বুদ্ধিজীবী বিষয়ে গ্রামসি আমাদের যা শিখায়া গেছেন — বিজয় প্রসাদ | ভাষান্তর: তানভীর হোসেন

ফয়েরবাখরে নিয়া লেখা থিসিসে কার্ল মার্ক্স (১৮১৮- ১৮৮৩) একটা লাইন লিখছিলেন যা সঙ্গত কারণেই আজও বিখ্যাত: এখনও পর্যন্ত দার্শনিকরা শুধু জগতের ব্যাখ্যা করছেন মাত্র; যার মূল উদ্দেশ্য আসলে জগতটারে বদলানো। মার্ক্স যা বোঝাইতে চাইছিলেন তা আসলে খুব সোজাসাপ্টা- তা হইল- এখনকার বুদ্ধিজীবীরা মানুষের গল্পগুলা ইন্টারপ্রিট করতেই বেশি ব্যস্ত যেখানে ক্যাপিটালিজমের বৈষম্য তারা যেইটাতে অভ্যস্ত হইয়া উঠছে সেইটারে পরিবর্তন করার আকাংঙ্খাকে প্রায় অসম্ভব কইরা তুলছে। এই শিক্ষাটা মার্ক্স পরবর্তী জেনারেশনগুলাকে আচ্ছন্ন কইরা ফেলে, বিভিন্ন শ্রেণি ও জাতীয়তা থেকে উইঠা আসা বুদ্ধিজীবীরা তাদের নিজ নিজ সমাজ বদলাইতে তাদের প্রতি মনোযোগী হইয়া ওঠেন, তাদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন। মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটে।  

কিন্তু এই ধরণের বুদ্ধিবৃত্তি তা প্রাতিষ্ঠানিকই হোক বা আর্টিস্টিক নিজেদের সংখ্যালঘুর দলই ভাবছিল। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই মুক্তির আন্দোলনে নিজেদের শামিল করেন নাই। পুরান কমিটমেন্ট, সামাজিক হায়ারার্কি, অর্থ আর ঈশ্বর নামক টোপের লোভ সামাল দেওয়াটা সহজ কাম আছিল না। মার্ক্সের উক্তিটা আছিল সেইসব বুদ্ধিজীবীদের নিয়া যারা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ থিকা নিজেদের আলাদা ভাবতেন, ভাবতেন যে তাদের কাজকাম জগতের ঘোরালো মারপ্যাঁচের নোংরামি মুক্ত। তারা জগত নিয়া লিখছেন ঠিকই কিন্তু তাও নিজেদের ঈশ্বর জ্ঞান কইরা। উপরে যেমন বলা হইছিল তেমন জগতকে একেবারেই অস্বীকার কইরা। এইরকম বিচ্ছিন্নতাবাদ আসলে সম্ভব ছিল না। বুদ্ধিজীবীরা জগতে বসবাস করছেন, সেখানেই তাদের নাড়ী পোঁতা ছিল, ছিল নিজ নিজ শ্রেণি অভ্যাস আর সহজাত প্রবৃত্তি। 

“নিজের ১১ নম্বর থিসিসে ফয়েরবাখরে নিয়া কার্ল মার্ক্স (১৮১৮- ১৮৮৩) একটা লাইন লিখছিলেন যা সঙ্গত কারণেই অদ্যাবধি বিখ্যাত হয়ে আছে”

এই বুদ্ধিজীবীদের সেরা’রা জগতটা বুঝতে চাইছেন, যা যা দেখছেন সেগুলারে ইতিহাস বা ইতিহাসের বাইরে গিয়া ব্যাখ্যা করার ভেতর দিয়া। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মার্ক্সের সময়ে এবং আমাদের সময়ে জগত নিয়া যা লিখছেন সেখানে তাগো দেখা জগতরে বদলানোর বিষয়ে কোন কথাই নাই। তাদের জিনিসগুলা ছিল খোলাসা করার টেক্সট, রিয়ালিটি বোঝানোর টেক্সট যেগুলা রিয়ালিটির ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবরে ইঙ্গিত করে। এমনকি যারা কোন সমস্যা আন্দাজ করতে পারছিলেন আর বদল আনতে চাইছিলেন তারাও রিয়ালিটির সাথে তাল মিলাইয়া , রিয়ালিটিরে বদলানোর সম্ভাবনা নিয়া রিয়ালিটিরে জানতে চান নাই। এই অবস্থানটা নিতেই, মার্ক্স তার সেই আপ্ত বাক্যটাতে পরিবর্তন যে সম্ভব এ বিষয়ে ঈমান রাইখা বর্তমানের ভেতর দিয়া দাসত্ব মুক্ত একটা ভবিষ্যতের রাস্তা খুঁইজা বাইর করার প্রস্তাব রাখেন।

