‘সিনেমা হইতেছে সর্বগ্রাসী একটা শিল্প। আর কবিতা একক একটা চরিত্র’ — ইলিয়াস কমল

কূটালাপ দশ মাসে ১৩ জন কবির সঙ্গে ফেসবুক ইনবক্সে আড্ডার আয়োজন। যে আলাপে তর্কের হার-জিতের খেলা না, শুধু শুধু পিঠ চাপড়ানো বা বাহবাও নাই। আড্ডাগুলোতে কবিতা, দর্শন, সিনেমা এবং সাহিত্যের বহুবিধ দিক নিয়ে অনেক অনেক কথা হয়েছে। কূটালাপের ১৩তম আড্ডায় মধ্যমণি ছিলেন কবি ইলিয়াস কমল। যার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন চিত্রপরিচালক হওয়া। কমলের সঙ্গে আড্ডায় স্বাভাবিকভাবেই কবিতা ও চলচ্চিত্রের আলাপ সমান্তরালে হয়েছে। কমলের সঙ্গে আড্ডা দেয়া যাক…


কবিতা সোসাইটিতেও তেমন এক্সিস্ট করে না। কবিতা একটা বিচ্ছিন্ন গ্রহের নান্দনিতার মতো। কবিতা মানুষের জীবনে বাধ্যগত কোনও কিছু না।


হাসনাত শোয়েব: কমল ভাই, কবিতার মতো একটা ভাবালুতা মার্কা বিষয় আপনি লিখতে আসলেন কেন?

ইলিয়াস কমল: আগে যদি সিনেমার প্রেমে পড়তাম, মানে সিনেমার প্রতি আগ্রহটা আগেই তৈরি হইতো তাইলে বালের কবিতা লিখতে আইতাম না। বলা যায়, কবিতার প্রেমেই পড়ছিলাম ছোটবেলা। আর নয়তো কবিতা দূর সতীনের ঘর
করতো।

হাসান রোবায়েত: আপনার প্রেম নিয়া আমার সন্দেহ আছে কমল দা!

কমল: কোন প্রেম? আপনার প্রতি আমার কোনও প্রেম নাই। সন্দেহ তাই অমূলক না।

রোবায়েত: আপনি বলছেন, ‘বলা যায়, কবিতার প্রেমেই পড়ছিলাম ছোটবেলা।’

শোয়েব: আপনি কবিতার প্রেমে পড়তেছেন ব্যাপারটা অশ্লীল। কি এমন পড়লেন যে, প্রেমে পড়ে গেলেন?

কমল: ঘটনাটা একটু পুরনো। আমার যে সবার বড় ভাই, মানে আমাদের সাত ভাই-বোনের মাঝে সবার বড়, আমরা তাকে বড়দা ডাকি। সে যখন কলেজে পড়তো, তখন তার লেখা ছাপা হইতো কলেজবার্ষিকীতে। ওই সময় আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করি নাই। তো আমার এই জিনিস ভালো লাগে। আরেকটু পর যখন স্কুলে যাই, তখন থেকেই মনে হইতো, কবিতা আমিও লিখব।এই রকম প্রেম। প্রেমের বহুত রকম আছে না? সব তো আর মেঘমঞ্জরির প্রেমে পড়ার মতো না।

শোয়েব: তারপর যখন সিরিয়াসলি কবিতা লিখতেছেন তখন কাদের কবিতা পড়ে আপনি মূলত অনুপ্রাণিত বোধ করলেন?

কমল: জীবনানন্দ। রূপসী বাংলা ইন্সপায়ার করছিলো খুব। কিন্তু কখনোই তার মতো হইতে চাই নাই। জীবনানন্দ শুরুতে ইনস্পায়ার করলেও যখন ৩০ এর দশকের পর আরও পড়তে শুরু করলাম, তখনকার অনুপ্রেরণা বিনয় মজুমদার।

শোয়েব: আপনি কবিতাকে মূলত কিভাবে ভাবেন? একটা সোসাইটিতে কবিতা কেন এক্সিস্ট করে? তার কাজ কি?

কমল: আমি বোধহয় কবিতাকে আর এক্সিস্ট করি না। বোধহয় বলতেছি এই কারণে, আমি কবিতা নিয়া কোনও ভবিষ্যত চিন্তা করি না। আমি চাই, লিখতে। আমার মাঝে কবিতা কোন জায়গায় থাকবে বা না থাকবে সেটা সময়ের ব্যপার। আর হ্যাঁ, কবিতা সোসাইটিতেও তেমন এক্সিস্ট করে না। কবিতা একটা বিচ্ছিন্ন গ্রহের নান্দনিতার মতো। কবিতা মানুষের জীবনে বাধ্যগত কোনও কিছু না। এইটা অতিরিক্ত। ফলে তার কাজ সৌন্দর্য বর্ধন করার মতোই।

রোবায়েত: আপনি কি নিভৃতচারী কবি?

শোয়েব: কিন্তু তবুও কবিতা টিকে আছে। এর পেছনে কোন প্রনোদনাগুলো কাজ করছে? যেহেতু এটা অলমোস্ট জনবিচ্ছিন্ন আর্ট ফর্ম।

কমল: কবিতা টিকে আছে মানুষের বহুরৈখিকতায়। মানুষ এখনো মানুষ। যন্ত্র না। ফলে মানুষ নিজেরে বাইরেও ভাবতে পারে। যেমন একটা মানুষ প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটা অফিস করে, কখনোই স্বাভাবিক রুটিন জীবনের বাইরে যায় না। সেই লোকটাও এমন কিছু করতে পারে বা করে যা তার পক্ষে অন্যরা ভাবতে পারে না।

রাজীব দত্ত: classical music তো কবিতার চে আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন। শোয়েবের প্রশ্নে..

কমল: এইটা মানুষের ইউনিক দিকগুলোর একটা। এই কারণে মানুষ দলছুট হয়, ব্যতিক্রম হয়। আর ভিন্ন রুচি খুঁজে ফেরে। এই যে মানুষ নিজের বাইরে অন্য কিছু খোঁজে, নিজেকেও অন্যকিছু মনে করে এইটা আছে বলেই পৃথিবীতে কবিতা টিকে আছে।
          এইবার রাজীবের উত্তরটা দিচ্ছি। কবিতার চেয়ে মিউসিজ (শব্দ) সবসময়ই শক্তিশালী। এখন একটা দুর্গে যদি মানুষ না থাকে, তাহলেও সেটা দুর্গ। আর একটা তাঁবুতে যদি মানুষ থাকে, সংসার থাকে সেটা সেই তাঁবুই। অনেকটা নরম আর শক্ত’র মতো। ক্লাসিক্যাল মিউজিক কবিতার চেয়ে জনবিচ্ছিন্ন হইলেও শক্তিশালী এবং এ কারণেই তার দাবি থেকেই যায়।
          এইবার রোবায়েতের প্রশ্ন- ফেসবুকে আমার প্রায় সাড়ে তিন হাজার বন্ধু। বাস্তবেও আমি মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারি। অন্তত কারো সাথে বিরক্ত না হয়ে গেলে। এমন একটা অবস্থায় নিভৃতিচারী কবি নিজেরে বলি কেম্নে? তবে আমি তো নিজেরে কবি হিসেবেই দাবি করি না। আমি মনে করি, আমি কবি না। কবি বিষয়টা আমার কাছে একটু ভারি, একটু টিপিক্যাল। আমি ওই টিপিক্যাল মানুষ হইতে চাই না। আমি মানুষ হইতে চাই। টগবগে আর প্রাণোচ্ছ্বল।

রোবায়েত: কবি ভারী এইটা কেন মনে হইলো?

কমল: ভারী একদম টিপিক্যাল অর্থে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গড়পরতা কবিদের যে ব্যক্তিত্ব আমরা দেখছি সেই হিসেবে। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ বা আরও আরও উল্লেখযোগ্য যে কবিগণ আছে, তাদের ব্যক্তিত্বের সাথে এই কথা যাবে না।

শোয়েব: আপনি কবি হতে চান না, আবার কবিতা লিখছেন এটা স্ববিরোধি না কিছুটা? আমিও অবশ্য তেমনই ভাবি। আপনারটা শুনতে চাই।

কমল: কবির যে সত্তা- সেইটা আমি ধারন করতে চাই না। আমি মনে করি, একজন বাস ড্রাইভারও কবিতা লিখতে পারে। সেই রকম একটা জায়গা থেকে নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকে লিখি। যখন এইটা আর ভালো লাগবে না, লিখব না।

শোয়েব: সেক্ষেত্রে সিনেমা এবং কবিতার তূলনামূলক বিচারটা আপনি কিভাবে করবেন?

কমল: এইটা ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। বলছি- সিনেমা যখন আবিষ্কার হয়, তখন কিন্তু এইটা একটা পিউর আর্ট হিসেবে আবির্ভুত হইছিলো। মানে এইটার সাথে তখন তেমন জনরুচির বিষয় ছিলো না। কিন্তু সিনেমার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যোগ হইছে পুঁজি। আর এইটা কেবল বাড়ছেই। ফলে, সিনেমার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ সম্পৃক্ত হইছে। আর কবিতার বিকাশের সাথে সাথে হইছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) জনবিচ্ছিন্ন। তাই সিনেমা আর কবিতা দুইটা বিপরীত মেরুর শিল্প। কারণ সিনেমা হইতেছে সর্বগ্রাসী একটা শিল্প। আর কবিতা একক একটা চরিত্র। আধুনিক সময়ে একক কোনও আইডলজি নিয়া মানুষ বাঁচতেছে না। মানুষ এখন নানামুখী জীবন-যাপন করে। নির্দিষ্ট কোনও একক ধর্মের (ইসলাম-সনাতন বা এই টাইপের ধর্ম না) অনুসারী মানুষ না। যে মানুষটা জ্যাজ শোনে, সে আবার ক্লাসিক্যালও শোনে। ফলে সিনেমা আর কবিতার কোনও তূলনামূলক কিছু হয় না।

শোয়েব: কিন্তু একজন যখন কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সিনেমা বানাইতে আসে তখনো কি ব্যাপারটা এরকম থাকবে?

