পল্লীজীবনের পশ্চাৎপট ‘সোনালি কাবিন’-এর ঔজ্জ্বল্যের নিদান হলেও আল মাহমুদ লৌকিক সারল্যকে পরিহার করেছেন সযত্নে, অন্যথায় বিপদ ছিলো তার জসিম উদ্দীন হবার।
সোনালি কাবিন একটি বহুমাত্রিক কবিতা। আল মাহমুদের কাব্যখ্যাতির মূল স্তম্ভ এই কবিতাটিতে বিবিধ বৈপরীত্যের সহাবস্থান ঘটলেও বিপ্লবের ঘূর্ণায়িত পিস্টনের প্রাবল্য একে একটি ঈর্ষণীয় সংহতি দিয়েছে। প্রেম ও বিপ্লবের সপক্ষে তার অনুরাগ একই উষ্ণতায় ব্যক্ত, যদিও এই দুটি অনুষঙ্গের প্রতি তার মনোভাব অতি সরল ও একরৈখিক। কাবিনবিহীন হাত দু’টি অর্পণ করেও কবি বয়ন করেন প্রতিশ্রুতির অনতিহ্রস্ব তালিকা, গ্রাম্য কিশোরীর লজ্জাবিধূর এবং অসংস্কৃত মনের কাছে হাজির করেন ইতিহাস-লোকবিশ্বাস-নৃতত্ত্ব-রাজনীতির তথ্য ভারাক্রান্ত জটিল বাকবিভূতি; কৌমের যৌথসংগ্রামের স্মৃতি-স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকেন প্রেমাকূল এক ব্যক্তিসত্তা হিসাবেই— যদিও পশ্চাৎপটে আমরা যুথজীবনের কোরাসকে আবছাভাবে দেখি; তৎসম-তদ্ভব শব্দের জটিল বুননের মধ্যে অবলীলায় গেঁথে দেন মুসলমানি ‘জবান’—এর নানাবিধ শব্দের ফুল। সরল প্রেমনিবেদন রূপ দেয় ভাষণের; দু’টি ব্যক্তিসত্তার মিলনের মধ্যে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আশা না দেখে আমরা দেখি কামুক এক পুরুষের দৈহিক চরিতার্থতার লালসাময় উচ্ছ্বাস। কিন্তু এতসব বৈপরীত্য সত্ত্বেও ‘সোনালি কাবিন’ একটি আশ্চর্য কবিতা, এ অঞ্চলের কবিতার ইতিহাসে তুলনারহিত এবং অভিনব। বাংলা কবিতায়— শ্রেণি-সংগ্রাম, বিপ্লব তথা মার্কসবাদের অনুভব এর আগেও প্রভাব পেয়েছে। কিন্তু একটি দেশের, একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানসিক গঠন, তার মেজাজ, তার আচরণ ও উচ্ছ্বলতায় এতটা সিক্ত হয়ে ওঠেনি আর কোন কবিতা, আর সেই সঙ্গে মেটাতে পারেনি শিল্পের কঠোর দাবি। আল মাহমুদ স্মৃত হবেন মূলত এই একটি কবিতার জন্য এবং অধুনা এই কবির বহু শৈথিল্যকে আমরা ক্ষমা করতে পারি শুধু তার ঐ একদা-অর্জিত সফলতার কথা বিবেচনা করে। অনুরূপ আরেকটি শিখর তিনি ছুঁতে পারবেন এমন ভরসা কম।
২.
নিপাট সরল এক আত্মিক দৈহিক বিবাহের পয়গাম নিয়ে দুয়ারে দাঁড়ান এসে প্রেমিক কবি; ‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রেও’ যেমন উচ্চকিত তিনি, তেমনি সরাসরি ভাষণ, উচ্চকণ্ঠ ও নির্দ্বিধ, কামিনীর প্রতি, ‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী / যদি চাও দিতে পারি কাবিন-বিহীন হাত দুটি— … বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল / পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না’
‘সোনালি কাবিন’ সাম্প্রতিক কবিতা-ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা দ্রোহী কবিতা, সর্বাপেক্ষা যৌনতাশ্রয়ী কবিতাও সম্ভবত, কেননা আল মাহমুদ এমন একজন শক্তিশালী অর্জুন যিনি কামনা-যৌনতার ধনুতেও অনায়াসে বিপ্লবের ছিলা পরাতে পারেন, অথবা বিপ্লবের বল্লমের ফলায় খচিত করতে পারেন রতির কারুকাজ। অধুনা দেখছি তার ইসলামী কবিতাও স্বচ্ছ বহির্বাসের নিচেই যৌনতাপিত স্তনবৃন্তের মতো মৃদু কাঁপতে থাকে। পাঠকগণ স্মরণ করুন তার ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’র ‘নীল মসজিদের ইমাম’- কবিতাটি, যেখানে মাহমুদের অলৌকিক ধর্মতত্ত্বের ভাণ স্ফারিত হয়ে যায় যখন তিনি বয়ান করেন এমত পঙক্তিনিচয়—
‘কোথায় হারিয়ে এসেছ তোমার বুকের সেফটিপিন
ইবলিসকে তোমার ইজ্জত শুঁকতে দিও না ইত্যাদি’।
মূলত এই আগাম-নির্দেশটুকু এটা বোঝানোর জন্য যে, মাহমুদ বিবিধ বৈপরীত্যকে সহবাসে লুব্ধ করতে পারেন— আপাত সারল্যের সাথে বিবাহ দিতে পারেন জটিলতার; বিপ্লবের সাথে যৌনতার, ‘আন্তরিক রতির দরদের’ সাথে ‘দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্ত বর্ণ পতাকা’। ‘সোনালি কাবিন’-এর যৌনতা ও বিপ্লব এবং উদ্দীপিত ভাষার হৃৎস্পন্দন এত দ্রুত যে, কে কাকে প্রেরণা জোগাচ্ছে তা বোঝা অসম্ভব। উগোল মাছের মতো নারীর কাদায় তৃপ্ত হয়ে কবি উঠে দাঁড়ান—
‘নদীর চরের প্রতি জলে খাওয়া ডাঙ্গার কিষাণ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান’
তার কাছে প্রেম ও বিপ্লব সমার্থক, পরিপূরক ও অনোন্যনির্ভর। আল মাহমুদের সাফল্য এইখানে যে, তথাকথিত গণসাহিত্যের নিদ্রাকর্ষক Platitude-গুলোকে একটি রোমান্টিক খামের মধ্যে পুরে দিয়েছেন এবং সমগ্র কবিতাপাঠ শেষে যে নবীন নওশার চিত্রটি আমাদের সামনে দুলতে থাকে তা যতটা না বিপ্লবীর তারও বেশি একজন প্রেমিকের, তবে একদিন বিপ্লবের সমাপনই হবে শ্রেষ্ঠ বাসরযাত্রা এমন একটি আশাবাদ আমাদের চোখের সামনে দোলায়িত হয়। আল মাহমুদ ‘সোনালি কাবিন’ কবিতাতেও তার স্বভাবজ তীরগুলো ব্যবহার করছেন— সমাজ পরিবর্তনের খটখটে উপযোগবাদের সাথে যৌনতার অনুপানটুকু যুক্ত না হলে কবিতাটি অপাঠ্য— হতো।
আল মাহমুদের কবিতাটি একটি প্রসারিত ড্রামাটিক মনোলোগ। চতুর্দশ সংখ্যাঙ্কিত পরম্পরায় চতুর্দশটি সনেট একটি নীরব (ধারণা হয়, নায়কের প্রগলভতায় কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত নবীনা বধূকে উদ্দিষ্ট— যার প্রতি কবি কামুকের অলজ্জ আহ্বান, ‘হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী পাটিতে আমার / এবার গুটাও ফণা কালো লেখা লিখানো হৃদয়ে; … বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী / জানতো না যা বাৎসায়ন আর আর্যের যুবতী’। সমকালীনতা থেকে বিযুক্ত করার জন্য কবি এই নারীকে স্থাপন করেছেন কালহীনতার প্রেক্ষাপটে— ইতিহাসের বিভিন্ন উন্মন্থন ও উন্মাদনার মধ্যেও যে-নারী চির পুরুষের ব্যগ্র ফলার ঘায়ে ‘উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার’, যার শরীর ‘শস্যের সুবাস’। এই নারী চর্যার শর্বরী, গলায় মালা পরে মহুয়ার মাটির বোতল নিয়ে চন্দ্রালোকে আচমন করে, বেহুলার মতো যে-নারীর ভাসানে ভেসেছে ‘দেবদ্রোহী ভাটির কুমার’।
বাঙলা-ভাষী জনগোষ্ঠীর সংগ্রামিতা, প্রাকৃতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বৈরিতা ও সংদমনের বিরুদ্ধে তার দ্রোহ, সব কিছুই চেতনার গভীরতরে শীলীভূত। যেকোনো দুর্ঘটে উসকে ওঠে সে আগুন, মানুষ বাজখাঁই গলায় প্রতিষ্ঠা করতে চায় অধিকার। সেই অর্থে ‘সোনালি কাবিন’ বাঙালি মানসের উন্মুখর দীপ্রতার পাটাতনকে ছুঁতে পেরেছে এবং হতে পেরেছে একটি বিশ্বস্ত উচ্চারণ।
৩.
‘সোনালি কাবিন’ লৌকিক জীবনের হার্দ্য-করুণ ভূমির উপর স্থাপিত। এর ভাষায় বাক্যবন্ধে গ্রামীণ জীবনের বিবিধ সৌরভ; বিবাহ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ব্রত বা রিচুয়াল আমাদের আবহমান বাংলার লোক-সংস্কারের স্মৃতির উষ্ণতা দেয়। এর সাথে যুক্ত কিছু বিদেশাহ্নত লৌকিক নৃতাত্ত্বিক অনুষঙ্গ। ফ্রেজারের ‘দ্য গোল্ডেন বাফ’-এ বর্ণিত আদিবাসী জীবনের চিত্র চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যখন মাহমুদ লেখেন ‘কবির কামনা হয়ে আসবে কি হে বন্য বালিকা / অভাবের অজগর জেনো তবে আমার টোটেম’। প্লাবনের বিপদ মাথায় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে যাদের অধিবাস সেই কৃষকদের প্রাণবন্ত জীবনসংগ্রাম উঠে আসে এমন উচ্চারণে—
‘নদী সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কি না সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার’
নদী-সন্ত্রস্ত গোর্কি-পীড়িত গ্রামজীবনের বাকপ্রতিমা উজ্জ্বল ফুটে থাকে এসব পঙক্তিতেও:
‘ক. নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
খ. ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার?
গ. গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল
ঘ. লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ু ভরা পালের দোহাই
ঙ. রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছলছল’
১৩-সংখ্যক সনেটে লৌকিক জীবনের ব্রত-পার্বণের যে চিত্র তা তুলনারহিত— বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির মূলসার বধূবরণের দৃশ্যে সমুপস্থিত, সেই সাথে ধান্য নির্ভর সমাজের বিবিধ মনস্তাত্ত্বিক প্রধাবনাও:
‘মঙ্গল কুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রামবাসী
উঠোনে বিন্নীর খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
শুভ এই ধানদূর্বা শিরোধার্য করো মহীয়সী
আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক’।
পল্লীজীবনের পশ্চাৎপট ‘সোনালি কাবিন’-এর ঔজ্জ্বল্যের নিদান হলেও আল মাহমুদ লৌকিক সারল্যকে পরিহার করেছেন সযত্নে, অন্যথায় বিপদ ছিলো তার জসিম উদদীন হবার। এর কারণও স্পষ্ট: মাহমুদের প্রতিপাদ্য গ্রামজীবন নয়, তার প্রতিপাদ্য ইতিহাসচেতনার আলোকে সম্ভাব্য বিপ্লবের আশাবাদ। শোষণহীন, ‘সম্পদের সুষম বন্টন’ সমন্বিত সমাজের স্বপ্ন এই কবিতার নাভিকেন্দ্রে; প্রেমিকাকে নিবেদন শুধু বাগভঙ্গির একটি চমকদার খোলস। মুনশিয়ানার সাথে এই প্রতারণা করতে চেয়েছেন আল মাহমুদ এবং সফল হয়েছেন। ‘সোনালি কাবিন’ মূখ্যত প্রেমের কবিতা নয় বলেই কবি নায়ককে ইতিহাস ও সমকালের পাঁচালিকারও হতে হয়েছে, সাতকাহন গাইতে হয়েছে গৌরবদীপ্ত এক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পতন ও বঞ্চনার। কবির এক হাতে বাঁশরী, অন্য হাতে ইতিহাসের পৃষ্ঠা। ৯, ১০ এবং ১১ সংখ্যক সনেটকে বলা যায় এই গুচ্ছের Interlude যেখানে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস এবং বর্তমান পঙ্গু নিষ্প্রাণতার প্রতিচিত্র। সঙ্গে সঙ্গে ঝিকিয়ে ওঠে তাঁর শাণিত বিদ্রুপের চাকু। নায়িকার গাত্রবর্ণের শ্যামশোভা যে, অনার্য ধারা ধরে বর্তমানে এসেছে, ‘একদা তারাই জেনো গড়েছিল পুণ্ড্রের নগর’ এবং
‘আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব’।
কিন্তু কবির দুঃখমথিত উচ্চারণ বর্তমান অবনমনের জন্য— ‘রাক্ষুসী গুল্মের ঢেউ সব কিছু গ্রাস করে এসে / ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে গৌতমের স্তব’ এবং বিভেদের যে আগুন আর্য-সভ্যতাকে পুড়িয়েছে, যে ‘কৌটিল্যের ঘুণ’ খেয়েছে সাম্যবাদের সকল আসবাব তার জন্যও:
‘ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার,
বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ’।
অনন্তর কবির অর্ন্তবেদনা শ্লেষের রূপ নেয়, তীব্র ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে তাঁর কণ্ঠ থেকে:
‘আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরুহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?
কি করে মানবো বলো শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই
শীলভদ্রও নিয়েছিল নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
অতীতে বাদ দিলে আজ তার কোনো কিছু নেই।
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস
আমাদের কলাকেন্দ্রে আমাদের সর্বকারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা’।
সনেট ১১
ইয়ুঙ-কথিত যৌথ-নির্জ্ঞানকে মান্য করে বলা যায়, একটি জনগোষ্ঠীর মানস প্রতিবেশ, প্রেম ও দ্রোহ, ক্ষোভ ও সংরাগ তারা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত। বাঙলা-ভাষী জনগোষ্ঠীর সংগ্রামিতা, প্রাকৃতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বৈরিতা ও সংদমনের বিরুদ্ধে তার দ্রোহ, সব কিছুই চেতনার গভীরতরে শীলীভূত। যেকোনো দুর্ঘটে উসকে ওঠে সে আগুন, মানুষ বাজখাঁই গলায় প্রতিষ্ঠা করতে চায় অধিকার। সেই অর্থে ‘সোনালি কাবিন’ বাঙালি মানসের উন্মুখর দীপ্রতার পাটাতনকে ছুঁতে পেরেছে এবং হতে পেরেছে একটি বিশ্বস্ত উচ্চারণ। বাঙালির চিরায়ত সংগ্রামিতার সাথে মাহমুদ অবশ্য বৈশ্বিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অতিরিক্ত মাত্রাও যোগ করেছেন:
‘শ্রমিক সাম্যের মন্থেও কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাঁদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা’।
৪.
‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ দিয়ে দেনমোহর শোধ করতে চান না কবি; ‘সোনালি কাবিন’ নিরলঙ্কার নয়, এর গাত্রে বহু বাচনিক অলঙ্কারের শোভা গ্রথিত। উপমা, রূপক এবং শ্লেষোক্তির সংগ্রন্থনায় গড়ে উঠেছে এই সনেটগুচ্ছের বিশিষ্ট বাকপ্রতিমানিচয়। ২—সংখ্যক সনেটে তীব্র-বিষ সাপিনীর রূপকে প্রণয়িনীকে আবাহন—
‘হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গুটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে,
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তারও চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে’।
এই প্রণয়িনীই আবার উপমিত বুনো হংসিনীর সাথে যে দেবে ‘পালক উদাম করে উষ্ণ অঙ্গের আরাম’ এবং কামনাস্পন্দিত দোঁহার মিলনের জন্য প্রকৃতি থেকে আহ্নত উপমান—
‘ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ—
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়’
কখনো কখনো নায়ক নিজেকে তুলিত করে সহিংস ব্যাধের সাথে, যখন ‘সাপিনী বিশেষ’ নায়িকার প্রতিচিত্র পাখির নিরীহ, প্যাসিভ আত্মসমর্পণে লুপ্ত হয়ে যায়— ‘ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না / নিষাদ কি কোনোদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?’ অন্যত্র নারী চিরপলায়নপরা, ব্যাঘ্রভীতা চপলা হরিণী, যে এক অর্থে শোষিত নিপীড়িদ মানব সমাজের ভীরু অসহায়তার প্রতীক—
‘প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উল্লাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো, কোন ঝোপে লুকোবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে’
সনেট ১১
বাচনিক প্রাবল্যের সহায়ক হিসাবে এসেছে অনুপ্রাসের ব্যবহার। বিশেষ্য ও বিশেষণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা noun phrase-গুলোর শরীরে ব্যঞ্জনধ্বনির পুনরাবর্তন উচ্চারণকে দেয় দীপ্তি ও সৌন্দর্য। কিছু উদ্ধার:
‘ক. পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব
খ. তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস
গ. অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা
ঘ. দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দৃপ্তবর্ণ পতাকা আমার
ঙ. যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ
চ. বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
ছ. কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে
জ. যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার
ঝ. সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক’
‘সোনালি কাবিন’-এর অন্যতম সম্পদ এর শব্দ-সম্ভার। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এর গায়ে তৎসম-তদ্ভব শব্দের সাথে লোকজ এবং মুসলিম জবানের অন্তরঙ্গ শব্দরাজির সহাবস্থান ঘটেছে। কৃষিজীবী মুসলমান সমাজের একান্ত ঘরোয়া মুখের ভাষা থেকে এ শব্দসমূহ আহ্নত হলেও, সাহিত্যের ছাত্রগণ এদের মধ্যে পুঁথিসাহিত্যের বিস্মৃত সৌরভ সহজেই শুঁকতে পারবেন। উল্লেখযোগ্য শব্দবন্ধগুলো হলো— ‘কথার খেলাপ’, ‘জবান নাপাক’, ‘নাদানের রোজগার’, ‘আমিষের নলা’ এবং ‘তালাক, ‘কসুর’, ‘বানু’, ‘নালৎ’, ‘সবক’, ‘কবুল’, ‘গতর’ ইত্যাদি। কিন্তু চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি হলো এই যে, এই সনেটগুচ্ছের শেষ অংশে লোকজ ইসলামী শব্দগুলোর উপস্থিতি অত্যধিক হলেও প্রথম নয়টি সনেটে লোকজ শব্দবন্ধ তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিক দিয়ে ‘সোনালি কাবিন’-এ লক্ষ্যযুক্ত একটি স্পষ্ট বিভাজন। শেষের দিককার সনেটগুলোতে কবির উচ্চারণে হঠাৎ এসব শব্দের তুমুল উত্থান কেন ঘটলো তার উত্তর কবিই একমাত্র জানেন; আমরা যা ধারণা করতে পারি তা হলো— প্রথম পর্বের কবির ভূমিকা অনেকটাই ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাতা ও ভাষকের। কিন্তু শেষ পর্বে ঐ ভূমিকা অবসিত হয়ে স্থিত হয় প্রেমিকের নিবেদনের মধ্যে এবং ভাষার নৈর্বক্তিকতা অপসৃত হয়ে সেখানে ব্যক্তিগত বাচনভঙ্গির আন্তরিক দরদ প্রকাশমান হয়। যেহেতু ১৩ এবং ১৪ এই দুটি প্রান্তীয় সনেটে কবি ও প্রেমিকা মুখোমুখি— ইতিহাস, সাম্যের দাওয়াত ইত্যাদি কেবল প্রয়োজনীয় পশ্চাৎপট— তখন কবির মুখোশ পরার প্রয়োজনও অবসিত। আন্তরিক উচ্চারণের টানেই উঠে আসে এমন শব্দাবলি যা মুখের ভাষা, যা অন্তরের এবং অকৃত্রিম, এমনকি অসংস্কৃত।
‘সোনালি কাবিন’-এ নাস্তিক্যের জয়গান গাওয়া হলেও উচ্চারণভঙ্গিতে, কোথাও কোথাও, স্পষ্টত কোরানের বাগভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে। কবি-নায়কের স্পষ্ট উচ্চারণ ধর্মহীনতার সপক্ষে —
‘আমারতো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্র বর্ণ অঙ্গের গড়ন।
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস’।
সনেট ৪
কিন্তু তিনি শেষ সনেটে উচ্চারণ করেন—
‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর’
তখন তার ভঙ্গিতে অনস্বীকার্যভাবে কোরানের অনুসৃতি। আল মাহমুদের তাবৎ কবিতায়ই এরকম অকস্মাৎ প্রচ্ছায়া দেখা যায় তাঁর মানস-প্রতিবেশের যা নিঃসন্দেহে মুসলিম সমাজে তাঁর বেড়ে ওঠার ফল। আল মাহমুদের ভাষার বিশিষ্টতার অন্যতম নিয়ামকও সম্ভবত সেটিই।
লেখাটি একটি দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে ৮ জুলাই ২০০৫-এ প্রকাশ হয়