 

—স্থায়ী পারস্যুয়েডার

প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইতালিয়ান কম্যুনিস্ট মিলিট্যান্ট আন্তোনিও গ্রামসি (১৮৯১- ১৯৩৭) মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবী বিষয়ক থিমটার পুনঃপ্রবর্তন করেন। গ্রামসি স্পষ্টতই জানতেন যে বুদ্ধিজীবীরা কখনও এক ধরনের না, বরং নানান ধরনের হন। বুদ্ধিবৃত্তিক কামকাজ যে শুধুমাত্র সোসালিজমের প্রতি কঠোর আনুগত্য আইনা দেওয়ার ভূমিকা পালন করবে তা ধইরা নেওয়া যাবে না। 

গ্রামসি বলছেন যে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরাই হয় নিজেদের পরিবর্তন বিমুখ হিসাবে দেখছেন, না হয় রক্ষণশীল কিংবা মুক্তিকামী হিসাবে না দেইখা টেকনিকাল চিন্তক হিসাবে দেখছেন। এইখানে আইসা তিনি অরগ্যানিক, ট্র‍্যাডিশনাল আর নব্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ফারাক করার জন্যে কিছু কাজের জিনিস প্রস্তাব করছেন।

বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বানানো কোন শ্রেণী না। তারা যে শ্রেণী থেকে উইঠা আসেন সেই শ্রেণীতেই তাদের নাড়ী পোঁতা, হয় তারা নিজেদের শ্রেণীর জন্য কমিটমেন্ট বা অন্যান্য শ্রেণির জন্যে নতুন কমিটমেন্ট ডেভেলপ করেন।    

জেলে থাকতে গ্রামসি এই বিষয়ে পরিষ্কার কইরা লিখছিলেনঃ ‘ অর্থনৈতিক উৎপাদনমুখী জগতের কেজো ভূখণ্ডে জন্মানো প্রত্যেক সামাজিক গোষ্ঠী স্বাভাবিক নিয়মেই পরস্পরকে যুগপৎ তৈরি করতে থাকে, এক বা তারও বেশি বুদ্ধিজীবীর স্তর থেকে যারা এদের মধ্যে হোমোজেনিসিটি আনে এবং এদেরকে নিজেদের কাজ সম্বন্ধে সচেতন করে আর এই বুদ্ধিজীবীরা শুধু অর্থনৈতিক না, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাজ করে। ক্যাপিটালিস্ট উদ্যোক্তা নিজের পাশাপাশি তৈরি করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনিসিয়ান, রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, নয়া সংস্কৃতির সংগঠক, নয়া একটা আইন ব্যবস্থা ইত্যাদি।” 

ফলে প্রত্যেক শ্রেণি নিজ নিজ বুদ্ধিজীবী উৎপাদন করে। ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণির দরকার পড়ে নিও লিবারাল অর্থনীতিবিদ (রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ) আর বিজ্ঞাপন নির্বাহীর (নয়া সংস্কৃতির সংগঠক)। এই বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যেকেই নিজেদের সামনে আনে নিরপেক্ষ, শ্রেণি ধারণার উর্ধ্বে থাকা কেউ, রিয়ালিটির সমঝদার হিসাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পরিচালিত হইতে থাকে শুধুমাত্র কয়েকটা শ্রেণিগত অবস্থান, জগতকে দেখার ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণির চাহিদা ও আগ্রহজাত একটা দৃষ্টিভঙ্গী দিয়া। যেমন একজন ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতিবিদই জোর দিয়া বলেন যে বিশ্বের ক্ষুধা হইলো অভাবের ফলাফল; অথচ বিশ্বে যে চাহিদার ১৫০% খাদ্য উৎপাদিত হইতেছে তা এই অর্থনীতিবিদ কখনই কবুল করেন না। চাষীগোষ্ঠীর আবার নিজেদের বুদ্ধিজীবী আছে- চাষীদের মধ্যে যারা শস্যের রোগ ও আবহাওয়া সম্বন্ধে জানে, যাদের কাছে অন্য চাষীরা ক্ষেত বা সেচ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান নিতে আসে। তারা হইলেন চাষীগোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী। প্রত্যেক বুদ্ধিজীবী তার নিজ নিজ শ্রেণির ক্ষেত্রে অরগ্যানিক। এরা অরগ্যানিক বুদ্ধিজীবী, গ্রামসি যেমন বলছেন, “এরা নিজ নিজ শ্রেণীর ভেতর, তাদের কাজকামের বিষয়ে হোমোজেনিসিটি এবং সচেতনতা তৈরি করে।”

যাই হোক, ছড়ি ঘোরানো শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিই শেষ পর্যন্ত নিজেদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীকে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। নিজেদের শ্রেণিবৈষম্যকে তারা  সমাজ বিজ্ঞানের মতো একটা ভণ্ডামি দিয়া ঢাইকা ফেলতে পারে, ছড়ি ঘোরানো শ্রেণির ইন্টারেস্ট অনুযায়ী ক্যাটাগরি এবং কনসেপ্ট প্রতিষ্ঠা কইরা ফেলে। যেমন মনে করেন মুলধারার অর্থনীতিতে অভাব কনসেপ্টটা থিকা শৃংখলা বিষয়টারে শেইপ দেওয়া হয়। অভাব যদি মূল কনসেপ্ট হয় তাইলে শৃংখলার একটা কথা থাকে তা হইলোঃ অপ্রতুল জিনিসপত্রগুলা বন্টনের সবচে খাসা উপায় কী? উত্তর আসে, ‘বাজার’। এই ‘বাজার’ টার্মটাও কিন্তু নিরপেক্ষ না। এইটা ভেতরে ভেতরেই চাপা থাকে যে বাজার আসলে সামাজিক কাঠামো দিয়া শেইপড হয়, তাদের দ্বারাই হয় যারা বাজার কেমন হবে তা ঠিক কইরা দেওয়ার মতো প্রভাবশালী। ‘বাজার নির্বাচন‘ এর মানে হইল ধরেন যারা ক্ষুধার্ত কিন্তু ট্যাকা পয়সা নাই তাগো খাওয়ার সুযোগ দেওয়াটাও ঠিক না। মূলধারার অর্থনীতিবিদরা বলে যে বাজারগুলা মূল্য ঠিক করে দেয় আর মূল্যই অপ্রতুল কাঁচামালগুলার ভাগ বাটোয়ারার সবচে ভাল উপায়। ব্যাপারটা দেখতে নিরপেক্ষ মনে হইলেও সত্যি হইলো এইটা ছড়ি ঘোরানো শ্রেণির কাছে যারা অরগ্যানিক বুদ্ধিজীবী বইলা পরিচিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গী।   

অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা যারা অন্যান্য শ্রেণীর যেমন চাষী গোষ্ঠীর জগত দর্শনের তারা জিজ্ঞেস করতে পারেনঃ যারা চাষ করতেছে তারা খাইতে পাইতেছে না এইটা ক্যামনে সম্ভব? এইটা ক্যামনে সম্ভব যে জগতে ক্ষুধার্তের চাহিদার চাইতেও বেশি উৎপাদন হইতেছে? তাইলে উদ্বৃত্ত খাবারগুলা কই যাইতেছে? ক্যান সরকার ক্ষুধার্ত মানুষরে খাওয়ানোর আগেই এগুলা ধ্বংস কইরা ফেলতেছে?  এগুলা হইলো বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের প্রিটেনশনের বাইরের জিজ্ঞাসা। যেগুলা এলিট ব্লকের শ্রেণি পার্সপেক্টিভ আপনানো বুদ্ধিজীবীরা বানাইছেন।

চাষী গোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিরে ক্যাপিটালিস্ট গোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তির মতো সিরিয়াসলি নাওয়া হয় না। প্রত্যেকটা সামাজিক গঠনে ছড়ি ঘোরানো শ্রেণিই ঠিক কইরা দেয় যে কোনটারে যুক্তিসঙ্গত আর সত্য বইলা মানা হবে। ফলে সেই বুদ্ধিজীবীদেরকে খাঁটি/ আসল বুদ্ধিজীবী, ট্র‍্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবী হিসাবে দেখা হয়। অর্থনীতিবিদ আর বিজ্ঞাপন কর্তারা হইলেন সেই ধারার ট্র‍্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবী পাশাপাশি পুরান কালের উচ্ছিষ্টরাও- যেমন ধরেন ধর্ম প্রচারক আর জমিদারদের মতো লোকেরা।

গ্রামসির মতে অরগ্যানিক বা ট্র‍্যাডিশনাল কোন বুদ্ধিজীবীই হাড়েমজ্জায় রক্ষণশীল বা র‍্যাডিক্যাল হন না। ট্র‍্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা তাদের ছড়ি ঘোরানো শ্রেণিতে পোঁতা অবস্থায়ই টিপিক্যালি রক্ষণশীল আর সামাজিক প্রথা/ রীতি/ বিন্যাস পাল্টায়া দেওয়ার মতো সিস্টেমিক পরিবর্তন বিরোধী। বিভিন্ন শ্রেণির অরগ্যানিক বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই ট্র‍্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারা দিয়া পরিচালিত হন যার ফলে তারাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ষণশীল আর পরিবর্তনের ব্যাপারে খুব একটা উতসাহী থাকেন না। 

এই জিনিসটা জার্মান আইডিওলজিতে মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলসের “সমকালের শাসনব্যবস্থা হইলো শাসক শ্রেণির আইডিয়া” এই কথাটারই প্রতিফলন।

পক্ষান্তরে/ আবার শ্রমজীবী মানুষের কিছু অরগ্যানিক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা তাদের শ্রেণির অবস্থা দেখেন, ব্যাখ্যা করেন শাসনের প্রচলিত আইডিয়ার বিরুদ্ধে গিয়া এবং জগত সম্বন্ধে একটা র‍্যাডিক্যাল ধারণার অবতারণা করেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর উদয় হয় ঠিকই কিন্তু সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন বা কোন রাজনৈতিক দলে তার বীজ পোঁতা না হইলে উইড়া যায়।  গ্রামসি এই বুদ্ধিজীবীদের বলেন নব্য বুদ্ধিজীবী যারা সংগঠক, নির্মাতা, স্থায়ী পারস্যুয়েডার হিসাবে বাস্তব জীবনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। গ্রামসির মতে স্থায়ী পারস্যুয়েডার, নব্য বুদ্ধিজীবীরা হইতেছেন তিনি যিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, জনসাধারণের জন্য যুতসই চেতন/ বোধের বিকাশে/ ছড়াইয়া দেন, বক্সের বাইরে গিয়া চিন্তা করার প্রবণতার প্রতি যে দমবন্ধ করা সংকীর্ণ মানসিকতা সেইটারে ঠ্যালা দেন এবং জনোপযোগী স্ট্রাগলের জন্য স্পেস বানায়া তাদের টিকায়া রাইখা জয়লাভ করেন। এই নতুন বুদ্ধিজীবীরা সঙ্গত কারণেই মার্ক্সিস্ট নন কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রধান প্রধান শ্রেণীগুলার স্ট্রাগলের সাথে লাইগা থাকেন। আর লড়াই ও পোস্ট ক্যাপিটালিস্ট সমাজ গইড়া তোলার প্রয়োজনীয়তাটা তাদের কাছে একদম পরিষ্কার।


সূত্র: স্টুডেন্টসস্ট্রাগল.ইন

শেয়ার