কমল: এইরকমই থাকবে। একটা উদাহরণ দেই। একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। ওইখানে একটা ব্যাপার ছিলো, একটা লোক প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে বাসে উঠলো, ঘেমে-নেয়ে একাকার। এমন অবস্থায় বাসে থাকা একজন তার দুরাবস্থা দেখে হেসে দিলো, এবং যে মাত্র উঠলো সেও হেসে দিলো। এইখানে বাসের পুরনো যাত্রীর কোনও অনুপ্রেরণা প্রত্যক্ষ নাই। কিন্তু তার হাসির অনুপ্রেরণায় নতুন বাসে উঠা যাত্রীটাও হাসতে পারলো। তো এই রকম একটা কবিতা একটা সিনেমার অনুপ্রেরণা হইতেই পারে। আবার একটা কবিতা একটা খুনেরও অনুপ্রেরণা হইতে পারে। কার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসবে তার তো কোনও ইয়ত্তা নাই।

শোয়েব: আপনি তো সিনেমা বানাইতে চান। বিশ্ব সিনেমার পারস্পেক্টিভে বাংলা সিনেমাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? আর সংকটের রূপটা কেমন?

কমল: এই উত্তরটা একটু বিস্তারিত দিব। দীর্ঘ হবে। বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাপট না, বাংলাদেশের সিনেমার প্রেক্ষাপট, শোয়েব?

শোয়েব: বাংলাদেশ।

কমল: ওই অর্থেই বলছি। বিশ্ব সিনেমার পারস্পেক্টিভে বাংলাদেশের সিনেমার এখন পর্যন্ত কোনও নিজস্ব সিনেমাভাষা নাই। একটা ভাষা তৈরির সম্ভাবনা ছিলো সত্তর বা আশির দশকে। কিন্তু সেইটা শেষ পর্যন্ত নানা কারণেই দাঁড়ায় নাই। কিন্তু এখনও বাংলা সিনেমা বিশ্ব সিনেমার কাছে পৌঁছানোর সুযোগ রাখে। তার জন্য অনেক কিছু করা প্রয়োজন। কিছু সংকট তো আছেই। সেইসব সংকটের মধ্যে সবচে বড় যে বিষয়টা, এইটা হইতেছে আমাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা। আমরা এখনও সিনেমাভাষা বিষয়টা বুঝি না। ফলে সিনেমার ভাষাটা নিয়া আমাদের এই অজ্ঞতার প্রভাব আইসা আমাদের নির্মাতাদের সামনে এবং তাদের ঘাড়েও পড়ে। বিষয়টা কিরকম? ধরেন একজন টিভিতে কোনও সিনেমা বানাইলেও সেইটারে আমরা অনায়াসে নাটক বলে চালাই দিচ্ছি। এইখানে ভিজ্যুয়াল গল্প বলা বা ভিজ্যুয়াল পৃথিবী নির্মাণটাই যেখানে একটা সিনেমাকাঠামোতে পরে, সেইখানে নাটক বলে আদতে কিছু নাই। আমাদের দেশে যেইটা নাটক হয়, সেইটা তো অন্য বিষয়। একদমই আলাদা কিসিমের মাল। তো এইখানে আমাদের সিনেমার এই মুহূর্তে সবচে বড় সংকট হইতেছে নির্মাতা আর দর্শকের মাঝের পার্থক্য। নির্মাতা চায় তার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাষ্যে সিনেমা নির্মাণ করতে, আর দর্শক চায় তার রুচির সিনেমা। এই দ্বন্দ্বটা পৃথিবীর সব সিনেমাশিল্পেই আছে। কিন্তু আমাদের দেশের এই সংকটটা এই কারণে যে, আমরা (দর্শকরা) দীর্ঘদিন সিনেমার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি করে রাখছি। এই দূরত্ব তৈরির পিছনেও সিনেমা বানানোর কারিগররা আছেন। আবার এই দূরত্ব ঘোচাবেনও তারাই।ফলে এই সংকটটা কাটবে যতো বেশি সিনেমা হবে, ততো দ্রুত। বছরে যদি ৪০ থেকে ৬০টা ছবি হয়, তখন নানা ধরনের ছবি হবে। নানা ধরনের দর্শকরা হলে যাবে। আর নির্মাতার ভাবনার সাথে দর্শকের ভাবনার সেতুবন্ধন তৈরি হবে। ইন্ডাস্ট্রি আবারও বাড়তে শুরু করবে।

মোস্তফা হামেদী: সিনেমা হলই তো এখন হাতেগোনা। উপজেলা/জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ হল শপিং মলে পরিণত হইছে। ফলে সিনেমার সাথে মানুষের দূরত্ব তো অনিবার্য হয়ে উঠতেছে। নাকি হল তেমন গুরুত্বপূর্ণ না সিনেমাশিল্পের বিকাশে?

কমল: হল অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই হুলগুলো আরও ত্রিশ বছর-৪০ বছর পুরনো। আর দর্শকের রুচিও বদলে গেছে। এই পরিবেশে সব দর্শক হলে যাবে না। তাই একবার ইনভেস্ট করেই সিনেমা নিয়া বিজনেস করা যাবে না। সব বিজনেসের মতোই এখানেও অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী বারবার পুঁজি খাটাইতে হবে। নইলে দর্শক এই জায়গা থেকে বিমুখ হয়ে যাবে। আমার কাছে যখন আরও ভালো কিছু থাকবে, তখন আমি মন্দটা নিবো কেনো?

হামেদী: এই পুঁজি খাটানোতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা জরুরি?

কমল: রাষ্ট্র তো মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্রে চলে। এইখানে যে কেউ পুঁজি খাটাইতে পারে। সিনেমা একটা পুঁজিবাদী শিল্প। এইটাতে পূুজির নিয়ন্ত্রণ বেশি। রাষ্ট্র ভূমিকা রাখতে চাইলে রাখতে পারে। না চাইলে নাই।

হামেদী: কমল, তোর সাথে আমার পরিচয় দুই হাজার সাতের দিকে। ‘বসন্তের কবিতা উৎসব’ নামে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম রাশেদ শাহরিয়ারের সাথে। তোর মেসে ছিলাম। ময়মনসিংহকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার সাথে তোর কেমন যোগাযোগ ছিল? তোর সাহিত্যচর্চায় কোনো ভূমিকা আছে ঐ আবহের?


মেইনস্ট্রিম বা বিকল্প কোনও সাহিত্য নাই। সাহিত্য সব এক। ভালো লেখা আর মন্দ লেখা। সাহিত্য কোনও সিনেমার বিজনেসের মত বড় বাজেট, ছোট বাজেটের হয় না।


কমল: আমি কবিতা লিখতে শুরু করি এসএসসি পরীক্ষার পর। তখন সাধারণত ছড়াতে যেমন নানা ধরনের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরতো, ওগুলো দেখে মনে হইতো ওইটা কবিতা না- আর যাই হোক। তখন লিখতাম। তো ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার থেকে বাম রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। ময়মনসিংহে তখন শূন্য দশকের কবিদের একটা বড় সংখ্যা খুব অ্যাক্টিভ। তাদের সংস্পর্শে আশার আগে দেখলাম ময়মনসিংহের তারাকান্দায় (তখন তারাকান্দা ফুলপুর উপজেলার অংশ ছিলো, এখন স্বতন্ত্র উপজেলা) অনুশীলন সাহিত্য সংসদ খুব অ্যাক্টিভ। লিটলম্যাগকেন্দ্রিক কার্যক্রমে তারা মোটামুটি সারাদেশেই কম-বেশি পরিচিত। অনুশীলন সাহিত্য সংসদ থেকে সরকার আজিজ-এর সম্পাদনায় ময়মনসিংহ জং নামের পত্রিকা বের হইতো। পরে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর তাদের সংস্পর্শেও আসি।তারা চিন্তার গঠনে কিছু ভূমিকা তো অবশ্যই রাখছে। ময়মনসিংহে যারা আছেন, বা ওই সময় যারা ছিলেন তাদেরও যথেষ্ঠ ভূমিকা আছে। তবে হ্যাঁ, ময়মনসিংহের শামসুল ফয়েজ ছাড়া আর কোনও সিনিয়র কবি-সাহিত্যিকের আশপাশে তেমন মিশি নাই। সবই তরুণ। শূন্যের বা নব্বইয়ের শেষ দিককার। তাদের ভূমিকা অবশ্যই আছে। নানা ধরনের আড্ডা আর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ তাদের সাথেই প্রথম শেয়ার হইতো। নতুন লেখাও।

হামেদী: তারপর তোকে ঢাকা কেন যাইতে হইল? এইটা কি কেবল জীবীকার তাগিদে? নাকি সাহিত্যিক হওয়ার বাসনা থেকে? আগে তো এইরকম একটা প্রবণতা ছিল, সাহিত্যিক হওয়ার জন্য কোলকাতা বা ঢাকা যাইতে হবে। রাজধানীর বাইরে অবস্থান সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে?

কমল: ঢাকায় আমাকে জীবীকার তাগিদেই আসতে হইছে। আমি চেষ্টা করছি ময়মনসিংহে জীবীকা নির্বাহ করতে, পারিনি। তবে হ্যাঁ, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই আমি সিনেমার প্রেমে পড়ি। তখন মনে হইছে বাংলাদেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই সিনেমায় কিছু করার মিনিমাম চেষ্টা করলেও সেইটা ঢাকাতেই করা উচিত। তাই জীবীকার তাগিদ ও সিনেমার স্বপ্ন আমারে ঢাকায় আসতে বাধ্য করছে। দ্বিতীয়ত রাজধানীর বাইরের সাহিত্য আর রাজধানীর সাহিত্য বলে আসলে তেমন কোনও পার্থক্য নাই। যেমন শাহাদুজ্জামান তো লন্ডন বসে উপন্যাস লিখে। তার আগের উপন্যাসগুলোও তো ঢাকায় থাকতেই লিখছে। তাই বলে সেগুলো কি তখন বেশি বিক্রি হইছে? বা বেশি পাঠকপ্রিয় হইছে বা বেশি সমাদৃত হইছে? না। বিষয়টা হইতেছে তোমার কাছে কোয়ালিটি লেখা থাকলে তুমি যে কোনও দেশে বা যে কোনও স্থানে থেকেই প্রকাশ করো তাহলে সেইটা তার নিজের জায়গা করে নিবেই।

হামেদী: ময়মনসিংহ অঞ্চল তো পালা, গীতিকা, বাউল গানে খুবই সমৃদ্ধ। এক অর্থে গ্রামবাংলার শিল্পচিন্তার ভাষাই এইগুলা। ঠিক কী কারণে এই ভাষা আমরা আর চর্চা করতে চাচ্ছি না বা পারছি না? কিংবা মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে এই ভাষা আদরণীয় হয়ে উঠলো না কেন?

কমল: এই কথা ঠিক যে, লোকজ সাহিত্যিক নিদর্শনের দিক দিয়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল বেশ সমৃদ্ধ। এই কথা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নাই। এইগুলো গ্রাম-বাংলার শিল্পচিন্তা ঠিক না, পুরো সামগ্রিক বাংলার জীবনচিত্রই ওই সময়কার বিভিন্ন লোকজ সাহিত্যে আসছে। এমনকি এখনকার সময়েও সেই সময়ের অনেক লেখা অনেক বেশি বাস্তব এবং ব্যবহারিকও। কিন্তু তোর ভাষা-সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হয়ে তো এই বিষয় খুব স্পষ্ট করেই জানার কথা যে, সময় ও স্থানের সাথে ভাষা বদলায়। ফলে সেই সময়ের জনমানুষের ভাষা বদলাইতেছে। আমরা যতটা না লোকজ, তারচে বেশি নাগরিক হওয়ার চেষ্টা করি। ফলে আমাদের জীবন ও ভাষার মধ্যেও এই প্রভাব আছে। আমাদের মুখের ভাষা আর জীবনের ভাষা এক না। আর দুই তিনশ বছর কেন, ৮০/৯০ বছর আগের যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা, সেই ভাষাতেও আমরা এখন লিখি না। কেন? এইটা জীবনের স্বাভাবিক পরিবর্তনের সাথে ভাষা বদলাবার কারণেই। মেইনস্ট্রিম বা বিকল্প কোনও সাহিত্য নাই। সাহিত্য সব এক। ভালো লেখা আর মন্দ লেখা। সাহিত্য কোনও সিনেমার বিজনেসের মত বড় বাজেট, ছোট বাজেটের হয় না।

হামেদী: সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতা সম্পর্কে তোর মূল্যায়ন কী? এইটা কি কোনো ফাঁদ? নাকি সভ্যতার স্বাভাবিক গতিতেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে হচ্ছে?

কমল: আন্তর্জাতিকতা একটা নিজস্ব ধারণা। আমি যে এখনও হেমিংওয়ের উপন্যাস পড়ে, মার্কেসের উপন্যাস পড়ে শিহরিত হই তার কি আন্তর্জাতিকতা? আন্তর্জাতিকতাটা ঠিক কী জিনিস? এইটা একটা ফাঁপা বুলি বলেই মনে হয় আমার। ধরি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কোনও বই যখন স্পেনের বা কম্বোডিয়ার কোনও পাঠক পড়বে, সে এইটা নিতে পারবে কী না? যদি পারে তাইলে ওইটা তারও সাহিত্য। এইটারে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলা যায়। তবে পৃথিবী যেহেতু নিজেই একটা গতিতে ছুটতেছে, আর সবকিছুর গন্তব্য হইতেছে ভার্চুয়ালিটি। এই ভার্চুয়ালিটির মধ্যে দিয়া সমস্ত কিছু একত্রিত হইতে পারে। এর বেশি কিছু না। এইটা মানে যেইটারে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলা হইতেছে এইটা স্রেফ একটা বাজার।

হামেদী: ‘অতিরিক্ত বাগানবাড়ি’ বাংলা কবিতায় নতুন কী সংযোজন করলো?

কমল: ফালতু একটা প্রশ্ন। একদম সিনেমার নায়িকাদের যেমন করা হয়, শরীর ঠিক রাখতে আপনি কী করেন!

ফারাহ্ সাঈদ: ‘অতিরিক্ত বাগানবাড়ি’ আপনার কবিতার বইটির নামের মাঝে একজন জমিদারকে দেখতে পাই , যিনি ঘাপটি মেরে বসে আছেন। এই সৌখিন জমিদারারের মনোজগতে কবিতা কীভাবে ধরা দেয়?

কমল: রবীন্দ্রনাথ তো জমিদার ছিলেন। আর নজরুল তো বলতে গেলে রাস্তার ছেলের মতোই ছিলেন একটা সময়।কবিতা কি আর ওই জমিদারি দেখে চলে? আমরা তো হাসন রাজারে দেখছি, যে কিনা তার বিশাল জমিদারি রেখেও গানের পেছনেই ছুটছে। গানরে ভালোবাসছে। আমরা তার নাম গানের জন্যই মনে করি। তার সম্পদ বা জমিদারির জন্য মনে করি না। তাই কবিতা কীভাবে ধরা দেয়? এইটা আসলে যতটা না বলার, তারচে বেশি অনুভব করার বিষয়। আমার কাছে কবিতা একটা লোকাল বাসে বসে থাকার সময় একটু বাতাসের মতো। তার কোনও নির্দিষ্ট ধরন নাই। যেকোনও সময় যেকোনভাবেই ধরা দিতে পারে।

ফারাহ্: ‘মুনিয়ার জন্য ভবিষ্যৎ’ এই কবিতাটিকে আসলে আমার অনুগল্প বলে মনে হয়েছে। পাঠকের এই রকম প্রতিক্রিয়াকে কিভাবে দেখেন?

কমল: মুনিয়া আসলে আমার ভবিষ্যৎ। আমি ভাবতেছিলাম, যে আমি যেখানে যাইতে পারবো না, বা যেখানে আমি পৌঁছতে পারবো না, সেখানে কি আমার কোনও কিছু পৌঁছবে কী না! এই রকম একটা অনুভূতি আমার ছিলো ওই কবিতাটা লিখার সময়। অনেক পুরনো কবিতা। আর আমার কবিতার একটা কংক্রিট ধরন নাই। কিছুটা বহুরূপী। এই বহুরূপী স্বভাবের মধ্যে গল্প-অনুগল্প ভাব থাকতেই পারে। অসম্ভব কিছু না। সেইটারে আমি লেখাটার একটা ভিন্নরূপ হিসেবেই দেখি।

ফারাহ্: রোবট সোফিয়াকে আপনার লেখা কোনো কবিতা শোনাতে চাইলে কোন কবিতাটির বেছে নেবেন? কেন?

কমল: তার প্রতি আমার কোনও আগ্রহ নাই। তার বরং আমারে নিয়া আগ্রহ থাকতে পারে। আর আমি কবিতা শোনাইতে চাই না। পড়াইতে চাই। অবশ্য সে পড়তে চাইলে অন্য কথা। তখন বলবো তার যেইটা মন চায় সে সেইটাই পড়ুক।

ফারাহ্: ‘মেডিটেশন’ কবিতাটা লেখার পেছনে কোন স্মৃতি বা গল্প আছে কী? মনে হচ্ছিলো আপনি কোন সময়কাল লিপিবদ্ধ করছেন।

কমল: ২০০৬ সালে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেই, তখন আমার খুব বাজে সময় যাচ্ছিলো। একটা সময় দেখা গেলো, রাজনৈতিক বন্ধু ছাড়া আমার খুব একটা বন্ধু নাই। মানে দুই-একজন সাহিত্যিক বন্ধু ছিলো সিনিয়র। ওই সময়টা আমি খুব বাজে কাটাইছি। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে মিশতে পারতাম না সহজে। তাদের অধিকাংশই খুবই গতানুগতিক জীবন যাপন করে। তাদের জীবনে কোনও সংস্কৃতি নাই। ওই সময় আমি নিজে যে সংগ্রামটা করছি এইটা খুব তীব্র ছিলো। মনে হইতেছিলো অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার মতো। এমনিতেই আমি অস্থির প্রকৃতির, তখন আমার মানসিক অবস্থা আরও অস্থির হয়ে গেছিলো। তখন কলেজের এক বড় ভাইরে দেখতাম খুব ঠাণ্ডা জীবন যাপন করে। তার ভেতর উচ্ছ্বাসহীন একটা জীবন কাটায়। আমি ওই রকম হইতে চাইছিলাম। তারে জিগাইলে সে বলে সে মেডিটেশন করে। আমিও করতে চাইছিলাম কিছুদিন। পারিনি। বরং তাদের মেডিটেশনগুলো যে ভুয়া ছিলো, সেইগুলো আমার কাছে ধরা পড়ছিলো বলে ভাবছিলাম। তখন নিজের সময়টাকে আঁকতে চাইছিলাম লেখায়।

ফারাহ্: বহুল সমাদৃত কবিতা ‘বনলতা সেন’ -কে ঘিরে সমকামিতার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্যে কোথাও কী এমন ধারনা পাওয়া যায়? নাকি এটা নিছক ভ্রম?

কমল: সমালোচনা বা আলোচনা সবসময়ই পারস্পেক্টিভ নির্ভর। যেমন ধরেন কবিতায় কোনও কবি নিয়মিত পৌরাণিক উপাদান ব্যবহার করবেন এমন ইনটেনশন কয়জনের থাকে? বা বুদ্ধদেব বসু কি এমন ভেবে কবিতা লিখছেন? তবুও তো সাহিত্যের শিক্ষক-ছাত্ররা এই রকম অনেক কিছু নিয়ে গবেষণা করে। কেন করে? এইটা তাদের দেখার একটা নতুন আয়না। দেখতে চায় আসলেই আছে নাকি কিছু। এমনও হইতে পারে কবি এইসবের কিছুই ভাবেননি! বিষয়টা এইরকমই। নতুন একটা পারস্পেক্টিভ থেকে কেউ একজন দেখছেন। আর নিজের পক্ষে যুক্তি নিজেই বের করছেন। এর বেশি কিছু না।

শিমন রায়হান: আপনার লেখা প্রথম পড়ি ‘উজান বাকের পায়রা’ শিরোনামে ‘লোক’ এর একটি বিশেষ আয়োজনে। সম্ভবত এটিই ছিল দ্বিতীয় দশক ঘোষণা দিয়ে প্রথম কোন আয়োজন, পত্রিকার শেষে একটি বিশেষ পর্বের মতো। আপনি কি এরকম দশক বিভাজনে বিশ্বাসী?

প্রকাশক : ঐতিহ্য
প্রকাশক : ঐতিহ্য

কমল: দশক বিভাজনটা খুব জরুরী না। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে জরুরীও। যেমন ধরুন আপনি একটা সময়ের কোনও প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চান তখন তার জন্য দশক জরুরী। কিন্তু আপনি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে দশক জরুরী না। দশক বিভাজনের কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা দুই’ই আছে। সুবিধার মধ্যে হলো এই সময়ে অনেকেই নিজের দিকে ফোকাসড হওয়ার সুযোগ পায়। আবার এইটা অসুবিধাও। ধরেন গত দশকেও আমরা দেখছি কেউ কেউ লিখছে, আবার এই দশকেও লিখতেছে। তো গত দশকে তার দিকে ফোকাস ছিলো না, এই দশকে কিছুটা আছে। এই রকম সুবিধা-অসুবিধা আর কি। এইটারে নিয়া খুব উৎসাহও নাই আমার, আবার একেবারে নিরুৎসাহও নাই।

শিমন: এরপর রজত সিকস্তি সম্পাদিত মেটাফিজিকস-এ বোধহয় আমরা একই মলাটবদ্ধ হই। আমার স্মৃতিশক্তি যদি প্রতারণা না করে তাহলে সেখানে কবিতার পাশাপাশি কাব্যভাবনাও প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। আপনার কাব্যভাবনার কিছু নবায়ন ঘটেছে কি এর মধ্যে?

কমল: ওই কাব্যভাবনার কিছুই মনে নাই। তবে ওই সময় যা ভাবতেছিলাম তা লিখছিলাম। এখন তার সাথে মিল-ও থাকতে পারে, অমিল-ও। মোটেও আশ্চর্য হবো না এমন কিছু হইলে।

শিমন: কবিতার চর্চায় দারুণ মুখর পশ্চিমের অনেক শহরেই এখন তা দূর অতীত হয়ে গেছে বলে জানা যায়। কবিতা কি একটি ডেড আর্ট আজকের দিনে?

কমল: কবিতা কখনোই ডেড আর্ট না। কবিতা এখন বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার নানামুখী কারণ। আমি মনে করি এর পেছনে সবচে বেশি দায় পুঁজির। পুঁজি তো মানুষকে নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন করে তোলে। আমি একটা বইয়ের কথা বলতে পারি, মানুষ পুঁজির কাছে কিভাবে সহজে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে তা বোঝা যাবে ওই বইয়ে। শাহযাদ ফিরদাউস-এর উপন্যাস শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার। এই উপন্যাসটা খুবই ছোট। ১শ ২০ পৃষ্ঠার মতো। ওইখানে দেখায় যে মুক্তবাজার অর্থনীতি কোন জায়গা পর্যন্ত যেতে পারে। আর পশ্চিমের শহর কবিতার জন্য অতীত হয় নাই। অতীত হইছে জীবনযাত্রার জন্য। সেখানেও পুঁজিই প্রধান চালিকাশক্তি। কবিতার সাথে পুঁজির একটা বৈপরিত্য আছে। কবি হয়তো সম্পদশালী হইতে পারেন, কিন্তু পুঁজিপতি না। দুইটা ভিন্ন জিনিস। তাই বলবো কবিতা মোটেও মৃত শিল্প না।

শিমন: চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা আপনার তুমুল আগ্রহের বিষয়টি জানি। একজন কবি ও চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র বানাতে গেলে চলচ্চিত্র তার কাছ থেকে কী বেশি বা কম পেতে পারে?

কমল: একজন কবি যদি চলচ্চিত্র বানান, তাহলে সেটা অবশ্যই আর দশটা সিনেমা নির্মাতার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে। তবে তিনি কি কবি হিসেবেই সিনেমাটা বানাচ্ছেন, না সিনেমা নির্মাতা হিসেবে বানাচ্ছেন এইটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে। ধরুন সত্যজিৎ রায় কবি ছিলেন না। কিন্তু তিনি যে সিনেমা বানাইছেন, সেই সিনেমা কি রবীন্দ্রনাথ বানাইতে পারতেন? শক্তি চট্টোপাধ্যায়? না। বিষয়টা এমন যে, তার কবিসত্তা বা সিনেমা নির্মাতাসত্তা একীভূত হচ্ছে কী না! যদি হয়, তাহলে সিনেমা অবশ্যই নতুন কিছু পাবে।

শিমন: জীবিত চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে আপনার পছন্দের মধ্যে কারা রয়েছেন? অন্তত দুজনের নাম বলতে পারেন।

কমল: ইনারিতু আমার পছন্দের নির্মাতা। এর পর উডি অ্যালেনের নাম বলবো। তবে এইভাবে দুইজনের নাম বললে অন্যদের প্রতি অন্যায় হয়ে যায়।

শিমন: এ সময়ের বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে কাদের কিংবা কার কথা বলবেন?

কমল: বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের প্রতি প্রেম ক্ষণজন্মা। দীর্ঘ সময় ভালো লাগা ধরে রাখে না। তবে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত’র কাজ ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ মনে রাখার মতো।

শিমন: দেশে চলচ্চিত্রের একটি খারাপ কাল অতিবাহিত হচ্ছে। যদি ধরে নিই কয়েকটি ধারাবাহিক পদক্ষেপে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। তবে আপনার দৃষ্টিতে প্রথম পদক্ষেপ কী হবে?

কমল: সিনেমায় ইনভেস্টর আসতে হবে। আর প্রচুর ছবি বানাইতে হবে। বছরে কম করে হলেও ৫০টা ছবি হইতে হবে।এত ছবিই তো এখন হয় না।


আমি আমার দেশের অনেক সিনেমা নির্মাতাদের চেয়েও ভালো সিনেমা বানাব, এই আত্মবিশ্বাস আছে।


শিমন: কিন্তু ব্যবসা না জমলে বিনিয়োগকারী আসবেন কেন?

কমল: একদম মরুভূমিতেও ব্যবসা করা যায়। ব্যবসাটা বোঝাইতে হবে আপনাকে! আমার যে পণ্য দরকার, সেইটা দিতে পারলে তো অবশ্যই নিবো। যেকোনও সময়, যেকোনও জায়গা থেকেই নিবো।

রোবায়েত: আপনার বই ‘অতিরিক্ত বাগানবাড়ি’ প্রায় কয়েকবার পড়েছি। ভালো লাগা খুবই কম। পুরা বই পড়তে গিয়ে কয়েকবার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছি। খুবই বর্ণনাত্মক লাগছে। অতিকথন আর ক্লীশে। অথচ এই বইটাতেও চমৎকার কয়েকটা কবিতা আছে। আমার কেন জানি মনে হয়েছে কবিতা নিয়ে আপনি সিরিয়াস না। সত্যিই কি তাই?

কমল: হ। একদম তাই। কবিতা নিয়া মোটেও সিরিয়াস না। সিনেমা নিয়া সিরিয়াস।

রোবায়েত: পৃথিবীতে ব্যর্থ কবিদের ভয়ংকর ডিরেক্টর হয়ে ওঠার ইতিহাস আছে। আপনি কি সেদিকেই আগাচ্ছেন?

কমল: ভয়ংকর ডিরেক্টর বলতে কোনটা বুঝাইতেছেন?

রোবায়েত: মারাত্মক ভালো সিনেমা বানাইছেন এমন।

কমল: আমি আমার দেশের অনেক সিনেমা নির্মাতাদের চেয়েও ভালো সিনেমা বানাব, এই আত্মবিশ্বাস আছে। তবে সেইটা ঠিক কেমন হবে জানি না। আমার কমার্শিয়াল মানে মাস পিপলের ছবির প্রতিও তুমুল আগ্রহ। কিন্তু অবশ্যই সেইটাও আমার নিজের মতো। আমি চাই সিনেমাটা মানুষ যেমন কল্পনা করে এমনই হোক।

রোবায়েত: যেমন ধরেন ‘অযান্ত্রিক অক্ষরের প্রতিলিপি’ এই অংশের ০৭ নম্বর কবিতা। এইটা একটা ভালো সিনেমার গল্প হইতে পারে। বা ধরেন ‘শিমুলপুর রোড’। এইগুলো যদি সিনেমা হয় তবে, সংসারের দেয়াল ঘড়ি আর মৃত্যুকে কিভাবে ইমেজে বাঁধতে চান আপনি? বা ধরেন, ‘আমাদের আশেপাশেই শিমুলপুর রোড / অল্পক্ষণের পথ।’ এই অল্পক্ষণের পথ আপনি ক্যামেরায় কিভাবে দেখাতে চান?

কমল: আমি আমার কল্পনার রাজ্য লিখতে চাইছি, সেইটা ভিজ্যুয়াল করতে চাইছি কবিতায়। পাঠক জানে, সেইটা তার কাছে সেইটা ভিজ্যুয়াল হইছে কী না। তবে কবিতার ভিজ্যুয়াল আর সিনেমার ভিজ্যুয়াল পৃথক। আমি আগে বলছি, কবিতা হইতেছে জনবিচ্ছিন্ন একটা ব্যক্তিক মাধ্যম। এইটা নিজের কাছে আরও নিজের করে তোলে। আর সিনেমা এক্সপ্লোর করে, নিজের ভাবনা নিজের কাছ থেকে আরও দূরে আরও বেশি মানুষের কাছে ছড়াইয়া দেয়। এইটা বেশি মানুষ সংশ্লিষ্ট। তাই কবিতার ভিজ্যুয়াল আমি করতে চাই না। বরং জীবনের ভিজ্যুয়াল নিয়া আমি ভাবি।

রোবায়েত: কিন্তু আমি যে দুইটা কবিতার লাইন বললাম ওগুলো তীব্রভাবে জীবনেরই কথা বলে। তাইলে তা সেলুলয়েডে আসতে সমস্যা কোথায়? কিয়োরাস্তামির ‘Through the Olive Trees’ এর শেষ সিনে কিন্তু এমন জীবনেরই ইমেজ আসছে লং শটে, অলিভ বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। অথবা ধরেন, ‘Wind Will Carry Us’ এর শেষ দৃশ্য।

কমল: জীবনের কথা সব লাইনই বলে। আপনি কি বলবেন, আপনার কবিতা কোনও জীবনের কথা বলে না? সবকিছু অডিও ভিজ্যুয়াল করতে হবে কেনো? ধরুন জীবনানন্দের বনলতা সেন নিয়া মানে ওই কবিতাটা নিয়া যদি কেউ সিনেমা বানায় (শুনলাম বানাইতেছে) তো সেইটা কী কবিতার মতই হবে? ওই স্বাদ বা অনুভূতিই দিবে? আমি মনে করি না। সিনেমা আসলে সিনেমার স্বাদই দিবে। যদি সেইটা সিনেমা হয়ে ওঠে আর কি। এখন কথা হইলো আমার কবিতায় যে জীবন আছে, আমি কি সেই জীবন সিনেমায় চাই কী না? এইখানে এখনো দ্বিধা আছে আমার। আমি আসলে নিজের একটা সিনেমা জগৎও চাই আবার মানুষের জন্যেও সিনেমা বানাইতে চাই। মানে আমি চাই মানুষ তীব্রভাবে সিনেমার কাছাকাছি থাকুক। এইখানে যখন সিনেমা যাত্রাটা শুরু হবে তখন আসলে গন্তব্য চূড়ান্ত হবে। যেহেতু এখনও জার্নিটা শুরু হয় নাই বলা যায়, তাই এই উত্তরের জন্য আপনার কিছুটা অপেক্ষাও করতে হবে।

রোবায়েত: ‘ভিরিদিয়ানার বাড়ি’ আমার খুব পছন্দের কবিতা। কেন যেন মনে হয় এই কবিতাটা স্বপ্ন আর বাস্তবের নো-ম্যান্স ল্যান্ডের আখ্যান বর্ণনা করে। কিছুটা Midnight in Paris এর মতো। ভিরদিয়ানার পথ। এখানে আমারও যাইতে ইচ্ছা করে। এই যে কবির নো-ম্যান্স ল্যান্ড সেটা কি ভাষায় ধরা যায় আসলে?

কমল: ‘ভিরিদিয়ানার বাড়ি’ কবিতাটা বইয়ে সবার শেষে যোগ হইছে। এই কবিতাটা লিখার সময়ও আমি ঠিক ওই যে মিডনাইট ইন প্যারিসের মতো একটা কল্পনার জগতে ছিলাম। আই মিন বাস্তবে হয়তো তখন অফিস করতেছি, কিন্তু ভাবনাটায় ছিলো একটা জগৎ। যেই জগৎটা কেবল কবির, অথবা ঠিক কবির না প্রতিটা সৃজনশীল মানুষের। ওই রকম একটা প্রেক্ষাপট থেকে কবিতাটা লিখা। আর ততোদিনে কবিতার পাণ্ডুলিপিও চূড়ান্ত। এই কবিতা লিখার পর আমি বাসায় গিয়ে আবার পুরো পাণ্ডুলিপি পুনর্গঠন করলাম। (আগেই বলে রাখি, এখন যেমন আছে তাতেই হা.রোর পড়তে বিরক্ত লাগছে, তখন পড়লে সে আমারে গালি দিত একদম) আর এই কবিতার বইটায় রাখার জন্য স্পেস তৈরি করলাম। প্রশ্ন হচ্ছে কবির নো ম্যান্স ল্যান্ড নিয়া। এইটা আসলে অনেকটা নির্বাণ লাভের মতো। আপনি নির্বাণ লাভ করলে যেমন আমি তার কিছুই পাব না, তেমনি আমার প্রাপ্তিতেও আপনার বোধে ঢুকবে না। তাই কবির নো ম্যান্স ল্যান্ড আসলে তার একান্ত নিজস্ব একটা জগৎ। এইখানে সে নিজেও সবসময় প্রবেশ করতে পারে না। কখনো কখনো পারে। যেহেতু এইটা এতোই দুর্বোধ্য একটা জায়গা, তো সেইটা ভাষায় প্রকাশ করাও কিছুটা দুর্বোধ্য হবেই।


আমার আগ্রহ সিনেমার প্রাণে। সহজিয়ায়। আমি কথা বলার মতো গল্প বলার মতন সিনেমাকে ভাবি। তাই আমার কবিতার ভাষাও অনেকটা তাই।


রোবায়েত: তাহলে কি দুর্বোধ্য কবিতাগুলো খুব বেশি ব্যক্তি কবির নির্বাণের টেক্সট?

কমল: না। বরং উল্টো। নির্বাণ তো কবির বিষয়। ওই সময়কার টেক্সট প্রসঙ্গে কবি ভালো বলতে পারবে। প্রত্যেকেরটা তো পৃথক।

রোবায়েত: বাংলা কবিতায় সিনেমার মেকানিজম ব্যবহৃত হয়ে আসছে বেশ অনেক দিন হলো। জীবনানন্দকে বলা হয় প্রথম জাম্পকাটের ব্যবহারকারী। ফ্রান্সে গদাররা এইসব ব্যাপক করছেন। আপনি যেহেতু অনেক আগে থেকেই সিনেমারও লোক। আপনার কবিতায় আধুনিক সিনেমার প্রয়োগ-কৌশল ব্যবহৃত না হয়ে বরং দেদারছে ব্যবহৃত হলো উপন্যাসের মেকানিজম। বর্ণনাপ্রধান, এলানো ভাষা [অধিকাংশ সময়েই ম্যাড়ম্যাড়ে]। এটা কেন ঘটলো? আপনার ভাষাকৌশল সিনেমা দ্বারা কেন প্রভাবিত হইলো না?

কমল: আমি সিনেমায়ও গল্প বলায় বিশ্বাসী। অনেক পোয়েটিক ও প্রশংসিত ছবিও আমি এভয়েড করি, কারণ আমাকে ধরে রাখতে পারে না। আমি মনে করি জীবনকে জীবনের মত স্বতঃস্ফূর্ত হইতে হবে। এর বাইরে আমি যেতে চাই না। যেমন আমি টাই-কোট পড়তে পারবো না বলেই কেবল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরির প্রতি আগ্রহী হই নাই। অথবা আমি এখন যা রোজগার করি, তারচে বেশি রোজগার করতাম এমন চাকরি যেইটাতে আমি স্বস্তি পাইতাম না। ওই চাকরিও আমি করি নাই। আমি অন্তরের শান্তি চাই। এ কারণে সিনেমার কোনও অংশ যদি কেবল নতুন টেকনিক হয়, সেরা হয় তার প্রতি আমি ততটা আগ্রহী না। আমার আগ্রহ সিনেমার প্রাণে। সহজিয়ায়। আমি কথা বলার মতো গল্প বলার মতন সিনেমাকে ভাবি। তাই আমার কবিতার ভাষাও অনেকটা তাই।

রোবায়েত: আমাদের অঞ্চলের মিথ নিয়ে আপনার আগ্রহ কেমন?

কমল: আমাদের অঞ্চলের দুই ধরনের মিথ। একটা লোকজ, আরেকটা পৌরানিক। কোনটার কথা কন?

রোবায়েত: আপনার আগ্রহ কোনটা নিয়ে? তবে যেকোনো মিথই সম্ভবত লোকজ। পরে তা পৌরাণিক হয়।

কমল: আমার লোকজ মিথগুলো নিয়া আগ্রহ আছে। ভালো লাগে। মনে করি এইগুলো সংরক্ষণ প্রয়োজন। তবে নিজের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে এইগুলোরে আমি ততটা চাই না। কারণ আমি মনে করি, আমার ভেতর যতটা না লোকজ ভাব আছে, তারচে বেশি নাগরিক ভাব। ফলে নাগরিক মুড আমারে তাড়ায় বেশি।

রোবায়েত: নগরও একদিন মিথ হবে। আজকের নগর তো এমন থাকবে না। যেমন ধরেন পুরান ঢাকা। এসব নিয়ে কাজ করবেন?

কমল: হ। আমার আগ্রহ আছে। মনঃস্তত্ব নিয়াও কাজ করার আগ্রহ আছে। আমার কবিতায় যে ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব (আপনার ভাষ্যে) তার পেছনেও মনঃস্তত্ব নিয়া কাজ করার চিন্তার একটা প্রভাব আছে। আমি নিজেও তো ম্যাড়ম্যাড়ে।

রোবায়েত: আপনি মোটেও ম্যাড়মেড়ে না। খুবই উজ্জ্বল আর চঞ্চল। কথা তীব্রভাবে বলতে পছন্দ করেন। বরং টেক্সটে আপনার চরিত্র উল্টা। এটা কেন? কেমন বানানো দুখী দুখী ভাব।

কমল: আমি মনে হয় আসলে ওই টেক্সটটাই। বাস্তবটাও একটা ভান। কোনটা সত্য সেইটা যে যেভাবে আবিষ্কার করবে সেইভাবে। আর দুঃখবোধ তো মানুষের সবচে শান্তির জায়গা। মানুষ যতটা দুখী বোধ করতে ভালোবাসে, জীবন উপভোগ করতে ততটা বাসে না। অবশ্য পারেও না।

রোবায়েত: মানে, মানুষ মূলত রোমান্টিকতার বাইপ্রোডাক্ট?

কমল: একদম। ধরেন, একটা মানুষ তিনশ কোটি টাকার মালিক। তার তো টাকার অভাব নাই। সেও টাকার অভাব বোধ করে। এইটাও ওই ধরনের কারণে। তার ভিতর আরও আরও টাকার জন্য দুঃখবোধ আছে বলেই সে এইটা করে।

রোবায়েত: আপনার সিনেমা-বিষয়ক গদ্য আমার প্রিয়। ইনারিতুর কাজ নিয়ে একটা গদ্য পড়েছিলাম। গদ্য কম লেখেন কেন?

কমল: গদ্য লিখতে পারলে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু ধৈর্য্য হারাইয়া ফেলি। মনে হয় দ্রুত বলে শেষ করে ফেলি। এই অস্থিরতা কাটাইতে পারি না বলে ৫ বছর ধরে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখবো লিখবো করতেছি, কিন্তু ধৈর্যে কুলায় না।

রোবায়েত: আচ্ছা, হলিউড এত ভূতের সিনেমা বানায় কেন?

কমল: এইটা আমিও জানি না। আমি ভূতের ছবি দেখি না। তবে আমার একটা ধারণা আছে। কোনও একটা গবেষণায় পড়ছিলাম মানুষ ভূতের ছবি দেখলে তার শরীরের কি জানি (চর্বি নাকি) মনে নাই কমে। হইতে পারে এই কারণে আমেরিকানদের কাছে হরর প্রিয়। তবে আমেরিকানদের কাছে এক কথায় ফ্যান্টাসি সব থেকে বেশি প্রিয়। ফ্যান্টাসির মধ্যে কিন্ত হররও পড়ে।

রোবায়েত: এমির কুস্তুরিকার ফ্যান্টাসি তো অমন না। ডেস্পারেট আর্ট তৈরি করেন উনি। কিন্তু হরর মুভিতে কেমন যেন। আমার ধারণা অধিকাংশ আমেরিকনরা অমন। বোম ফালাও আর হরর মুভি বানাও। দুইটাই তো হরর।

কমল: ফ্যান্টাসি কিন্তু বলিউডি তাইওয়ানের ছবিও অনেকটা হরর। রুচি অর্থে। কিন্তু আমেরিকানরা অলওয়েজ ডেস্পারেট। তারা এইরকম ছিলো না। কিসিঞ্জারের পর থেকে তাদের এই দোষ-গুণাবলি বিকশিত হইছে।

রোবায়েত: ধরেন, বিয়ে করলেন। বউ মানে ভাবী আর সিনেমা বা কবিতা কিছুই বানাইতে দিল না। কেমন লাগবে?

কমল: এইটা সম্ভব না। একটা গল্প পাবলিকলিই করি। বছর দেড়েক আগে আমার একটা বিয়ার প্রস্তাব আসছিলো। আমার এক কাজিন তার বন্ধুর শালির সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। তো আমি মেয়ের ছবি দেখলাম। তারপর মেয়ের দুলাভাই আর আমার ভাই একদিন আমার সাথে দেখা করতে আসলো। মোটামোটি আগাইতেছে। এমন সময় আমার সন্দেহ হইলো, আমি কি ঠিক পথে যাইতেছি কি না। ভাইয়েরে কইলাম আমি মেয়ের সাথে কথা বলব। সে ফোন নম্বর দিলো। তখন রমজান মাস। আমি বলছি যে আমি রোজা-টোজা করি না, নামাজও পড়ি না। তো আমার কথা সেই মেয়ে বিশ্বাস করলো না। সেই রমজানের ঈদে আমার অফিস ছিলো। ঈদের আগের রাত অফিস করে ঈদের সকালে বাসায় ফিরে ঘুম দিছি। সন্ধ্যায় যখন কথা হইলো তার সাথে, তখন জিজ্ঞাস করলো আপনি ঈদের নামাজ পড়েননি? আমি বললাম, বাসায় থাকলে পড়ি। অফিস থাকলে পড়া হয় না। এইবার সে বললো, আপনি তো ভালো মানুষ না। আমি (মানে ওই মেয়ে) ভাবছিলাম যে আমার স্বামী আমারে নামাজ পড়াবে। আমি তৎক্ষণাৎ বলে দিছি, তাহলে অন্য কাওরে বিয়ে করেন। আমারে নিয়া আপনার পোশাবে না।

রোবায়েত: হা হা। আর্টিস্টদের বিয়ে নিয়ে আপনার মতামত কী? করা বা না করা নিয়ে।

কমল: না কইরা থাকতে পারলে ভালো। কিন্তু নানা পারস্পেক্টিভ আছে তো। আর বাংলাদেশ তো দেখায় উদার, আসলে রক্ষণশীলতার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে একটা রাষ্ট্র। এইখানে যাই করো, বুঝে-শুনে।

রোবায়েত: তারকোভস্কির ডায়েরি পড়ছেন কমল দা?

কমল: না।

রোবায়েত: আচ্ছা। আমি আপ্নেরে গিফট করবো।

কমল: বাহ্। এইটা দারুণ হইবো।


১৩ কবির এই আড্ডাগুলো এক করে বই প্রকাশ করেছে দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য। বইটির ক্রয়মূল্য ৩৬০ টাকা। সরাসরি ঐতিহ্য থেকে ডেলিভারি পেতে ঐতিহ্যের ফেইসবুক পেজ www.facebook.com/oitijjhya এ অর্ডার করতে পারেন। এছাড়া https://www.rokomari.com/book/157660/কূটালাপ?ref=pbbr_t1_pg0_p29_pb175 এই লিংকে গিয়েও বইটি অর্ডার করতে পারেন। 


রুহুল মাহফুজ জয়: কমল, খবর কি? মেঘমঞ্জরি কিরম আছে?

কমল: মেঘমঞ্জরির খবর তুমরার নিওন লাগতো না। আমি একলাই নেই।

জয়: আমরা সবাই মিলেই জানি। জানতে পারি না?

কমল: জানবানে। বই করে নেই।

জয়: মেঘমঞ্জরি কি শুধুই কবিতা? এই সিরিজ নিয়া বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে?

কমল: ভাবি নাই। তার উপর নির্ভর করবে। সে আসলে কী চায়। সবকিছু কি নিজের চাওয়ার ওপর থাকে মিয়া?

জয়: তার মানে কবিকে কী তার কবিতা নিয়ন্ত্রণ করে?

