আফগানিস্তানে তালিবানদের এত দ্রুত ক্ষমতা গ্রহণের কারণ — স্লাভয় জিজেক | ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী

স্লাভয় জিজেক একজন সাংস্কৃতিক দার্শনিক। তিনি ইন্সটিটিউট ফর সোশালজি অ্যান্ড ফিলোসোফি, ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার একজন প্রবীণ গবেষক। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বার্কবেক ইন্সটিটিউট ফর দ্যা হিউম্যানিটিজের আন্তর্জাতিক পরিচালক। তালেবানদের এত দ্রুত আফগানিস্তান পুনর্দখল নেয়ার আসল কারণ যার প্রকাশ পশ্চিমা উদার মিডিয়া উপেক্ষা করে বিষয়ে দুই বছর আগে প্রকাশিত জিজেকের লেখাটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন দিলশাদ চৌধুরী।


৮০,০০০ সৈন্যের তালিবান বাহিনী কিছুটা ডমিনো খেলার মত একে একে পতন হওয়া শহরগুলো দখলের মধ্য দিয়ে পুনরায় আফগানিস্তানের কতৃত্ব হাতে নিলো, যেখানে উন্নত অস্ত্র আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিন লাখের বেশি সদস্যের শক্তিশালী সরকারি বাহিনীর বেশিরভাগই যেন তাদের সামনে মোমের মত গলে পড়লো কিংবা আত্মসমর্পণ করলো লড়াইয়ের কোনো চেষ্টা ছাড়াই। এমনটা কেন হলো? 

পশ্চিমা মিডিয়া আমাদের বলে যে এই ব্যাপারে অনেক ব্যাখ্যাই দেওয়া যায়। যার মধ্যে প্রথমটা চরম বর্ণবাদী: আফগান জনগণ বলতে গেলে গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট পরিপক্ব নয়, তারা সাগ্রহে ধর্মীয় মৌলবাদ কামনা করে— সর্বকালের সেরা হাস্যকর কথা। অর্ধশতক আগে, আফগানিস্তান ছিলো এক (কিছুটা মধ্যপন্থী) প্রবুদ্ধ দেশ যেখানে দ্য পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান নামের একটা শক্তিশালী বামপন্থী দল ছিলো যারা কিনা কিছু বছরের জন্য ক্ষমতায় যেতেও সক্ষম হয়েছিলো। আফগানিস্তান ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকেছে তারও পরে, কম্যুনিস্ট শক্তির পতনরোধে অভীষ্ট সোভিয়েত দখলদারির প্রতিক্রিয়া হিসেবে। 

আরেকটি ব্যাখ্যা মিডিয়া দেয় আর তা হলো আতঙ্ক, যেহেতু তালিবানরা নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের যারা এদের রাজনীতির বিরোধিতা করে।

উপরন্তু আরও একটি ব্যাপার হলো বিশ্বাস: তালিবানরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা তারা ঈশ্বর কর্তৃক তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বকে পরিপূর্ণতা দিচ্ছে এবং তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। সুতরাং, তারা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতেই পারে কারণ মহাকাল তাদের পক্ষে। 

কেন তালিবানরা এতটা নির্বিঘ্নে দেশটির দখল নিতে পারলো তার একটা আরও জটিল এবং বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা হলো চলমান যুদ্ধের কারণে উদ্ভুত বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতি। যার কারণে হয়ত একটা বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে যে যদিও তালিবান রাজত্ব উৎপীড়নের সৃষ্টি করবে এবং শরীয়াহ আইন চাপিয়ে দেবে, তবুও অন্তত এটা কিছুটা নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা ফেরানোর নিশ্চয়তা দিতে পারবে। 

যাই হোক, এসব ব্যাখ্যা দেখে মনে হয় যেন একটা খুব সাধারণ ব্যাপারকে উপেক্ষা করা হচ্ছে যা উদারমনা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে বিব্রতকর। তা হলো তালিবানদের জীবনের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং এদের যোদ্ধাদের ‘শহীদী’র ব্যাপারে উন্মুখতা, মরতে প্রস্তুত থাকা যা কেবলই যুদ্ধে নয়, এমনকি আত্মঘাতী কাজগুলোতেও। যে ব্যাখ্যা তালেবানরা মৌলবাদী হিসেবে ‘আসলেই বিশ্বাস’ করে, যে তারা স্বর্গে যাবে যদি তারা শহীদী মৃত্যু লাভ করে। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টিয় চেতনা থেকে বিশ্বাস (“আমি জানি আমি স্বর্গে যাব, এটাই বাস্তব”) আর সংযুক্ত আত্মবাদীতার জায়গা থেকে বিশ্বাসের পার্থক্য তুলে ধরার পক্ষে যথেষ্ট নয়। 


আমরা কি কল্পনা করতে পারি এক সঠিকরূপে যৌথ মুক্তিকামী ঐক্যে অবদমিত সমষ্টির ফিরে আসা? অবশ্যই। আমরা যে শুধু কল্পনা করতে পারি তাই নয়, বরং এটি ইতোমধ্যেই বিপুল শক্তিতে আমাদের দরজায় আঘাত করছে।


অন্য কথায়, এটা কোনো ভাবাদর্শের বস্তুগত শক্তিকে বিবেচনায় আনতে অক্ষম— এক্ষেত্রে, বিশ্বাসের শক্তি— যেটা শুধু আমাদের প্রত্যয়ের প্রবলতায় ভর করে দাঁড়িয়ে নেই বরং কিভাবে আমরা অস্তিত্বগতভাবে আমাদের বিশ্বাসের প্রতি সমর্পিত তার উপর ভিত্তি করে আছে: এই বিশ্বাস বা ওই বিশ্বাস বাছাই করার ক্ষেত্রে আমরা মূল বিষয় নই, কিন্তু আমরাই ‘আমাদের’ বিশ্বাস, এই বিশ্বাস যদি হয় আমাদের জীবনকে পরিব্যাপ্ত করা অর্থে। 

এই ব্যাপারই ছিলো মূল কারণ যার জন্য ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোকে ১৯৭৮ এর ইসলামিক বিপ্লব এতটাই বিমুগ্ধ করে ফেলেছিলো যে তিনি দু’বার ইরান ভ্রমণ করেন। তার মুগ্ধ হবার কারণ শুধুমাত্র শহীদী মেনে নেয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান কিংবা একজনের নিজের জীবন হারানোর ব্যাপারে উদাসীনতা ছিলো না; উনি সংযুক্ত হয়েছিলেন এক বিশেষ নির্দিষ্ট ধরনের ‘সত্য ইতিহাস’ বলার কায়দার সাথে, জোর দিয়েছিলেন এক পক্ষপাতদুষ্ট এবং যন্ত্রণাদায়ক সত্যকথন পদ্ধতির প্রতি, এবং সংগ্রাম ও কঠোরতার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আনা, আধুনিক পাশ্চাত্য শক্তির প্রশমিত, নিরপেক্ষকরণীয় এবং সাধারণ রূপ প্রকাশের বিরোধী হিসেবে। এই ব্যাপারটা বোঝার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে কাজ করা সত্যের ধারণা বোঝা জরুরি, আংশিক সত্যের একটা ধারণা যা কিনা পক্ষপাতদুষ্টদের জন্যই সংরক্ষিত। 

অথবা, যেমনটা ফুকো নিজেই বলেছেনঃ 

“যদি এই ব্যক্তি, যে অধিকারের কথা বলে (অথবা, অধিকারসমূহের) সত্য কথা বলে থাকে, তাহলে সেই সত্য আর দার্শনিকের সার্বজনীন সত্য থাকে না। এটা সত্য যে সাধারণ যুদ্ধের ব্যাপারে এই আলোচনা, এই আলোচনা যেটা যুদ্ধকে শান্তির অন্তরালে দেখাবার চেষ্টা করে, নিঃসন্দেহে এই যুদ্ধকে সার্বিকভাবে ব্যাখ্যা করার এবং যুদ্ধের স্বাভাবিক গতিকে পুনঃনির্মাণ করার একটা প্রচেষ্টা। কিন্তু সেটা একে একটা মোটমাট কিংবা নিরপেক্ষ আলোচনায় পরিণত করে না; এটা সর্বদাই একটা দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভরশীল আলোচনা। এটা সার্বিকতার ব্যাপারে আগ্রহী হয় একটা নির্দিষ্ট সীমা অবধি, যতক্ষণ এটা ব্যাপারটাকে একচোখা ভাবে দেখতে পারছে, বিকৃত করতে পারছে এবং সেটাকেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পারছে। সত্য সেটাই, এক কথায় বলতে গেলে, যেটা কেবল তার বিবাদের স্থান থেকে, বিজয়ের জন্য চাওয়ার প্রেক্ষিত থেকে, এবং চূড়ান্তভাবে, বলতে গেলে, স্বয়ং কথকের বেঁচে থাকার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।” 

এমন একটা আকর্ষণীয় আলোচনাকে কি আধুনিকতাপূর্ব আদিম সমাজের চিহ্ন যারা কিনা এখনো আধুনিক স্বাতন্ত্র্যে প্রবেশই করেনি, বলে বাতিল করে দেয়া যায়? আর এর আজকের যে পুনর্জাগরণ, তাকে কি ফ্যাসিবাদী পশ্চাৎপদতা বলে খারিজ করে দেয়া যায়?

পশ্চিমা মার্ক্সবাদ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখা যে কারো কাছে উত্তরটা পরিস্কার: হাঙ্গেরিয়ান দার্শনিক গেওর্গ লুকাক্স দেখান যে কিভাবে মার্ক্সবাদ একটি ‘সার্বজনীন সত্য’, এর পক্ষপাতদুষ্টতা সত্ত্বেও নয় বরং এইজন্য যে এটি ‘একদর্শী’, কেবল একটি নির্দিষ্ট বৈষয়িক অবস্থান থেকেই উপলব্ধ। আমরা এই মতের সাথে একমত হতেও পারি, নাও হতে পারি, কিন্তু সত্য এটাই যে সুদূর ইরানে ফুকো যা খুঁজছিলেন— সত্য বলার যন্ত্রণাদায়ক (যুদ্ধকালীন) কায়দা— সেটা ইতোমধ্যেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থিত ছিলো শ্রেণিসংঘাতের মধ্যে, যেটা অভীষ্ট ঐতিহাসিক জ্ঞানের অন্তরায় নয় বরং এর শর্ত। 

জ্ঞানকে বিষয়গত (নিরপেক্ষ) ভাবে দেখার সাধারণ ইতিবাচক প্রবণতা বাস্তবতার শরণাপন্ন হয় যাকে কিনা কোনো নির্দিষ্ট বৈষয়িক বিবেচনায় বিকৃত করা হয়নি— যাকে ফুকো চিহ্নিত করেন “আধুনিক পশ্চিমা শক্তির শীতলতাবাদী, নিরপেক্ষতাবাদী, এবং সাধারণীকৃত রূপ” হিসেবে— এটা হলো ভাবাদর্শের পবিত্রতম অবস্থা— “ভাবাদর্শের সমাপ্তি”র ভাবাদর্শ। 

অপরপক্ষে, আমাদের হাতে আছে আদর্শহীন ‘বস্তুগত’ বিশেষায়িত জ্ঞান। আরও আছে ছত্রভঙ্গ একক ব্যক্তিবর্গ, যারা প্রত্যেকেই কেন্দ্রীভূত নিজ নিজ স্বতন্ত্র ‘কেয়ার অফ দ্য সেল্ফ’ (এই শব্দবন্ধটি ফুকো ব্যবহার করেন যখন উনি তার ইরানি অভিজ্ঞতার ত্যাগ করেন) এর প্রতি, ছোট ছোট জিনিস- যেগুলো তাদের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে। 

উদার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সার্বজনীন দায়বদ্ধতার  এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, বিশেষত যদি এতে জীবনের ঝুঁকি থাকে, ব্যাপারটা হয়ে ওঠে সন্দেহজনক এবং ‘অযৌক্তিক’….

এখানে আমরা মুখোমুখি হই এক আকর্ষণীয় প্যারাডক্সের: যখন এতে সন্দেহ আছে যে গতানুগতিক মার্ক্সবাদ তালিবানের সফলতার একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখাতে পারবে, এটি একটি যথোপযুক্ত উদাহরণের যোগান দিলো যে ফুকো ইরানে কি খুঁজছিলো (আর আমরা এখন আফগানিস্তানে কি খুঁজছি), এক উদাহরণ যেটার সাথে কিনা কোনো ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের সম্পর্ক নেই বরং কেবল যৌথভাবে মিলিত হয়ে একটু ভালো জীবনের আশার হাতছানি আছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের জয়জয়কারের পর এই যৌথ ঐক্যের উদ্দীপনাকে দমন করা হয়েছে। আর এখন সেই অবদমনই মনে করি ফিরে এসেছে ধর্মীয় মৌলবাদের বেশে। 

আমরা কি কল্পনা করতে পারি এক সঠিকরূপে যৌথ মুক্তিকামী ঐক্যে অবদমিত সমষ্টির ফিরে আসা? অবশ্যই। আমরা যে শুধু কল্পনা করতে পারি তাই নয়, বরং এটি ইতোমধ্যেই বিপুল শক্তিতে আমাদের দরজায় আঘাত করছে। 

বৈশ্বিক উষ্ণতা বিপর্যয়ের কথাই ধরা যাক— এটি দাবি করে বড় আকারের যৌথ উদ্যোগ যা কিনা তাদের নিজস্ব রূপকল্প অনুযায়ী শহীদীর প্রত্যাশা রাখবে, বলিদান দিতে হবে এমন অনেক আরামের, যেগুলো আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদি আমরা আমাদের পুরো জীবন অভ্যাসেই বদল আনতে চাই, তবে আমাদের নিজস্ব ‘কেয়ার অব দ্য সেল্ফ’ যা কিনা আমাদের সুখের প্রতি কেন্দ্রীভূত, সেটাকে দমন করতে হবে। বিশেষায়িত বিজ্ঞান একা এই কাজ করবেনা— এটা হতে হবে বিজ্ঞান যা কিনা  গভীর যৌথ ঐক্যের মধ্যে প্রোথিত থাকবে। এটাই আমাদের উত্তর হওয়া উচিত তালিবানদের প্রতি। 


দিলশাদ চৌধুরী
অনুবাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

শেয়ার