মোস্তফা হামেদীর কবিতা

সেতুদি

 

নদীকে না বলে দিদির পাড়ে স্থাপন করি সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর

নদী দেখার আগে দিদিকে দেখি বাজারের হাটখোলা দরজায়

 

সেতুদি—আমার প্রথম নদী—অথৈ ইশকুল

হাবুডুবু পাঠে হাতেখড়ি জীবনের ভোর বিহানে

 

কয়েন

 

কে যেন লক্ষ লক্ষ কয়েন ছিটাচ্ছে হাইওয়ের উপর

 

কালো মোজাইকের ফ্লোরে

মেঘোত্তমার নাচ

 

তার ঘাঘরার ভিতর

উপচে উঠছে

 

তরঙ্গের রাগ

 

বাজছে সন্তুর

 

পত্র-পল্লবের পাশে

 

বিভ্রম

 

শুয়ে থাকা লম্বাটে ছায়ার নামই শেষ দুপুর

 

রোদের দিকে তাকিয়ে গাছ

গোছাচ্ছে ফল

 

পিতলের থালায় এখনও কেউ লিখে যাচ্ছে

কতিপয় রোগের নাম

 

কাঠের ঘ্রাণ শুঁকে বলে দিতে পারে

জাহাজের মাস্তুলে

কী কী কথা বুনেছিল নাবিকেরা

আর ক’নটিক্যাল পরে

মিঠা পানির কল চাপছে

ছিপছিপে তরুণী

 

তার চেহারার রঙে গড়িয়ে যায়

যেসব মোহ

 

মেঘের নামাবলী ভেসে উঠছে সেসব আর্দ্র

আয়নায়

 

ময়ূর পেখম তোলো

 

ময়ূর পেখম তোলো

 

এ-বেলা গাছেরা

ঝরিয়ে নিচ্ছে মেদ

অবাঞ্ছিত লোম

 

বনের গভীর থেকে

তীব্র টাটকা ঘ্রাণ

ঢুকে পড়ছে নাসারন্ধে

 

যেন ঘুম ভেঙে জাগে

বনকুমারীরা

 

তাদের সবুজ ফিতা

মৃদু আলাপন

কুলকুচার ধ্বনি

মৃদঙ্গের ডাকে

মিলেমিশে বয়ে যায়

বাতাসে বাতাসে

 

স্নানের প্রস্তুতিরত

তীব্র রমণীর

কাঁচুলি খোলার পর

যে কটা সুরভি

যে সম্মোহন-সেতার

বেজে ওঠে, নাচে

উতল তরণী কামে

পুষ্পশাখা যত

 

আমোদিত সে আঘ্রাণে

আমের বউল

ছাতিমতলার গ্রাম

মিঠাই মোকাম

 

যেন যুবতী হাওয়া

গায়ে এসে লাগে

আর পাতায় পাতায়

শিরশির করে

ধমনীর ধারাস্রোতে

ধরে যায় নেশা

 

আব্রু ও আলস্য ভেঙে

একাকী ময়ূরী

বনপথে আলুথালু

ঘূর্ণিচক্রে ঘোরে

 

ময়ূর পেখম তোলো

নাচো রক্তরাগে

 

দোহন

 

ভোরে নমিত আকাশ—যেন গাভীর তলপেট দুধে ভার হয়ে আছে। দোহনের ব্যথা নিয়ে জাগে সমস্ত রাত।

উপশম দেবে বলে কোনো পরম আঙুল।

 

বিস্তৃত বিছানার উপর শুয়ে থেকে ঘুম পায়। জোছনার খড়ের ওমে নিমীলিত চোখ, মায়াময়।

অজস্র ঝরনার উৎস হয়ে ছড়িয়ে আছে ছায়াপথব্যাপী।

সারাদিন রোদ চরে। ঘনজঙ্গল, বালিয়াড়ি, লোকের ঢিঁহি পরগণা পার হয়ে খুরজুড়ে শ্রান্তির ছাপ—ধীরে তলিয়ে যাওয়া অন্তহীন সম্মোহনের দিকে।

 

তাড়া নেই কোনো। হাওয়ামণ্ডলে ঘুঘরার গান—পাখির কুঁই—শিশুর বিহ্বল স্বর—ধীরস্থির এক লহমা ধরে ছড়িয়ে আছে।

শান্ত মুখশ্রীর দিকে তোলো প্রার্থনার হাত।

 

গাছালির আচ্ছাদন ছিঁড়ে ভোর ফোটে। যেন হাওয়ার সানকিতে কেউ দোহন করছে গাই।

 

অবগাহন

 

এখন বড় অস্থির চিত্ত। এক সন্ধ্যাবনে হারিয়ে ফেলা শেষ আলোটুকু বনমর্মরের ফাঁকে জ্বলছে।

একটু পর পর এক বিষম হাওয়া আছড়ে পড়ছে ঐ বনবিভার ওপর। অসহায়ত্বকে কবুল করে সে

নিভে যেতে চাইছে।

 

এই তো সেই বয়ান, যা তাকে হতবাক করে দিতে চাইতো বিপুল কলরোলের মাঝে।

 

একটা ফাঁকা আওয়াজ। ঝাঁক বেঁধে—কারা যেন ছুটছে তটে।

 

অবগাহনের আগে সম্ভবত মানুষ খানিকটা জিরিয়ে নেয়। আর উগরে দেয় সমূহ কৌতুক।

খুব কাছ ঘেঁষে শুনছি মাছেদের ঘাঁই।

 

পাথরচাপা হাসি। সতীর্থ ফুলের পাশে গেঁথে থাকছে বল্লম।

 

রণক্ষেত্রের মতো প্রতিটা শব্দই সাংকেতিক।

 

—সে ঝাপটানি শুধু থাক।

প্রগাঢ় নীরবতা ভেঙে তুমি কার কথা ভাবো?

 

শেমিজের ফুলগুলি

 

ঢেঁকিঘরজুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে, আতপ চালের ঘ্রাণে মগ্ন নিশিগঞ্জ,

পাড়ে পাড়ে নাচছে কোমর

 

কেউ বসে থাকে আকুতি জাপটে ধরে— মনের ছাপচিত্রে

পাল্টে যায় হারিকেনের আলো

 

শেমিজের ফুলগুলি ফুটতে শুরু করেছে — প্রচ্ছদতট থেকে শোনা যায় মোহনদীর ধ্বনি

 

খাঁচায় চরকাটা হাঁস, একটু একটু করে শরীর বাঁকিয়ে দিচ্ছে সংঘাতের দিকে

 

ঝোঁপের নিবিড়তা ধরে আসক্তির স্রোত

 

সবজি কাটার পাশে

 

তোমার সবজি কাটার পাশে আটকে যাচ্ছে চোখ

দরজা খোলা রেখে রোদে সঁপে দিলে পিঠ

 

খোঁপা বাঁধার মুহূর্তে, কী দেখছে বিড়াল নোনা চাহনিতে

 

পুষ্করিণীর ঘাটে ফেনিয়ে তুলছে অশ্লীলতা

 

ঢলে পড়া কয়েকটি রাজশিমের লতা

 

ভারাক্রান্ত আমকাঠের আলনা

 

একগুচ্ছ লাউশাক, শীতকালীন শিম ও ফুলকপির তাজা অনুভূতি চিরে চিরে

তোমার হাতের মুঠি হয়ে উঠছে

সাবলীল

 

সমাধি

 

ঝুপ করে সে লুকিয়ে পড়লো।

 

দৃশ্যের সমাধিতে হরিৎ ছায়া।

কাঁপাকাঁপা আলোর কণায় ঝিলমিল ধুলি।

ডাকছে হালের পশু।

 

আদিম গৃহস্থবাসের পাশে ফুটে আছে

ভুঁইচাপা ফুল, মনোভঙ্গির অনুরক্ত হয়ে।

যে ঘ্রাণ চাই তা এ রকম:

 

ধ্বনি ও রঙে ধোয়া,

 

গড়িয়ে চলেছে কোনো ফুলের স্মৃতি

বাসনাবাগান বেয়ে

 

তারে দেখি নাই

দেখার চেয়ে সে বেশ দর্শনীয়।

 

 

তুষ্টি

 

টিলা কখনো পাহাড় পেরোতে পারে না

এই দুঃখ নিয়ে সে বসে থাকে পাদদেশে

ছোট ছোট ঘাস, বাদাবন, ভাঁটগাছ,

কোমল বৃষ্টিফোঁটা দিয়ে

নিজেকে সাজায়

নিজস্ব একটা টিলার ওপর বসে

আমি ছিপ ফেলছি

ছোট ঝিরিতে

 

যা পাই তা দিয়েই হাঁড়ি চড়ে

পাতা চুঁইয়ে আসা রোদ

লতায় ঝুলে থাকা মিষ্টি আলু

লাল মাটির ছড়া

কাঁচা লবঙ্গের ঘ্রাণে মিশ্রিত বাতাস

গুলে খাই

 

আমার হয়ে যায়

পাহাড় পেরোতে পারি না বলে

আমি নিজেকে কখনো দুঃখ দেই নি


মোস্তফা হামেদী

 

জন্ম : ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি.

ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর

 

পড়াশোনা :

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

পেশা:

প্রভাষক

বাংলা বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ , নোয়াখালী

 

প্রকাশিত বই:

১। মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ [কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫]

২। তামার তোরঙ্গ [কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮]

৩। জড়োয়া [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯]

৪। শেমিজের ফুলগুলি [কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০]

৫। ঋতুরহস্যের ধারে [কবিতা,ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০২১]

 

পুরস্কার:

হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার ২০২০ [ শেমিজের ফুলগুলি কাব্যের জন্য]

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading