হুজাইফা মাহমুদের সঙ্গে বা তাঁর কবিতার লগে পরিচয় হইবার কিছুদিন পর তাঁরে জিগাইতেছিলাম, বই করবেন না?
উনি না করতেছিলেন এইভাবে, বই বাইর করলে সমকাল, পাঠকগো নানা ইচ্ছা, আবদার ও দাবির দিকে তাকাইতে হয়। সেই দিকে তাকাইতে গিয়া তিনি কবিতা লিখেন যেই আনন্দ ও অন্তর্গত পরিতৃপ্তির লাইগা, সেই প্রাচুর্য বেইকা-চুইরা যাইব বইলা বোধ করতেছেন।
এরপর বুড়িগঙ্গার কালাপানি আরো কালা হইছে। হু.মার বইভাবনা নানাদিকে যায়া-টায়া বই করবার দিকে স্থিত হইলো ঢাকাপ্রকাশের উন্মেষের সাথে। আর এর মধ্য দিয়া তাঁর ৩৪টা কবিতার একটা সংকলন আমাদের সামনে আইলো।
এই বই নিয়া আমার আগে থিকা আগ্রহ ছিল এই জন্যে, যে অন্তঃর্গত ও দূরাগত বিহ্বলধ্বনি আমার বিশেষ আগ্রহরে টাইনে ফেরে, তারই নিবিড়তম ও অবিশ্লেষমূলক মিঠাই তাঁর লেখায় আমি পাই। এই বই প্রেসে যাইবার সময় থিকা আমার মাথায় এইটা নিয়া লেখার ভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করতেছিল। বই পড়বার পর নিজের ভেতর নানা ব্যাপারে অনটনে ওই আগ্রহরে অপসৃত হইতে দেখলাম।
২.
হু.মা তাঁর কবিতা নিয়া কী কইতে চান, সেই দিকটা আমার বক্তব্য সামর্থে কুলোইবো না বোধ’য়। খালি আচ্ছিন্ন স্তবকীয় আলাপ, আমারে
বাতাস লাগানো পঙক্তি, স্পর্শতাড়িত ব্যাপারগুলা আমি কইতে চাই। তাঁর ‘শিরিষের ডালপালা’য় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থিকা আমরা কিছুটা উদ্ভাবন করতে পারি, কিসের ভেতর থিকা তাঁর কবিতা আসতেছে এই ধরনের অগ্রাহ্যতা ও বিভিন্ন উৎসের জাজ্বল্যে।
হু.মা তাঁর কবিতায় বহু বহু ঘটনার কথা কন তাঁর শৈশবে ঘইটে যাওয়া
নানা ফেরে।
নির্জনতার দিকে তাঁর মন কেমন কেমন করা যে কেসাসসমস্ত শোনান
তা ভিন্নিক অবগাঢ়িতা নিয়া ফুইটে আছে। নিভৃতে হঠাৎ মাইক যেন কোরআনের অলৌকিক তেলাওয়াতে কিংবা সহোদর-সহোদরা নিয়া ভেঁপু বাজাইতে বাজাইতে চইলা যাইতে থাকা ট্রেন দেখা কিবা নদীর পাড় ঘেইষা মখমল হাওয়ার ক্যাওয়াস তাঁর শৈশব দৃষ্টিরে জলমগ্ন কইরে দিতো নাকি! তিনি মা’র কাছে যায়া বাহানা বিহনে তাঁর উপশম খুঁইজে যাইতেন, শুনি। আমার মনে পড়ে শৈশবে, হুমায়ূন ফরিদি কোনো এক চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকা করতে যায়া এক সৎলোকের স্ত্রীর পেটে চাক্কু হান্দায়া দিছিলেন, তা দেইখা বুক থেইকা ভার সরাইতে পারি নাই কয়দিন। এই কনটেক্সটে রণজিৎ দাশের একটা কবিতায় প্রথম মিথ্যার উদ্ভাবনে একটা শিশুর ব্যথিত তাকায়া থাকার কথাও মনে পড়তেছে আমার। লোরকার প্রথম কবিতার বইয়ের ভূমিকায় লিখছে ওঁ, এইটা আমার মনে ফিরায়া আনতেছে আমার আবেগপূর্ণ শিশুবেলা, যখন আমি পাহাড়ি দিগন্তঘেরা তৃণপ্রান্তরের উপর দিয়া দৌড়ায়া যাইতাম। এই সমস্ত ক্ষেত্র দেইখা হুমার কবিতার দিকে নজর দেয়া লাগবে। কারণ, ইনি কথোপকথনে কইতে চাইতেছেন বারবার, খুব বেশি স্মৃতিতাড়িত ও পিছনধরা তিনি।
হু.মা কবি হিসেবে সেই উপলব্ধি, প্রজ্ঞ, অবচেতন ওঁ প্রজ্ঞার মালিক, যিনি অন্তরীণ নিঝুমতা, দূরাগত স্পন্দন, Internal music ধরতে চান কবিতায়। বিমিশ্র মিশেলের ছায়া ও ডেকচিতে তিনি মিলাইতে চাইতেছেন অস্পষ্টতা ও বেদনারাগ। তাঁর কবিতায় আপনারা ধইরে ফেলতে পারবেন তাঁর ক্ল্যাসিক্যাল শোনার অভ্যাস।
হু.মা ব্যাটা তাঁর সত্তার সেই অসামান্য ধারকতারে ছুঁইতে চাইতেছে নানা প্রতীক ও উপসর্গতায়, যারে ধরবার ব্যাপারে তানিম কবিরের কবিতা পড়া যাইতে পারে, “ধরি আমি , ধরি কোনোদিন ধরি নাই যারে, তাঁরে ধরে বসি আছি নদীর কিনারে।”
এই লোক চোখ বন্ধ কইরা এমন সব শান্তির কল্পনা করতেছেন, যা কখনো কখনো নৃতাত্ত্বিক ও যাপনিক ক্ষেত্র থিকা বহুদূরে কিবা এমনও হইতে পারে কল্পলোক সাজাইতেছে তাঁর শৈশবের বিভ্রমরে এমন লয়া, যা মায়ার আলেয়া হয়া নাচতাছে। নইলে এই কবিতাকাররে এই ধরনের নিরুপদ্রবতার বিবরণতার শিখা জ্বালাইবার লাইগা কি বিদেশী মহানগো কাছ থিকা কিছু বরকত লাভ করতে হইছে! আমরা সেইসকল সম্পূর্ণরূপে জানি না।
আমরা যেইটা ভাবতে পারতেছি কিবা খোলা চোখে দেখি, লোরকা যে কইছে, একজন কবি সবসময় নৈরাজ্যবাদী, তা থিকা আশ্চর্যভাবে দূরে সইরে গিয়া হু.মা ছাওয়াল আইলসেমি করতেছেন আর ভাবতে লাগতেছেন কোনোদিন না দেখা নদীর কথা, ঘুমের কথা, পাতার ভ্রমণের কথা, আম্মার কথা, বুবুর কথা, ঝিনুক কুড়াইবার যায়া কী গান গাইতেছিলেনসহ ইত্যকার নানা কুঁড়েমি-ঢিলেমি, কাল্পিক ছায়া, ঘোড়া, হরিণ, নদী ইত্যাদি স্বমনোরম কাবজাব ও জিনিশপাতি।
৩.
মিছাল বা উদাহরণের দিকে যাই কিছুমিছু।
সাইলেন্স কবিতার প্রথম বাক্যই বলতেছেন, ‘কোনো জিজ্ঞাসা নাই।’ এর কি তাইলে একটা অর্থ দাঁড়াইতেছে এই অর্থ ধইরে, তিনি চুপত্বরে ভাবতেছেন প্রশ্নহীনতায়! প্রশ্ন মানেই তো চাঞ্চল্য, উত্তর খোঁজা, ছটফট সক্রিয়তার হাউকাউ। তাঁর আইলসেমি তাইলে প্রশ্নহীনতার আরোপ!
হু.মা ব্যাটার কবিতার মিছা দিতে যায়া লাগতেছে কি এই লোক দেখার পর্যায়রে এতো না দেখার দিকে নিয়া লিখছে!
‘কোনোদিন না দেখা নদী’র শুরুর স্তবক এইরম,
“যেন কোনো মাতৃসিঁথি বেয়ে নেমে আসে নদী
নেমে আসে আমাদের জন্মান্ধ হৃদয় অবধি
সমস্ত তুঁতফল পাকে যে বিলোল হাওয়ায়
আর, রাতভর নদীটির বুকে জাগে তার হাহাকার।”
কিংবা ‘পথের সংশয়’ কবিতায়,
“আমূলে উড়ছে যেসব বেনামি পত্রাবলি
অবিন্যস্ত দিগ্বলয় জুড়ে
সেইসব অজ্ঞাত প্রাপকের মুখ, ভাবি”
ভায়েরা, এই কবিতায় আমাদের মহাল্লে ইসতেশহাদ বা ধরিবার বিষয় হইলো এই, বেনামি, অজ্ঞাত, অবিন্যস্ত শব্দত্রয়। তাঁর চিন্তা, বিভাবন বাঁকায়া আছে এইসব।
এই আইলসা মানুষটার প্রতীক, উপমা ও উপসর্গের একই মাত্রার ঘুরান-ফিরান আমরা দেখলেও মাঝে মাঝেই যেন তিনি পালটায়া ফেলতেছেন এলাকা-ফেলাকা।
‘ভোরের বৃষ্টি’ কবিতায় একটা ব্যাপারের প্রসারের দিকে যায়া দেখি তিনি তিনটা চিত্রকল্প আনছেন পরপর লাগোয়া।
১ম চিত্রকল্পঃ সহস্র জলজ ফুল ফুঁটে থাকে পাতায় পাতায়।
২য় চিত্রকল্পঃ এই আধফোটা আলোহীন বিবশ দিন
৩য় চিত্রকল্পে যায়া দিতেছেন উপমাঃ যেন সহজ মেয়েলি গ্রামখানা
ঢেকে গেছে সঘন মেঘের স্তুপে।
কিংবা ‘হাতঘড়ি ‘কবিতায় একটা আশ্চর্য বিবরণ দেখবো,
“যখন জন্মায়নি সময়, তারও বহু আগে
সৃষ্ট কেবল এক বিকল হাতঘড়ি
নেড়েচেড়ে দেখেছিল প্রিয় ফেরেশতারা।”
অথবা ‘তন্দ্রা পাহাড়’ কবিতায় তিনি হরিণের কথা আনছেন এমনভাবে, যেই হরিণের কথা আর কথাও বলেন নাই,
“সে এক উপকথার হরিণ, তাঁর নাভিখণ্ডে
মিশে আছে হরিৎঘাসের সুবাস
তার অনাগত পদধ্বনি বেজে চলে আমার হৃৎপিণ্ডে।”
হু.মা মৌলভীর কবিতায় এক নিত্য ব্যবহার্য হইলো ঘোড়া। কিন্তু বোধ ও বসন্ত কবিতায় তিনি ঘোড়ার মহিলা লিঙ্গকে অন্যভাবে নিয়াইলেন পুরাপুরি, এইরম ব্যবহার খুইজা পাওয়া মুশকিল বাংলা কবিতাতেই। তিনি লিখছেন,
“আহা, কি অন্যমনস্ক ঘোটকি তুমি
তোমার তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বজ্ঞার ভেতর
কয়েকটা চড়ুই ঢুকে পড়ে
অসংখ্য চড়ুই তোমার নিন্দ্রার ভেতর।”
এগুলা, এই মিছালগুলা দেয়া হইছে হু.মার নিজস্ব রীতির বাইরে যায়া যেই ব্যাপারগুলা ঘটাইছেন নিজের রীতিতে অগুলা ঢুকায়ে ফেইলা। বাকি ব্যাপারগুলা তো আছেই।
৪.
আমার মনে হয় কি, কোনো সংবেদনশীল, আধুনিক কবিতার কিছুমাত্র খোঁজ রাখা লোকও তাঁর কবিতা পইড়া হেভি আরাম বা মজা পাইবো।
হু.মা মওলানার দিকে সবচে বড় নজর রাখবার কারণ হইলো, যেই লোক আপাদমস্তক কওমি মাদরাসার তালেবে এলেম, কিন্তু শিল্পনন্দনে সম্যক ইউরোপিয়ান, সেই লোক আইলসেমি এবং পরিতৃপ্তির ভিতর দিয়া কি স্বগত পঙক্তি সাজাইলেন। বইয়ের প্রকাশক হইল, ঢাকাপ্রকাশ। দাম ১২০টাকা।