বাংলা ভাষার অনেক লেখকের হাত ধরে জেন গল্পের অনুবাদ হয়েছে; পূর্বে। সাহিত্যের খবরাখবর যারা অল্প-স্বল্প রাখেন তাদের কাছে জেন গল্প প্রায় পরিচিত। সুতরাং নতুন করে যারা জানতে চান বা আরও অধিক জানার আগ্রহ থাকলে নিশ্চয় গুগলে গিয়ে ‘zen stories’ লিখলে দুনিয়াটা উন্মুক্ত হবে। আমিও গুগলে গল্পগুলো পড়েছি। আর বিভিন্ন সময়ে কয়েকটা অনুবাদের প্রচেষ্টা চালিয়েছি।
—উপল বড়ুয়া
ঘোষণা
জীবনের শেষ দিনে তানজান ৬০টি পোস্টাল কার্ড লিখলেন এবং পরিচারককে অনুরোধ করলেন, তার সব ডাকে পাঠানোর জন্য। তারপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
কার্ডে লেখা ছিল: আমি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এটাই আমার শেষ ঘোষণা।
তানজান
জুলাই ২৭, ১৮৯২
বিষয় কি এটাই?
জেন গুরু হাকুইন তাঁর শুদ্ধাচার জীবন-যাপনের জন্য প্রতিবেশীদের কাছে প্রশংসিত ছিলেন।
এক সুন্দরী জাপানি বালিকা যার বাবা-মা’র ছিল ফলের দোকান, বাস করতো গুরু হাকুইনের কাছাকাছি। হঠাৎ, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, বালিকাটিকে সন্তানসম্ভাবা অবস্থায় আবিষ্কার করলো তার বাবা-মা।
বিষয়টি তাদেরকে খুব রাগান্বিত করলো। অনেক জোরাজুরিতেও বালিকা তার অনাগত সন্তানের বাবার নাম মুখে আনলো না। তবে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যধিক হয়রানির শিকার হওয়ার পর সে হাকুইনের নাম নিল।
চরম রাগান্বিত বালিকাটির বাবা-মা গেলো গুরু হাকুইনের কাছে। তাদের কথা শুনে তিনি যা বললেন তা হলো, ‘বিষয় কি এটাই?’
জন্মের পরে শিশুটিকে নিয়ে আনা হলো হাকুইনের কাছে। ঐ সময় তিনি সমস্ত মযার্দা হারিয়ে ফেলেছেন, তাতে অবশ্য তাঁর কোনো সমস্যা হলো না। তবে তিনি খুব যত্নের সঙ্গে শিশুটিকে লালন-পালন করতে লাগলেন। তিনি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শিশুটির জন্য দুধ রোজ করলেন এবং যা যা প্রযোজনীয় তার সবই করতে লাগলেন।
এক বছর পর বালিকা মা’টি আর নিজের অবস্থানে স্থির থাকতে পারল না। সে তার বাবা-মাকে সত্যটা জানিয়ে দিল যে, শিশুটির আসল বাবা এক তরুণ যে মাছ বাজারে কাজ করে।
বালিকাটির বাবা-মা আরেকবার হাকুইনের কাছে গেল। ক্ষমা প্রার্থনার পর তারা শিশুটিকে ফেরত চাইল।
হাকুইন তাতে সম্মতি প্রকাশ করলেন। কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই তিনি শিশুটিকে তাদের কাছে হস্তান্তর করে বললেন, ‘বিষয় কি এটাই?’
হোশিনের শেষ কবিতা
দীর্ঘদিন ধরে চীনে বাস করার পর জাপানের উত্তর-পূর্বাংশে ফিরে শিষ্যদের শিক্ষা দিতে লাগলেন জেন গুরু হোশিন। যখন তিনি বৃদ্ধাবস্থায়, একদিন শিষ্যদের ডেকে চীনে শোনা এক গল্প বললেন। এখানে গল্পটা দেওয়া হলো:
কোনো এক বছরের ২৫ ডিসেম্বর, বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া তোকুফু তাঁর শিষ্যদের বললেন, ‘আমি আগামী বছর পযর্ন্ত বেঁচে থাকবো না। সুতরাং তোমরা অনুসারীরা আমাকে এই বছর খুব ভালোভাবে সেবাযত্ন করো।’
শিষ্যরা ভাবলো তিনি মজা করছেন। কিন্তু তোকুফু ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান শিক্ষক। যার কারণে শিষ্যরা সবাই সেবাযত্ন ও ভোজ দিয়ে ওনার বিদায়ী বৎসরের দিনগুলো সফল করতে লাগলো।
নতুন বছরের সন্ধ্যাটা তোকুফু এই বলে শেষ করলেন যে, ‘তোমরা সবাই আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছো। আগামীকাল অপরাহ্ণে যখন বরফ ঝরা থেমে যাবে তখন আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো।’
শিষ্যরা তাঁর কথায় হাসলো। ভাবলো বার্ধক্যে তিনি বোকার মতো কথা বলছেন। কারণ ঐ রাত ছিল ঝকঝকে এবং বরফবিহীন। কিন্তু মধ্যরাতে বরফ পতন শুরু হলো এবং পরেরদিন শিষ্যরা তাদের শিক্ষককে আর খুঁজে পেলো না। তারা ধ্যানশালায় গিয়ে দেখলো, সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তোকুফু।
হোশিন, যিনি গল্পটি শোনাচ্ছিলেন, তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন, ‘এটা কোনো জেন গুরুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, নিজের বিদায়ী দিন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা। তবে তিনি যদি সত্যিই তা কামনা করেন, তবে নিজের ইচ্ছেতেই সব করতে পারেন।’
কেউ একজন বলল, ‘আপনি পারেন?’
‘হ্যাঁ। আজ থেকে সাতদিন পর আমি তোমাদের দেখাবো আমি কী করতে পারি।’, উত্তর দিলেন হোশিন।
শিষ্যদের কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করলো না। যখন পযর্ন্ত না হোশিন তাদেরকে একত্রে ডাকলেন তার আগ পযর্ন্ত অধিকাংশই সেই আলাপচারিতার কথা ভুলে গিয়েছিল।
তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘সাতদিন আগে আমি বলেছিলাম, আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তার জন্য প্রথানুযায়ী একটি বিদায়ী কবিতা লিখতে হবে। কিন্তু আমি কবিও নই, ক্যালিওগ্রাফারও নই। তোমাদের কেউ আমার শেষ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করো।’
অনুসারীরা ভাবলো, তিনি মজা করছেন। তবে তাদের একজন লেখা শুরু করলো।
‘তুমি কি প্রস্তুত?’, হোশিন জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, গুরু।’ লেখা শুরু করা শিষ্যটির উত্তর।
তারপর হোশিন নির্দেশ দিতে লাগলেন: ‘আমি এসেছি দীপ্তি থেকে। এবং দীপ্তিতেই ফিরে যাচ্ছি। এটা কি?’
গতানুগতিক যে চার লাইনের কবিতা তার থেকে এক লাইন কম ছিল কবিতাটিতে। তাই শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুরু, আমাদের এক লাইন কম হয়েছে।’
হোশিন, বিজয়ী সিংহের মতো গর্জাতে লাগলেন এবং চিৎকার করে বললেন, ‘কা!’
শিষ্য তাই লিখে দিলেন।
গূঢ় অর্থ
এক তরুণ জেন শিক্ষার্থী তার আশ্রমের জন্য বাজারে সবজি কিনতে যাচ্ছিল। পথে, নিজের আশ্রম থেকে আরেকটু দূরত্বে সে দেখা পেলো আরেক শিক্ষার্থীকে, যাকে সে মাঝেমধ্যে দেখে।
সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
‘আমার পা যেখানে নিয়ে যায়’, উদ্দীপনাহীন উত্তর দিল অন্য শিক্ষার্থীটি।
আমাদের সেই তরুণ শিক্ষার্থীর মনে উত্তরটি ঘুরতে লাগলো এই ভেবে যে, নিশ্চিতভাবে তাতে কি কোনো গূঢ় অর্থ নিহিত আছে?
আশ্রমে ফিরে, এই আলাপচারিতার কথা তার অগ্রজ গুরুকে বর্ণনা করলো সে। গুরু বললেন, ‘তুমি বালকটিকে জিজ্ঞেস করতে পারতে যদি তার পা না থাকতো তবে সে কী করতো?’
পরেরদিন, দৈবাৎ আবারও শিক্ষার্থীটি ঐ বালকের দেখা পেলো। এবারও সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’ এবং বালকটি উত্তর দেওয়ার আগেই সে পুনরায় বলল, ‘ওহ, আমি জানি… আমার মনে হয়, তোমার পা যেদিকে নির্দেশ দেয় সেদিকে!
‘না! আজ, আমি অনুসরণ করছি বাতাসকে।’ অপ্রত্যাশিত উত্তর এলো। এই উত্তরে শিক্ষার্থীটি খুবই বিভ্রান্ত হয়ে গেলো যা তার মনকে একেবারে শূন্য করে দিল। পুনরায় আশ্রমে ফিরে, সে ঘটনাটি বলল তার গুরুকে।
বৃদ্ধ গুরু বললেন, ‘তোমার তাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, যদি কোনো বাতাস না বয় তবে সে কী করবে?’
অল্প কয়েকদিন পরে, বাজারে আরেকবার বালকটির দেখা পেলো শিক্ষার্থীটি। আহ! এখানেই ছিল তার জেন মুহূর্ত!
‘তাহলে এখন তুমি কোথায়? আমার মনে হয়, তোমার পা যেখানে যায় বা যেখানে বাতাস বয়। কিন্তু, যদি…’
নির্লজ্জভাবে হেসে বালকটি উত্তর দিল, ‘দুটির কেউ নয়, আজ আমিই এখানে সবজি কিনতে এসেছি।’
বর্তমান মুহূর্ত
এক জাপানি যোদ্ধা শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার পর নিক্ষিপ্ত হলো কারাগারে। ঐ রাতে সে ঘুমাতে পারলো না কারণ সে ভীত ছিল যে, তাকে হয়তো পরেরদিন জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও ফাঁসি দেওয়া হতে পারে। তারপর তার জেন গুরুর কথা মনে পড়লো। যিনি তাকে বলেছিলেন, ‘আগামীকাল সত্য নয়, বিভ্রম। শুধু সত্য হচ্ছে বর্তমান মুহুর্ত।’
এই গুরুবাক্যকে মাথায় রেখে সেই যোদ্ধা শান্তি পেলো এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
বুদ্ধ
টোকিওতে মেইজি যুগে বিপরীত চরিত্রের দু’জন বিখ্যাত শিক্ষক বাস করতেন। একজন হচ্ছেন উঁশো, শিঙ্গনের প্রশিক্ষক, খুব সতর্কতার সঙ্গে বুদ্ধের নিয়মবিধি মেনে চলতেন। কখনও নেশা করতেন না তিনি। এমনকি সকাল এগারোটার পর কোনো খাবারও খেতেন না।
আরেকজন শিক্ষক হচ্ছেন তানজান, ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি কখনও বুদ্ধের নিয়মবিধি অনুসরণ করতেন না। যখন খাওয়ার ইচ্ছে হতো তখন খেতেন এবং দিনদুপুরে যখন তন্দ্রা পেতো তখনই ঘুমাতেন।
একদিন উঁশো তানজানের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ঐ সময় তানজান ছিলেন মদ্যপানরত। অথচ বৌদ্ধদের কাছে জিহ্বায় এক ফোঁটা মদ নেওয়াও পাপের সামিল।
উঁশোকে দেখে ‘ভাই’, বলে অভিবাদন জানানোর পর তানজান বললেন, ‘তুমি কি মদপান করবে না?’
‘আমি কখনও পান করি না!’, আশ্চর্যান্বিত উঁশো উত্তর দিলেন।
‘যারা মদ পান করে না তারা মানুষ নয়,’ তানজান বললেন।
রেগে গিয়ে উঁশো ব্যাখ্যা করলেন, ‘তুমি কি আমাকে অমানুষ বলতে চাইছো কারণ আমি মদে পরিতৃপ্ত হই না তাই! আমি যদি মানুষ না হই, তবে আমি কে?’
‘বুদ্ধ’, তানজানের উত্তর।
পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু
চাইনিজ জেন গুরু সোজানকে তাঁর এক ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু কী?’
গুরুর উত্তর, ‘মৃত বিড়ালের মাথা।’
‘কেন মৃত বিড়ালের মাথা সবচেয়ে মূল্যবান?’, জানতে চাইলো ছাত্র।
সোজানের উত্তর, ‘কারণ কেউ এর দাম নির্ধারণ করতে পারে না।’
ইশুনের প্রস্থান
যখন জেন সাধু মা ইশুন নিজের ষাট বছর বয়স অতিক্রম করলেন তখন পৃথিবীকে বিদায় জানাতে চাইলেন। তিনি কয়েকজন ভিক্ষুকে বললেন, কিয়াং প্রাঙ্গণে কাঠ জমা করতে।
সেই স্তুপ করা চিতা কাঠের মাঝখানে দৃঢ়ভাবে বসে তিনি কোণায় কোণায় আগুন জ্বালিয়ে দিলেন।
‘ও সাধু মা!’, এক ভিক্ষু চিৎকার করে বললেন, ‘ওখানে কি গরম নয়?’
ইশুনের উত্তর, ‘তোমার মতো বোকা লোককে এমন বিষয় উদ্বিগ্ন করবে।’
আগুনের শিখা খলবলিয়ে উঠলো এবং তিনি প্রস্থান করলেন।
কাজ নেই, খাবারও নেই
চাইনিজ জেন গুরু হায়াকুজো তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করতেন। এমনকি নিজের আশি বছর বয়সেও বাগানের পরিপাটি, তলানি পরিস্কার, গাছের আগাছা ছাঁটাই সব করতেন উনি।
বয়োবৃদ্ধ গুরুকে এমন কঠোর পরিশ্রম করতে দেখে তার শিক্ষার্থীরাও দুঃখ অনুভব করতো। তবে তারা জানতো, তাদের থামতে বলার উপদেশ তিনি শুনবেন না। তাই তারা গুরুর কাজের যন্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখলো।
ঐদিন গুরু কিছুই খেলেন না। পরেরদিনও কোনো খাবার মুখে তুললেন না তিনি। এমনকি পরেরদিনও থাকলেন উপোস।
‘তিনি সম্ভবত রাগান্বিত কারণ আমরা উনার যন্ত্রপাতি লুকিয়ে রেখেছি’, এমন আন্দাজই করলো শিক্ষার্থীরা, ‘ভাল হয় তা ফিরিয়ে দেওয়া।’
সেদিন তারা তাই করলো, যন্ত্রপাতি ফিরে পেয়ে গুরু কাজ শুরু করলেন এবং আগের মতো খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলেন। সন্ধ্যায় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিলেন, ‘কাজ নেই, খাবারও নেই।’