নির্বাচিত ২৫ কবিতা | টোকন ঠাকুর


আত্মচরিত


নিষ্প্রয়োজনে
আমি
ছোট নাম লেখাতে গেছি
      কবির খাতায়
নিজ প্রয়োজনে
আমি
নক্ষত্রের দেনা
   নিয়েছি মাথায়
বিষ-প্রয়োজনে
আমি
সাপ ও বেদেনি
  চেয়েছি দুটোই

দুহাতে দুধের ছানা, বেপরোয়া মুঠোয় মুঠোয়
সম্পূর্ণ ফুটেও নারী ক্ল্যাসিক্যালি অস্ফুট__

সুতরাং, আজ আমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো—
আমি কি কবি ছিলাম? সাপুড়ে ছিলাম? নাকি ছিলাম যা, তাই?

শিস্-প্রয়োজনে
আমি
হাওয়া-ধাক্কা দিচ্ছি
বসন্ত-জঙ্গলে গাছদেবতার
                        শুকনো পাতায়

কে আমি? বিখ্যাত কেউ? কী ছিলাম? গুরু কেউ? লঘু ঢেউ?
ঝরনার বাথরুমে শাওয়ার ছিলাম?
সুহাসিনীর ড্রেসিং টেবিলে আয়না ছিলাম?
গুপ্তকথা হচ্ছে, আদতে সেই রাক্ষসদের ছেলে,
                মানুষের ছদ্মবেশে থাকি
যোগ্যতা, নিজের মুখে জোছনারাত অনুবাদ করতে পারি,
এর বাইরে
     আমি যা ছিলাম, তাই

                                                ছিলাম যা, তাই

বুদবুদ পর্যায়ের কবিতা


কথা হয়, মীমাংসা হয় না
মনে এত ছিটমহল

নিয়তই, মীমাংসার ভান করে, সান্ত্বনাসূচক
বারান্দায় ছুটে আসে সাঁওতালি রাতের মাদল;
ছাদে উঠে গুনে গুনে দেখি
কাছে ও দূরের প্রেক্ষিত, সম্পর্ক, আলো
অন্ধকারে আলো গুনে যাওয়াই ভালো জমকালো

নিজেকে মুঠোয় নিয়ে খেলাটাই খেলা!
খেলা হয়, জয়-পরাজয় মীমাংসা হয় না
মনে এত প্রতর্ক প্রহরা
চারিদিকে শুধু শব্দে শব্দে ভরা

কী তুরীয় খরা!

দ্যাখো একটি প্রাণপণ বাক্য হয় না
ফলে, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে, হচ্ছে না এমন কী তা?

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কালিদাসের মেঘ
রবীন্দ্রনাথের পাখি
কিন্তু ধরাই যাচ্ছে না, কোন ফাঁকে, আড়ালে-আবডালে উড়ে যাচ্ছে
(রোদ-উৎসবে পুড়ে যাচ্ছে দালিচিত্রে গলে যাচ্ছে)
আমার ডানাময় দিন, অমীমাংসিত স্বপ্ন
এমনকি বুদ্বুদ পর্যায়েই, কবিতা


গার্লস স্কুলের দফতরি

যে পত্র অলিখিত, সেই পত্রে
প্রকাশিত হতে চাওয়া বাক্য সাজাই
টিনের চালে বৃষ্টি বাজাই
এমন কি বাঁশবন হয়ে উঠি মনে মনে
নিজে তো ভিজিই, আমার না লেখা পত্র ভিজে যায়
                                     ঘনঘোর বর্ষাকাল আমার মাথায়
গীতাঞ্জলির পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আমি কি ভাসিয়ে দেব কাগজের তরী?
কবিতা লিখতে পারি না, আমি
কুমুদিনী গার্লস স্কুলের আকস্মিক চাকরি চলে যাওয়া দফতরি
কিছুটা দুর্নাম আর অনেক অনেক বৃষ্টি নিয়ে
                                             সারাদিন কী যে করি!

গদ্যপদ্য 

গদ্যে লিখেছি গ্রীষ্ম
পদ্যে লিখি শীত
শিশ্ন ও যোনির মতো
পুরো বিপরীত

ছোট্ট কবিতা


তুমি যেন ঠিক কার মতো?
একটি ছোট্ট পাখির বাচ্চা
অথবা বাচ্চার মা’র মতো?

তুমি যেন ঠিক কার মতো?
যার মতো আর দেখিনি কাউকে
স্মরণী-কুসুম, তার মতো?

তুমি তবে ঠিক তার মতো?
কার মতো, কার মতো?
যার মতো আর দেখিনি আগুন
পুড়িয়ে বাঁচায়, তার মতো?

যার মতো আর ভাবিনি কাউকে
তার মতো, তার মতো?
যার বেশি কেউ দূরেরও নয়
তার মতো, তার মতো?


দুপুরের গান 

আমার ভুলের সমান

দুপুরের গান
তোমার চুলের সমান
 দুপুরের গান
ঝাঁ ঝাঁ রোদের সমান
দুপুরের গান
বোকা বোধের সমান
দুপুরের গান
একা হাঁটার সমান
দুপুরের গান
বেঁধা কাঁটার সমান
দুপুরের গান
তোমাকে দেখার সমান
দুপুরের গান
কবিতা লেখার সমান
দুপুরের গান
নীরবতার সমান
দুপুরের গান
তোমার কথার সমান
দুপুরের গান
পাখির বুকের সমান
দুপুরের গান
আমার দুঃখের সমান
দুপুরের গান

পোকাজন্মের অনুভূতি 

কত কী যে লেখা যায়!

আর কী কী যে লেখা যায় না!
একটি কবিতা কি হতে পারে এমন আয়না
তাকালে দেখা যায়
কুঁকড়ে যাওয়া মুখ, নিজের
আর ঘামে  ভিজে
যাওয়া শরীর, রান্নাঘরে চুলার পাশে মুখ, মায়ের
দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্ররেখা
ফুটে উঠেছে বাবার মুখে, এই হচ্ছে আমাদের
দীননাথ বাংলা কবিতা, আমার নিজের দেখা
কবিতা যা লিখি, লিখি না অধিক
অন্তরনগর ট্রেন চলে ঝিকঝিক…
আন্তঃনগর না কিন্তু, অন্তরনগর
ভোরবেলা হাঁটতে থাকি দিগন্ত-বরাবর!
ভালোবাসা ডাক দিয়ে চলে গেছে
আমি হাঁটতে থাকি নদী-চরাচর
আমি গাইতে থাকি চাঁদ-পোড়া গান
মনে মনে যে সমুদ্র রচনা করি
তাতে ভাসাই সাম্পান
মনে মনে যে মাঠ আমি লিখে রাখি মাটির রাস্তায়
দেখি, ধুলো উড়িয়ে এক বাইসাইকেল যায়
সাইকেলই যায় শুধু, চালক থাকে না
শেয়ার বাজারের লোক  এ খবর রাখে না
হঠাৎ সামনে পড়ে হাঁড়িধোয়া নদী
ইশ, জলের উপর দিয়ে সাইকেল চলত যদি!
ওপারে যেতাম, নদীর ওপারেই রাধিকার গ্রাম!
এখানে কি লেখা যায় তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম?
তার মানে রাধিকার, যার জন্যে এত এত গান
এত এত কবিতা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম
এত এত প্রাণশ্বাস, হাঁসফাঁস দিন
এই দিন সম্পূর্ণ নয়, আংশিক রঙিন
আমি এই দিনগুচ্ছ দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে, অনুভূতির মা
ও আমার পাখি পাখি, ও আমার যন্ত্রণা!
ও আমার তামাকপোড়া রাতের শাদা ধোয়া
ও আমার স্বমেহনের নিজেকে আদর, ছোঁয়া
ও আমার প্রেসক্রিপশনের ওপর বীর্যপাতের ছবি
রাতের পরে রাত চলে যায়
ভোরবেলাতে আত্মমগ্ন বিষণ্ণ ভৈরবি
আমাকে তুমি ভাবতে পারো বোকা
আমাকে তুমি ভাবতে পারো ফুলের মধ্যে পোকা
আমি হয়তো পোকাজন্মই লিখছি ফুল ও ফলে
তোমার হয়তো হয় না কিছুই, আমার ঠিকই  জ্বলে
কার যে তখন পাঁজর পুড়ে যায়
সকালবেলায় গলিতে রেওয়াজ, ছাই নিবেননি ছাই?
সকালবেলার পাখি বলতেই শহর জুড়ে কাক
দাবি করেছি, চিৎকার সব কলাকেন্দ্রে যাক
খুব ভেবেছি, ভিখারিনীর জন্যে প্রেমের কবিতা
এক বসন্তে হোক না সমর্পিতা
যদিও আমার ভাবনাতে আর কী আসে যায় বলো
কাঠ বলেছে তুষ বলেছে, কী করবা, জ্বলো!
কবিতা আর লিখতে চাই না , লিখেই বা কী হয়!
লেখায় তো সেই একই কথা—অমোঘ পরাজয়
কার পরাজয় কে আর দ্যাখে, জয়ের বাসনায়
মাতাল যখন পরিপার্শ্ব, তখন মদের শুধু দোষ?
মানচিত্রের ভেতরে থাকাই চূড়ান্ত আপোষ?
আছে কি তাই মানচিত্রের বাইরে কোনও মাটি?
ভাবনা এমন, ভাবনা সোনার পাথরবাটি!
ভাবতে ভাবতে ভাবনা শুধু তোমার কথা ভাবি
আমার অস্থি নাও খুলে নাও, এই করেছি দাবি
আমার প্রতি পৃষ্ঠা থেকে প্রতি বাক্য পড়ো
আমাকে তুমি তোমার পেটে শিশুর মতো গড়ো
এই বলেছি, তোমাকে আমার মায়ের মতো ভেবে
যখন তখন ব্লাউজ খুলে দুধ খেতে কি দেবে?
তোমার নাভি আমাকে আবার জন্ম দিক ভোরে
কতবার তো তোমার জন্যেই গিয়েছি আমি মরে
তুমি কি আমায় মৃত্যু দেবে, জন্ম দেবে না?
শকুন্তলা, তুমিই আমার মা আমার অনুভূতির মা
আমার যত শ্বাসপ্রশ্বাস তোমার বুকে রেখে
ঘুমোতে দাও, এই বলেছি মৃত্যুস্বপ্ন মেখে
আমার যত ধুকপুকানি খাদ্য ভেবে খাও
বলেছি তা শোনো না কেন? না শুনে কই যাও?
দুপুর ভরে বৃষ্টি আসে, বিকাল ভরে একা
এই অবস্থায় চলতে থাকবে লেখা?
না না তা হয় না, হয় না কিছুতেই
পাখির মতো পেয়েছি তোমায়, দেখি আবার নেই
আঁখির মতো চেয়েছি তোমায়, আঁখির কাছাকাছি
এই কি পোকার বেঁচে থাকা? এইভাবেই তো বাঁচি!
যখন তুমি ঘুমোতে যাও, তোমার বুকের কাছে
শ্বাসপ্রশ্বাস হয়েই আমার বেঁচে থাকারা আছে
দোহাই, এই অবস্থায় তোমাকে যেন আর কেউ না পায়
জানো না তুমি। জলের ওপর আঙুল দিয়ে
তোমার কথায় লিখে যাচ্ছি বাংলা কবিতায়!

ভূগোল মাস্টার


এই আকাশ আমার পিতা
মাটি আমার মা
আমি তাদের সন্তান, ঐ দিগন্ত

কিন্তু ভূগোলমাস্টার বলছেন—

দিগন্ত একটি ধারণামাত্র

পাতাবাহার

কবিতা লেখামাত্রই আমি সেই কবিতার মা
কয়েকদিন পর, নতুন আরেকটি কবিতা লেখামাত্রই
আমি সেই আগের কবিতার খালা

তারপর আরো কবিতা লেখা হলে অনেক আগের কবিতাকে
                                      দূরের আত্মীয় মনে হয়
কবিতা যখন ছাপা হয়, অন্যেরা পাঠ করে
তখন তো সেই আগের কবিতা অনেকটা অচেনা হয়ে পড়ে

আমার পুরোনো কবিতাগুলো পড়তে গেলে মনে হয়
এরা সেই বাল্যবন্ধু, যাদের নামই প্রায় ভুলে গেছি
দেখলেও চিনতে কষ্ট হবে (কাউকে কাউকে তো চিনবই না)

তার মধ্যেও ঠিকই চিনে ফেলব, আমার কোন কবিতাটি খুব জেদি ছিল
কোন কবিতাটি সেই মেয়ে, ক্লাস নাইনে উঠেই যে-বিষ খেয়েছিল প্রেমে
                                    যে-কখনো দশম শ্রেণিতে উঠবে না আর

হয়তো সেই কামরাঙা কবিতাটির নাম ছিল পাতাবাহার 


চরম পরিস্থিতি 


ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের জন্য আমি কী করতে পারি?

যদি ঘনজঙ্গলে যাই
বাঘিনীর খপ্পরে পড়ি (হায়)
বাঘিনী যদি আমাকে থাবায়, খায়
তখন, দুধ হয়ে পৌঁছুতে পারি
মা-বাঘিনীর স্তনের বোঁটায়

বন-পর্যটকই একদিন মনোযোগ দেবে
পড়ে থাকা কঙ্কালে, আমার হাড়ে

ওই যে বাঘিনী আসছে

এইবার, যেকোনো মুহূর্তেই, ক্ষুধার্ত বাচ্চারা
জঙ্গলে কবিতা লিখতে আসা আমাকে
খেয়ে ফেলতে পারে


ঝড় 

সন্ধ্যায়, প্রজাপতি ঢুকে পড়ে ঘরে 

তাতেই তো ঘরখানা নড়ে 

পোকা ও প্রজাপতির গল্প

এখনো কবিতা পড়ো মানে তুমি মনে মনে ভাবো
আচমকা এক ফুরফুরে বিকেলে প্রজাপতি সম্মেলন হবে।
সেই সম্মেলনে তুমি স্বাগতিক, তোমার ব্যস্ততা থাকবে।
তুমি ফুলদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে
ঘাসের বক্তব্য শুনতে শুনতে, হয়তো বা ভুলে যাবে-
একজন কবি এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে—
পোকা থেকে তুমি প্রজাপতি হয়ে কতটা বদলে গেলে?
এখনও কবিতা লেখা হয় মানে সেই লোকটিই কবি-
যে কীনা পোকা হতে পারেনি বলে প্রজাপতি হতে পারছে না

ইউটিউব কনটেন্ট  

হাততালি কী করে হয়?
হাততালি কী করে হতে পারে?
বাড়িতে মা মৃত্যুশয্যায়।
মা’র মুখে বিড়বিড়ানি কবিতা ফুটছে—
          ‘বাবা তুই কনে রে? আমারে
          হাসপাতালে নিয়ে চল…’
সব কিছু রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে, ইউটিউবার-পুত্র
একটি কনটেন্ট বানাচ্ছে
ইউটিউব তাকে টাকা দেবে
ট্র্যাজেডি বলছে, হাততালি দে
মর্মান্তিক বলছে, মুগ্ধ হ
আপনি হাততালি দেবেন
আমরা হাততালি দেব
বংশী হাওয়ায় সুর, চিরদিন তোমার আকাশ
                                    তোমার বাতাস
মাটিতে, মায়ের কবরে জন্মাবে ঘাস;
ছোটবোন বলল, ‘এই নিয়ে তুই কবিতা লিখতে চাস?’
তাই শুনে যদি হাততালি হয়
নিশ্চিত, আমার কবিতা হয় না
হয় না কবিতায় হাততালি হয় কী করে?
সন্ধ্যায়, বসে আছি নদীকুলে, বটের শিকড়ে

স্বাধীনতার কবিতা 

বাক-স্বাধীনতা ছাড়া

বাঁচা, বেঁচে থাকা বলে?
বাঘ স্বাধীনতা ছাড়া
বাঘ নাকি জঙ্গলে?

 নিজেকে দেখার ঝোঁক

তোমার মধ্যে আমি আমাকে দেখতে পাই—এই হচ্ছে প্রেম!

আয়নার সামনে দাঁড়ালেও আমি আমাকে দেখতে পাই
কিন্তু কাচের সঙ্গে আমার কোনো প্রেম হয় না

হাসলে, আয়নার মধ্যে আমি আমার হাসি দেখতে পাই
কাঁদলে, আয়নার মধ্যে আমি আমার কান্না শুনতে পাই না
আয়নার ভেতর থেকে কোনো শব্দই আসে না
আয়নার মধ্যে বরং এক অমানবিক পৃথিবীর ছবি দেখা যায়—

তাকালেই, আমার বাম চোখ আয়নার মধ্যে ডান চোখ হয়ে যায়
বাম হাত ডান হাত হয়ে যায়, বাম পা ডান পা হয়ে যায়
আমি সরে গেলেই, আয়না থেকে আমার সব সরে যায়
আলো ছাড়া আয়না নিজেই উধাও, অন্ধকার আমাকে দেখাবে কি?

তাই কাচের সঙ্গে কোনো প্রেম হয় না, তোমার সঙ্গে হয়
তোমার মধ্যে আমি আমাকে দেখতে পাই, অন্ধকারেও পাই
আমি হাসলে তুমিও হাসো, তুমিও কাঁদো, শব্দ শুনতে পাই
আমার ডান-বাম সবসময় তোমার কাছে ডান-বামই থেকে যায়

আমি সরে গেলে আয়নায় প্রতিবিম্বিত আমিও সরে যায়
শুধু পারদ লাগানো, বস্তুত ফ্রেমে বাঁধানো কাচ পড়ে থাকে

অথচ সামনে থেকে সরে গেলেও তোমার মধ্যে আমি থেকে যাই
তুমি কেমন তাকিয়ে থাক—আমি কখন ফিরব সেই অপেক্ষায়!
এই লোডলেডিং বেচাকেনাকালে তোমাকে আমার আলো মনে হয়

আয়নার মধ্যে নিজেকে দেখা আমার শ্বাস-প্রশ্বাস শোনা যায় না
আর তোমার মধ্যে আমার বুকের ধ্বনিসমগ্র কীরকম আছড়ে পড়ে
সে আমি নিজেই শুনেছি বলে আয়নার সঙ্গে আমার ভাব হতে পারে না

তোমার সঙ্গে হয়, তোমার সঙ্গেই দ্যাখো কেমন অটোমেটিক বিনিময়
আমার জ্বর হলে তোমার শরীরেও একটু গরম গরম ভাব জমা হয়!


শহীদ কাদরীর সঙ্গে একবার দেখা


শহীদ কাদরীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারত
পুরানা পল্টন, রেকস রেস্তোঁরা, বিউটি বোর্ডিং
বা যে-দেশে আঙ্গুরের মদ, মমার্ত
বা হিপ্পিদের দেশে
পঞ্চাশের দশকের সঙ্গে আমার দেখা হতে পারত
হলে, ভালোবেসে
আমার পরিধি একটু বাড়ত
তাতে কী-বা হতো আর, কার?
অনাথ বাংলা কবিতার
শান্তি পাব না জানি, তবু
প্রেমিকাকে বলতে পারতাম—
শহীদ কাদরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার

জঙ্গলের মধ্যে জাদুঘর

জঙ্গল দেখলেই মনে হয়, ঐ জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায় হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম। এই পৃথিবীতে যতগুলো জঙ্গল আছে, প্রায় প্রত্যেকটা জঙ্গলের মধ্যেই একটা করে জাদুঘর আছে।

জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল। সেই সাইকেলটা কার গো, কার? যথা অপরিণামদর্শী কৌতূহলে, জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া যে বালক আর কোনওদিনও ফিরে আসিল না, তার? জংলিপনায় স্নাতকোত্তর আমি, জঙ্গল দেখলেই বুঝতে পারি—এই জঙ্গলের ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। বাইসাইকেল আছে। বালক-পুরুষ ফিরতে না-পারার জনশ্রুতি আছে।

জনশ্রুতির অধিক রহস্য, সেটাই ধরিত্রী, সেটাই অবলীলা চৌধুরীর লাবণ্য; লাবণ্যের ভেতরে মিশিমিশি আফ্রিকা, ঘনান্ধকার আমাজান—সাহস করে একবার ঢুকে পড়লেই জাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবার প্রেরণা পাওয়া যাবে। ক্লান্ত সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এবং সম্ভবত আমার আর কোনওদিনও ফিরে আসা হবে না… হবে না

এ অঞ্চলে এটাই সত্য, জঙ্গলে হারানো পুরুষ শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে যায়।


ভাষা-সমস্যা 

ভাষার সমস্যা আছে। সব কথা সে প্রকাশে সমর্থ নয়। যতই পণ্ডিতি করি, সান্ধ্যসুর ধরি, ঠিক যেন হলো না—আমার কী বলার ছিল? ‘কী’ বলার মধ্যে আমি কী ভাব বোঝাতে চেয়েও, শেষ পর্যন্ত বাক্য যেন বাগে এল না, বরং বিরাট বিট্রে করে বসল। কুয়োর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া চৈত্র মাসের মহাজোছনা যেন আমি আর তুলে আনতে পারলাম না। এদিকে পরিস্থিতি প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে ঝুপঝাপ আঁতাত শুরু করে দিল। কারণ, এই কালপর্বের নাম যুদ্ধক্ষেত্র। আমাকে ক্রলিং করে মাটিতে বুক বাঁধিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভ্রম হচ্ছে, তবে কি আমার বুকপকেটে সেরকম কোনো চিঠি আছে—যার প্রেরক কোনও  শহরবাসিনী, প্রহেলিকা চৌধুরী?

কিন্তু ওই যে বললাম, ভাষার সমস্যা! ভাষায় আমি জোছনা দেখাতে পারছি না, সূর্যাস্ত দেখাতে পারছি না, যুদ্ধ দেখাতে পারছি না, রক্ত কতটা লাল দেখাতে পারছি না, বাতাসের বেআদব আচরণ দেখাতে পারছি না! এমনকি আমার মন এখন কতখানি অবাধ্য যে সে আমার ঘরেই থাকে না, প্রতিদিন একই রাস্তায় একই দিকে যায়—মনোগমনের এ বর্ণনা লিখে বোঝানো অসম্ভব! অ্যাবসার্ড!! কারণ, ভাষা শিল্পকে যতটা সমর্থন করে বা শিল্পীকেও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারে কিন্তু শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন দূরত্ব, যতটা লৌহবেদনা—ভাষা তা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।

কতটা নির্মম, দুর্ভাগ্যপীড়িত, যদি বলো, এই ভাষাতেই আমাকে লিখে জানাতে হবে সেই প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প, লৌহবেদনার ইতিকথা? মন-আনমনা, বাক্য যেন ভাব বুঝল না, বাক্য বিরাট বিট্রে করে বসল। অথচ, কুয়োর মধ্যে চৈত্র মাসের মহাজোছনা গড়াগড়ি যায়…


বসন্তদিন

রহস্যপুর গল্পটা পড়া শেষ হয়নি

আমি সিরিয়াস পাঠক। পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে যাই, তাকিয়ে দেখি গল্পের মধ্যে সোনার ঢেঁকি—পাড়ের শব্দও শুনি। ঠিক তক্ষুনি, পর্দাজুড়ে দৃশ্যমান, হাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে দইঅলা বলে একটা চরিত্র, আমি তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই কয়েক পৃষ্ঠা, হঠাৎ সামনে পড়ে পোড়ো রাজবাড়ি, রাজবাড়িটা ভাঙা ভাঙা এবং ভৌতিক! ভীতিলুব্ধ সিঁড়িতে একটা প্রজাপতি, আমি প্রজাপতিকে লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি। প্রত্নকোঠার ছাদের কিনারে গিয়ে বলি, ‘প্রজাপতি, তোমার আত্মজীবনী আমি মুখস্থ করতে চাই’, শুনেই ডানাঅলা এই প্রায়পাখিটি উড়ে যায়। এবার আমিও উড়তে থাকি প্রায়পাখিটির সঙ্গে, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, বাক্যের পর বাক্য, শব্দের পর শব্দ, প্রয়োজনীয় নৈঃশব্দ্য;  প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তুমি কি কোনো বংশীবাদক, সুরের ফাঁদে ষড়যন্ত্র করছ? ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ?

রহস্যপুর গল্পের তেইশতম পৃষ্ঠায় সেই হাইডআউট লোকেশন, পাঠক যেখানে অসহায়, দুরু দুরু-সন্ত্রস্ত কিন্তু এগিয়ে যেতে উৎসাহী। প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে মুখোমুখি এক মায়াবী অধ্যায় : আলো হয়ে প্রকাশিত নারী। নারীর সর্বাঙ্গে সদম্ভ আগুন, অহোরাত্র নারীকে পড়তে গিয়েই আগুনে পুড়তে হয় এই নিয়তি নির্ধারিত বলে, মন পুড়ে যায়। পোড়া মন চিকিৎসাধীন, নার্সও দেখতে প্রায়নারী, বেতন-ভাতায়।

আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি, গল্পের মাঝামাঝি কোনো পৃষ্ঠায়। খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র, প্রজাপতির। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে, তার ডানার খোপের অন্ধকারে রঙ মেখে ঘুমিয়ে থাকি, জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে, এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে। টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী। সিরিয়াস পাঠক আমি, হিটলিস্টে আছি, সুতরাং খুন হয়ে যাব– এই ভয়ে অসুস্থ থাকি। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে (জন্মদোষে) নার্স ও নারীর আন্তঃপার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি, পড়ার চেষ্টা করছি আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন।

এদিকে বসন্তদিন

সাতাশে আশ্বিন

ধাত্রীমাকে মনে করতে পারি না আমি—অথচ আমার জন্ম তাঁরই হাতে। আমার জন্ম মামাবাড়ির এক দোচালা টিনের ঘরে, ঘরের পেছনে নদী। আমার নাড়ির ফুল কি পোঁতা নয় নদীপাড়ের কাশবনে? বাঁশবন কি নয় আমার বাল্যকাল? ঘুরতে ঘুরতে যত যত নদী চোখে পড়ে, দেখি, নদীপাড়ে কাশবন আছে কীনা! কাশবন কি নদীপাড়ে প্রভাষণা করে?
আমার জন্মদিন সাতাশে আশ্বিন। সেদিন কি দুর্গা বিসর্জন ছিল? দক্ষিণ এশিয়ায় বছর বছর কাশফুল ফোটে, জন্মদিন আসে। হাওয়ারা হইচই করে জানিয়ে যায়, ধাত্রীমার জন্যে একটি কবিতা লিখতে পারো না? কিন্তু আমার তো মনে নেই তাঁর মুখ, তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি! বিস্মরণের অসহায়ত্বকে কি কবিতায় আনা সম্ভব?
নদী দেখি, কাশবন দেখি। নদীই কি সেই বিধবা ধাত্রীমা? কাশবনই কি তাঁর পেকে ওঠা চুল? এই জন্যেই কি আমি নদীপাড়ে এত কৌতূহলী, স্তব্ধব্যাকুল? আমার জন্মদিন, সন্ধ্যার বাঁশবনে কি সেইজন্যেই এত হুলুস্থুল?
কবিতা লিখতে চাই, পারি না। না-পারা মন আকুপাকু করতে করতে বালু হয়ে যায়। নিরক্ষর মন ছুটে যায় চন্দ্রগ্রস্থ-চরাচরে; গেলেই তো দেখি, কাশবন নদীপাড়ে প্রভাষণা করে—
ধাত্রীমাকে মনে নেই। মনই এমন, হয়তো মনে না-থাকাকেও মনে পড়ে…

দ্বিজেন শর্মা কবিতাগাছ

দ্বিজেন শর্মা ছিলেন একজন উদ্ভিদগোত্রের মানুষ—এই কথা কেউ কেউ বিশ্বাস করে আছে। আমিও বিশ্বাস করি বলে যে-কোনো গভীর জঙ্গলে গেলেই দেখতে পাই, দ্বিজেন শর্মা আকাশের দিকে মাথা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। শর্মার শরীর থেকে ডালপালা ছড়িয়ে যাচ্ছে, হাওয়ায় দোল খাচ্ছে নানান বয়েসি পাতা, হলুদ পাতারা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে।
পাখিরা তো প্রধানত গাছেই বসতি গড়ে। দেখতে পাচ্ছি, দ্বিজেন শর্মা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বনের মধ্যে, তার সারাগায়ে শুধু পাখি আর পাখিঃ কিচিরমিচির পাখিজন্ম হচ্ছে। পাখিদের মাতৃভাষায় পাখিরা কথা বলে যাচ্ছে। মৃত্যুর পর দ্বিজেন শর্মার নোটবুকে পাওয়া গেছে একটি বাক্য, ‘পাখিদের মধ্যেও দুএকজন কবি আছেন, বাউল আছন। পাখিদের মধ্যে কেউ বিনয় মজুমদার আছেন! কিম্বা পাখিদের কেউ লালন ফকির আছে্ন! পাখিদের মধ্যেও সিমির মতো মেয়েটি আছে, যাকে আত্মহত্যা করে মরতে হয়েছে। একটি পাখি তনু, তার লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করতে হয়েছিল। একটা পাখি নুসরাত, যাকে পুড়িয়ে মারা হলো। কোনও কোনও রক্তাক্ত পাখি দম্পতির নাম সাগর-রুনী।’ দুপুরে, সবুজ বনের মধ্যে যে কোনো একটি পাখিগাছ দেখলেই আমি টের পাই, গাছটির নাম দ্বিজেন শর্মা, যার সবুজ শরীরে পাখিদের জীবন যাপনের অনেক গোপন তথ্য লেখা আছে। হয়তো হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো কেউ একজন একদিন এই বন-দরবারে এসে সব আবিস্কার করবেন।
ততদিন আমাদের শুধু অপেক্ষা। কেন না, জগদীশচন্দ্রের দেশে দ্বিজেন শর্মাকে চিনে উঠতে হলে আমাদের কিছু অপেক্ষা শিখতে হবে, বনের গভীরে যেতে হবে। না চিনলে চেনাজানা দু’একটি গাছকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, ‘ বলেন তো কোন গাছটি দ্বিজেন শর্মা?’
আমি আজ দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আশঙ্কা, সেই গাছটি কেউ কেটে ফেলেনি তো?

 বাসি বাসি কবিতা

খাদ্য বাসি হয়ে গেলে তা ফেলে দিতে হয়,  খিদে পূরণ হয় না। একটি নাটক দেখলাম মঞ্চে, মনে হলো, নাটকের দল বাসি খাদ্য খাওয়াচ্ছে বলে দর্শকের বমি বমি ভাব হচ্ছে। অর্থাৎ বাসি খাদ্য খাওয়া যায় না। জীবন টাটকা চায়। জীবন সুস্থ থাকতে চায়। 

আমি ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সপ্তবেদী ছায়ামঞ্চের অশ্বথতলায়, আমি নিশ্চিত, সেই ভালোবাসাকে তোমার বাসি বাসি লেগেছে। এখন যতই আমি বলি, ভালোবাসি, তুমি তো জানোই তা বাসি।
যতই আমি গন্ধরাজ গন্ধরাজ হই, তুমি তো জানোই এ ফুল বাসি…

একাদের কবিতা

আসি যাই ঝিনেদায় থাকি তো ঢাকায়, কী আসে যায় এহেন থাকা-না থাকায়! আসি যাই ঝিনেদা-ঢাকায় যেন বা তেরশো কোটি আলোকবর্ষ দূরে সেই গ্রাম যার কাশফুল ফোটা নদীতীরে আমি জন্মালাম নাকি জন্মই নিইনি শুধু জন্মাবার ভঙ্গি করে রক্তাপ্লুত ধাত্রীমার হাতে পৌঁছলাম অথবা পৌঁছনোর ভঙ্গিতে লেখার মধ্যে ঢুকে পড়লাম, এককথায় লেখালেখি হয়ে গেলাম, বর্ণমালা হয়ে গেলাম, শব্দ-বাক্যের খেলা আর ধুলার ভেতরে জাগলাম, ঘুমোলাম; লেখায় এত লাম লাম লাম হলে লেখা পড়া যায়? যায় না! লেখা কি তেমন আয়না—যার মধ্যে তুমি নিজের মুখটি দেখতে পাবে, নিজের ঘুমটি ঘুমিয়ে নিতে পারবে? লেখা কি তেমন শয্যা? লেখা কী রে ভাই? লেখার মাজেজা কি এই নয় যে, যে লিখেছে সে তার সাম্রাজ্যে সম্রাট ও একা? আমি কি কোনো একার কথা লিখছি? ত্রিভুবনে একজনই একা নাকি অনেকে একা? একাদের সংখ্যা কত, একারা থাকেই বা কোথায়? সেই তো শুরুর কথাই ঘুরে ফিরে আসে, কথা বসে, কথা খায়- দায়; তেরশো বছর ধরে আসি যাই ঝিনেদায়, কতকাল ফেরি চলে পদ্মায়; দুপুরে বা সন্ধ্যায়, সময় উড়িয়ে দেয় ঢেউ নদীর হাওয়ায়, তাই গান গাই, গান আমাকে গায়—নদীর কুল নাই কিনার নাই, নাই রে…


ওম সম্মেলন


প্রেম হলে সেই পাখি, যার সোনালি ডানা ছুঁয়ে দেখবার সৌভাগ্য পাওয়া চাই। যার একটি মায়াবী পালক খসিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। প্রেম সেই পাখি, যার চোখের মণিতে সামুদ্রিক নৌকার মাস্তুল দেখা যায়। যার মসৃণ গ্রীবায় নিঃসন্দেহে রোমিও-জুলিয়েট মঞ্চস্থ হতে পারে। প্রেম সেই পাখি, যার ঠোঁট দেখলেই প্রতীয়মাণ হয়- একজন একা মানুষের আত্মজীবনী কী ভয়ঙ্কর পিপাসার্ত! বীভৎস!

যখনই কেউ প্রেমে পড়ে মানে সেই পাখিতে পড়ে। তখন সে প্রেমরূপ পাখির ডানা ছুঁতে চায়। কারণ, তার অবচেতন মন প্রার্থনা করে ডানার নিচে আত্মগোপন। একুশ শতকের যন্ত্রণায় জ্বলেও প্রেমে এরকম আত্মগোপন এখনো উঠে যায়নি। কিন্তু হঠাৎ কোনো পাখি যখন উড়ে যায়, ডানার নিচের ওমে যে আত্মগোপনকারী সে ধপ করে পড়ে যায়। নিঃশব্দে শব্দ হয়, ধপাস! অর্থাৎ পাখি উড়ে গেলেই প্রেম উড়ে যায়। সেই প্রেম সেই পাখি আর সন্ধান করেও পাওয়া যায় না। এরপর যত পাখি চোখে পড়ে, সব অন্য পাখি। কোনোভাবেই আমি ভুলতে পারি না, সেই পাখি কোথায় গেল- যার অপরিসীম ডানার নিচে একদিন আত্মগোপনে ছিলাম, ওম সম্মেলন করেছিলাম!

আজ যেসব পাখি ওড়াউড়ি করছে, ডালে বসে আলস্য ভাঙছে- এরা তো জানেই না যে, প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করলেও আমি আত্মগোপনে থাকতে ভালোবাসি। ফলে, এখন আমি বুঝতেই পারছি না, কোন পাখিটার ডানার নিচে ওম সম্মেলন সফল হবে, সার্থক হবে?

কোন পাখিটা উড়বে না আর, স্বভাব ভেঙে?


ভাইরাস সিনড্রোম 

যে কেউ যখনই প্রেমে পড়ে, বুঝতে পারি, আমিও তার সঙ্গে প্রেমে পড়ে গেছি। প্রেমিক তো এতদিন উথালপাতাল ছিল, হাওয়ায় ভাসমান ছিল,  তার সঙ্গে আমিও উথাল-পাতাল হয়েছি, হাওয়ায় ভেসেছি। নিজের বুক থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল কী পরিমাণ,  তা টের পাচ্ছিলাম প্রেমিকের বুকের রক্তক্ষরণ দেখে। মেয়েটিকে মনে মেখে ছেলেটি যেমন বোকা, যথেষ্ট আউলা এবং অক্ষরজ্ঞানহীন। চিঠি লিখতে পারে না, মেসেজ পাঠাতে পারে না। আমারও ভীষণ নিরক্ষর নিরক্ষর লাগে। প্রেমিক ছেলেটির বুকে শুধু কম্পন আছে, চোখে আছে পিপাসা।  কেউ প্রেমে পড়লেই আমার বুক কাঁপে, স্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ শুকিয়ে যায়। নির্ঘুম  রাত্রির জানালায় বসে শিঁস দেয় কাজলডাঙার পাখি। কেউ প্রেমে পড়লেই সেই শিশ সে শুনতে পায়, আমিও পাচ্ছি। দ্যাখো, মৎসাগন্ধা নদীর ধারে আছে কুঁড়েঘর।  সেই ঘরে কেউ নেই, কেউ নেই? আছে। প্রেম আছে, প্রজাপতি আছে। অপেক্ষা করছে বুকের মধ্যে সেই নদী, কুঁড়েঘর! । ছেলেটি .যখন বর, মেয়েটি কি কবুতর?

যে কেউ যখনই কী নেই কী নেই অনুভব করতে করতে প্রেমে পড়ে, আমিও অনুভব করি কী নেই কী নেই! আমিও বুঝতে পারি, ভালোবাসতে না পারলে কবিতা লেখা স্রেফ একজন কেরানির কাজ। ভালোবাসাই তো কবিতা, এ কথা কি তুরীয়ার নাকে নাক ঘষে আমি শতবার লিখিনি?
আর  যখনই  কারো প্রেম ভেঙে যায়, মনে হয়, আমারই প্রেম ভেঙে গেছে। আমিও ভাঙা প্রেমিকের সঙ্গে উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে দ্রুত বেগে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছি। হয়তো, পাদদেশে পৌঁছনোর আগেই আমার মৃত্যু হবে। ক্ষতবিক্ষত শরীর, পতন হচ্ছে আমার,  আমি পাথরের সঙ্গে টক্কর খাচ্ছি শুধু—
এবং যখনই কারো বিয়ে হয়, তখন আমার কী মনে হয়, অনুমান করতে পারো?

টোকন ঠাকুর 
জন্ম, ঝিনাইদহ। সনদপত্রে সুনির্দিস্ট থাকলেও প্রকৃত সন-তারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। । ঔপনিবেশিক আক্রান্ত একাডেমিক ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অনাস্থাশীল, তাই কেরানিসুলভ কোনও পেশা নেই তার।
ইমেইলঃ tokonthaakoor@gmail.com
শেয়ার