হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার (তৃতীয় পর্ব) ।। অনুবাদ: পৌলমী সরকার

প্রশ্ন: আপনার লেখায় যেন ঠিক দুই ধরণের নারী চরিত্র থাকে; যাদের সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্রটির প্রাথমিকভাবে বেশ দৃঢ় সম্পর্ক থাকে – প্রায়ই সেই নারী তারপর হারিয়ে যান এবং তার স্মৃতি তাকে কেবল তাড়া করে বেড়ায় – আরেক ধরনের নারী চরিত্র যারা তারপরে কেন্দ্রীয় চরিত্রটির জীবনে আসে এবং হয় তার গন্তব্যের দিশা দেখায় অথবা স্মৃতি থেকে সেই প্রথম নারীকে মুছে দেয়। এই দ্বিতীয় নারীটিকে দেখা যায় অনেক সহজভাবে, যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়েও যে অনেটা মুক্তমনা এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকেও তার সাথে বেশ উষ্ণ আলাপ করতে দেখা যায় – যা সে প্রথম নারীর সাথে করতো না, এমনকী তার সাথে বিশেষ হৃদ্যতাও ছিলো না। এই ধরনটির কি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে কোনো?

হা.মু: আমার কেন্দ্রীয় চরিত্রটি সব সময়ই বাস্তব জগৎ আর আধ্যাত্মিক জগতের এক সীমারেখায় বিচরণ করে। আধ্যাত্মিক জগতে নারী, পুরুষ সকলেই শান্ত, বুদ্ধিমান, বিনয়ী, জ্ঞানী। কিন্তু বাস্তবের নারীরা অনেক বেশি সক্রিয়, চতুর। তাদের যথেষ্ট হাস্যরস আছে। এখানেই কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মন দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে এবং সে ঠিক বুঝতে পারে না কোন্ জগৎটি তার জন্য সঠিক। আমি মনে করি এটিই আমার লেখার মূল বৈশিষ্ট্য। এটা Hard Boiled Wonderland এ বেশি করে প্রকাশ পায়। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি মানসিকভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। Norwegian Wood এও তাই। সেখানেও দুটি নারী চরিত্রের মধ্যে সে কোনভাবে একজনকে বেছে নিতে পারে না – গল্পের প্রথম থেকে শেষ অব্দি।

প্রশ্ন: হাস্যরস সম্পন্ন নারীটিকেই ব্যক্তিগতভাবে আমার বেশি পছন্দ হয়। হাস্যরসের মাধ্যমে পাঠকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, কিন্তু ভালবাসার বিবিধ বর্ণনার মাধ্যমে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। Norwegian Wood এ আমি তাই সব সময় Midori-কেই খুঁজেছি।

হা.মু: বেশিরভাগ পাঠকই একই কথা বলবেন। বেশিরভাগই Midori-কেই বেশি পছন্দ করবেন। এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রটি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত তাকেই বেছে নেয়। কিন্তু ওর আরেকটি সত্তা যেন অন্য কোন একটি জগতেই থেকে যায়। সে কিছুতেই তা আটকাতে পারে না। এটি তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি মানুষেরই কিছু মানসিক দুর্বলতা থাকে। সেই দুর্বলতাও তাদেরই একটা অংশ। আমাদের দুটি সত্তা আছে – প্রকৃতস্থ এবং অপ্রকৃতস্থ। আমরা দুটি সত্তার সাথে অনেক কথা বলি। এটা আমার বিশ্বাস। আমি যখন লিখি, বিশেষত তখনই আমি আমার অপ্রকৃতস্থ সত্তাটির দেখা পাই। ‘অপ্রকৃতস্থ’ শব্দটি অবশ্য বলা ঠিক নয়। অসাধারণ বা অবাস্তব বললে মনে হয় ভালো। যদি একসময় আমাকে বাস্তবে ফিরে যেতে হয়, বাস্তব সত্ত্বাটি আবার জেগে ওঠে। কিন্তু ওই অবাস্তব সত্তাটি যদি আমার না থাকতো, তাহলে আজ আমি এখানে আসতে পারতাম না। অন্যদিকে, আমার কেন্দ্রীয় চরিত্রটি দু’জন নারীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাই একজনকে ছাড়াও সে এগোতে পারে না। সেক্ষেত্রে Norwegian Wood একটি সঠিক উদাহরণ।

প্রশ্ন: Norwegian Wood এর Reiko চরিত্রটি সেদিক থেকে খুব আকর্ষণীয়। কিন্তু তাকে ঠিক কোন জগতের বাসিন্দা বলা যায়? সে যেন উভয় জগতেই বিচরণ করে।

হা.মু: সে অর্ধ সচেতন এবং অসচেতন অবস্থায় থাকে। এটি একটি গ্রিক মুখোশ। একদিক থেকে দেখলে তার চরিত্রটি দুঃখের, অন্যদিক দিয়ে দেখলে মনে হয় সে হাস্যরসের অধিকারী। সে কিন্তু প্রতীকী। আমার ওর চরিত্রটা খুব ভালো লাগে। যখন আমি লিখছিলাম, তখনই আমার বেশ ভাল লেগেছিল তাকে; Reiko-San.

প্রশ্ন: আপনার বইয়ের অনুবাদের বিষয়ে জানতে চাইবো। নিজে একজন অনুবাদক হিসাবে, অনুবাদের সমস্যাগুলোর সাথে তো আপনি পরিচিত। আপনি কোন্ কোন্ বিষয়ের ভিত্তিতে আপনার বইয়ের অনুবাদক নির্বাচন করেন?

হা.মু: আমি তিনজন অনুবাদককে পছন্দ করি: Alfred Birnbaum, Philip Gabriel, Jay Rubin. এক্ষেত্রে আমার নীতি হলো ‘যিনি আগে আসবেন তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। আমরা বন্ধুস্থানীয়। সুতরাং এ ব্যাপারে প্রত্যেকেই সৎ থাকি। তারা আমার বই পড়েন এবং তাদের মধ্যে একজনের সেটিকে খুবই ভালো লাগে। তিনি কাজটি করতে চান। সুতরাং তিনিই সেবার দায়িত্বটি নেন। নিজে একজন অনুবাদক হিসাবে আমি জানি, কোন বিষয়ের অনুবাদ ভাল হওয়ার মূল কারণ হলো বিষয়টি নিয়ে উৎসাহ। যে বিষয়টি অনুবাদ করতে যাচ্ছেন, খুব ভাল অনুবাদকেরও সেই বিষয়টি নিয়ে যদি বিশেষ উৎসাহ না থাকে, তাহলে গল্প সেখানেই শেষ হয়ে যায়। অনুবাদ একটি পরিশ্রমের কাজ এবং এটি সময়সাপেক্ষও।

প্রশ্ন: অনুবাদকদের মধ্যে মনোমালিন্য হয় না?

হা.মু: সেরকম নয়। তাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ আছে। তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন চরিত্রের ভিন্ন মানুষ। ‘Kafka on the Shore’ টি Phil এর খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনিই সেই বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন। Jay এর বিশেষ ভাল লাগেনি। Phil খুব নম্র ও ভদ্র স্বভাবের একজন মানুষ। Jay খুবই সতর্ক, যত্নবান ও যথার্থ একজন অনুবাদ। তিনি একটু বেশি দৃঢ়তাসম্পন্ন মানুষ। Alfred একটু বাউন্ডুলে স্বভাবের আর কি। আমি জানিও না এখন ও কোথায়। ও মিয়ানমারের এক নারীকে বিয়ে করেছিল। তিনি সক্রিয় একজন বিপ্লবী। মাঝেমাঝেই প্রশাসন তাদের গ্রেফতারও করেন। ও এরকমই একজন মানুষ। সে এক স্বাধীন অনুবাদক। অনুবাদ করলে কাহিনীতে সেও কিছু পরিবর্তন করে – মাঝেমাঝেই। এটাই তার কায়দা।

প্রশ্ন: অনুবাদকদের সাথে ঠিক কিভাবে কাজ করেন? কাজের অগ্রগতি, কায়দাগুলি যদি একটু বলেন?

হা.মু: তারা অনুবাদ করার সময়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। তারপর প্রথম খসড়াটি হলে, আমি সেটা পড়ি। কখনো কখনো কিছু পরামর্শ দেই। ইংরেজি ভাষায় আমার লেখার অনুবাদটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ছোট দেশে যেমন – ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া ইংরেজি অনুবাদ থেকেই ওরা ওদের ভাষায় আমার বইয়ের অনুবাদ করে; জাপানি থেকে পারে না। সুতরাং ইংরেজিতে সঠিক ও যথাযথ অনুবাদ হওয়া খুব প্রয়োজন। তবে অন্যান্য বেশিরভাগ দেশেই মূল জাপানি থেকে অনুদিত হয়।

প্রশ্ন: আপনি নিজে বাস্তববাদীদের যেমন: Carver, Fitzgerald, Irving প্রমুখের লেখাই অনুবাদ করতে পছন্দ করেন। এতে কি পাঠক হিসাবে আপনার রুচির প্রকাশ ঘটে? অথবা এটি কি কোনভাবে নতুন কিছু বিষয়েও লেখালেখি করতে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করে?

হা.মু: আমি তাদের বই-ই অনুবাদ করি, যাদের কাছ থেকে আমি কিছু শিখতে পারবো। এটিই প্রধান বিষয়। আমি এই বাস্তববাদী লেখকদের লেখা থেকে অনেক কিছুই শিখি। তাদের লেখা অনুবাদের জন্য নিবিড়ভাবে, নিপুণভাবে পড়া দরকার। এভাবে পড়তে গিয়ে তাদের কিছু না বলা কথাও যেন খুঁজে পাই। যদি আমি আধুনিক যুগের শেষের দিকের লেখক যেমন: Don Deliuo, Jhon Barth বা Thomas Pynchon প্রমুখের লেখা অনুবাদ করতাম, তাহলে তাদের অবাস্তব কল্পনার সাথে আমার কল্পনার বারেবারে সংঘাত হতো। তাদের লেখা আমি খুব পছন্দ করি যদিও, কিন্তু যখন অনুবাদ করি, আমি বাস্তববাদীদের বেছে নেই। যেখানে আমার কল্পশক্তির কোনরূপ আঘাত লাগে না।

প্রশ্ন: আপনার লেখাকে তো আমেরিকান পাঠকদের কাছে জাপানি সাহিত্যের সবথেকে বেশি সহজবোধ্য মনে করা হয়। কারণ আপনি নিজেই লেখক হিসাবে অন্যান্য জাপানি লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাশ্চাত্যঘেঁষা। আপনার সাথে জাপানি সংস্কৃতির কিরকম সম্পর্ক হতে পারে, তাই ভাবছিলাম।

হা.মু: আমি বিদেশে বসে বিদেশীদের নিয়ে লিখতে চাই না। আমি আমাদের নিয়ে লিখতে চাই। জাপানকে নিয়ে, জাপানের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখতে চাই। অনেকে বলেন যে আমার লেখার ধরনটি বিদেশী ছাঁচে ঢালা; হতে পারে সত্যিই তাই, তবে আমার গল্পগুলি কিন্তু আমারই – একদম নিজস্ব, তাদের কোন পাশ্চাত্যকরণ হয় না।

প্রশ্ন: অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকানরা আপনার গল্পে পাশ্চাত্যের কিছু সূত্র বা মিল খুঁজে পান। যেমন ধরুন The Beatles জাপানের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে।

হা.মু: যখন আমি লিখি আমার যে কোন একটি চরিত্র McDonalds এর হ্যামবার্গার খাচ্ছে, আমেরিকানরা অবাক হন যে আমার চরিত্রটি Tofu না খেয়ে Hamburger কেন খাচ্ছে? কিন্তু আমাদের কাছে Hamburger একটি খুব সাধারণ বিষয়। এটিকে প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনাই বলা যায়।

প্রশ্ন: তার মানে আপনি কি বলতে চান যে আপনার লেখায় সমকালীন জাপানের শহুরে সংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়?

হা.মু: যেভাবে আমার চরিত্রেরা কথা বলে, ভাবনা-চিন্তা বা কোন কাজ-কর্ম করে, তা সম্পূর্ণই জাপানি কায়দায়। কোন জাপানি পাঠক, প্রায় কোন জাপানি পাঠকই এটা বলতে পারবে না যে তা আমাদের জীবনযাত্রা থেকে আলাদা কিছু তুলে ধরে। আমি জাপানিদের নিয়েই লেখার চেষ্টা করি। আমি লেখার চেষ্টা করি আমরা কি, কোথায় যাই, কেনই বা যাই ইত্যাদি। এটিকেই আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু মনে করি। [চলবে]


#দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।


অনুবাদক পরিচিতি:
পৌলমী সরকার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানের ছাত্রী।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading