আলাপচারিতা ।। হাসান রোবায়েত ও ওরা দশজন (প্রথম পর্ব)

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার পরিবেশ নেই। প্রতিষ্ঠান আর স্বঘোষিত সাহিত্য-মোড়লদের থেকে মুক্তির জন্য চাই আলাদা প্ল্যাটফর্ম আর নিজের লেখাটি লেখার এবং নিজের কথাটি বলার সাহস। এই প্রজন্মের সেই সাহস আছে। তারা প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্তিকে তীব্র আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায়। সেই বিশ্বাস থেকেই আমরা আড্ডা দেয়া শুরু করেছি। সমালোচনা করছি নিজেদেরই। শুরু করেছিলাম রাজীব দত্তকে দিয়ে।এবার আড্ডা হয়ে কবি হাসান রোবায়েতকে কেন্দ্র করে। রোবায়েতের সঙ্গে আলাপচারিতাতেও সবার কণ্ঠেই যেন ভাঙাগড়ারই আহ্বান। তা আত্মবিশ্বাসী, ক্ষ্যাপা এবং যৌক্তিক। রোবায়েতকে ঘিরে আড্ডা দিয়েছেন আরো দশজন কবি। শুধু পিঠ চাপড়ানো নয়, সমালোচনার তীব্র বাণ ছুটে গেছে তার দিকে। রোবায়েত উল্টো তীর ছুড়েছেন। আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে এমন কিছু, বাংলা কবিতা নিয়ে যেসব কথা খুব কমই হয়েছে। অথবা কখনোই হয়নি এসব কথা। রোবায়েতের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন ফয়সাল আদনান, অনুপম মণ্ডল, রাজীব দত্ত, রুহুল মাহফুজ জয়, রাসেল রায়হান, মোস্তফা হামেদী, হাসনাত শোয়েব, ফারাহ্ সাঈদ, হুজাইফা মাহমুদ ও শিমন রায়হান। এই আলাপচারিতা যতটা সাক্ষাৎকার, তারচেয়েও বেশি আড্ডা। চলুন, আড্ডা দেয়া যাক।


কবিতা তো মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে মনে হয় আমার। এইটাও আসলে এক ধরনের ভাষিক দক্ষতা। আমি তো কবিদেরকে ভাষা-প্রকৌশলী বলে মনে করি।


ফয়সাল: রোবায়েত, এইটা আমার যেকোন ফর্মাল সেটিংয়ে প্রথম সাক্ষাৎকার নেয়া। তো আপনি প্রথম সাবজেক্ট।

রোবায়েত: আমারও তেমনি। প্রথম দেয়া। হা হা!

ফয়সাল: কেমন লাগছে এরকম একটা ব্যাপার? মানে সাক্ষাৎকার?

রোবায়েত: ভালোই। তবে অন্যরকম। ঐ কিছুটা নার্ভাস টাইপ আর কি!

ফয়সাল: আমার প্রথম সিরিয়াস প্রশ্ন, কবিতার কম্যুনিকেটিভ হওয়াটা কত গুরুত্ব রাখে আপনার কাছে?

রোবায়েত: কোনো গুরুত্বই রাখে না। কবিতা একটা মায়া। তো এইটারে আসলে কানেক্ট করা বা না করার কিছুই নাই। সেইটা যে যার যার মতো করে নেয়। না করে নিলেও কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

রাজীব: মায়া বলতে কি বুঝতে চান?

রোবায়েত: এক ধরনের টান। যেইটা আসলে ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব না মনে হয়।

ফয়সাল: তাহলে কবিতা আর পাঠকের মাঝে দূরত্ব রাখতে চান আপনি এমন কি ধরে নিবো? কবিতার ভাষা বিষয়ে তাহলে কি ভাবনা আপনার? ভাষাকে আপনি ঠিক কিভাবে ডিকন্সট্রাক্ট করতে  চান আপনার কবিতায়? বা আদৌ চান কিনা? আর মায়া তো একটু ভ্যাগ হয়ে গেলো, স্পেসিফিক হওয়া যায়?

রোবায়েত: ফয়সাল ভাইয়ের অনেকগুলো প্রশ্ন। আমি একটু সময় নিয়ে বলি।

ফয়সাল: হাহা, নিশ্চয়! সরি ফর বোম্বার্ডিং।

রোবায়েত: কবিতা আর পাঠকের মাঝে দূরত্ব তো থাকেই। টেক্সট হয়তো কখনোই পুরোপুরি ধরা দেয় না। আমি আসলে ইচ্ছা করে হয়ত দূরত্ব ক্রিয়েট করি না। টেক্সট নিজেই সেটা করে নেয়। তবুও তো কেউ কেউ তার দেখা পায়। আর ভাষার মাঝেই আমি আসলে বেঁচে থাকি। আমার ভাষাও আমি তৈরী করতে চাই একদম নিজের মতো করে। মানে, নিজের অ্যালগরিদমে। এই সেলফ অ্যালগরিদমটা মনে হয় ব্যক্তি টু ব্যক্তি আলাদা।

ভাষাকে ডিকন্সট্রাক্ট কীভাবে করতে চাই! সেইটাও ঐ নিজস্ব অ্যালগরিদমেই। আমি আসলে সিন্ট্যাক্স প্যাটার্ন নিয়ে প্রচুর ভাবি। সেইখানে যত ধরনের প্রোবাবিলিটি আছে সেইটারে ইউজ করতে চাই।

ফয়সাল: এমনটা আমারো মনে হয়েছিলো। মিলে যাচ্ছে।

রোবায়েত: মিলে যাচ্ছা বলে আমারও মজাই লাগতেছে। তবে মায়ার ব্যাপারে আর বোধ হয় সিগনিফিকেন্ট হইতে পারবো না। হা হা

রাজীব: টেক্সট হয়তো পুরাপুরি ধরা দেয় না – এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে।

রোবায়েত: নিশ্চয়ই রাজীব দা!

রাজীব: টেক্সট কিন্তু অনেক রকম। না?

রোবায়েত: অবশ্যই অনেক রকম। আমি যখন টেক্সট কথাটা উচ্চারণ করছি, তখন আমার টেক্সটকেই বোঝাতে চাই রাজীব দা।

রাজীব: ধরেন, গুণের টেক্সট- আই মিন কবিতা তার কি কোনো আড়াল আছে? আমার তো নাই  নাই লাগে। তো তার টেক্সট কিন্তু পুরাপুরি পাঠকের নাগালেই। কিন্তু উৎপলে (উৎপলকুমার বসু) গেলে হয়তো নাগাল থেকে দূরেই সরে যায়। তো টেক্সট পুরাপুরি ধরা দেয় না, এটা কি ঠিক?

রোবায়েত: আমি আমার নিজের টেক্সট নিয়ে এমন বলতে চাই রাজীব দা। আরো আরো টেক্সট আমার এই মন্তব্যের সাথে যায়।

ফয়সাল: ফয়সাল: ‘ঠিক’ কি উচিৎ অর্থে বললেন রাজীব?

রাজীব: রাইট কি-না বোঝাতে চাচ্ছিলাম। দেখলেন আমার টেক্সটও পুরাপুরি ধরা দেয় নাই।

ফয়সাল: আপনার কবিতায় আমি বিভ্রম, হেঁয়ালির ব্যবহার যেমন দেখেছি, এগুলো কি আপনি আলাদা করে ক্রিয়েট করেন, নাকি এভাবেই আপনার কবিতাগুলো হচ্ছে নিজেই? আই মিন কবিতা কি এভাবে মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে ভাবেন?

রোবায়েত: আমার কবিতায় বিভ্রম এমনিতেই আসে হয়তো। সম্ভবত আমরা যেটাকে রিয়্যালিটি বলে জানি, সেইটাও এক ধরনের অ্যাপারেন্ট রিয়্যালিটি। সো, বিভ্রম আসলে এমনিতেই ঢুকে পড়ে। কবিতা তো মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে মনে হয় আমার। এইটাও আসলে এক ধরনের ভাষিক দক্ষতা। আমি তো কবিদেরকে ভাষা-প্রকৌশলী বলে মনে করি।

ফয়সাল: আমি অবশ্য এভাবে দেখি যে ভাষা-প্রকৌশল কবিতার জন্য দরকার। তবে মেকানিক্যালি বা বানায়ে কবিতা হওয়াটা ডিফিকাল্ট, কবিতার কাব্যগুণ বা ফ্লুয়েন্সি তাতে আটকায়। যাই হোক – যত মত, তত পথ। পাসিং দ্য ফ্লোর টু অনুপম।

অনুপম: আপনি বলছেন ভাষা অর্থের দিকে যেতে চায়। আপনি এ দ্বারা কি বোঝাতে চাচ্ছেন? মানে ভাষাটাকে কোন দিকে নিতে চাচ্ছেন আপনি?

রোবায়েত: এইটা আমার একটা কবিতার লাইন ছিল। আমি এইটারে একটা শব্দ দিয়ে বলছিলাম, অহেতুক অর্থের দিকে যাইতে চায়। তো, সিমান্টিক্স নামে ভাষাবিজ্ঞানের একটা শাখা আছে। ওরা কিন্তু বলতেছে যে, অর্থ হইলো সবচে কুটিল। এইটা কার কাছে যে কীভাবে ধরা দেয়, তার ঠিক নাই। তো, আমি যখন অর্থের কথা বলি সেইটারে একটা ব্যারিয়ার মনে হয় আমার। আমি কবিতায় কোনো  ব্যারিয়ার রাখতে চাই না। ভাষাকে আমি সম্ভবত ইনফিনিটির দিকে নিতে চাই। যার যার ভাষা সে তার মতো করে কানেক্ট করুক। আমার মতো করে নয়।

অনুপম: ইনফিনিটি বলতে? অর্থের দিকে যেতে না দেয়ার কি না অর্থের দিকে নেয়া নয়?

রোবায়েত: ঐ যে, যার যার ভাষা। আমার বোঝা হয়ত আমার কাছে ঠিক। অন্যের কাছে তা নাও হইতে পারে। মানে, এইখানে, ইন্ডিভিজুয়াল সুপার সেট বলে কিছু নাই। সবই আসলে সাবসেট। অর্থের দিকে যেতে না দেওয়া আর না নেওয়া তো একই রকম অনুপম। শুধু সাবজেক্ট চেঞ্জ হয় আর কি!

অনুপম: আরো এক জায়গায় আপনি বলছেন ভাষার কোনো দায়িত্ব নেই আমাকে অযোগ্য করে  তোলা ছাড়া। মানুষই তো ভাষা তৈরি করে। তাহলে কথাটার ভিত্তি কি?

রোবায়েত: অযোগ্যতার উত্তর সম্ভবত ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’র প্রথম কবিতার প্রথম লাইন। ‘এতটা বৈমাত্রেয় কেন এই ভাষা!’ আসলে আপনি যা বলতে চান তা কি বলতে পারেন সব সময়? ভাষা সেইখানেই আমাকে অযোগ্য করে তোলে। আমার সাবকনসাস, আনকনসাসকে ভাষা সব সময় ধরতে দেয় না। মানুষের নিজের তৈরীর কাছে মানুষ তো অসহায় হইতেই পারে। যেমনটা মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইন।

অনুপম: কবিতা কি আসে না বানাতে হয়?

রোবায়েত: দুইটাই। আমার কাছে আসে তারপরে আমি বানাই।

ফয়সাল: আমার এইখানে একটা সম্পূরক প্রশ্ন থাকে অনুপমের কাছে, কবিতা আসলে ‘আসে’টা কিভাবে? এইটা তো ওহী হইতে পারে না, নাকি পারে?

অনুপম: আমি আরোপিত আর স্বাভাবিকতার পার্থক্য বলতে চাইছি আসলে।


আমি তাকেই ভালো কবি বলি যার নিজস্ব ভাষা আছে এবং সেগুলো কবিতাও হয়ে ওঠে।


জয়: রোবায়েত, ভাষাই কি কবিতার প্রধান অস্ত্র?

রোবায়েত: নিশ্চয়ই। যেহেতু ভাষা দিয়ে এর সারফেসকে প্রকাশ করা হয়।

রাসেল: আপনি বললেন, কবিতা বানান। সেটা কবিতার জায়গায় কতটা উচিত (!), কিংবা বৈধ (!)? বৈধ হলে বোধের জায়গাটাকে কীভাবে দেখবেন? অনেকেই অভিযোগ করেন, আপনার কবিতার সাথে মাথার সম্পর্ক, হৃদয়ের না।

ফয়সাল: মানে ইংরেজিতে বললে অর্গানিক আর মেইড আপ, এইটাই দেখা যাচ্ছে রোবায়েতের কবিতা নিয়ে প্রধান আলোচনা কেন্দ্র আজকের!

রোবায়েত: এমন অভিযোগ তো বহু পুরোনো, আমার ক্ষেত্রে। বানানো বা না বানানোটা আসলে কিছুই না, পড়ার পরে পাঠকের কাছে সেইটারে কবিতা বলে মনে হয় কি-না সেইটাই আসল। আর পাঠক তো অজস্র। কে কোথায় কখন আমার কবিতা পড়ছে তা তো আমি জানি না। একই টেক্সট হয়তো ‘ক’ এর কাছে মনে হচ্ছে বানানো কিন্তু ‘খ’ এর কাছে মনে হচ্ছে স্পন্টেনিয়াস। সো, এইটারে আমি অতটা গুরুত্ব দিই না। হা হা!

রাসেল: পাঠকের ভূমিকায় উত্তর দিলে? মানে আপনি পাঠক হিসেবে?

রোবায়েত: মানে আমি যখন নিজেই আমার কবিতার পাঠক, সেক্ষেত্রে?

রাসেল: উঁহু, যে কারো, যার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ।

রোবায়েত: আমি সেই কবিতাকেই ভালো বলি, যা একই সাথে নতুন আর আমাকে কবিতার স্বাদ দেয়। কবি সেইটাকে কীভাবে তৈরী করেন সেইটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা একদমই নাই। আপনার এই প্রশ্নটা গ্রিকদের প্যারাডক্সের মতো যে, ঈশ্বর কি এমন পাথর বানাতে পারবেন যা তিনি নিজেই উঠাতে পারবেন না।

রাসেল: সম্ভবত ভাষা নিয়ে সব থেকে বেশি প্রশ্ন করা হচ্ছে আপনাকে। সেটা স্বাভাবিকও। আচ্ছা, স্বতন্ত্র একজন থার্ড ক্লাস কবি (নাম বলা যায়, বলব না), আর ভালো কবিতা লেখে, এমন একজন নিজস্বতাবিহীন কবি – এর মধ্যে কাকে এগিয়ে রাখবেন? কেন?

রোবায়েত: আমি তাকেই ভালো কবি বলি যার নিজস্ব ভাষা আছে এবং সেগুলো কবিতাও হয়ে ওঠে।

রাসেল: আমার বউ মাদ্রাসায় পড়া। আমার মনে আছে মেলার সময় সে ৩/৪ জনের বই পড়েছিল, যার মধ্যে সে আপনার কবিতাগুলোতেই বেশি মুগ্ধ হয়েছিল। অথচ সে ঐ অর্থে কবিতা পড়ে না। তো যে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠে আপনার বিরুদ্ধে, সেটা বোধ হয় এখানে খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। কিংবা দুর্বোধ্যতার পরেও আপনার কবিতা সুখকর (এটা আমার মত)। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি এই সুখটাকে কবি হিসেবে কতটা প্রাধান্য দেন? আর পাঠক হিসেবে?

রোবায়েত: কবি হিসেবে আমি ঐটা নিশ্চয়ই এনজয় করি। অনেকেই আমাকে এমন বলেছে, তিনি কিছুই বোঝেননি কিন্তু তার অন্যরকম ফিল হয়েছে। এক ধরনের মায়ার সন্ধান তিনি পেয়েছেন। তো, এইটাও মনে হয় আমার ভাষার জন্যই।

ফয়সাল: অভিযোগ আমলে নেওয়ার কিছু নাই, কৌতুহলকে এনকারেজ করা হোক। রাসেলের ‘অভিযোগ’ প্রসঙ্গে একটি সাইড কমেন্ট।

রোবায়েত: হা হা

রাসেল: নিশ্চিত নন?

রোবায়েত: কে আর নিশ্চিত! আমার থট প্রসেস তো আর তার না। হাহা

রাসেল: একটু ভাষা থেকে সরি। ননসেন্স টাইপ প্রশ্ন; ধরেন, সামনের বছর জানতে পারলেন যে আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেছেন। কী করবেন?

রোবায়েত: প্রথমেই একটা পুদিনাপাতার চা খেতে চাইবো। তারপর, আব্বুকে ফোন করে বলবো, বাবা, আজ তোমার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। হা হা

রাসেল: তারপর?

রোবায়েত: আপনার এই তারপর শুনে, হেমন্তের একটা গান মনে পড়তেছে। ‘তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা।‘ হা হা

ফয়সাল: পুরস্কার কি গ্রহণ করবেন? করলে কেন বা না করলে কেন না?

রোবায়েত: মেবি গ্রহণ করবো না।

রাসেল: আপনার কবিতায় আরবি শব্দের ব্যবহার এত বেশি কেন?

রোবায়েত: আমি তো মাদ্রাসায় পড়ছি রাসেল। সেই জন্যই হয়তো আরবী আসে।

রাসেল: আপনার বই পড়তে পড়তে শেষে একটা অপ্রত্যাশিত চমক আছে, অন্তত আমার কাছে। ছন্দের একটা কবিতা, দীর্ঘ। এখানে কি পরোক্ষ কোনো মুন্সিয়ানা দেখানোর ইচ্ছা ছিল?

রোবায়েত: ‘ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান’ লিখেছিলাম নিজের দমটাকে দেখার জন্য। আমি তো প্রায় ছোট ছোট করে লিখি তো ঐটাকে বড় করতে চাইছিলাম।

জয়: কবিতায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার কিভাবে দেখেন, বা ভাষাগত রূপান্তরের বা অনুবাদের জরুরৎ রাখে কিনা এই বিদেশী শব্দগুলা?

রোবায়েত: শব্দ আমার কাছে জাস্ট শব্দ। বিদেশি না দেশি তা আমি ভাবি না। আমি তা-ই ব্যবহার করতে চাই যা আমার অ্যালগরিদমকে সাহায্য করে। নট নেসেসারি যে সেগুলোর পরিভাষা হোক।

ফয়সাল: আপনার কি কখনো মনে হয়েছে এই এলগরিদমের সাথে থাকার চেষ্টা, আপনার কবিতাকে ছাঁচে ফেলে দিচ্ছে, নতুনত্বের পথে বাধা দিচ্ছে?

রোবায়েত: এইটা মজার প্রশ্ন ফয়সাল ভাই। একটু তো ছাঁচে ফেলে দেই-ই। সম্ভবত এই ছাঁচ আমি আরো কিছুদিন পছন্দ করবো। তবে, আমার নেক্সট বইটা অন্য রকম ফর্মে কথা বলবে। আর আমি তো প্রচুর লিখি। বিচিত্রও লিখি বোধ’য়। তাই এটা নিয়ে ভাবি না।

ফয়সাল: আপনার সেলফ কনশাসনেস ভালো লাগলো রোবায়েত। চিয়ার্স!

রাসেল: শব্দ জাস্ট শব্দ কেমনে? আপনি কিন্তু ফ্রেঞ্চ কিংবা হিব্রু ব্যবহার করছেন না। এমন শব্দ ইউজ করছেন যা আসলে পাঠক জানে। তার মানে কি এটা হতে পারে না, পাঠককেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে?

রোবায়েত: না রাসেল। আমি তো জানি না পাঠক কোন শব্দটা জানে আর কোনটা জানে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি আমার র‌্যান্ডম সিলেকশনকে গুরুত্ব দিই।

হামেদী: সবাই শুরু থেকেই ডিপে ঢুকে পড়ছে।আমি হাল্কা চালে শুরু করতে চাই।তারপর অন্যান্য প্রসঙ্গে যাব। আপনি কবিতার লাইনে আসলেন কবে? মানে, শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।

রোবায়েত: কবিতার লাইনে আসাটা বেশ মজার। নাইন-টেনে আমার ক্লাশের এক মেয়েকে ভালো লাগতো। তো, তারে কিছু লিখে পটাইতে চাইছিলাম। তো সেও পটলো না আর আমার লেখালিখিরও পটল তোলা হলো। এর অনেক দিন পর যখন ফেসবুকে আসি। তখন আনফরচুনেটলি একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে কবিদের লিস্টে ঢুকে যাই, তাদের কবিতা রোজ রোজ ভাইসা আসতো, সেসব দেখেই মনে হলো, এ আবার এমন কি! লেখাই তো যায়! এই শুরু।

হামেদী: তার মানে মানুষ যে বলে- প্রেমে পড়লে লোকে কবি হয়ে যায়।এই কিংবদন্তি আপনার সাথে মিলে গেছে।হা হা হা

রোবায়েত: না না মেলে নাই। চিঠি লেখার সাহস হইতো না। পা কাঁপতো। তাই এই অন্য লাইন ধরা আর কি! সে অর্থে আমি তখন চিঠিই লিখতাম আসলে কবিতা না।

হামেদী: মানে অপ্রকাশের ভারটা কবিতার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন।

রোবায়েত: সেই রকমই। তখন থেকেই বোধ হয় আমি আড়াল চাইতাম টেক্সটে।

ফয়সাল: আড়ালটাই কবিতা।

রোবায়েত: তারে সেই সময় লিখছিলাম, ‘রাত্রির মগডালে বসা তোমার চোখের পাখিটাই বুঝি প্রেম’।

হামেদী: নারী তাইলে সাবজেক্টিভ না হয়ে অবজেক্টিভ হিসাবে আসল আপনার কাছে?

রোবায়েত: হ্যাঁ। আমি সাবজেক্ট করতে চাইনি। অবজেক্টই করতে চাইছি সব সময়। বাংলা কবিতায় নারী তো প্রায় সব সময়ই সাবজেক্ট ছিল।


সেই আর্টিস্টই বড় যিনি প্রচুর নিতে পারেন। কিন্তু সেগুলো নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।


হামেদী: গুড। শুরু থেকেই বাংলা কবিতারে উল্টাইয়া দেওয়ার একটা ফিকির ছিল আপনার মধ্যে?

রোবায়েত: সে তো ছিলই।

হামেদী: যাই হোক, প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আপনি একটা ঘটনার প্রসঙ্গ টানছিলেন।ঐটা একটু বিস্তার করেন।

রোবায়েত: হা হা। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। জুন মাসে গ্রীষ্মের ছুটি ছিল। বগুড়ায়  গেলাম। ওখানে ‘পড়ুয়া’ নামে বিখ্যাত বইয়ের দোকান আছে। একজনকে একদিন দেখলাম হাতে অনেকগুলো কাগজ। সবগুলোই হাতে লেখা। তো আমার একটু কৌতুহল হল উল্টে-পালটে দেখার। উনি যখন কাগজগুলো টেবিলের উপর রাখলেন, সুযোগও পেয়ে গেলাম। দেখি সবগুলোতেই হিন্দু নাম। আমার তো ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী? উনি উত্তর দিলেন, এইগুলা হলো কবিতা, আসছে সুদূর কোলকাতা থেকে। আমার তো উনাকে বিরাট লোক মনে হইলো। বাপরে কোলকাতা! তখন তো কোলকাতা আমার কাছে সেই ব্যাপার! আমি বলে কয়ে উনার ফেসবুক আইডি নিয়ে বন্ধু হলাম। তারপর দেখে দেখে কোলকাতার কবিদেরকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তখন থেকেই মূলত আমার ওয়ালে খালি কবিতা আসা শুরু করলো। ঐগুলো দেখেই ভাবলাম, এ লেখা আবার এমন কঠিন কী! এইটা ছিল একদম শিশুসুলভ ব্যাপার। হা হা!

হামেদী: আপনার শুরুটা বেশ ইন্টারেস্টিং।আপনি কলকাতা হয়ে ঢাকায় ঢুকলেন।এইটা আপনার কবিতার মেজাজ নির্ধারণে কোনও প্রভাব রাখছিল কি-না শুরুর দিকে? এখনও বা ঐটার প্রতিক্রিয়া কতটা কাজ করে আপনার মনে?

রোবায়েত: মেজাজ নির্ধারণে ভূমিকা কিছু রাখছিল মনে হয়। এখন তেমন কাজ করে না।

হামেদী: কী রকম সেটা? খোলাসা করেন।

রোবায়েত: থট প্রসেসে। আর কোনো ভূমিকা রাখেনি মনে হয়।

হামেদী: আচ্ছা । এবার অন্য প্রসঙ্গে যাব। ‘মৌলিক কবি’ বা ‘মৌলিক কবিতা’ এই টার্মগুলি লজিক্যাল কি না? মৌলিক কবিতা লিখতে পারা আসলে কতটুকু সম্ভব?

রোবায়েত: না, লজিকাল না। প্রেজেন্টেশনের ভিন্নতাকেই আমরা হয়তো মৌলিকতা বলি। আর্ট আসলে মৌলিক নয়। আগের আর্টিস্টদের প্রভাব পড়বেই। আমরা তো আসমান থেকে পড়ি নাই কেউই।

হামেদী: তার মানে এইটা একটা ধারাবাহিক প্রসেস।আমি এক সাক্ষাৎকারে শাহ মাইদুল ইসলামরে বলছিলাম – আমরা হচ্ছি আসলে পরম্পরার সন্তান।এইরকম কি-না?

রোবায়েত: নিশ্চয়ই। সেই আর্টিস্টই বড় যিনি প্রচুর নিতে পারেন। কিন্তু সেগুলো নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।

রাজীব: পিওর আর্ট বলতে আসলে কিছু নাই।

হামেদী: ভাষা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন হয়ে গেছে এর মধ্যে। আমার এটা ঠিক ঐ অর্থে প্রশ্ন না। মন্তব্য আকারে নিতে পারেন।কিছু সংযোজন বা দ্বিমতও করতে পারেন।
**
প্রত্যেক কবির-ই ন্যূনতম কবিকল্পনা, কাব্যবোধ এই ব্যাপারগুলো থাকে।আমার মনে হয়, কবি সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েন ভাষা নিয়ে।বলা যায়, কবির দ্বৈরথ-ই মূলত ভাষার সাথে। আপনার মধ্যেও এই টানাপোড়েনটা বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়।আপনার কবিতা থেকেই কোট করি,

‘এতটা বৈমাত্রেয় কেন এই ভাষা’ কিংবা ‘ফুলের গর্ভে তার ভাষা ঝুলে আছে’ অথবা ‘ভাষা-অহেতুক অর্থের দিকে যেতে চায়’। ভাষাকে একটা স্বতন্ত্র ক্যারেকটার হিসাবে পাচ্ছি আপনার কবিতায়?

রোবায়েত: আমি ভাষার মধ্যেই বাস করি। আমার যত দ্বৈরথ ভাষার সাথেই, আইডিয়ার সাথে না।

হামেদী: রবীন্দ্রনাথের বিজয়িনী, জীবনানন্দের বনলতা সেন-অরুণিমা সান্যাল, বিনয় মজুমদারের চাকা, আপনার রোশনি আক্তার আলাদা কোথায়? এটা কি কেবলই নামের উল্লেখ? নাকি এর মর্মগত কোনও তাৎপর্য আছে?

রোবায়েত: নামের উল্লেখ নিশ্চয়ই না। এর মর্মগত তাৎপর্য তো আছেই। এই ক্যারেক্টারকে ঘিরে আমি অনেক কিছুই সৃষ্টি করতে চেয়েছি।

হামেদী: মানে এইটা আপনি সিম্বল হিসাবে ধরতেছেন?

রোবায়েত: ঠিক সিম্বল না। এইটা এক ধরনের আশ্রয় বলতে পারেন। এক ধরনের আইডিয়াল নারীও ভাবতে পারেন।

হামেদী: আপনি সাইলেন্স শিকার করতে চান। কখনও ইমেজ নিয়ে খেলেন। আবার কখনো বা বিমূর্তায়নের আরোহী। তো এই ব্যাপারগুলো তো জীবনানন্দ দাশ, জহরসেন মজুমদার, উৎপলকুমার বসুরা বেশ ভালোভাবেই চাষ-বাস করে গেছেন। আপনার ফসলের রং-ঘ্রাণ এদের থেকে কোন জায়গায় ভিন্ন?

রোবায়েত: ভিন্ন কি-না সেইটা আমি বলতে পারবো না। আপনার কী মনে হয়?

হামেদী: আপনার সিনট্যাক্স আলাদা।শব্দ জগতটাও আলাদা।কিন্তু আপনি চাপ বোধ করেন কি-না এই বিষয়গুলো নিয়ে ডিল করতে, যেহেতু আগে অনেক কাজ হয়ে গেছে?

রোবায়েত: না। আমি চাপ বোধ করি না। ঐ যে আপনি বললেন আমার সিন্ট্যাক্স আলাদা, শব্দ-জগতটাও আলাদা। সেইটার জন্যই আমি আলাদা হয়তো।

ফারাহ্: কবিরা এতো আত্মহত্যাপ্রবণ কেন হন?

রোবায়েত: কারুবাসনার ক্লান্তির জন্য।

রাজীব: আমার তো মনে হয় না। কয়জন আর করেছে! কি আরামে থাকে।

ফারাহ্: ‘শিরিন ওসমান’ আপনার একজন পাঠক ইদানিং মন্তব্য করেছেন যে আপনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেও, লোকে আপনাকে কবি বলেই চিনবে। আপনার অনুভূতি কি ? কখনো ভেবেছেন কি  লেখা ছেড়ে দেবেন ?

রোবায়েত: অনুভূতি নাই। এসব আমাকে তেমন টাচ করে না। তবে লেখা ছেড়ে দেবো কিনা ভাবিনি। যদি কখনো দেখি আর পারছি না, তখন প্রকাশ করবো না। কিন্তু নিজের খাতায় হয়তো ঠিকই লিখবো।

ফারাহ্: আপনার কবিতায় সুইসাইড ঘুরে-ফিরে আসছে।

রোবায়েত: সুইসাইড একটা রোমান্টিক কনসেপ্ট মনে হয়। যা সবার ভেতরেই থাকে, আমার ভেতরেও আছে।

ফারাহ্: বাক্ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শাহানা আপা’ কবিতাটি প্রায় সব পাঠকই রোমান্টিক কবিতা বলে ধরে নিলেও, আপনি সম্ভবত বলেছেন সেটা ঠিক নয়। লেখক ও পাঠকের এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

রোবায়েত: পাঠক যেভাবে নিছে সেইটা পাঠকের বোঝা। এইখানে আমার কিছু করার নাই। কবি-পাঠকের সম্পর্কটা আসলে রেসিপ্রোকাল। যার যার মতো করে কানেক্ট করে বা করে না।

ফারাহ্: আপনি কি ব্যর্থ তাহলে? অলমোস্ট কেউই আপনার মতো ভাবে না (শাহানা আপা?)।

রোবায়েত: সফলতা বা ব্যর্থতা কবিতায় নাই।

ফারাহ্: কিন্তু টোটালিটি ব্যবহার না করে কবি কি বেশিদূর যেতে পারেন?

রোবায়েত: আমি জানি না পারে কিনা! আমি যাবো, এইটা আমার রাস্তা।

ফারাহ্: আপনি ইমেজ তৈরি করেন কবিতায় , অনেক কবিতায় এইসব দৃশ্যকল্পের একের সঙ্গে অন্যের (একই কবিতায় বাক্যগুলোতে) কোন যোগাযোগ নেই। কিভাবে এইসব কবিতার অবতারণা?

রোবায়েত: যোগাযোগ থাকাটা কি জরুরি? আমি মনে করি না। এইখানেই আমার কাজ আসলে। একটা চায়ের আড্ডায় নানান রকম প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু সব শেষে সেইটা আড্ডাই। আমি স্ট্যাব্লিশড টোটালিটিকে অস্বীকার করি।

ফারাহ্: কবিতায় কখনও স্ল্যাং ব্যবহার করেছেন? অন্য কবিদের লেখাতে স্ল্যাং-কে কিভাবে দেখেন?

রোবায়েত: স্ল্যাং খুবই পছন্দ আমার। এইটা নিয়ে প্রচুর ভাবছি। ফাইনেস্ট ইউজ এখনো করতে পারিনি।একদিন হয়তো পারবো। আর যারা করেন তাদের ব্যবহার যদি পুরনো না হয় তবে ভালো লাগে।

ফারাহ্: কবি কি সত্যি দায়মুক্ত? দেশ/সমাজ/পাঠক বা অন্য কিছু থেকে?

রোবায়েত: না। সেও যেহেতু পলিটিক্যাল পার্সন সুতারাং মুক্ত নয় হয়তো।

ফারাহ্: শুধু দেশ/সমাজ নয়, পরিবার/আপনজন ওদের থেকেও?

রোবায়েত: পরিবার একেক জনের কাছে একেক রকম। মনে হয় না মুক্ত। অন্য মানুষের মতো কবিও পরাধীন।

হুজাইফা: জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত শব্দটি,” বিপন্ন বিস্ময়” এর যথাযথ একটি রূপ খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি বহুদিন। শেষমেষ এক ধরনের অবশ অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই আসেনি আমার মনে। আপনি এর কোন অর্থ জানেন?

রোবায়েত: না । এইটা আসলে অদ্ভুত কম্পোজিশন। ক্লাসিক মিউজিকের মতো। অসহায় করে তোলে কিন্তু উত্তর দেয় না।

হুজাইফা: আমার মনে হয়েছে, সমগ্র জীবনানন্দই আসলে এই শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়! গাঢ় অনুভব, কিন্তু অব্যক্ত! আপনি কি বলবেন?

রোবায়েত: আমারও তাই মনে হয়।


কত ওজনের শব্দের পর কত ওজনের শব্দ বসলে সেইটা হারমোনাইজড হবে এইটার একটা বিদ্যা বলতে পারেন ছন্দকে।


জয়: ব্যাখ্যা কোন?

রোবায়েত: বিপন্ন বিস্ময়ই আমাদের ক্লান্ত করে। এইটার মেটারিয়ালিস্টিক ব্যাখা দেয়া যেতে পারে কিন্তু সেদিকে যাচ্ছি না জয় ভাই।

হুজাইফা: ছন্দ নিয়ে আপনার কাজ কিন্তু কম না। মোটামুটি ভালই! ছন্দটাকে কিভাবে দেখেন? কেবলই একটি টুলস? নাকি এর আলাদা কোন তাৎপর্য আছে?

রোবায়েত: আলাদা কোনো তাৎপর্য আছে কি-না জানি না। তবে বাংলা ভাষার নার্ভ ধরতে বাংলা ছন্দ কাজে দেয় নিশ্চয়ই। এইটা আসলে বাংলা ভাষার মিউজিককে ডেনোট করে।

হুজাইফা: একটু ব্যাখ্যা করবেন? কখনোও তো এমন হয়, নিছক ছন্দের কারণে কবিতার এন্টায়ার মিউজিক ফল করে! মানে ছন্দ বজায় রাখতে গিয়ে বিভিন্ন কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। যার ফলে কবিতার ন্যাচারাল ফ্লো-টা থাকে না! আমার কাছে এমন মনে হয় আরকি কখনো কখনো!

রোবায়েত: ভাষার একটা নিজস্ব হারমোনি থাকে। যেমন ধরেন, বাংলা ভাষায় ৪ অক্ষরের বেশি শব্দ খুব একটা নাই। তো এই শব্দগুলোর অ্যাসিমিলেশন কীভাবে হবে। কত ওজনের শব্দের পর কত ওজনের শব্দ বসলে সেইটা হারমোনাইজড হবে এইটার একটা বিদ্যা বলতে পারেন ছন্দকে। আমাদের মধ্যযুগের কবিতায় কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রচুর আছে। ইনফ্যাক্ট সবই ঐ রকমই আর কি! জীবনানন্দও তো প্রায় সবই লিখেছেন ছন্দে। তো, এইটা ব্যারিয়ার না। চর্চার বিষয়।

হুজাইফা: আমাদের কবিতায় ট্র্যাডিশন ও মিথের ব্যাবহার কিরূপ হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?

রোবায়েত: একদমই তছনছ করে। মিথ আর ট্রাডিশান যদি তার পুরনো রূপ নিয়েই হাজির হয় তাকে আমি চর্বিত চর্বনই বলতে পারি জাস্ট। কিন্তু যদি সেইটা আসে নতুন করে ‘নতুন মিথ’ হয়ে ওঠার প্রভোকিং ক্যারেকটারিস্টিক্স নিয়ে তবেই সেটা করা যায়। না হলে ঐ যেই লাউ সেই কদুই হবে! ট্রাডিশনাল জিনিসপত্র আমিও ইউজ করছি তবে ডিকন্সট্রাক্ট করে।

হুজাইফা: কিন্তু মিথ কে মিথের জায়গায় রেখে,বা ট্র্যাডিশনকে তার জায়গায় রেখেও কিন্তু কাজ হয়েছে প্রচুর। এবং সেগুলো একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না কিন্তু! আমার তো মনে হয় তারপরও অনেক স্পেস থাকে, যেটা নিয়ে কাজ করা যায়!

রোবায়েত: আমি আমারটা বললাম।

হুজাইফা: আপনি যদি একেবারে তছনছ করে দেন, তাহলে সেটা মিথ বা ট্র্যাডিশন হিসেবে কতটা বাকি থাকবে? তখন কি সেটাকে মিথের ব্যাবহার বলা যায়?

রোবায়েত: যাবে। কারণ সিম্বলগুলো তো মিথেরই উপাদান।

হুজাইফা: হা হা হা। এখানে বোধহয় আরও আলোচনার স্পেস আছে, তবে আমি আর সেদিকে যাবো না।

রোবায়েত: গেলেও যাইতে পারেন। হা হা! আমাদের আব্দুল মান্নান সৈয়দেই এমন আছে।

জয়: রোবায়েত মনে হয় একটু ব্যাখ্যা দিতে পারো।

রোবায়েত: যেমন ধরেন,
“এই রাত্রিরা বেথেল্‌হাম্‌-কে ব্রথেলে পরিণত করে”
”জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন, জলবায়ুহীন মুণ্ডু’’

এইখানে বেথেলহাম আর জল্লাদ একটা মিথের আরেকটা ট্রাডিশনের কিন্তু কেমন অদ্ভুত ভিন্নভাবে আসছে।

হুজাইফা: রিলকের “অর্ফিউস” সনেটগুচ্ছ যদি ধরেন, তাহলে সেটা অসাধারণ একটি কাজ। কিন্তু আমার মনে হয় না তিনি সেখানে ডিকন্সট্রাকশন করেছেন!

রোবায়েত: রিলকের সময়টায় কিন্তু মিথের ব্যবহার প্রচুর ছিল। জোসেফ ক্যাম্পবেল মিথের এইসব নানান সামাজিক ব্যবহার নিয়ে বলছেন।

হুজাইফা: মিথকে মিথের যায়গায় রেখে কি অসাধারণ লিখেছেন বুদ্ধদেব!

রোবায়েত: আমি অবশ্য বুদ্ধদেবের দিকে আর যাইতে চাই না যখন মান্নান সৈয়দ এইসব নিয়ে নতুন কাজ করছেন।

হুজাইফা: হা হা হা…কবিতায় এ্যাবসার্ডিটি অনেকটা আবশ্যকীয় রূপ ধারণ করেছে, সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ব্যাপারটা যখন অ্যাবসার্ডিটি অব অ্যাবসার্ডিটি বা বিমূর্ততার বিমূর্তায়নের পর্যায়ে চলে যায় তখন বিষয়টা অনেকটা টাফ হয়ে যায় না পাঠকের জন্য? আমার মনে হযেছে আপনার বহু কবিতায় এই বিষয়টা আছে।বিশেষ করে আগের কবিতাগুলোতে।

রোবায়েত: আমি কি জানি পাঠকের জন্য কোনটা টাফ আর কোনটা সহজ! আমি শুধু নিজের লেখাটাই লিখতে চাই। সোসাইটিতে তো আমার কোনো স্বাধীনতাই নাই। অন্তত লেখার খাতায় আমি স্বাধীন থাকতে চাই। আর অ্যাবসার্ডিটি আদতে সুন্দর। যেমন ধরেন, ক্লাসিক্যাল মিউজিক, ধর্ম, ম্যাথমেটিকস, কোয়ান্টাম ফিজিক্স এই সবই তো অ্যাবসার্ডিটি দিয়ে ভরা। আমার সেসব কল্পনা করতে ভালো লাগে।

হুজাইফা: আপনি যখন আপনার লেখা পাঠকের কাছে দিচ্ছেন, তখন কি তাদের কিছু বিষয় আপনার বিবেচনায় রাখতে হবে না? অবশ্য যদি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত থাকতে চান তাহলে আমার আপত্তি নাই।

রোবায়েত: পাঠকের কাছে দিচ্ছি অর্থে সেধে দিচ্ছি না তো! পাঠক তার রুচি অনুযায়ীই বেছে নিচ্ছে।

হুজাইফা: প্রকারান্তে আমি বলতে চাইছি,আমাদের কল্পনার কোন ব্যারিয়ার নাই, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের কল্পনাও তৈরী হয় চিন্তার অভিজ্ঞতা থেকে। সেটাকে অতিক্রম করব কিভাবে?

রোবায়েত: আমি এই ব্যাপারটা বহুত আগেই বলছি। স্ট্যাব্লিশড নলেজের মধ্যে আমি অধিকাংশ সময়েই থাকতে চাই না। নলেজ যে ধরনের কল্পনা বা চিন্তাশক্তি ক্রিয়েট করে আমি তার থেকে বের হইতে চাই। এইটারে বলতে পারেন, শূন্যজ্ঞান নিয়ে শুরু করতে চাই। জিরো নলেজ। যেমন  শিশুরা করে।

হামেদী: বাংলার রূপ-রস-ছন্দে কবিতা চর্চার নামে সাম্প্রতিক সময়ে একদল কবিকে অপ্রচলিত সংস্কৃত ছন্দে কবিতা লিখতে দেখি।এই প্রবণতাকে আপনি কতটা সার মনে করেন?

রোবায়েত: হা হা! দিলেন তো ঝামেলায় ফেইলা! সংস্কৃত ছন্দে যদি নতুন কবিতা লেখা হয় তবে সেটা তো খুবই ভালো। বাংলা কবিতার জন্যই ভালো। তবে একটা ডেড ল্যাংগুয়েজের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কতখানি বাংলাভাষার মতো ফ্লুইড ল্যাংগুয়েজকে হ্যান্ডেল করতে পারবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেন বলেই করেননি। উনার মতো বস লোক তো এই তল্লাটে বিরল! তার চেয়ে মধ্যযুগের কাজগুলো নিয়ে আমি বেশি উৎসাহী।

(চলবে…)

শেয়ার