আমি একটি চিত্রকর্মের দিকে তাকিয়ে আছি, সমুদ্র সৈকতের। জনশূন্য চিত্রটি সূক্ষ্ম অন্তরীপরেখা, বিশুদ্ধ বালি আর স্বচ্ছ জলের ফ্রেমে আটকে আছে। জলরঙের সূক্ষ্ম আঁচড়ে আঁকা। ভাবছি ওই সৈকতে যাওয়ার জন্য আমি কতটাই না ব্যকুল হয়ে আছি। যতবারই তাকাই, ততবারই এই ভাবনা মাথায় উঁকি দেয়।
কিন্তু আমি তা পারবো না। কেউই পারবে না, এমনকি শিল্পীও না। এই সৈকত শুধু তার কল্পনাতেই আছে। ক্যারিবিয়ান সাগরের মাত্র কয়েক গজ দূরে পনের বছর পার করে দিলেও পানির সাথে তার প্রায় কখনোই দেখা মেলেনি। গুয়ানতানামো বে বন্দী শিবিরের তিনি একজন বন্দী।
গত বছর আমার এক বন্ধুর বন্ধু যে কিনা পেশায় একজন আইনজীবী, জানতে চাইলো তার মক্কেলের কিছু চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারবো কিনা। আমি হ্যাঁ বলতেই এইসব স্বেচ্ছাসেবী আইনজীবীদের মাঝে কথা ছড়িয়ে পড়লো, তারপর বন্দীদের মাঝেও। অল্প সময়ের মধ্যেই আমার ম্যানহাটনের অফিসকক্ষ শত শত চিত্রকর্মের এক্রিলিকের ঝাঁঝালো গন্ধে ছেয়ে গেলো, আর মেঝেতে জাহাজের ছোট ছোট মডেলের স্তুপ জমে গেলো। এই জাহাজগুলোর পাল পুরনো টি-শার্ট দিয়ে বানানো, আর পালের সাথের দড়িগুলো ছিলো প্রার্থনাটুপির কিনারা ছেঁড়া সুতো।
যে আটজন শিল্পীর কাজ আমি নির্বাচিত করেছিলাম, সেই কাজগুলো বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার শেষ কয়েক মাসের সময় আসতে লাগলো, ততদিনে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলো। আমি খুব সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আইনজীবীরা খুব জোর লাগিয়ে কাজ করলো। তারা সামরিক পর্যবেক্ষক বোর্ডকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, দুই জন বন্দী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আর হুমকি নয়। তাদের অন্যান্য দূর দেশের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করার ঠিক আগের দিন, ২০১৭ এর ১৯ জানুয়ারি আরও দুই বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়।বাকি চারজন বন্দী শিল্পী এখনো গুয়ানতানামোতেই আছেন। খুব সম্ভব এই প্রশাসনের সময়কালেই তারা বা আরও যে বন্দীরা আছেন সবাই ছাড়া পাবেন।
প্রশ্ন ছিল, তাদের এখানে কেন আনা হয়েছে? একজন শিল্পী কতক সৈনিকের জন্য রান্না করার কাজ নিয়েছিলেন। আরেকজন ১১ই সেপ্টেম্বরের পরিকল্পনায় সঙ্গ দিয়েছিলেন। আরেকজন এমন একজনের চিঠি বহন করছিলেন যাকে কিনা তার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। অন্যরা ঠিকভাবে জানেনই না তাদের কি কারণে এখানে আনা হয়েছে, কেননা তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আনা হয়নি, কোন বিচারও হয়নি। আমি প্রশ্ন করা বন্ধ করলাম, তার পরিবর্তে কাজগুলোর দিকে তাকালাম।
ওবামা গুয়ানতানামোর অবস্থা ভালো করার চেষ্টা করেছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই জয়েন্ট টাস্কফোর্স গুয়ানতানামো ওয়েবসাইট এক নতুন শিল্প কার্যক্রমের কথা ফলাও করে প্রচার করতে লাগলো যা বন্দীদের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা দেবে এবং তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। কর্তৃপক্ষ একজন প্রদর্শক নিয়োগ করলো, যার তত্ত্বাবধানে বন্দীরা আপেল বা শূন্য গেলাসের বাহ্যিক অবয়বের শেড টানার মতো কাজ খুব আন্তরিকভাবে চর্চা করছিল, যা হয়তো একটা শহরতলীর অব্যহত শিক্ষা কার্যক্রমেই দেখার আশা করা যায়।
শুধু যেটুকু ব্যতিক্রম ছিল, তা হলো বন্দীদের পা মেঝের সাথে শিকলে বাঁধা থাকতো এবং তারা আঁকার কাজের জন্য পেতো কাঠকয়লা। কারণ কর্তৃপক্ষ ভয়ে থাকতো যে পেন্সিলকে ধারালো করে মারণাস্ত্রে পরিণত করা হতে পারে। এটাও ব্যতিক্রম ছিলো যে বছরজুড়ে অনশনে থাকা বা প্রতিদিন জোর করে খাওয়ানো মানুষগুলোকে দিয়ে আঁকানো আপেল বা শূন্য গেলাসের ভিন্ন এক অর্থ দাঁড়ায়। ব্যতিক্রম ছিল যে প্রত্যেকটা শিল্পকর্মের উপরই “মার্কিন বাহিনী অনুমোদিত” সীলমোহর এঁটে দেয়া হতো ; যার অর্থ দাঁড়ায় যে চিত্রগুলোর ভেতর আল কায়েদার জন্য কোনো বার্তা লুকোনো নেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সামরিক সেন্সর কাজগুলোকে গুয়ানতানামো ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে।
আর্ট ক্লাস আরম্ভ হওয়ার পর বন্দীরা নিজেদের বিষয়বস্তু বেছে নিতে শুরু করলো। বারবার তারা সম্মোহিতের মতো সমুদ্রেরই চিত্র আঁকতে বা ভাষ্কর্য বানাতে থাকলো। জাহাজ, ঢেউ, সমুদ্রঝড় কিংবা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। জাহাজ ঘাট, পোতাশ্রয়, জলের কিনারায় আনত আকাশচুম্বী অট্টালিকা। বালুময় সৈকত, পাথুরে সৈকত, খাড়া পর্বত কিনারার চূড়া থেকে নিচের অনধিগম্য জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকা পর্যটক। তারা তাদের সেল থেকে সমুদ্রকে শুনতে পেতো। গুয়ানতানামোতে বন্দীরা কয়েক স্তরযুক্ত বেষ্টনীর ভেতর থাকতো, আর বেষ্টনীগুলো কয়েক স্তরের তেরপল দিয়ে ঢাকা থাকতো। একবার হারিকেনের সময় কোন এক ব্লকের তেরপল কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই সময়টাতে যেসব বন্দীরা সমুদ্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলো, তারা তেরপল আবার লাগানো পর্যন্ত যতক্ষণ সম্ভব সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অন্যান্য বন্দীদের আরো কঠোর নিরাপত্তা সম্বলিত এলাকায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যারা এই অল্প সময়ের দেখাটাও দেখতে পেতো না।
‘মবি-ডিক’ উপন্যাসের শুরুর কয়েক পাতায় হারমান মেলভিল নিউ ইয়র্কের “জল-প্রহরী”দের কথা বলেছেন, অফিসে কাজ করা মানুষজন যারা সময় পেলেই শহর ঘিরে থাকা সমুদ্র, নদী, এইগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। মেলভিলের ভাষায়, যেন “পুরো শহরে নিযুক্ত নীরব প্রহরীদের মতো, সমুদ্রঘোরে আছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো নশ্বর মানুষ”। মেলভিল দাবি করেন, এই ছন্নছাড়ারা “জীবনের অধরা অলীক ছায়া”র ধ্যান করতো। বন্দী শিল্পীদের মতে, তারা সমুদ্রকে আশা এবং ভয় উভয়েরই প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। তারা একে চিত্রিত করেছেন পালানোর স্বপ্ন দেখা এবং তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব পালিয়ে থাকা যায় তার জন্য । শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সম্পূর্ণরূপে কাজে নিমগ্ন রেখে তারা ভেবে নিতে পারতেন যে, তারা সমুদ্রে কোন এক জাহাজের মধ্যে আছেন।
ম্যানহাটানের অন্যান্য ভবনের মতো প্রদর্শনীর স্থান থেকেও জলরাশি দেখতে পাওয়া যায়। আমি চারপাশের নিউইয়র্কবাসীদের ভেতর মেলভিলের সেই “জল-প্রহরী”দের আর দেখি না। কিন্তু ইদানিং আমি জলে পা ভেজাচ্ছি তাদের হয়ে, যারা পা ভেজাতে পারছে না, জলের দিকে তাকিয়ে থাকছি তাদের হয়ে, যারা তাকিয়ে থাকতে পারছে না।
“ওড টু দা সীঃ আর্ট ফ্রম গুয়ানতানামো” নিউ ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির জন জে কলেজ অভ ক্রিমিনাল জাস্টিস এর প্রসিডেন্ট গ্যালারিতে জানুয়ারী ২০১৮ তে মাসব্যপী চলবে।
এরিন থম্পসন জন জে তে আর্ট ক্রাইম অ্যান্ড আর্ট ল-এর সহকারী অধ্যাপক। তার প্রথম গ্রন্থ ‘Possession: The Curious History of Private Collectors from Antiquity to the Present’ এনপিআর বেস্ট বুক অভ ২০১৬ পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে।