১.
খুব সকালে ঘুম ভাঙলে কিংবা সকালের দিকে ঘুমাতে গেলে আমি কিছুক্ষণ পূবের জানালা খুলে চেয়ে থাকি। ইলেকট্রিক খাম্বার তার উত্তর দক্ষিণে চলে গেছে। আরেকটু সামনে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর পেছনে প্রকাণ্ড একটা আম গাছ। আমার নজর মূলত এই ঝাকড়া মাথার আমগাছের ডালপালা, পাতার দিকে, এবং ইলেকট্রিক খাম্বার তারে কোন পাখির বসে থাকা বা ইতস্তত ওড়াওড়ির দিকে। কিন্তু এক সকালে আমি এসবের দিকে তাকিয়েও খুব অস্থিরতায় ভুগতেছিলাম। রোজকার রিপিটেড দৃশ্যাবলি হয়তো আমাকে ক্লান্ত করতেছিলো। আমি টেবিলে পড়ে থাকা অনেক কয়েকটা কবিতার বই থেকে বায়েজিদ বোস্তামীর আমি যে মরি না তাই টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। বলে রাখি বোস্তামীর কবিতার সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনেরই বলা যায়। ফেসবুকের কল্যাণে তাঁর কবিতার সাথে আমার পরিচয় বছর চারেকে এসে ঠেকলো। যা-হোক বইটা পড়তে শুরু করলাম যখন, দেখি পয়লা কবিতা থেকে শুরু করে আমি বই এর শেষ তথা একচল্লিশ নম্বর কবিতায় এসে পড়েছি। আবার উল্টোদিক থেকে মানে একচল্লিশ নম্বর থেকে পড়া শুরু করলাম। তো এইভাবে বইটা একরকম উল্টে পড়া, পাল্টে পড়া হলো। এই যে একটা বই দুইবার উল্টেপাল্টে পড়া বিরতিহীন— এইখানে কি বইয়ের কলেবর বা ফর্মাসংখ্যা কোনভাবে ম্যাটার করেছে? না, ম্যাটার করছে বোস্তামীর কবিতা আর কবিতার শরীর। বোস্তামীর কবিতার পাঠকমাত্রই জানেন তাঁর কবিতা নির্মেদ। কবিতাকে অযথা অলংকার পড়িয়ে ভারী করে তোলার প্রয়াসও বোস্তামীর নাই।
২.
পাঠক হিসাবে আমি নিজে একটা ব্যাপারকে সমস্যা হিসাবেই ধরি। যা-ই পড়ি না কেন সে পড়াটার সাথে রিয়ালিটির সংযোগ কিংবা ঘটে যাওয়া ঘটনা এমনকি দেখা কোন সিনেমার ঘটনা, চরিত্রের সমান্তরালে মিলিয়ে দেখার একটা চেষ্টা চালানো। বোস্তামীর কবিতা পড়তে পড়তে আমি নিজের দিকে তাকালাম। ক্রাউড থেকে টোটালি আইসোলেটেড একটা যাপিত জীবনে এই কবিতা একান্তই আমার নিজের মনে হয়।
” শামুক জীবন চেয়েছিলাম
জলে ভেসে যাওয়া
ধীরবেগে
বরষায়
জল ফুরোলে মাটির ওমে
একা গুটিসুটি……”
( শামুক জীবন চেয়েছিলাম)।
এই যে শামুকের মতো একা গুটিসুটি মেরে থাকা একটা জীবন কাটানোর আকাঙ্ক্ষা, এইটা কি শুধুই মাটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে না চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই? আমি যে মরি না তাই-এর কবিতাগুলো পড়লে দেখা যাবে কবিতায় ছড়িয়ে আছে চাপা ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, চারদিকের বিবিধ মকারির চাপে পিষ্ঠ আর্তনাদ। দখলদারির দুনিয়ায় একান্ত ব্যক্তিগত আছে যতটুকু, সেটুকুও যেন আর ব্যক্তিগত থাকছে না। ব্যক্তিগত থাকছে না এমনকি জীবন, মরণও।
দখলে আছে সব —
নদী ও সমুদ্র
পাহাড় ও জঙ্গল
জমিন ও আসমান
খাদ্য ও পানীয়
শিশু ও নারী
( দখল)
তো এইসব দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু মরিবার মুরোদটি যেহেতু আমার নাই, তাই ঘটে যাওয়া, ঘটমান এবং ঘটিতব্য সমস্ত মশকারি নিয়েই আমাকে বেঁচে থাকা লাগে।
৩.
এই টিথোনাসের জীবন কি আমরা চেয়েছিলাম? বেঁচে থাকা যেন একরকম অমরত্বের বোঝা। রোগ, শোক, জরা এসবের বাইরেও আছে বিবিধ মশকারি। সামগ্রিকভাবে বেঁচে থাকার সমস্ত অনুসঙ্গই যেন একটা বিন্দুতে মিলিত হয়ে জীবনের প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছে ক্রুর হাসি।
৪.
গভীরতম ঘৃণা পরিণত হলো গভীর ভালোবাসায়— এ-ও কি শুধু অক্ষমতা থেকে? মরবার অক্ষমতা থেকে যাপিত জীবনের যন্ত্রণাকে ভালোবাসা? বিষাদকে কেন তবে নিমফুলের সুঘ্রাণের মতো নরম মনে হয়? বিষাদও ভালোবেসে ফেলেছে জীবনকে। মেঘ আঁকা মায়াময় চোখে বিষাদ জীবনের আস্তিন টেনে ধরে বলে ফেলে যেও না! জীবন আর যন্ত্রণার এই যৌথযাপন, এই দোস্তি। বিষাদকে পোষা বেজির মতো তাই কাঁধে করে শহরজুড়ে ঘুরি।
৫.
ট্রু লাভ ইজ প্যাশনেটলি ইরোটিক…..
বোস্তামীর কিছু কবিতা প্রেমের সংরাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ এবং কামুকতায় ভরা। এবং সুন্দর ব্যাপার এই যে, একটা কবিতা হয়তো প্রেম নিয়ে লেখা, কবিতাটা হয়ে উঠেছে পুরোপুরি প্রেমের। যৌনতা বা কামের গন্ধমাত্র নেই। আবার যৌনগন্ধী যে কবিতা, সে কবিতা জুড়ে যৌনতারই বন্দনা। ট্রু লাভ ইজ প্যাশনেটলি ইরোটিক, এই কথা কবি কতটা মানবেন সেটা পাঠকের না জানলেও চলে। তবে বইয়ের অনেকগুলো কবিতাই প্রেমের জটিলতাকে ছাড়িয়ে আরো খোলামেলা, আরো সহজ ও সরল হয়ে উঠেছে, সোজা বাংলায় যৌনগন্ধী। প্রেম যেখানে, সেখানে যৌনতা স্বাভাবিক। বোস্তামী যৌনতায় কতটা প্যাশনেট এইটা যদি আমরা তাঁর কবিতায় খুঁজতে চাই তাহলে মেটফোরগুলোকে নিজের মতো করে বুঝে নিতে হয়। যদিও মেটফোরগুলো শুধু মেটাফোর হিসাবে থাকলেও বোঝা যাবে কবি ইনটেনশনালি যৌনতা লুকিয়ে রাখতে চাননি তার কবিতায়। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক…..
” একটা বুনো, বেহায়া, ক্ষ্যাপা ষাঁড় তাড়া করে একেকদিন। ষাঁড়টাকে বশ মানানোর সাধ্য আমার থাকে না। ওটা কেবল তোমার স্পর্শেই যা একটু মাথা নিচু করতে জানে। নইলে শুধু শিং উঁচিয়ে গুঁতানোর মতলব আঁটে। এত বিপদে ফ্যালে মাঝে মাঝে বেকুব বনে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না।” ( ষাঁড়)
শামসুর রাহমান-এর একটা কবিতা থেকে কয়েক লাইন তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
… নিজেই জানি না, শুধু জানি অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত।
কেঁপে উঠি ঘনঘন একা ঘরে
ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী শিং নাড়ে,
কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে,
আসে ব্যেপে কুজঝটিকা হৃদয়ে আমার,
তবু তোমাকেই খুঁজি প্রতিক্ষণ,
এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু পুঁজি।”
(হাতের কাছে বই নেই, স্মৃতি থেকে তুলে দিলাম তাই কবিতার, কবিতাগ্রন্থের নাম বলতে পারছি না)। মেটাফোরের সাদৃশ্য খোঁজার জন্য রাহমানের কবিতাটা টানলাম না। খেয়াল করে দেখি দুটো কবিতারই এন্ডিং ক্লোজ। কবিতার থিমও একই রকম। অপ্রাপ্তি বা যৌনতার হাহাকারের ইঙ্গিত দুটি কবিতাতেই আছে।
বোস্তামীর আরো কয়েকটা কবিতার নাম নেয়া যেতে পারে। যেমন বেকুব ঘোড়ারে আমার নিশিতে পায়, দুপুর স্বমৈথুন। স্বমৈথুন কবিতার শেষ লাইনটা মনে হয় সেক্সুয়াল একটা ডিপ্রাইভেশন থেকে ভোগ আর পুঁজিবাদী শুয়োরদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়া বাণ, সিদ্ধান্ত।
” জেনো হে শুয়ার
বেদরদি দুনিয়ায় স্বমৈথুনই শেষ আশ্রয়।”
কিন্তু এই বাণ ফিরে আসে, বিদ্ধ হয় আমাদেরই অক্ষম বুকে। তখন নিজেকেই মনে হয় শুয়োর। দখলদার, সুবিধাবাদী শুয়ারের দল থেকে পিছিয়ে পড়া, বিতাড়িত শুয়োর। বেরহম, বেদরদি দুনিয়ায় তখন তৈরি করতে হয় নিজের একটা দুনিয়া, খুঁজে নিতে হয় নিজস্ব আশ্রয়।
৬.
বোস্তামীর আরো একটা কবিতা পড়ে রণজিৎ দাশের একটা কবিতার কথা মনে হলো। বোস্তামি আর রণজিৎ দুজনের কবিতারই বিষয়বস্তু আপেল। বোস্তামী লিখেছেন,
” আপেল নিয়ে একটা কবিতাও লিখি নাই কখনো আমি
এই কথা ভাবতে ভাবতে আপেলে কামড় বসাইলাম
তারপর এই কবিতাটা লিখলাম
আপেল নিয়া কবিতা না লেখার খেদ থাকলো না আর।”
(আপেল নিয়া লেখা একটা কবিতা)
রণজিৎ দাশ এর আপেল নামক কবিতায়, ” আপেলে কামড় দিয়ে মনে হলো চতুর্দিকে স্যানাটোরিয়াম।”
আপেলে কামড় দিয়ে একজনের মনে হলো আপেল বিষয়ক কবিতা লেখার চেয়ে আপেলে কামড় দেয়া যেন অধিকতর শৈল্পিক, অধিকতর বাস্তবিক। এই যে আপেলে কামড় দেয়া হলো এই হলো কবিতা, আপেল বিষয়ক কবিতা। আপেল বিষয়ক সমস্ত কল্পনার থেকে মুক্তি। রণজিৎ দাশের কাছে যেমন স্যানাটোরিয়ামের অভিজ্ঞতা হলো আপেলে কামড় দেয়া। আপেলকে স্রেফ মেটাফোর হিসাবে ধরলেই আমরা বুঝে নিতে পারি একটা মনোটোনাস লাইফের বন্দীদশা, রিপিটেশনের বলয়গ্রাস থেকে মুক্তি আপেলে কামড় দেবার মতো সুখকর। স্রেফ আপেলে কামড় দেয়া একটা অতিসাধারণ ঘটনা কিভাবে অসাধারণ, কবিতার মতো শৈল্পিক হয়ে ওঠে।
৭.
আমি যে মরি না তাই কবিতাপুস্তকের ৪১টা কবিতা পড়ে সুইনবার্নের সেই বিখ্যাত উক্তিটা মনে পড়লো। দুই প্রান্তে ঘুম, মাঝখানে একটু চক্ষু মেলে চাওয়াই জীবন। আমি যে মরি নাই তাই-এর একদিকে প্রেম, আরেকদিকে গ্লানি, হাহাকার, ক্ষোভ, আর্তনাদ। কিন্তু তারও মাঝখানে আছে জীবন, বেঁচে থাকা। সার্থকতা, সুন্দরতা। সুন্দর যেমন মাঘের পাতলা দুপুরে রোদের ওম গায়ে মেখে নিমগাছে সবুজ টিয়ার নিমফল খাওয়া।
৮.
কবিতা তো কিছুটা নিজেরও আত্মন্মোচনের ব্যাপার। হয়তো কবিতাতে মোটাদাগে কবির জীবন থাকে না। কিন্তু কবিতা পড়ার পর আমরা কি কবিকে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠি না? বস্তুবাদীর দেখা আর কবির দেখার মাঝে যদিও বিস্তর ফারাক, দুজনের সত্য যদিও ভিন্ন কিন্তু কবিকে নিয়ে আমরা নিজেরাও একটা সত্য খোঁজার চেষ্টা করি। আমারও কৌতূহল আমি যে মরি না তাই-এর কবিকে নিয়ে। ঢাকায় আমি কভু চাঁদ দেখি নাই এই শিরোনামের একটা কবিতায় কবি বলতেছেন,
” ঢাকা শহরেও হাইরাইজরাজির চিপাচুপায় চাঁদ ওঠে
ঘাড় হইতে মাথা কিঞ্চিৎ উঁচা করবার আলস্যহেতু
আমি তারে দেখি না
ঢাকায় আমি কভু চাঁদ দেখি নাই, দেখতে চাই না।”
এই কবিতা পড়ে কবিকে পলায়নপর মনে হয়। কিন্তু এই পলায়ন যে পলায়ন নয় বরং নিজের কাছে ফিরতে চাওয়ার আকুলতা— নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের দুনিয়া আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কাছে ফিরতে চাওয়া— এটা বুঝি তাঁর আরো কিছু কবিতা পড়ে। যেমন মানুষের খাতা থাকি নাম কাটায়া কবিতায় দেখি কবির মৌন গাছ কিংবা কুলুকুলু রবে নদী হয়ে বয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। গোরু কবিতায় গোয়ালের সবচেয়ে শান্ত গোরুটি হয়ে থাকার ইচ্ছা। যাবনা কেটে দিলে যে সবটুকু খেয়ে নেবে একটুও ছড়াবে না, ফেলবে না।ভোগবাদী মানুষের দুনিয়ায় মানুষের ভোগ আর অপচয়ের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া শ্লেষ! এসব কবিতা পড়ে কবিকে যতটা নিহিলিস্টিক মনে হয় ততটা মনে হয় তিনি নন। দখল, বিষাদ এসব কবিতা পড়লে বোঝা যাবে আসলে সামাজিক, রাজনৈতিক নিরাশা এসব কবিতায় উঠে এসেছে।
৯
“কবিতার জলোচ্ছ্বাসে ভেসেছে আমার চরগুলি।
দুমড়ে পড়েছে সমকাল। ঝড়ে উড়ে গেছে বাস্তবতা।
কোথায় গিয়েছে ভেসে মানুষিক সব জটিলতা।”
(জলোচ্ছ্বাস, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
কবিতা তো কারো কারো জন্য মানুষিক, মানসিক সমস্ত জটিলতা থেকে পালানো, মুক্তির পথ। সমকালের বেদনাদায়ক বাস্তবতা থেকে পালাতে গিয়ে কবিতার কাছে নিজেকে সমপর্ণ করলে মনে হয় সমকালই দুমড়ে পড়েছে যেন কবিতার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে। গ্রেগরি করসোর কাছ থেকে ধার করে বলি, ‘If you believe you are a poet, then you are saved’. কবি বোস্তামী হয়তো বেঁচে গেছেন তাঁর চারপাশের মেইডআপ মনের মানুষজনের কাছ থেকে দূরে গিয়ে শুধু নিজের কবিতার সাথে আছেন বলে।সমস্ত মকারি থেকে বাঁচার অনুষঙ্গ শুধুই কবিতা। কষ্ট, গ্লানিও যেখানে ম্লান হয়ে গেছে বেঁচে থাকার কাছে। বোস্তামীর কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর কবিতাও আমাদেরকে সেদিকেই টানে। যেখানে জীবনের সমস্ত সরল আর সৌন্দর্য। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমরাও নিজেদেরকে saved ভাবতে পারি। ভাবতে পারি আমরাও আছি বেঁচে থাকাদের দলে।
এই লেখাটাকে কবিতার আলোচনা, সমালোচনা কিংবা পাঠ প্রতিক্রিয়া না বলে বরং একজন কবিতা পাঠকের ডায়েরি থেকে…. শিরোনাম দেয়াটাই অধিকতর নিরাপদ মনে করি।
বই: আমি যে মরি না তাই
প্রকাশ: ২০২২
প্রকাশক: বৈভব
প্রচ্ছদশিল্পী: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১৫০ টাকা