যাত্রা: পৃথিবীর পথে পথে
কনফুসিয়াসকে নিয়ে কিছু ছোটগল্প রয়েছে —
‘কোনো এক গ্রাম-সমাবেশে আপ্যায়নের কালে তিনি হাতে লাঠি বহন করা বয়স্ক মানুষদের সাথেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।’
‘যখন গ্রামের মানুষজন অশুভ আত্মাকে তাড়াচ্ছিলো, তিনি তখন তিনিতার court robe পরে পূর্বপ্রান্তে গ্রামবাসীদের সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।’
যখন গ্রামবাসীদের পান ও আপ্যায়ন পর্ব শেষ হতো, কনফুসিয়াস সর্বদা অপেক্ষা করতেন যতক্ষণ না তারচেয়ে বয়সে বড় লাঠি-ভর দিয়ে হাঁটা বৃদ্ধরা দরজা অতিক্রম করে না যান। তিনি কখনোই তাঁদেরকে পেছনে ফেলে হনহন করে ছুটতেন না।গ্রামের লোকেরা যখন অশনিশক্তি তাড়াতে লেগে যেতো, কনফুসিয়াস খুব সম্মানের সহিত পূর্বপ্রান্তে তার court robe পরে দাঁড়িয়ে যেতেন।
এগুলো ছিলো খুব ছোট ছোট উপলক্ষ। আমরা হয়তো এখনো অবাক হবো একথা ভেবে যে, কেনো প্রাচীন গ্রন্থের লেখকেরা একজন মহান সাধুর এমন ছোট ছোট ঘটনা-সংশ্লিষ্ট আখ্যান রচনা করতে যেতেন। এগুলো কী সবাই-ই করতে জানতেন না? এসব কী শুধু সেই সাধুকেই গৌরবান্বিত করে?
প্রকৃতপক্ষে, তথাকথিত সাধুর ভাষা এবং কর্ম আসলেও ছিলো অতোটাই সাধারণ, এতোই সাধারণ যে এটা আধুনিক মানুষকে কিছুটা সন্দেহপরায়ণ করে তোলে। এই গল্পগুলো এমনই যে মনে হতে পারে এগুলো আমাদের প্রতিবেশীর বাড়িতে বা খোদ আমাদের বাড়িতেই গড়পরতা ঘটে যাওয়া আর দশটা মামুলি ঘটনা।
কিন্তু তারা কি আশ্চর্য উষ্ণ ও কুসুমিত! এই গল্পগুলো আমাদের বোঝাতে সক্ষম যে, সাধুরা আমাদের থেকে কার্যত খুব দূরের কেউ নন। আবার কনফুসিয়াস আমাদের দেখান তার উন্মোচিত কিছু গূঢ় সত্যকে, এবং তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন তার জীবনেই ঘটে যাওয়া ঘটানাবলির সাথে, যাতে আমরাও এগুলো মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে পারি।
আমরা তাহলে দেখতে পাই যে, যেসব কর্ম আপাতভাবে গুরুত্বহীন মনে হয় সেসবই মানুষের অন্তরাত্মা থেকে আসলে গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে।
কনফুসিয়াসের ছাত্র Zilu একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো যে, সে কীভাবে একজন junzi হতে পারে। কনফুসিয়াস Zilu-কে বলেছিলেনঃ ‘সে নিজেকে পরিচর্যা করে এবং reverence বা সম্মানলব্ধ করতে পারে।’ নিজেকে পরিচর্যা করো আর খুব সক্রিয় একটা সম্মানজনক মনোভাব বজায় রাখো। এসব শুনে Zilu’র অভিব্যক্তি ছিলো এরকম যে, ‘আপনি এগুলো করেই একজন junzi হতে পারবো বলছেন? না, এটা এতোটা সহজ হতে পারে না গুরু, পারে কি?’
কনফুসিয়াস কিছুটা যুক্ত করে বলেন, ‘সে নিজেকে পরিচর্যা করে এবং তার সঙ্গীদের মনে শান্তি সঞ্চার করে।’ আগে নিজেকে একজন ভালো মানুষ বানাও, তারপর অন্যকে প্রশান্ত করার চিন্তা করো।
Zilu এতো সহজেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি এবং কনফুসিয়াসকে আবার চাপাচাপি করতে লাগলো — ‘এই কি সব?’
কনফুসিয়াস বলে চললেন, ‘সে নিজেকে পরিচর্যা করে এবং অন্যদের নিরাপত্তা বিধান করে। এমনকি Yao এবং Shun এর মতোন সন্তরাও অন্য মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করাটা কষ্টসাধ্য মনে করতেন।’Yao এবং Shun এর মতোন junzi, সন্ত এবং প্রজ্ঞাবান সম্রাটগণও এই কাজকে শক্ত মনে করতেন। কাজেই, তুমি যদি এই কাজকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারো তবে তুমি অবশ্যই একজন junzi এর মতোন অতীব ভালো মানুষ হতে পারবে!’
The Analects of Confucius গুলি এই ধরনের সাধারণ ছোট ছোট গল্পের সমাহার-যেসব আমাদের যে কারো জীবনেই ঘটে থাকতে পারে— কনফুসিয়ানিজমে আমরা খুব অল্পই পাই এমন কোনো অংশ যা অতি উচ্চমার্গের নীতিস্থাপনীয়। আমাদের এই কথা মনে হবার জন্যেই কনফুসিয়াস যে সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা আমাদের আওতাবহির্ভূত।বরং সেসব অনেক উষ্ণ ও আমাদের জীবন-ঘনিষ্ঠই বটে।
কনফুসিয়াস আমাদের যাতে একনিষ্ঠ হতে বলেন তা হচ্ছে- দুনিয়াতে শান্তি ও স্থিরতা আনার চেয়ে নিজেই কিভাবে নিজের সেরা version-টি হতে পারা যায় সেদিকে আগে মনোযোগী হওয়া।একজনের নৈতিক চরিত্র পরিচর্যা করাই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ নিজের জাতি ও সমাজের দায়িত্ব নেবার আগে। কনফুসিয়াস এবং তার শিস্যরা নিজেদের সেরা version-টি হতে পারার জন্য অনেক কষ্ট করতেন- তারা এটা শুধু আত্মসিদ্ধির জন্য করতেন না, তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো তারা যে সমাজে বাস করতেন তার প্রতি দায়িত্ববোধের অভিজ্ঞান।
কনফুসিয়াস বলেছিলেনঃ ‘প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা নিজেদের সমৃদ্ধ করবার জন্য পড়াশোনা করতেন; আর আজকের মানুষ অন্যকে মুগ্ধ করবার জন্য পড়ে।'(Analects XIV)
প্রাচীন আমলের মানুষ নিজেদের আরো ভালো মানুষে পরিণত করতে পড়াশোনা করতেন, কিন্তু বর্তমানে আমরা লোক দেখানোর জন্য এবং নিজেদের সুবিধা অর্জনের জন্য পড়ি।
যার জ্ঞানের প্রতি প্রকৃত সম্মান আছে সে তার মনের উন্নয়নের জন্যই অধ্যয়ন করে থাকে।বই থেকে, সমাজ থেকে, ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত লব্ধ জ্ঞান থেকেই আপনি শিখবেন কিভাবে সুখ ধরে রাখতে হয়।
প্রথমে নিজেকে একজন অনুগত, শিক্ষিত ও জ্ঞানী নাগরিকে পরিণত করুন, তারপর এভাবে সুসজ্জিত হয়ে সমাজে আপনার অবস্থান খুঁজে নিন এবং জীবনে আপনার ভূমিকা বুঝে নিন।শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমার অবস্থান অন্বেষণ ও নিজেকে উন্নত করার প্রক্রিয়াটাকেই সম্পন্ন করা।
কিন্তু ‘অপরকে মুগ্ধ করার জন্য পড়াশোনা’টাই বা তাহলে কেমন?
এটা হচ্ছে শিক্ষাকে কেবল একটি হাতিয়ার বা কৌশল হিসেবে গণ্য করা যা একটি চাকুরি পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে বা একান্তই ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে।
কনফুসিয়াস কখনোই বলেননি junzi হতে হলে আপনাকে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির মতো হয়ে উঠতে হবে।
তিনি যেভাবে দেখেন তা হলো, junzi হতে হলে আপনাকে আপনার নিজেরই সেরাটা খুঁজে ফিরতে হবে এবং খুঁজে পেতে হবে।এই প্রক্রিয়ার শুরুটা হবে আপনি যে অবস্থানে আছেন সেই অবস্থান থেকেই, আপনার চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই যাত্রাটা শুরু করতে হবে, এবং শুরুটা আজই করতে হবে- যাতে করে আপনার মন একটি যথোপযুক্ত ভারসাম্য অর্জন করতে পারে।
আর যখনই আপনি সত্যিকারের শান্ত, দৃঢ়, মাটির কাছাকাছি অবনত মন এবং অন্তঃকরণ ধারন করবেন আপনি জীবনের উত্থান-পতন আর অর্জন-বিসর্জনের দ্বারা তাড়িত হওয়াকে এড়াতে সক্ষম হবেন।
এ প্রসঙ্গটি আমাকে একটা ছোট গল্প মনে করিয়ে দেয়—
তিনজন দর্জি অনেক দিন আগে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা তিনটি দোকান একই রাস্তায় খুলে বসে। তারা প্রত্যেকেই বেশিরভাগ খদ্দের আকৃষ্ট করতে চাইতেন।
প্রথম দর্জি তার দোকানের সামনে একটি বড় বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, যাতে লেখা ছিলো— ‘আমি এই অঙ্গরাজ্যের সেরা দর্জি।’
এটা দেখার পর দ্বিতীয় দর্জি ভাবলেন যে তিনি এর চাইতে ভালো কিছু করতে পারেন। তাই তিনি এর চাইতেও বড় এক বিজ্ঞাপন ঝুলালেন এই কথা লিখে যে— ‘আমি সারা দেশের মধ্যে সব থেকে সেরা দর্জি।’
তৃতীয় দর্জি এই দুটি দেখে ভাবলো আমাকে কি তাহলে সারা দুনিয়ার সেরা দর্জি লিখতে হবে? তিনি এই বিষয়টা অনেক লম্বা সময় ধরে ভাবলেন, এবং একটা খুব ছোট বিজ্ঞাপন ঝুলালেন। এটাই তার দোকানের দিকে অন্য দুটো দোকানকে শূণ্যতায় ভাসিয়ে অই রাস্তার সব খদ্দেরকে আকর্ষণ করতে পেরেছিলো।
তৃতীয় সেই দর্জির বিজ্ঞাপনে কীইবা লেখা ছিলো?
‘আমি এই রাস্তার সেরা দর্জি ।‘
এই গল্পের মর্মকথা হচ্ছে তৃতীয় দর্জিটি আগে তার সামনে যা ছিলো সেখান থেকেই শুরুটা করেছিলেন, এই শুরুর স্থান এবং সময়টা ছিলো স্থানিকভাবে এবং সময়গতভাবে সবচেয়ে নিকটবর্তী অর্থাৎ— ‘আজ এবং এখান থেকেই।’ এবং এজন্যই তিনি খদ্দেরদের আস্থা ও নির্ভরতা জিতে নিতে পেরেছিলেন।