দশটি কবিতা ।। কবির হোসেন

পাল্কিতে চড়ছেন পথিকবর

কবরে গিয়ে তো আর মরেন না। ঘরে মরে থাকা আপনার শব, চার দুগুণে আটপা ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতটুকু পথ বাকী রেখেই কেনো আপনাকে মরতে হয়? পৌনে-গন্তব্যে ঘুমিয়ে পড়া খরগোশকে ঘাড়ে করে দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন একজোড়া কচ্ছপ। কচ্ছপের দৌড়কে আপনার হাঁটা বলে উপহাস, ভেঙে-ভেঙে পড়ছে আপনার পায়ে, অট্টহাসিতে। ঘর থেকে কবরের দূরত্বটুকুই আপনার না-মাড়ানো পথ, ঢুকে যাচ্ছে অন্যের হিসাবে।

বাকীতে কেটে যাচ্ছে আরেকজনের জীবন; যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা যাঁর এক পা এখনো অন্য পা’কে হাঁটা শেখাচ্ছে।

 

 

কাঁটাতার

0১)

একটি বৃষ্টির ফোঁটা কাঁটাতারে কেটে দ্বিখন্ডিত হয়ে জল ও পানি হয়ে যায়।

 

0২)

মা—  গায়ে সর্ষে তেল মেখে স্নান করতে গেলে আমি সাঁতার কাটতে পারি না। তৈলাক্ত শরীরে জল কেটে গিয়ে পিছলে সরে যায়। আমি তখন জলে পিছল খেয়ে অতলে তলিয়ে যাই। তেল আর জলের দ্বন্দ্বে আমি সাঁতার হারিয়ে ফেলি পানির দরে। মা— গায়ে তেল মেখে জলে নামলে জল কেনো আমাকে ছুঁতে পারে না?  জল ঢেলে ঢেলে তেল যতই ধুতে যাই, জল ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। তেলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর জল টপকাতে পারে না। আমার তেলের শরীর জলে ভিজে না।

মা— আমি আর তেলে-রান্না খাবার গলায় দেব না। তেষ্টায় আমার গলা জলে ভিজবে না।

 

 

ডারউইনের বাসায় ডেভিড কপারফিল্ড


যতটুকু পিছনে এলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে, ততটুকু পৌঁছে দেখি আমার দেয়ালটা নেই। দেয়ালের খোঁজে আমি পেছন দিকে যেভাবে হাঁটছি, যে কেউ দেখে তাঁর ভেতরে বিশ্বাস গেড়ে নিচ্ছেন ভূতের অস্তিত্ব। আমার হারিয়ে যাওয়া সেই দেয়াল, আমার পিঠের কাঙ্ক্ষিত বিছানা যেনো, যার উপর বসে পা দুলিয়ে একজন ঘুড্ডিবালক সুতা গুটিয়ে নিচ্ছে আমাকে টেনে। আমি সেই সুতার টানে, পেছন দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেখেয়ালে রাখা এক বটির উপর ধপাস করে পড়ে যাই। দ্বিখন্ডিত আমি লক্ষ্য করি, আমার কোমর থেকে পা অব্ধি খন্ডিত অংশটুকু তড়পাচ্ছে রুইমাছের মত। আমি কিঞ্চিৎ হেসে দরোজায় বসে ঝিমানো এক মা’কে ডেকে বলি— মাগো… এভাবে যেখানে-সেখানে বটি দাঁড় করে রাখবেন না, বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জেগে ওঠা অপরিচিত প্রাচীন মা, মুখে ভার এনে বলেন— বড়শি কেনার টাকা নেই বাবা, তাই দীর্ঘদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকা অব্যবহৃত বটিটা উঠানে পেতে রেখেছিলাম।

 

 

প্যারাডাইজ লস্ট


পৃথিবীকে আমি একটা জ্যামিতি বক্স ভাবি। যার ভেতরে মার্জিন করে যাবতীয় পথ আঁকার ধুলোবালি মুছে স্কেলটা তুলে রাখি। মানচিত্র এঁকে এখন অবসরে আছেন যারা, ত্রিকোণমিতি, কম্পাস, পেন্সিল ইত্যাদি যার যার আসনে সাজিয়ে রাখি। পেন্সিলের মুখ থেকে টেনে আনি কাটার। সাজিয়ে রাখি। এভাবে পার্টস বাই পার্টস সাজাতে গিয়ে দেখি, ভেতরে ভুল চলছে, স্থানাভাবে বাইরে ছিটকে পড়েছে চাঁদা— অর্ধচন্দ্র নিয়ে। যেখানে পেন্সিল খ’সা তারকারাজি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

তারকারাজ্যে বসে চাঁদ অন্যের মুখে টর্চ মেরে নিজের যে মুখ দেখিয়ে যাচ্ছে, শিশু কোলে মা তাকে হারিয়ে যাওয়া ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।

 

 

হাংরি পার্টি


আমি যখন লিফটে চড়ে এক ঘর দুই ঘর ফেলে উপরে উঠছিলাম, আমার ঘরে— গন্তব্যে; তখন গলির রাস্তা দিয়ে একজন লোক এক ঘর দুই ঘর ফেলে যাচ্ছিল নিজের ঘরে— গন্তব্যে। আমার গন্তব্য ছয়তলায়, তাঁর গন্তব্য পাঁচটি ঘর ফেলে ষষ্ঠতে। আশ্চর্যজনকভাবে, আমরা দুইজন লোক পৌঁছি একই ঘরে— গন্তব্যে। একই পরিবারে। একই দেহে। একই হাত পা চোখে। একই জিভে। মুখোমুখি দাঁড়াই, কথা বলি তোতা পাখির কণ্ঠে।

দেখি, চারপাশ ভরতি একজন মানুষ, কথা বলছে অজস্র মুখে।

 

 

আমার বিখ্যাত জামাটি


জামাটা পরতে পরতে সেটা আমি হয়ে গেছি, মা। বাবাকে বলে দিও সেটা পরে বের না হতে। আমাকে পরে বাবা বের হলে বন্ধুরা বাবাকে আমার নাম ধরে ডেকে বসবে। আমার ভেতরে বাবা চলে গেলে, স্বামীর খোঁজে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিব্রতবোধ জাগাবে । তারচে বরং আমাকে তোলা রাখো ঘরের পুরনো হ্যাঙ্গারে। সেখান থেকে তাকে নামিয়ে কোলে করে মুখে খাবার তুলে দিও। ময়লা হলে কুসুম জলে স্নান করিয়ে দিও। রোদে শুকিয়ে ফের হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে যদি টের পাও তার ভেতরে বিবিধ কলুষ— দাগ, অদৃশ্য ময়লার নানাবিধ দুর্গন্ধ; এবং এইসব কলুষ, ময়লা ধুতে গিয়ে যদি তোমার হাত নুয়ে পড়ে, তার ভেতরে মুখ লুকিয়ে বল শুধু……

আমি তো জামা খুলে মাছের দম নিয়ে বসে আছি নদীর তীরে। তাৎক্ষণিক নেমে পড়ব আজীবন স্নানে।

 

 

আমি যেহেতু প্রথম বিশ্বে


কলম্বাস— চন্ডীদাসকে সাথে নিয়ে আমরা আবার দেশ খোঁজার অভিযানে নামবো। ইউরোপ আমেরিকার তলদেশে যেসব দেশ আছে, নোঙরের ফলায় কিছু খাবার গেঁথে বর্শি পেতে ধরবো। বর্শির সুঁতোটা হবে চিলির প্রতিপাদ বাংলাদেশ-এর দূরত্ব সমান । এই সমস্ত হা-ভাতে দেশ মুখে অসংখ্য ক্ষুধা নিয়ে কাঁনকো ফুলিয়ে খুঁজে যাচ্ছে নোঙরের শব্দ। একে একে নোঙর তুলে আমরা এইসব দেশ ধরবো। পতন থেকে উত্থানের কোরাস গেয়ে উন্নতির চাকচিক্য দেখিয়ে তাদের চমকে দেবো ।

কলম্বাস— এইসব দেশ ফ্রাই করে খেয়ে কাদের উপর কারা সত্য প্রমাণ করে চণ্ডীদাসকে আমরা চমকে দেবো ।

 

 

অন্ধ—কার?

০১)

পথে পা রেখেই আমি চিৎকার করে উঠি— আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না কেনো? অদৃশ্য এক শব্দ— যে কিনা আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল; বলল— আপনি তো অন্ধ! ঘাড় মটকে দেওয়ার মতন কথা!! যেখানে আমি আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি— অন্ধ হই কী করে? তবে কি চোখ উল্টে প্রত্যেক অন্ধই দেখে যাচ্ছে নিজেকে? আর নিজেকে দেখাকেই তো কেবল সর্বদ্রষ্টা বলেই জানি!— হয়তো এইসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আত্মজীবনী লিখে যাচ্ছে একেক অন্ধ তাঁর হাতের ছড়ি দিয়ে মাটিতে, পথে পথে।

আমার দেহ নিয়ে সমূদয় সন্দেহের কথা আমার সাইকিয়াট্রিস্টকে জানালে তিনি দীর্ঘশ্বাসে বলেন— জনাব, আপনি অন্ধ নন, পৃথিবীটাই অন্ধকার!

 

০২)

যে লোকটা জানে, সবুজ মরে গেলে হলুদ হয়ে যায়, আপাদমস্তক সবুজে মোড়ানো সে একদিন হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবের ভেতরে আরামে বসে, আমাকে ভুলে যেতে তাঁর ভেতরে আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে মেরে ফেলে। আমি তখন অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে একটা নীল চাদর জড়িয়ে একাকী হাঁটছিলাম টেকো জনাকীর্ণ পথে । আমার সাথে সাক্ষাৎ ঘটা লোকমাত্রই জানে আমি আপাদমস্তক একটা কালো চাদর, যেটাকে সূর্য রাত থেকে আলাদা করতে আমাদের তাড়া করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । তাড়া খাওয়া আমি যার সাথেই দাঁড়িয়ে কথা বলছি, হাসছি, কাঁদছি— পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের দল তাকে পাগল বলে ডাকছে(?)। আমি আমার সমস্ত ভলিউম ছেড়ে মানুষদলকে আমার উপস্থিতি জানাতে গেলে দেখি আমার স্বর নিভানো। আমি তখন বুঝি, আমিই তবে সেই লোক, পাগলেরা একাকী দাঁড়িয়ে যার সাথে কথা বলে!

 

 

যদিও প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত লোকটিও মা’র খেতে চায় না

তলোয়ারের মতোই আমার দেহে জন্মদাগ ঝিলিক দিয়ে কাঁদে।

সেই তলোয়ার— যে জন্মের আগে পেদানি খাওয়ার প্রতিশোধ নিতে কামারকে খুঁজে যাচ্ছে এর বুকে ওর বুকে ঢুকে। মানুষের বুকে এখন আর প্রেম জন্মে না, রাবারগাছ থেকে টপ টপ অশ্রু ঝরে জমে আছে কষের পাথর। সেই পাথরে ঘষে ঘষে ভোঁতা হয়ে এলে, শাণ নিতে উপস্থিত হয় কামারের কাছে। কামারের খোঁজে যতবার কামারের কাছে আসে, আহত, ভোঁতা অথবা নত হয়ে আসে। যেহেতু নত হওয়া মানেই পিঠ পেতে দেওয়া— পেটের পীড়ায় আহত কুঁজোর পিঠেই আঘাতের হাতুড়ি নাযিল হয়।

যাদের দেখে নেব বলে জমা রাখি, তাদের দেখে দেখে খরচ হয়ে যাই, দেখে নিতে পারি না।

 

 

অসুস্থ হাসপাতাল

ক্ষুধা একটি সার্বজনীন অসুস্থতা, চিকিৎসা আছে, মুক্তি নেই। এই অসুস্থতা নিয়ে একটি মাছ বড়শিতে চড়ে এখন হাসপাতালে আছে, মহিলা ডাক্তারের অধীন। ডাক্তার চিকিৎসার বদলে পোস্টমর্টেম করছে, খুন হওয়ার আলামত আবিষ্কারের পরিবর্তে খুলে ফেলছে পেটের যাবতীয় ভেতর এবং বাহির। মাছটি হলুদ রঙের সীমিত জলে এখন সাঁতার কাটছে। এই সাঁতারে তার পাখনার কোনো কৃতিত্ব নেই, না আছে তার; কৃতিত্ব টগবগে ঢেউ আর জলের। ঢেউ থেমে গেলে মাছটি আবার খুন হবে, নতুন স্বাদে। মাছটি তারপর ওষুধ হবে, অসুস্থ ডাক্তারের উদরে।

হাসপাতাল ভরতি অসুস্থ ডাক্তার, রোগীর কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে।



কবির হোসেন
জন্মঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮, নারায়ণ গঞ্জ, ঢাকা
প্রকাশিত বইঃ ব্রেকিং নিউজ

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading