‘৪১টি গুঁইসাপ’ পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা ও বই প্রকাশের গল্প ।। হাসিবুল আলম

ঘৃণা করা ছাড়া আমার জন্য দ্বিতীয় কোনো গোপন পথ খোলা রেখে যাওনি। হায় আমার কবিতারা! বিশ্বাস করো, তোমাদের পটভূমিতে আমি নান্দনিক কোনো গল্প ভাবতে পারি নাই। তোমাদের সব গল্পই শেষপর্যন্ত আর্থিক, হতাশামূলক, বিভ্রান্তিকর, প্রতারণাপ্রবণ, বিজ্ঞাপনমনষ্ক। কথা দিয়েছিল অন্য কেউ …অন্যরকমভাবে অথচ শেষতক একহাজার/ দুইহাজার/­ চারহাজার – এর থেকে, ওর থেকে ‘ধার করে করে.. ধার করে করে’ তোমাদেরকে মলাটবদ্ধ করতে হলো। তোমাদের নাম রাখা হলো ৪১টি গুঁইসাপ। ক্যানো করলাম? ক্যানো লিখলাম এইসব অপযাপন? ক্যানো তোমরা এসেছিলে? তোমাদের কি কোনো তাড়া ছিল? আমার কি কোথাও যেতে হবে? আমি জানি না। মাঝেমধ্যে হয়তো জানতে চাই… তোমাদের কাছে পৌঁছাতে চাই পূনরায় কিংবা চাই না। আমি জানি না। কিছুই জানা যায় না। যাকগে সেসব। এখন যাও… ছড়িয়ে পড়ো তোমাদের অভ্যাসে…পরমানুষদের­ বুকে…চুমু খাও…চুমু খাও তাদের! ভীষণ চুমু খাও! হে আমার বিষাক্ত প্রেমিকারা…

হাসিবুল আলম


৪১টি গুঁইসাপ। কবিতার বই হিসাবে নিশ্চয় অনভিপ্রেত নাম। শুধু বইয়ের নামেই না, হাসিবুলের কবিতারাও একটু আলাদা। এসব কবিতা স্বতন্ত্র ভাষামাধুর্য বা নিজস্বতায় ভাস্বর হতে চায় – নিজের কবিতা লিখবার জন্য হাসিবুলের যে চেষ্টার কমতি নেই, তা টের পাওয়া যায়। শুধু চমক নয়, হাসিবুলের কবিতা আমাদের পরিচিত যাপনের কথাই বলে; তীব্রতায়। কবি হিসাবে হাসিবুল আলমের সম্ভাবনাকে পিঠ চাপড়ে দিতেই শিরিষের ডালপালা ‘৪১টি গুঁইসাপ’ বইটির পাশে থাকছে। এটি হাসিবুলের প্রথম বই। বইটির প্রকাশক চৈতন্য এবং প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত।


।। মৃত কবি ।।

সন্ধ্যার  এইসব  একঘেয়ে  মর্মান্তিকতা  কেউ একদিন  খুড়ে দেখতে  আসবে…অজস্র কৌতুহলে।  অথচ সে অন্ধ  কচ্ছপ কিংবা নির্লিপ্ত এক কাঁটানটের ঝোপ ছাড়া আদৌ  কিসসু  ছিল  না!

ভাঙা  খাটের  নীচে একটা  জঙধরা  ট্রাংক ঘেটে  পাওয়া গ্যালো— বহুবছর আগেই  পৃথিবীর  দিনপঞ্জি থেকে ঘুমোতে যাওয়া কবেকার  বীথিময়  বৃহস্পতিবার…

 

।। বন বিষণ্নতার রতিসমগ্র ।।

বিকেলের যোনী খাঁজে আলগোছে আটকে যাচ্ছে  সন্ধ্যাপরবর্তী  চিন্তাগুলো। একটা  মরা কাকের  ক্যারিকেচার ধূলোজড়িয়ে শুয়ে আছে বহুদিন অথচ গন্ধ ছড়াচ্ছে না… ঘুমও পাচ্ছে না। কারো কাছে পঁচিশ বছর আগের বাইনোকুলার  আছে? ইদানিং দূরবর্তী  দিনপঞ্জিগুলোকে দেখতে  খুব  ইচ্ছে করে!

সেদিন এক ঘোরবাস্তব নীলবনের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলাম— কোনো কোনো হরিণী  কখনো  সঙ্গ  ছাড়ে না… ডেকে নিয়ে যায় ঘুমসমগ্রের ভেতরে  অথবা  ভূমিকম্পপ্রবণ সেই কাফকার  শহরে…
আমাকেও  ঘুমোতে  হবে?

 

।।  ফিরে তাকানোর বিবর্তনভ্রম ।।

অনেকদিন আগেই একটা বিষাক্ত পোকার ঘ্রাণ কিংবা সঙ্গ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। এই জন্মে যে দেয়ালে আমি ঘুম খেলছি তাও হয়তো দূর্বোধ্য হতে পারে-

ব্যবচ্ছেদবিদ্যা- আগামী সপ্তাহ্- ছয়তার-
দূরের শহর থেকে একটা ডাক আসবে!
যোনিচ্ছেদ- যতিচ্ছেদ আগ্রহ- গল্পভাঙা রাতগীটার-
মিথ্যে ভীড়ের অন্দর ভেবে লুকিয়ে রাখতে চাইবে! হয়তো শুয়ে থাকার রহস্যে বিছানাটা আর চুমু রটাবে না কখনো…

ফিরে আসাটা হতে পারতো স্লিপিংপিলের মতো আরামখোর এবং স্মৃতিনাশক- কিন্তু না হয়ে পৃথিবীতে তা হয়ে ওঠে ধান্দার জানালা। ঘুমটানা অবৈধ সন্ধ্যা…..

 

।। ক্লাইমেক্স ।।

হাইওয়ের ক্লাইমেক্স ধরে হাঁটি । হাঁটতে হাঁটতে দেখি- কারো সাথে দ্যাখা হয় কিনা!
দ্যাখা হলে চোখ দুটো ছিঁড়ে দিয়ে দেবো তাকে-
দেখুক সে- দ্যাখার মতোন কিছু আছে কিনা!
অথবা
মেরুদণ্ডটা খুলে পড়িয়ে দেবো তার পীঠে
দেখবো- মানুষের মেরুদণ্ড পড়ে কতো বছর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে!
মাকে নিয়ে- বাবাকে নিয়ে-
বউ..ছেলে..মেয়ে নিয়ে-
এইসব গণতন্ত্র  অর্থনীতি  আর  সন্ত্রাসবাদ গেঁথে
কিভাবে একটা মানুষ নবাগত হিজরী চাঁদ চুমুতে যেতে পারে।
নাকি সেও
রাতের রোমশ ভেড়াদের ভূমিকায় লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মাঝখানে?
যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা দ্রুতগামী মালবাহী ট্রাক তাকে পিষে না যাবে!

 

।। গো টু হেল ।।

১.

নরকে কি প্রতিদিন তেইশ হাজার খুন হয়?
সাতহাজার ৫২৩ টা রেপ হয়?
বছরে দেড়হাজার পৃষ্ঠার ফটোকপি করা শিট মুখস্থ করে কোনো ছাত্র?
ওইখানে কি স্লিপিংপিল খায় কেউ?
একজন পুরুষ বা নারী গোপনে আরো একুশজন নারী বা পুরুষকে বিছানায় যাবার অফার দেয়?
উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত জিহ্বার ঝোল আছে সেখানে?
নরকে বসে বসে কি কারো দীর্ঘশ্বাস পড়ে?

২. 

আমি আপনাদের কাছ থেকে শোনা অভিশপ্ত নরকে আস্থা রাখি না; নরক-  নিজেকে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে না পারার আক্ষেপ থেকে আরোপিত এক শিল্পকলা মাত্র! নিশ্চয়ই সাগরকলা কিংবা কাঁঠালীকলার মতোই… মিষ্টি মিষ্টি হবে ওর স্বাদ!

 

।। বাটারবন= সুন্দরবন।।

আমার এখন ক্ষুধা লাগছে। আমি খাবো।
বাটারবন খাবো। সুন্দরবন খাবো। যা পাবো তাই খাবো।
ব্যাঙ। সাপ। হরিণ। বাঘ খাবো।
পিৎজা। স্যান্ডউইচ। নান আর গ্রিল খাবো।
আমার গরম লাগতেছে এখন। ঘাম বেরোইতেছে।
ইলেকট্রিসিটি নাই।
আমি এখন বাতাস খাবো।
আমার বাতাস কই?
আমার এখন ক্ষুধা লাগছে।
হরিণ আর সুন্দরবন কই?
বাঘের রেসিপি বানাও।
আমি খাবো।
আমার এখন ক্ষুধা লাগছে।
যারে পাবো তারে খাবো।
আমার এখন ক্ষুধা লাগছে।
যারে পাবো তারে খাবো।
পৃথিবীর ‘বালক্ষেতে’ আমারে ক্যান আনছো?
এখন আমার খেতে হবে। বাঁচতেহবে। যতদিন বাঁচবো খেতে খেতে যাবো।
বাটারবন খাবো। সুন্দরবন খাবো।
পৃথিবীর যোনিমুখ খাবো। এইখানে আমার পরে আর কারো আসার দরকার নাই।
আমি চাই না পরবর্তী প্রজন্ম আসুক ।
বিয়া – শাদি – সঙ্গম  সব বন্ধ হোক ।

আমারই খাবার নাই।
ইলেকট্রিসিটি নাই।
বাতাস নাই।
পরবর্তী প্রজন্ম দিয়া আমি ‘বাল’ করবো?
আমার এখন ক্ষুধা লাগছে। আমি খাবো।
আমার বেঁচে থাকতে হলে কাউরে না কাউরে খেতেই হবে।
ধ্বংস হোক সব।
বিয়া – শাদি – সঙ্গম –  বন্ধ হোক সব।
আমার বয়স এখন ২২ ।
আরো অনেকদিন আমাকে বাঁচতে হবে। খেতে হবে।
আমার ক্ষুধা লাগছে। আমি খাবো।
বাটারবন খাবো। সুন্দরবন খাবো।
যারে ইচ্ছা তারে খাবো॥

 

।। জিইসি’র মোড়ে জন্ম নেয়া শিশুটির জীবনবৃত্তান্ত।।

১.

মা পাগল। রাস্তার পাশে একদিন খালাস করে দিয়ে সেও খালাস। বাবা অজ্ঞাত।
দুই মাস- তখন প্রয়োজন ছিলো গুটিশুটি মেরে থাকবার মতোন একটা কোল।

২. 

মাড়িতে কয়েকটা শাদা দাঁত। একা একা হাসে।
নয় মাস –   তখন প্রয়োজন ছিলো কামড়ানোর মতোন একটা শক্ত আঙুল।

৩.

অরফানেজের করিডোর ধরে ধরে হাঁটে। ছোট ছোট দুটো পা।
দুই বছর – তখন প্রয়োজন ছিল  ধরে দাঁড়ানোর  মতোন একটা হাত।

৪.

‘অনেক অনেক কাল আগের কথা,একদেশে ছিলো এক রাজা আর তার ছিলো…’
তিন বছর – ধরলাম এই  মিথ্যে গল্পগুলো শোনার থেকে না শোনাই ভালো!

৫.

মুক্তো দানার মতো দাঁত। এরকম দাঁতগুলো পোকায় ধরা দেখতেই ভালো লাগে।
চার বছর – তখন প্রয়োজন ছিলো কয়েকটা কিটক্যাট ।

৬. 

‘অ-তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে,আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে’
ছয় বছর – তখন প্রয়োজন ছিলো পড়া যায় এমন একটা বই ।

৭.

ছোট টুকটুকে লাল একটা শাড়ি। লাল একটা টিপ।
নয় বছর – এতো বড় একটা কপালে ওইটুক ছোট একটা টিপে কি হবে?

৮.

চারপাশে বারোমাস ছাইপাশ।
বারো বছর – সৌভাগ্যক্রমে আবিষ্কৃত  হলো সে একজন মেয়ে !

৯.

প্রতিদিন একটা করে গোলাপ পাওয়ার কথা ছিলো ।
চৌদ্দ বছর – এখন ও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গোলাপ বিক্রি করে।

১০.

আমরা যথাযোগ্য দামে ওর গোলাপটা কিনে নিলাম ।
ষোলো বছর – এখন ওর পেটের মধ্যে আরেকটা পেট । বাবা অজ্ঞাত !

১১.

‘ধন্যবাদ, এখানে জন্ম নেয়ার জন্য!’

 

।। অবৈধ সম্পর্ক: স্ত্রীকে খুন করে পালালেন প্রবাসী স্বামী ।। 

( পুরুষেরা প্রধানত এভাবেই কাঁদে-) 
১.

বিদেশে থাকি। পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা ময়লার ড্রেন সাফ করে ৭৫ দিরহাম পাই! ৫ দিরহাম দিয়ে শুকনো রুটি আর দুটো খোরমা খাই। বাকী ৭০ দিরহাম দিয়ে আকাশ কিনে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেই। তোমার কোনো আকাশ নেই। আমার খুব খারাপ লাগে। আমিও তো মানুষ! একদিন লোভে পড়ে একটা নক্ষত্র চুরি করি! তোমার আকাশে খুব সুন্দর মানাবে ওটা! কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ধরা পড়ে যাই- ছ’মাস জেল খেটে দেশে চলে আসি। এসে দেখি আমার পাঠানো সবগুলো আকাশ বিক্রিকরে তুমি একটা কনক্রিটের ছাদ তুলেছো, ড্রেসিংটেবিলের গোপন ড্রয়ারে রেখেছো পাশের বাসার মামুন সাহেবের ফটো! আমার খুব খারাপ লাগে- একদিন রাতে তোমাকে নিয়ে ছাদের ওপরে দাঁড়াই- আমার চুরি করতে চাওয়া নক্ষত্রটা দ্যাখানোর কথা বলে! আকাশে তাকাও তুমি- নক্ষত্রের আলোতে চোখ ঝলসে যায় আমার! আর সহ্য করতে পারি না!
২.
আশঙ্কাজনক অবস্থায় তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়! সৌভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আমার জন্য কোনো হাসপাতাল নেই ! কিন্তু  জানো সোনা, আমার খুব খারাপ লাগে- আমিও তো মানুষ ! আমার কি ইচ্ছে করে না লাশকাটা ঘরে তোমার পাশে শুয়ে শুয়ে ফিনাইলের গন্ধ নিতে?

 

।। আমরা কি কেউ ছিলাম?।।

আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধ এক ছায়াঘরে । দীর্ঘ  জৈবকলে কেটে যাচ্ছি আমরা— এখানে দূঃখের মতো আশ্চর্যিত এক ঘ্রাণে শুক্রানুর দীর্ঘশ্বাসগুলো অ্যাশ-ট্রেতে জমা রাখি ।

আমরা কেউ না । দীর্ঘ রাতরতিক্রিয়ার পলকা কৌতুহল মাত্র! তারপরে শুধু পৃথিবীর বোঝা হয়েই ‘আমরাও যে কেউ’ এই উপপাদ্যে সাঁতার কাটি —

স্কুলে ভর্তি হই । ছোট ছোট হাত-পায়ের মাফ দিয়ে ইউনিফর্ম বানাই । আর দিনকে দিন সেই ইউনিফর্মটাকেই বড় করবার ভুল দায়িত্ব কাঁধে করে বেড়ে উঠি…

আমাদের সাথে আমাদের কখনো দ্যাখা হয় না । উড়ো কথার ভিড়ে, বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঘামতে ঘামতে কিংবা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে যাদের সাথে কুশল বিনিময় হয়— তারা আমরা না!

ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় আমাদের ভেংচি কেটে যায় । আমরা কেউ না । নতুন করে দীর্ঘ রাতরতিক্রিয়ার পলকা কৌতুহল মাত্র!
জন্ম বলতে আদৌ কিছু নেই, মৃত্যু বলতেও কিছু নেই! আমরা আমাদের জন্ম দেখি নি, আমরা আমাদের মৃত্যুও দেখবো না । পুরোটাই ঢপ!

আদৌ আমরা কি কেউ ছিলাম?

 

।। ডিম ।।

যায় দিন। আসে দিন।
দিনগুলা য্যানো প্রকাণ্ড এক ঘোড়ার ডিম।
ভাজি ডিম॥ সিদ্ধ ডিম॥
একদিন
দুইদিন
বেশ কয়েক দিন।
ডিমগুলা য্যানো দীর্ঘকাল ভাবলেশহীন॥
ওই দিন  আসবার দিন।
মা আমার জন্য ভেজেছিলেন প্রকাণ্ড এক ঘোড়ার ডিম॥
এভাবে
একদিন
দুইদিন
বেশ কয়েক দিন॥
তারপর
পরশুদিন। যাবার দিন।
দ্যাখো জয়িতা-
জীবনগুলা ক্যামন শীতকালীন।
ক্যারাবীয় কোনো গুঁইসাপের উর্বর ডিমগুলার মতোই
নিশ্চল। কিন্তু সাবলীল॥


কবি পরিচিতি:

হাসিবুল আলম।
জন্ম: ৬ অগাস্ট ১৯৯৪, জয়পুরহাট। বর্তমানে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে  ‘কৃষিপ্রযুক্তি ‘ বিষয়ের শিক্ষার্থী।
hasibul.a94@gmail.com

 

শেয়ার