কমল: অনুভূতি, চিন্তা এইগুলোতে তো প্রভাব থাকতেই পারে। প্রিয় মানুষের প্রভাব মানুষের জীবনে থাকবে না?

জয়: আমি কবিতার কথা বলছি। কবিতা বা সাহিত্য কী কবি বা সাহিত্যিককে নিয়ন্ত্রণ করে? তোমার অভিজ্ঞতা কিরকম?

কমল: এইটা কবি বা সাহিত্যের কল্পিত বা অনুভূতির জগতের ওপর নির্ভর করে। কবি যদি পুরোপুরি তার কল্পিত জগতে বাস করে, বাস্তব ওভারলুপ করে থাকতে পারে, তাহলে সেইটা নিয়ন্ত্রণ করে। নইলে এতটা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নাই।


ভাষা সবসময়ই একটা চলমান প্রসেস। আপনি জানেন, ভাষা প্রতি তিন কিলোমিটার পর পর বদলায়। একই শব্দ ৫০ কিলোমিটার পর অন্য রকম উচ্চারণ।


জয়: মেঘমঞ্জরি লেখা শুরু করার পেছনের ইতিহাসটা জানতে চাই।

কমল: এইটার ইতিহাসটা আমি বলতে চাই না। কিছু ব্যক্তিগত থাকুক। সবার জন্য জীবনের সব উন্মুক্ত করতে আমি চাই না।

জয়: আচ্ছা। আমরা যে কবিতার নতুন ভাষার কথা বলি, এই নতুন ভাষা বলতে তুমি কি বোঝ?

কমল: নতুন ভাষা বিষয়টা আসলে খুবই কমপ্লিকেটেড। এই মুহূর্তে আমি যেইটা বুঝি, সেইটা হয়ত ভবিষ্যতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। আবার এমনও হইতে পারে এইটাই ভবিষ্যতে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।

জয়: ১৯৯৩ সালে বিনয় মজুমদার একটা অংক করে দেখিয়েছেন বাংলা ভাষায় শব্দসংখ্যা মাত্র ২৪ হাজার, সেখান থেকে হয়তো দু হাজার বাড়ছে। তো নতুন ভাষা, নতুন শব্দ খোঁজা কতখানি জরুরী?

কমল: গত কয়েক বছরে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রচুর শব্দ যোগ হইছে। যেমন খুব সহজে আমরা বোকাচোদা বইলা গালি দেই, এই শব্দ কি বাংলা একাডেমি স্বীকার করছে? মনে হয় না। একাডেমি এতটা স্মার্ট হয় নাই যে এইসব শব্দ এত দ্রুত ধারন করে নিবে। ভাষা সবসময়ই একটা চলমান প্রসেস। ভাষা প্রতি তিন কিলোমিটার পর পর বদলায়। একই শব্দ ৫০ কিলোমিটার পর অন্য রকম উচ্চারণ। তো বিনয় মজুমদার আরও ২৪ বছর আগে এই সংখ্যার কথা বলছে। এই এত বছরে তোমার ভাষাও বদলাইছে। তাইলে নতুন শব্দগুলো আমরা খুঁজে দেখতেছি না কেনো? এইগুলো তো আমাদের ব্যবহারিক। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কবিতায় নতুন শব্দ ঠিক কতটা জরুরী? জোর করে নতুন শব্দ তৈরির চেয়ে যেইটা স্বতঃস্ফূর্ত সেইখানে নতুন শব্দ ব্যবহার হইলে সেইটাকে গ্রহণ করা খুবই জরুরী।

ফয়সাল আদনান: কবিতার ভাষা এরকম দুখী দুখী কেন? এটা এক্যুইজেশন না, আমরা সবাই কম-বেশি বিষণ্ন কিছু লিখি, কেন?

কমল: কবিরা পৃথিবীর সবচে বেশি অনুভূতিপ্রবণ। ফলে সমাজে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই সবার আগে কবিদেরকে নাড়া দেয়। যান্ত্রিকতা বা অনুভূতি বর্জন করে লিখলেও সেইটা পাঠককে (গণ অর্থে না, কবিতার পাঠক অর্থে) নাড়াও দেয় না। তাই কোনও না কোনভাবে কবিতায় অনুভূতির প্রকাশটা হয়ই। সে কারণেই বোধ হয় একটু দুখী দুখী ভাষা থাকে কবিতায়।

রাজীব: সবচে? শিওর তো?

কমল: আমার তো তাই মনে হয়।

রাজীব: ধরেন একজন মিউজিশিয়ান বা যারা ছবি আঁকে, বা একজন নাপিত, কেন সবচে বেশি অনুভুতিপ্রবণ না বলে মনে হয়?

কমল: কারণ, আমার কবিতার প্রতি পক্ষপাত একটু বেশি। তুলনামূলক আলোচনা করলে প্রতিটা সৃজনশীল মানুষই প্রচণ্ডরকম অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু যেহেতু আমি লেখার সূত্রের জায়গা থেকে বলছি, সে কারণেই এইটাকে বেশি বলে মনে হয়।

রাজীব: আমার তো নাপিত বা এরকম যারা সৃজনশীল না আদৌ, তাদের মধ্যেও অনেক সেনসেটিভ লোক থাকে বলে লাগে। ইভেন কসাইও হইতে পারে। পেশার সাথে সেনসেটিভিটির কোন সম্পর্ক আছে?

কমল: সেনসেটিভ তো নাই এই কথা বলিনি। বলছি, অবশ্যই আছে। তবে কবিদের প্রকাশটা আমি টের পাই বলে তাদেরকে বেশি মনে করছি। অবশ্যই একজন মুচিও পৃথিবীর সেরা অনুভূতিপ্রবণ হইতে পারে। কিন্তু তার প্রমাণ আমরা পাই না। কবিদের অনুভূতির প্রমাণ পাই বলেই বললাম।

রাজীব: কবির নাপিতের অনুভুতি টের না পাওয়াটা স্বাভাবিক। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক চুল কাটার টাইম পর্যন্ত।

কমল: কবি কোনও পেশা না। এইটা পেশার চেয়েও বড় কিছু। পেশাকে সবসময়ই পেশাদার জায়গা থেকেই দেখা উচিত। এইটার সাথে সেনসেটিভিটির সম্পর্ক করা বোকামি। বর্তমান বিশ্বে তো এইটার প্রশ্নই আসে না। আমি সাংবাদিকতা করি, আমাকে হয়ত প্রিয় মানুষটার মৃত্যু সংবাদ কভার করা লাগতে পারে। তখন কি আমি অনুভূতিপ্রবণ হয়ে যাবো?

ফয়সাল: আমি অবশ্য একমত হইলাম না। আমার মনে হয় এইটা সোসাইটির ঠিক করে দেয়া রোল ফুলফিল করার মতো ব্যাপার। সোসাইটি ভাবে কবিরা দুখী, কাদো কাদো, নিরামিষ। আমরাও সেই নর্ম পূর্ণ করতে দুখী কবিতার ফর্ম ফিলাপের লাইনে দাঁড়াইছি।

রাজীব: আমার লাগে কবি জিনিসটাতে মহত্ব আরোপের ফল এইটা। কবিরাও কবিতার জন্য টাকা দাবি করে। বেশ্যার মতোন। বা অন্য যেকোন পেশার মতোন।

কমল: সোসাইটি ভাবতে বাধ্য হইছে। সে একদিনে এই ভাবনায় দাঁড়ায় নাই। কবি একটা পেশা হিসেবে এখনো পৃথিবীর সব দেশে দাঁড়ায় না। তারা যে টাকাটা দাবি করে এইটা অনেক ক্ষেত্রেই একটা সম্মানি। যদিও এই সম্মানি বিষয়টাতে আমার আপত্তিও আছে।

ফয়সাল: তোর কি মনে হয় কমল, মানুষের হাতে যদি অফুরন্ত সময় চলে আসে মানুষ কি করবে তখন?

রাজীব: কবিরা কি ছুঁয়ো না, ইনফেকশন হবে টাইপ, ফুলের মতোন?

কমল: ফয়সালের এই প্রশ্নটা মজার। সাথে রাজীবেরটাও।

ফয়সাল: রাজিবেরটা মজার কিন্তু আমারটা সিরিয়াস, সামনে এমন একটা সময় আসতেছে, যখন কায়িক বা মানসিক পরিশ্রম করে টাকা কামানোর দায় মানুষের নাও থাকতে পারে। সেই সময় কী মানুষ তার ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টি নিয়ে অধিক বিজি হবে এখনকার তুলনায়? কবিতা, শিল্প এসব নিয়ে থাকবে, নাকি তারা সারাদিন পর্ন দেখে মাস্টারবেট করবে, সেক্সটিং করবে, ঘাড় ব্যাকা করে ফেসবুকে লাইক দিতেই থাকবে?

কমল: মানুষের অফুরন্ত সময় চলে আসলে কি করবে? অনেক কিছুই করবে হয়ত। কিন্তু সেইটা শুধু সময়ের কথা চিন্তা করলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে না। ধর, আমার হাতে অফুরন্ত সময়। কিন্তু আমার অন্য কিছু করার ক্ষমতা নাই। টাকা নাই কোনও কাজ করার। তখন আমি ওই সময় দিয়া কী করবো? অথবা পুরো সমাজেই যদি তখন টাকা না থাকে, তখন মানুষ বিকল্প ব্যবস্থা করবে। যেমন অনেক সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা টিভি সিরিয়াল বা উপন্যাসে আমরা এইরকম ভবিষ্যতবাণী দেখি। শুধু একটা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ঘটনাটা শেষ হবে না।

রাজীব: কবিরা কি ছুঁয়ো না ইনফেকশন হবে টাইপ, ফুলের মতোন?

কমল: আমি তা মনে করি না। সব কবিই তো নিজেরা যথেষ্ট শক্ত সময়ের ভিতর দিয়া যাইতেছে। কিন্তু অর্ন্তগতভাবে তার যে বেদনাবোধ তা তো আর প্রকাশ্য না। মানুষ এখন মাল্টি ডাইমেনশনাল হইতেছে। যেমন ধরেন, একটা মানুষ একটা প্রেম থাকার সময়ই আরেকটা প্রেম করতেছে। তার একই সাথে দুইটা প্রেম করার স্কিল তৈরি হইতেছে। একই চাকরিতে থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাজও করতেছে। একই সাথে বহু কাজ করতেছে মানুষ। এই রকম কবিরাও বহুমাত্রিক হইতেছে। তাদের অনুভূতি কেবল তার লেখায়ই থাকতেছে না। বাস্তবেও, তবে বাস্তবে কেবল অনুভূতিপ্রবণই সে না। অনেক রূঢ়ও।

রাজীব: আপনি কিন্তু কথায় যথেষ্ট স্ল্যাং বলেন, কিন্তু কবিতায় ঠিক স্ল্যাং না, অইরকম শব্দ নাই কেন? ধরেন। চোদাচুদি জাতীয়?

কমল: কোনও কবিতাতেই ‘র’ কোনও শব্দ নাই। আমার মনে হয় আমি এইগুলো বলতে যতটা স্বচ্ছন্দ, লিখতে ততটা স্বচ্ছন্দ না। তবে হ্যাঁ, সিনেমায় যে র-নেসটা থাকবে না তার নিশ্চয়তা নাই।

রাজীব: শুধু স্বাচ্ছন্দ্য, নাকি রুচির কোন বিষয়? যেহেতু কবিতা, বলা যাবে না এমন কোনকিছু আছে?

কমল: না। আমি এইটা মনে করি না। আমার এইরকম হেডেক এখনও তৈরি হয় নাই।

ফয়সাল: ব্যাপারটা কি এমন যে তোর কবিতার রুচিটা বাবু রুচি? বা আমাদের কাব্যরুচি বৃহদার্থে?

কমল: বাবু রুচি জিনিসটা কি?

ফয়সাল: মানে সবকিছু খুব ‘সুন্দর’ ভাষায় বলা, প্রমিত এক অর্থে, তথাকথিত বাজে কথা বা স্ল্যাং না বলা, কোলকাতাইয়া প্রভাবকেও ধরতে পারিস।

কমল: না মনে হয়। আমি একটু আগেও বলছি যে আমার লেখায় এই রকম আসেনি কিছু। তার মানে আমি হয়তো অন্য কোনও মাধ্যমে এই জিনিস বা এই রকম রূঢ় কোনও কিছু ব্যবহার করবো না তার নিশ্চয়তা নাই। এখন এইটারে তোরা যে যেভাবে দেখবি সেইটা তোদের রুচির ব্যাপার। তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

জয়: কমল, তোমার কাছে একটা লেখা কখন কবিতা হয়ে ওঠে?

কমল: নির্দিষ্ট কোনও সময়ে যে এমন হয়, তা বলতে পারবো না। আমার কবিতা অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত। অনেকটা স্বাভাবিক প্রবণতার মতো। আমি প্রতিদিন লিখবো, বা লিখতেই হবে বা লিখতে চাই এই ধরনের কোনও ভাবনা মাথায় রাখি না। হ্যাঁ, এই ধরনের চাপ আমি নেই সিনেমার চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে। চাপ নিয়েই আমি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখি। লিখতে পারিও। কিন্তু কবিতা পারি না। আমার কাছে কবিতা নানা পারিপার্শ্বিকতার ফল।

জয়: একটা লেখাকে কবিতা হয়ে উঠতে হলে কি কি থাকা চাই?

কমল: কি থাকা চাই? এমন কোনও বাধ্যবাধকতা কি কবিতা মানে? মনে হয় না। তবে সাহিত্যের ছাত্র-শিক্ষকরা একটা বিষয় চর্চা করেন, তাতে কবিতা বা সাহিত্যে কয়েকটা গুণাবলি থাকতে হয়। আমি ওইগুলো এখানে উল্লেখ করছি না, এ কারণে যে ওইগুলো আমি মানি না। আমি মনে করি কবির নিজস্ব একটা ভাবনা থাকলেই হয়। আর সেইটা প্রকাশ করার মতো যথাযথ ভাষা। আর কিছু দরকার নাই।

জয়: তোমার কাছে নতুন কবিতার মানে কি? আমরা তো নতুন কবিতা নতুন কবিতা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। কবিতা আসলে কতটা নতুন হয়?

কমল: নতুন কবিতা কি প্রশ্নও বহু পুরনো হয়ে গেছে। যেমন ধরো রবীন্দ্রনাথের পর নতুন কবিতা হিসেবে ধরা হইতেছে ত্রিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডবকে। এই পঞ্চপাণ্ডবের অধিকাংশেরই কবিতায় ছিলো ইয়োরোপীয় ধাঁচের একটা কাব্যচেষ্টা। সেই কাব্যচেষ্টাটাকেই যখন অতিক্রম করছিলো, তখনই জীবনানন্দের লেখা হইছে রূপসী বাংলা। তো বনলতা সেন কবিতার ইয়োরোপীয় প্রভাব নিয়ে প্রচুর লিখা হয়। এমনকি এই নিয়া বিতর্কও আছে যে, ইয়োরোপীয় কবিতার ভাবে জীবনানন্দের কবিতা। তাইলে নতুন কবিতার রূপ কি ইয়োরোপীয়? আমি মনে করি না। আমি মনে করি মূল নতুন কবিতা রূপসী বাংলা। তো বিশ শতকের এই ত্রিশ দশকের পর থেকেই প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর (একটা করে জেনারেশন আসার সাথে সাথে) শুরু হয় নতুন কবিতার অনুসন্ধান। প্রতি দশ বছর পরে পরে এতগুলো মানুষ খুঁজেও তাইলে নতুন কবিতা পাইতেছে না? পাইতেছে। কিন্তু কোনটা নতুন কবিতা সেইটা আইডেন্টিফাইড হইলেও ভ্যারিফাইড না। এই ক্ষেত্রে এই দুই বিষয়েরই সংজ্ঞার ঘাটতি আছে। এইখানে আমি মনে করি, পাঠক যখন বা কবি যখন কবিতাটা পড়ে মনে করবে এই অভিজ্ঞতা আমি আগে পাঠ করিনি। তখনই সেইটা নতুন। বাকি সব পুরনো।

জয়: আড্ডার শেষ সওয়াল। তুমি প্রায়ই বলো বাংলা ছবির সুদিন ফেরাতে হলে নিজেদের গল্পটা বলতে হবে। শেকড়ে ফিরতে হবে। বাংলা কবিতাকে আরেকটা স্টেপে যাইতে কি আত্ম-অনুসন্ধান জরুরী হয়ে পড়েছে?

ফয়সাল: বাংলা কবিতার এমন আরেক স্টেপে যাওয়ার কি আছে? এইটা আমার কাছে আরেকটা ভণ্ডামি লাগে কবিদের। একটা ফলস ক্রাইসিস তৈরি করে প্রফেট হবার চেষ্টা

কমল: জয়ের প্রশ্নের উত্তর- সিনেমা আর কবিতা দুইটা পৃথক জিনিস কিন্তু। আগেও এই কথা বলছি। কবিতা জনবিচ্ছিন্ন, আর সিনেমা জনসম্পৃক্ত। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুইটা জিনিস। সিনেমায় অবশ্যই নিজের গল্পই বলতে হবে। ঢাকার গল্প, চট্টগ্রামের গল্প। ময়মনসিংহের গল্প, সিলেটের গল্প বা এরকম অজস্র বাংলাদেশের গল্প। হ্যাঁ, একটা জায়গায় সিনেমা আর কবিতার মিল অবশ্যই আছে সেইটা হলো ভাষা। যেহেতু তোমার ভাষা বাংলা কবিতায় ও সিনেমায়। এই ক্ষেত্রে কবিতার জগৎটা তো দিন দিন আরও ছোট হইতেছে, ভাষা এক হইলেও। তাই এই জগৎকে বাড়াইতে হবে। রুচির এইটা কেবল সাহিত্যের জগৎ না, পাঠকেরও জগৎ- এইটা একটা বিবেচনার বিষয়। এইটা সময়ের কাছে ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় নাই।

জয়: আমরা আমাদের দীর্ঘ এই আড্ডাযাত্রার ফলাফলও সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতের কবি এবং পাঠক নিশ্চয়ই এই ১৩টি আড্ডার অংশীদার হবেন। তোমাকে ধন্যবাদ।



ইলিয়াস কমল

জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করতে গিয়ে রূপান্তরিত হয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতির গিনিপিগ-এ। বর্তমানে ঢাকাবাসী। সিনেমা ও কবিতার জন্য নিজেকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত মনে করেন। ২০১৭-তে প্রকাশিত তার প্রথম কবিতার বই ‘অতিরিক্ত বাগানবাড়ি’।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading