্যের অংশ হোক বা না হোক। নিজের কাজ করতে গিয়ে কোন সীমারেখা অনুসরনের প্রয়োজন কি আমাদের রয়েছে ?

কনফুসিয়াস আমাদেরকে দেখিয়েছেন কীভাবে আমরা প্রত্যেককেই সমানভাবে ও যৌক্তিকভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। যা কৌশলগত দূরত্ব ও breathing space এর জন্য প্রয়োজন।

ইহাকে অনেকটা Zen Buddhist মতবাদের ‘the flower not fully open, the moon not fully round’ এই অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়।

ইহা হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের সবচাইতে শ্রেষ্ঠ অবস্থা। যখন একটি ফুল পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয় ইহা মিইয়ে যেতে থাকে; যখন চাঁদ পরিপূর্ণ পূর্ণিমার রূপ ধারন করে তখন খুব তাড়াতাড়িই সেটা ক্ষয়ে যেতে থাকে। কিন্তু যখন ফুল পুরোপুরি ফোটে না চাঁদও পুরোপুরি পূর্ণিমায় পর্যবসিত হয় না, তখন আপনার ভেতরে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয় এবং আপনি ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উপরের কথাগুলো সত্য। এভাবে চললে হয়তো আপনি দেখবেন আপনার সামনে অনেকগুলো নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞাতা অর্জন করে। যখনই তারা সেই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয় তখন মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান তাদেরকে একটি লিখিত Job Description প্রদান করেন, যেখানে পদের অবস্থান এবং কি কাজ করতে হবে তার বিবরণ থাকে। সেখানে কর্মরত ক্লার্ক, টাইপিস্ট থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা পর্যন্ত সবার কাছেই সেটা প্রদান করা হয়।

চীনে সাধারনত কাজের ধরন নির্ধারণ করা হয় কিন্তু কী পরিমান কাজ করা হবে সেটা নির্ধারন করা হয় না। সেখানে সব সময় বলা হয় যে তরুণেরা কঠোর পরিশ্রম করে সঠিক কাজটি করবে এবং পারলে একজনই তিনজনের সমান কাজ করবে। যাতে করে সবার সামগ্রিক চাপ কিছুটা কমে। বস্তুতপক্ষে ইহা আধুনিক কর্ম প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার মূলনীতির পরিপন্থী। যিনি কোন কার্য সামাধা করবেন তারই উচিত সেই কাজের যত্ন নেওয়া। যাতে করে প্রত্যেক কর্মীই একটি সুসংহত কৌশলের অংশ হতে পারেন।

কনফুসিয়াস বলেছিলেন-‘যদি না আপনার নিজ দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে আপনি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াদিতে মাথা ঘামাতে যাবেন না।’ অন্য কথায়, আপনি যে পজিশনেই থাকুন না কেনো, আপনার নিজের কাজটিই করা উচিত সর্বাগ্রে। আপনি অবশ্যই আপনার অধিক্ষেত্রের বাইরে যাবেন না এবং প্রয়োজনের সীমার বাইরে গিয়ে কাজ করে কখনই অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। এই পেশাগত আচরণটিই বর্তমান সমাজ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে।

যাই হোক একটা প্রচ্ছন্ন শর্ত এখানে এই যেঃ ‘যখন আপনার দায়িত্বের সাথে সম্পৃক্ত তখন অবশ্যই আপনাকে সরকারি বিষয়াদিতে অংশগ্রহণ করতে হবে।’ অতএব, যখন কোন কিছু আপনার দায়িত্বের অংশ তখন আপনি দায়িত্বের বিষয়ে নিজেকে কীভাবে সম্পৃক্ত রাখেন?

আমরা কিভাবে জানতে পারি যে আমাদের কী করা উচিত?

কনফুসিয়াস বলেনঃ ‘কোন Junzi ব্যক্তি পৃথিবীর যেকোন ব্যাপারে পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেন না। বরং তিনি থাকেন নৈতিকতার পক্ষে।’

এই কথা বলে কনফুসিয়াস বোঝাতে চেয়েছেন, একজন Junzi ব্যক্তি কোনকিছুর উপরে জোরারোপ করেন না, যুক্তি ছাড়া কোনকিছুকেই অগ্রাহ্য করেন না, কোন বিষয়ে অধিক আগ্রহ বা অনাগ্রহ দেখান না। কারো খুব নিকটবর্তী বা দূরবর্তী হন না। যা করেন নৈতিকভাবে ও ন্যায়ানুগভাবেই করেন।

নৈতিকতা এবং ন্যায়পরায়নতাই হওয়া উচিত আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডের মূল চালিকা শক্তি ও মানদণ্ড।

একবার যদি আমরা জানতেই পারি যে, আমাদের কর্মকাণ্ড ঠিক কী এবং কীভাবে ভূমিকা রাখবে তাহলে আমরা আমাদের যাপিত জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যেন সচেতন থাকি।

কথা এবং কাজের মধ্যে কনফুসিয়াস কাজের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যারা শুধু বাগাড়ম্বর করে ও লোক দেখানো আচরণ করে তাদের ব্যাপারে কনফুসিয়াস খুবই নিরাশ ছিলেন।

তিনি বলেছিলেনঃ ‘প্রকৃত অর্থেই বাক্যব্যায়ে অতি চতুর এবং তরলমতি মানুষের পক্ষে উদারচেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া খুবই বিরল।’

বাক্যব্যয়ে অতিচতুর এবং আচরণে তরলমতি এমন সব মানুষদের মধ্যে প্রকৃত গুণধর ব্যক্তিই আপনি হয়তো পাবেনই না।

তাহলে কনফুসিয়াস কীসের ব্যাপারে মত প্রদান করেছিলেন?

খুব সাধারণভাবেই তা হচ্ছে ‘কথা কম কাজ বেশি’। আপনি আপনার নিজের কাজের ব্যাপারে খুবই উদ্যমী হতে পারেন তবে তা হতে হবে কনফুসিয়াসের মতে ‘বাক্যব্যয়ে সতর্ক’। যখন আপনি কোন কাজ করতে পারবেন বলে জানেন তখন তা পারি বলে জাহির করবেন না। চীন দেশে একটি প্রবাদ আছে, ‘মানুষের মুখই বিপদ ডেকে আনে’, আরেকটু বাড়িয়ে বললে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে ‘অর্থবিনা অজস্র শব্দের স্রোত।‘   

কনফুসিয়াসের ছাত্র Zizhang চেয়েছিলেন একজন পদস্থ কর্মকর্তা হবার নিমিত্তে লেখাপড়া করতে। Zizhang চেয়েছিলেন সমাজে দায়িত্বশীল একটি অবস্থানে যেতে এবং তিনি তার শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এজন্য তাকে কী করতে হবে। কনফুসিয়াস তাকে বলেছিলেন- ‘তোমার কানকে বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করো কিন্তু যা সন্দেহজনক তা বাদ দিয়ে বাকিটুকু সতর্কভাবে পুনরুৎপাদন করো। যাতে করে তোমার ভুল কম হয়। তোমার চোখকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করো, এবং যা কি ঝুঁকিপূর্ণ তা কিছু পরিহার করো; বাকিটুকু নিজের চর্চায় নিয়ে আসো সতর্কতার সাথে, যাতে করে তুমিও কম কম পরিতাপ করো। যখন তুমি তোমার কথাবার্তায় খুব সামান্যই ভুল করবে এবং তোমার কাজে তোমাকে খুব সামান্যই পরিতাপ করতে হবে তখন পদস্থ কর্মকর্তা হবার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ (Analects II)

‘তোমার কানকে বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করো কিন্তু যা সন্দেহজনক তা বাদ দিয়ে’ এর অর্থ হচ্ছে আপনাকে প্রথমে আপনার কান ব্যবহার করতে হবে মানুষ যা বলে তা শোনার জন্য। কিন্তু তার যতটুকু আপনি বোঝেন না তা একপাশে ফেলে রাখতে হবে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা শিখতে পারি আর অন্যের গৃহীত পথ, মত, হতাশা, দুর্দশা ইত্যাদি থেকে পরোক্ষভাবেও আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি।

‘বাকিটুকু সতর্কভাবে পুনরুৎপাদন করো’ এর অর্থ হচ্ছে আপনি যখন কিছু শুনে তা পরে আলোচনায় আনবেন তখন যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এবং তা করতে গিয়ে আপনি ঠিক ততটুকুই আলোচনায় আনবেন যা আপনি নিশ্চিত।

‘যাতে করে তুমিও কম কম পরিতাপ করো’ এর মানে সরলভাবে এখানে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তাই।

 ‘তোমার চোখকে ব্যপকভাবে ব্যবহার করো, এবং যা কি ঝুঁকিপূর্ণ তা কিছু পরিহার করো’ এর অর্থ হচ্ছে চারপাশ দেখে চলুন কিন্তু যা কিছু নিয়ে আপনি নিশ্চিত নন তা এড়িয়ে যেতে পারেন। বিভ্রান্তি মূলত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতার ফলাফলঃ কোনো কুয়োর ব্যাঙ কী করে সাগরের বা আকাশের বিশালত্বকে উপলব্ধি করবে?

আপনি যখন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবেন, তখনো আপনাকে আপনার কাজের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই ধরনের সতর্কতাকেই বলা হয় ‘as if approaching a deep abyss, as if walking on thin ice’ (Analects VIII)

পর্যাপ্ত চিন্তা করুন, পর্যাপ্ত শুনুন, পর্যাপ্ত দেখুন নিজের কথা ও কাজের ব্যাপারে পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন- এভাবে চলার সুফল এই যে আপনাকে আপনার জীবনে খুব কমই পরিতাপ করতে হবে।



ভূমিকা বা প্রথম পর্ব

শেয়ার