আমারও মনে হতে থাকলো আল মাহমুদ সেই মধ্যযুগের গীতি কবিতারই আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন সোনালি কাবিনের সনেটগুলিতে।
একদিন সকালে সাব্বির ভাই কোথা থেকে যেন একটা লিটল ম্যাগ নিয়ে আসলো। লিটলম্যাগ ব্যাপারটা তখনও বুঝতাম না। নাইনে পড়ার ঐ সময়টায় যা পাইতাম তাই পড়তাম। ঐ পত্রিকাটাও পড়া শুরু করলাম। আল মাহমুদকে নিয়ে পুরা একটা পত্রিকা। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র একটা অংশ সম্ভবত ছাপা হইছিল সেখানে। শোভা নামের মেয়েটার কথা মনে আছে এখনও। কী দরদ দিয়ে লেখা! কিন্তু যে ঘটনাটা আমাকে বেশি ঘোরগ্রস্ত করেছিল, যেটা উনার আত্মজীবনী না— সেই পত্রিকায় ছাপা সোনালি কাবিনের ১৪-টা সনেট। গ্রিন হাউজের (বগুড়ার সবুজবাগে অবস্থিত একটা মেস) নতুন দিনগুলোতে পরিচয় ও অপরিচয়ের সংকটে, দোলাচলে আমার প্রায় প্রতিটা মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল মাত্র ১৪-টা সনেট। কেন এই গভীর আচ্ছন্নতা তার ব্যাখ্যা আমার কাছে ছিল না, শুধু মনে পড়ে একজন প্রাচীন গুণিন যেন কবজ করে ফেলছেন ধীরে ধীরে ডানপিটে কিশোরের মন।
তার কিছুকাল আগেই আমার পড়া হয়েছিল জীবনানন্দের কতিপয় বিখ্যাত কবিতা। সম্ভবত তার পরপরই সোনালি কাবিন পড়ার অভিজ্ঞতা উড়িয়ে দিয়েছিল তুমুল জীবনানন্দের মায়াবীর জগৎ। এক ধরণের টাইফুন বয়ে গিয়েছিল আমার সে সময়ের মনোবিশ্বে। সারাদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম সনেটগুলো। সাব্বির ভাইয়ের উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ১ম পত্র বইয়ের কবিতাগুলোর শেষদিকে, আলোচনা-অংশে পড়েছিলাম সনেট কী! কিচ্ছু বুঝিনি, বোঝার ভেতরে ছিল—সনেট হলো ১৪ লাইনের কবিতা। ৮ লাইন আর ৬ লাইনের মধ্যে গ্যাপ থাকে আর লাইনের শেষে থাকে নানান কিসিমের মিল। সেই যে সনেটের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হলো, আর যাই কোথায়। সোনালি কাবিনকে সামনে রেখে শুরু হলো আমার সনেট লেখা।
গ্রিন হাউজের আধো সমাপ্ত ব্যালকনিতে বসে বসে অনতিদূরের কৃষি ফার্মের শূন্য মাঠের দিকে তাকিয়ে যখন দেখতাম একটা বিষণ্ন পুকুরের পাশে বৃদ্ধ আমগাছ, তার পরেই সারি সারি আকাশমনি গাছের ফাঁক দিয়ে কেউ একজন আনমনে মাটি কুপিয়ে যাচ্ছে, তখনই আঙুলে গুনে গুনে ৮ আর ১০ অক্ষর বসিয়ে দিতাম আমার বান্ধবীর দেওয়া একটা ডায়েরিতে। কবিতাগুলোর নাম দিয়েছিলাম ‘জেওর’। ‘তস্করের হাত থেকে জেওর কি পাওয়া যায় ত্বরা—‘ এই লাইন থেকে নিয়ে ছিলাম শব্দটা। মাদরাসায় পড়ার কারণে জেওর শব্দটার মানে আমার জানা ছিল। আমাদের একটা কিতাবের নাম ছিল ‘নুজহাতুল ক্বারি’ যার উর্দু ‘ক্বারিয়ু কা জেওর’ মানে ক্বারিদের অলংকার।
এভাবে লিখতে লিখতে প্রায় ৪০-টা সনেট লিখে ফেললাম। সবগুলোই প্রায় আল মাহমুদীয়। সেগুলো সুন্দর করে তুলে রাখতাম ডায়েরির পাতায়। স্কুলে গিয়ে বান্ধবীকে দেখাবো বলে। মাথায় তখন খুব ঘুরতো—‘যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি’। সদ্য মাদরাসা থেকে আসা আমার সংস্কারে লাগতো ঐ কাবিনবিহীন হাতের ব্যাপারটা। উত্তরও পাইনি। আবার যেমন মনে হতো—‘দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর’। একজন কমিউনিস্ট কেন হালাল পশুর দোহাই দেন যিনি ফসলের সুষম বন্টনকে মনে করেন ধর্ম। আবার দেখা যায় কখনো তার নারীকেই প্ররোচিত করেন ‘এ বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক’। এই যে নারীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা, ইসলামী আইনের বিধানকে উল্টা করে দেখানো, এমন অনেক কিছুই মাথায় নিয়ে নিয়ে নবম শ্রেণীর ক্লাশ করা হতো সে সময়।
তো, ইতোমধ্যে আমার কাছে অনেকগুলো সনেট জমে আছে। এখন সনেটগুলো সত্যিই সনেট হলো কি না সে নিয়ে আমার টেনশনের অন্ত্য নাই। কী করা যায়! বুদ্ধি বাইর হলো—সাব্বির ভাইয়ের কলেজে যে ম্যাডাম বাংলা পড়ায় তাকে আমার সনেটগুলো দেখিয়ে একটা সার্টিফিকেট আনলেই তো আমি সনেটকার হয়ে যাবো। যেমন টেনশন তেমন ব্যবস্থা। একদম টাইপ করার মতো করে হাতে লিখে ফেললাম বেশ কয়েকটা সনেট। তারপর দুরুদরু বক্ষে সাব্বির ভাইকে দিলাম সেগুলো মাননীয়া ম্যাডামকে দেখানোর জন্য। তিনি দেখলেন এবং আমাকে ডেকে পাঠালেন তার সঙ্গে মোলাকাত করতে। আমি তো ভয়ে ও উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছি কখন রাত পোহাবে! পরের দিন গেলাম সেই কলেজে। টিনের লম্বা ঘরের ক্লাস রুম। খুব বেশি দিন হয়নি কলেজের বয়স। ম্যাডাম ক্লাশ নিয়ে শুকনা মাটির বারান্দা ধরে হেঁটে আসছেন। সাব্বির ভাই পরিচয় করে দিলো। উনি প্রথমেই বললেন, ‘সনেট তুমি লিখলে তো হবে না, সনেট লিখছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তোমার লেখা তো সনেট হবে না’। আমার তো মাথা খারাপ হবার জোগাড়! কী বলেন উনি! মাইকেল ছাড়া নাকি আর কারো সনেট লেখা যাবে না! অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম বিদেশি কয়েকজন কবির কথা বলে— উনি বুঝলেন না। আমাকে বারবারই বলতে লাগলেন সনেট লেখা তোমার কাজ না। আমাদের এইসব আলাপ-বিলাপ আরেকজন ম্যাডাম শুনছিলেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমি যখন ব্যর্থ হয়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন উনি ডেকে বললেন, ‘বগুড়ায় গেলে বাংলা ছন্দের রূপরেখা নামের একটা বই আছে ঐটা কিনে পড়ো তাহলে অনেক কিছুই হয়তো ক্লিয়ার হবে’। পরে অবশ্য সেই বইটা কেনা হইছিল তরফদার বুক ডিপো থেকে।
২.
আমার সেই সময়টা ছিল সোনালি কাবিনময়। সনেটগুলো পড়ার পর আল মাহমুদের ‘কবিতাসমগ্র’ দেখার জন্য প্রায়ই ঘুরঘুর করতাম ‘পড়ুয়া’ লাইব্রেরিতে। কিন্তু অত টাকা আমার কিছুতেই জমতো না। একবার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার ছোট বোন কী যেন আনতে দিয়েছিল বগুড়া থেকে ওর ঈদের জমানো টাকা দিয়ে। সরল মনেই দিয়েছিল ও। কিন্তু আমি পুরা টাকাটাই মেরে দিয়ে কিনে ফেলি আল মাহমুদের কবিতাসমগ্র। সেই টাকা পরে আর ওকে ফেরৎ দেওয়া হয়নি। ঝগড়াও কম হয়নি অবশ্য!
৩.
অনেক দিন পর একবার ভাবার চেষ্টা করেছিলাম জীবনানন্দের জগত থেকে হঠাৎ আল মাহমুদ আমাকে টানলো কেন! উত্তরটা যে পুরাপুরি পেয়েছিলাম এমন না। তবে, কিছু জিনিশ আমার মাথায় এসেছিল। গ্রিন হাউজের সিংগেল রুমে থাকতো বাবু ভাই। বগুড়া আজিজুল হক কলেজে বাংলায় পড়তো। বাবু ভাইয়ের পড়ার টেবিলটা ছিল মুঘলাই কিসিমের। বিরাট বড়, থাকে থাকে সাজানো বই। সেখান থেকে একটা বইয়ের প্রতি নজর পড়ে আমার। মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা।
‘সই, কে বলে পিরীতি ভাল
হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া
কান্দিতে জনম গেল’
এই যে ভাষার সারল্য মধ্যযুগের গীতিকবিতায় কেন যেন আমারও মনে হতে থাকলো আল মাহমুদ সেই মধ্যযুগের গীতি কবিতারই আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন সোনালি কাবিনের সনেটগুলিতে। যার ভাষা সরল এবং সহজেই অনুরণন ঘটায় মস্তিষ্কে ও মনে। সনেটগুলি পড়লে মনে হতো, একজন জেদী পুরুষের পদাবলী। যে মূলত কৃষিকেন্দ্রিক কোনো পরিবারের সন্তান। যার আছে গোয়ার্তুমির স্বভাব এবং অনার্য মেজাজের উত্তরাধিকার বহন করছে রক্তে রক্তে। যার যৌনতাও সে অর্থে গেঁয়ো। অথচ জীবনানন্দের জগত হলো বিষণ্ণ, হেরে যাওয়া, প্যারা খাওয়া মানুষের জীবন। এই বিষণ্নতাই মূলত ইয়োরোপ থেকে আমদানী হয়ে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে বাংলায়। জীবনানন্দের সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয় অথচ আল মাহমুদে আছে দৃপ্ত উচ্চারণ—
জীবনানন্দের নাগরিকের পাশে বধূ, শিশু, প্রেম আশা সবকিছু থাকা সত্ত্বেও
আল মাহমুদ হতে চেয়েছিলেন কওমের কবি হতে। সে কওম কেবল বাঙালী মুসলমানের না, সে কওম মূলত বাঙালি জনগোষ্ঠীর।
এই ভূত মূলত ইয়োরোপের নাগরিক। নিজেকে যাদের খুব সহজেই মনে হয় আউটসাইডার, খুব সহজেই যারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করে রূপান্তরিত পোকা হিশেবে। আমার ধারণা উনিশ শতকের আগে বাংলা অঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল না বললেই চলে। ক্ষুধা, জমিদারের অত্যাচার বা নারীর শ্লীলতাহানীর ঘটনায় হয়তো আত্মহত্যার ব্যাপার ঘটতো, কিন্তু ইয়োরোপের হাওয়া এসে বাংলায় আছর করার পর এই অঞ্চলেও বেড়ে যায় আত্মহত্যার প্রকোপ যার জন্য জীবনানন্দের নাগরিককে সব কিছু থাকার পরেও বেছে নিতে হয় লাশকাটা ঘর। অথচ বাংলার কৌম সমাজের যুবকের উচ্চারণ ছিল এমন—
আল মাহমুদ বরং মৃত্যুর অহেতুক রোমান্টিকতার মধ্যে না গিয়ে জীবনের পক্ষে সারাদিন দরজা ধরে থাকেন। আর এটাই বাংলা অঞ্চলের সৌন্দর্য।
মধ্যযুগের বাংলা কবিতা পড়তে গিয়ে আরেকটা ব্যাপার আমায় মাথায় ঘুরতে শুরু করে। আপনারা একমত হইতে পারবেন কিনা আমি জানি না। সেটা হলো, বাঙালির সাইকিতে বিষণ্নতা নাই বললেই চলে তার আছে তুমুল চিরবিরহ। ভাদ্র মাসের গাঢ় বর্ষায় সে আবিস্কার করে তার ঘরশূন্যতার বিরহ। চিরহাহাকারে টলোমল করে ওঠে ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর’/ । আঙিনার মধ্যে বঁধুয়াকে ভিজতে দেখে তার প্রাণ ফেটে যায়। আর্ত কাতরতায় ডুকরে ওঠে ‘মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়/ দেই তুলসী তল দেহ সমর্পিলুঁ/ দয়া জনু ছোড়বি মোয়।’ এমন আরো কত হাহাকারই তো তুলে দেওয়া যায় মধ্যযুগ থেকে। আল মাহমুদেও সেই ইয়োরোপীয় বিষণ্নতা নেই আছে গোঁয়ার্তুমি করে হলেও জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার জেদ।
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথের চাইতে বাঙালি যুবকের এমন প্রশ্ন-শাসনকেই আমার মনে হয় অধিক পূর্ববঙ্গীয়। প্লেটোনিক প্রেমকে নস্যাত করে সক্রিয় দৈহিক প্রেমই প্রধান হয়ে ওঠে সনেটগুলোতে।
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম, আল মাহমুদের রাবিন্দ্রীক ভাষা-বিন্যাস। ‘চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপ টিপ শব্দে সারাদিন/ জলধারা ঝরে/ । এই লাইনের জলধারা শব্দের ব্যবহার প্রায়শই ঠাকুরের কথা মনে পড়ায়। অবশ্য সে আমার দোষও হইতে পারে।
আল মাহমুদ হতে চেয়েছিলেন কওমের কবি হতে। সে কওম কেবল বাঙালী মুসলমানের না, সে কওম মূলত বাঙালি জনগোষ্ঠীর।