আইয়ুব বাচ্চু ও একটি ওয়াকম্যানের গল্প ।। হাসনাত শোয়েব

১৮ অক্টোবরের সকালটা বড় অদ্ভুতভাবে শুরু হয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই কেমন যেন বিপন্ন লাগছিল। সকালের  স্নিগ্ধতার মাঝেও  কোথাও যেন একটা শূন্যস্থান তৈরি  হয়েছিল। এর মাঝে কার পোস্টে দেখলাম আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। প্রথমে মনে হলো ফেক নিউজ। পরে বায়োস্কোপে গিয়ে কোন একটা টিভি চ্যানেল খুলতেই চোখে পড়ল ব্রেকিংনিউজ, ‘জনপ্রিয় ব্যান্ডসংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন’। একজন কিংবদন্তিকে এভাবে ‘জনপ্রিয় ব্যান্ডসংগীত শিল্পী’ ডিসকোর্সে বেধে ফেলা কেন জানি মানতে পারছিলাম না। আইয়ুব বাচ্চু কোন ‘যেন-তেন’  শিল্পী না। নব্বই নামের একটি দশককে শাসন করেছেন যে কজন  ‘মায়েস্ত্রো’, আইয়ুব বাচ্চু তাদের একজন। একটা জেনারেশনের রুচি, অ্যাটিচুড তৈরি হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুদের হাত  ধরে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। কত স্মৃতি, কত মুহূর্ত আমরা রক মিউজিককে উৎসর্গ  করেছি। তাদের একজন নিশ্চিতভাবেই আইয়ুব বাচ্চু, পরবর্তীতে এবি নামেই অধিক পরিচিত। একটা সময় ছিল, যার নামে চোখ বন্ধ করে কসম খাওয়া যেতে পারত অনায়সে।

সেই গল্প কবে শুরু হয়েছিল? মানুষের একটাই তো জীবন। ছোট্ট জীবন। সে জীবনে কেউ কাউকে প্রভাবিত করতে পারাটা সহজ কথা নয়। তারা আমাদের প্রভাবিত করেছিল। শুধু কি প্রভাবিত,  কখনো কখনো বদলে দিয়েছে তার গতিপথও। তবে সত্যিই মনে করা কঠিন প্রথম কবে আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনেছি। হয়তো তখন গান কি বুঝতেও শিখিনি, যখন থেকে বাংলা ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে পরিচয়। ভাগ্যিস আশেপাশে কয়েকজন বড় ভাই পেয়েছিলাম যাদের কাছ থেকে আমাদের মিউজিক্যাল বায়াত। মনে আছে, ফখরুল ভাই  যখন গিটার নিয়ে প্রথম বাড়িতে আসেন। আমি তার জানালা দিয়ে তার গিটার দেখতে গিয়েছিলাম। যেন রূপকথার কোন গল্প শুনছি। কারেন্ট চলে গেলে তার কণ্ঠেই প্রথম ‘সেই তুমি’ শোনা। এভাবে আমার লাইভ কনসার্টের হাতেখড়ি। তার আগ পর্ন্ত ছিল কেবল ক্যাসেটের ফিতা। প্রথমে মামার দুবাই থেকে পাঠানো একটি রেডিও। এরপর একটা ওয়াকম্যান এক বন্ধু উপহার দিয়েছিল কোন জন্মদিনে। তখন সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেই ওয়াকম্যানটিই যেন জীবন বদলে দিল। স্কুল থেকে এসে গান, স্কুলে যাওয়ার আগে গান, ঘুম থেকে উঠে গান, ঘুমানোর আগে গান। কি শুনি নাই  তখন। আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া পছন্দের গানের কথা ভাবছিলাম। আসলে অনেকগুলো গান সমানে পছন্দ। তবে একটা সময় বুঁদ  হয়েছিলাম, ‘এখন অনেক রাত’ এবং ‘ভাঙা মন নিয়ে তুমি’ তে। পরে ‘হাসতে দেখো, গাইতে দেখো,’ ‘মেয়ে’, ‘গতকাল রাতে’ কিংবা ‘রূপালি গিটার’সহ আরো অনেক গানগুলো অনেক ভালো লাগার।  আর গিটারিস্ট হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর কথা কি আর বলা যায়। গিটার প্লেয়িংয়ে রেভুলেশন নিয়ে এসেছিলেন। তাকে দেখে গিটার হাতে তুলে নিয়েছে অসংখ্য তরুণ। সত্যি নাকি মিথ কখনো যাচাই করে দেখিনি, তবে মফস্বলে তখন শুনতাম দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গিটারিস্ট নাকি বাচ্চু। এসব আমরা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম।

সে সময় মাইকেল জ্যাকসন পেয়েছিলাম খালাত ভাই  সম্পর্কিত মাসুদের কাছ থেকে। আর শাকিল ভাই, ফখরুল ভাইদের কাছ থেকে পেলাম বা্চ্চু, জেমস, সোলস, রেঁনেসা, দলছুট, ফিডব্যাক,  ওয়ারফেজ এবং অঞ্জন দত্তসহ অনেক কিছু। আর একটু পর আসলো আর্টসেল, অর্থহীন, শিরোনামহীন, মেটালিকা, সিস্টেম অফ ডাওন, ডিলান, মার্লে, কোহেন, গানস এন্ড  রোজেসের মতো আরো অনেকে। তারও পরে আসলো মেঘদল, মনোসরনীরা। এসব কিছুর জন্য আমি আমার শৈশবের কাছে কতৃজ্ঞ। মফস্বলে বেড়ে উঠার সুযোগ আমি কড়ায়-গণ্ডায় কাজে লাগিয়েছিলাম। এরপর যুক্ত হলো শাটল ট্রেন। উন্মাতাল করা সেসব দিন। তীব্র গরমের মধ্যে বগি ফাটিয়ে একটার পর একটা গান করতে করতে ষোলশহর থেকে ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস থেকে ষোলশহর। এভাবেই গেছে পাঁচটা বছর।

মিউজিশিয়ান হতে পারিনি। কিন্তু জার্নিটা তো মিথ্যা নয়। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কোনকিছু না বুঝেই  ব্যান্ড ফর্ম করা। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত টেনেছি। হতে হতেও হলো না,  এ আক্ষেপ আমৃত্যু থাকবে। আমি কখনো কবিতা লিখব ভাবিনি, কিন্তু আমি মিউজিক করব, রকস্টার হবো সেটা সবসময় ভেবেছি। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে যায়, কে বা জানে। কিন্তু আমি তো এখনও রকস্টার হতে  চাই।

যাই হোক, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর সব এলোমেলো লাগছিল। এখন রাত ৪ টা ৩১ (১৮ অক্টোবর দিবাগত রাত) মিনিট। ঘুম  আসছিল না কোনভাবে। রাতের বেলা কনসার্টে জেমসের কান্নার ভিডিও দেখে প্রচণ্ড অসহায় লাগছিল। একজন কিংবদন্তির জন্য একজন কিংবদন্তির এভাবে স্টেজে দাঁড়িয়ে কান্না, অদ্ভুত এক দৃশ্য। জেমসের এ কান্না বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আমাদের সোনালি সময়টা অতীত হয়ে গেছে। কতদিন নতুন একটা অ্যালবামের জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করি না। ‘সুরের ঝংকারে’ গিয়ে আর কখনো কাগজে গানের নাম লিখে দিয়ে আসা হবে না।  একপিঠে জেমস, অন্য পিঠে আইয়ুব বাচ্চু। হ্যাঁ, এটা তো ঠিক যে, নতুন গান আর তারা দিতে পারেননি বা পারছেন না। কিন্তু বিশেষ একটা সময়ে তারা নিজেদের নাম খোদাই করে দিয়েছেন। যা আরো অনেক অনেক দিন থেকে যাবে। এসব গানের কাছে চুপ করে বসে থাকা যাবে আরো অনেক দিন। আমার সৌভাগ্য নব্বই এবং লেট নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে বড়  হয়েছি। একটা পালাবদলের সাক্ষী হয়েছি। এ সুখটুকু অনবদ্য। সুডো বুদ্ধিজীবীতা দিয়ে একে ধরা বা বুঝা যাবে না। আর বাংলা রক মিউজিকের রাজনৈতিক বয়ান অন্যত্র  দিয়েছি। ভবিষ্যতে না হয় আবার দেয়া যাবে। আজকের বয়ানটুকু একজন  আইয়ুব বাচ্চুর জন্য তোলা থাকল। মায়েস্ত্রো অফ আওয়ার টাইম। যিনি গিটার হাতে কনসার্ট মাতিয়ে তোলা একজন রকস্টার।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading