হুজাইফা মাহমুদের সাথে আলাপ ।। আলাপকারীঃ মোস্তফা হামেদী ও হাসান রোবায়েত

হুজাইফা মাহমুদ সম্ভবত প্রথম আদ্যোপন্ত কওমি ব্যাকগ্রাউন্ড কবি, যার কবিতার বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে। ঢাকাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিতব্য তার বইয়ের নাম ‘অন্তঃস্থ ছায়ার দিকে’। হুজাইফার টেক্সট একটা শান্ত-নির্জন সুরেলা জগত সৃষ্টি করে, যেখানে চিরশান্তি বিরাজমান। কোনও ক্যাওস নেই। একেবারেই নির্মেদ। জনমানুষ থেকে দূরে গিয়ে একটা ইউটোপিয়া গড়ে তোলার চেষ্টা হু.মা’র কবিতায় পাওয়া যায়। এই সাক্ষাৎকার নানা কারণে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এক সময়। কেননা, হুজাইফার কবিতা থেকে এই সাক্ষাৎকারের আলাপচারিতা গড়িয়েছে ইসলামি সাহিত্য, বিশ্ব কবিতা , কাব্যরাজনীতি ও বহু উন্মুক্ত পথে। উপভোগ করা যাক…



আমার কবিতার জগতটা হলো আমার অবসন্ন আত্মার বিশ্রামের জায়গা। এইখানে অন্য কোন জাগতিক কোলাহল প্রবেশ করতে দিতে চাই না।


মোস্তফা হামেদীঃ

কী খবর হুজাইফা? বই আসতেছে আপনার। প্রথম বই। কেমন লাগতেছে?

হুজাইফা মাহমুদঃ

খবর ভালই, আলহামদুলিল্লাহ! প্রথম বইয়ের অনুভূতি আসলে একটা অন্যরকম ব্যাপার। আমি প্রথম প্রথম, মানে যখন বইয়ের কাজ শুরু করি এবং জমাও দিয়ে দেই, তখনও তেমন কোন অনুভূতি জাগেনি। এখন যখন বই প্রকাশের দিন ঘনিয়ে আসতেছে, তখন বেশ অন্যরকম এক আনন্দের ছোঁয়া পাইতেছি! এটা আসলেই অসাধারণ এক অনুভূতি!

হামেদীঃ

বইয়ের আগের গল্পটা শুনতে চাই। মানে লেখালেখি শুরু করা থেকে বই হওয়া পর্যন্ত যে জার্নিটা, তার গল্প।

হুজাইফাঃ

এটা তো মোটামুটি বিশাল এক জার্নি! আমার লেখালেখিতে, মানে কবিতায় আসাটা একটা অদ্ভূত ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘটে। এমনকি আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না কবিতার জন্য। আমি হয়তো কখনো বলবো এই ঘটনা, কিংবা আজকেও প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে।

বুঝে না বুঝে আমি কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম, যখন বয়স ছিল ১৪/১৫ বছর। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, আমার তখনকার সব কবিতাই (মানে কবিতা হিসাবে যদি ধরে নিই আর কি) ছিল ঘোরতর রাজনীতি এবং ইতিহাস বিষয়ক। আরেকটু খোলাসা করে বললে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। সে সময়টায় আমি নতুন নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস জানা শুরু করেছি, এবং বঙ্গবন্ধুর বিশাল পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। অজস্র কবিতা লিখেছি এই দুই বিষয়ে। এখন মনে হয়, আমার সেসব কবিতা যদি সংরক্ষিত থাকতো এবং প্রকাশ করা যেতো তাহলে নির্মলেন্দু গুণের পরে আমার নাম নিতে হতো আপনাদেরকে! হা হা হা।

সেটা ছিল একদমই প্রাথমিক পর্যায়ের কথা। তারপর নানান বাঁক, মোড় ঘুরে এখন পর্যন্ত এসেছি। এই জার্নির পেছনেও অনেক কথা আর গল্প আছে!

হামেদীঃ

সেইসব গল্প নিশ্চয়ই অন্য কখনও শুনবো। এই মাহেন্দ্রক্ষণে, মানে বই প্রকাশের সময়ে কবিতা নিয়ে আলাপ তুলতে চাই। আপনার কবিতা প্রথম পড়ি ফেসবুকেই। শুরু থেকে খেয়াল করি আপনার কারবার সুর নিয়ে। এটা কি সচেতনভাবেই করেন— কোনো ঘরানাকে অনুসরণ করে?

হুজাইফাঃ

খুব সম্ভবত সচেতনভাবে হয় না, অবচেতন মনেরই কাজ এটা। তবে কবিতায় সুর বিঘ্নিত হয় এমন কিছু যেন কবিতায় না এসে যায় এ ব্যাপারে আমার আলাদা একটা সচেতনতা বাই ডিফল্ট তৈরি হয়ে গেছে! এজন্য কবিতায় আমার অবস্থান অনেকটাই পিউরিটান বা কনজার্ভেটিভ টাইপের হয়ে গেছে। শব্দের ব্যাপারে বিভিন্নরকমের ছুঁৎমার্গ তৈরি হয়েছে। কবিতায় আমার বিচরণকেও অনেকটা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এর ইতিবাচক দিকগুলোর সুফলও ভোগ করতেছি আমি।

কবিতায় সুর আসলে সকলেরই থাকে,আমার মনে হয়। তবে এর রকমফের ঘটে নানানভাবে। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটা হলো আমি অনেকটা মিউজিকের মতোই, কোন সুরকে মাথায় রেখে লিখেছি। অথবা বিষয়টা আসলে এমন যে, ওই সুরটাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে কবিতাটি। সেখানে টেক্সটের আপাত মিনিং হয়তো ততটা শক্তিশালী না, কিন্তু আমি যে সুরের তন্ময়তা থেকে এটা লিখেছি সেটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকটা রিলিফিংও। বলতে গেলে ওই সুরের তৃষ্ণাটুকুই আমার কবিতাযাপন।

হামেদীঃ

মিউজিক শোনেন কেমন? কোন ধরনের মিউজিক শোনেন? ওসবের কোন প্রভাব আছে নাকি?

হুজাইফাঃ

মিউজিক বলতে উর্দু গজল এবং কাওয়ালি ঘরানার মিউজিকই শুনতাম। তবে কবিতায় সেসব মিউজিকের কোন প্রভাব আমি অনুভব করি না। আসলে কবিতায় যে সুরটা আমি আনতে চেয়েছি এবং চাই, সেটা আসলে কেমন সুর তা আমি নিজেও জানি না। আমি মাঝেমাঝে কল্পনা করার চেষ্টা করি, কবিতার অশ্রুত সুর যদি আমি কোনভাবে শুনতে পেতাম তাহলে কেমন শুনাতো? তখন আমার গ্রীকপুরাণের বিখ্যাত চরিত্র অর্ফিউসের কথা মনে পড়ে। তার মোহিনী বীণার সুরও তো কোনদিন বাজেনি পৃথিবীতে। তবুও মানুষ মনে মনে এমন এক সুরের কথা কল্পনা করে নিয়েছে, যা চিরকাল অশ্রুতই থেকে যাবে, কিন্তু সেই আশ্চর্য সুরের কল্পনা মানুষকে বিস্মিত করবে। আমিও ঠিক জানি না কবিতায় কোন ধরনের সুর নিয়ে আমি কথা বলছি, এবং এর শ্রুতরূপটাই বা কেমন। সম্ভবত কিটসের কবিতায় আছে এমন- heard music is sweet, But those unheard are sweeter..

অনেকটা এমনই। মানে সুরের চেয়েও মধুর হয়ে দাঁড়াচ্ছে অশ্রুত সুরের কল্পনা। আজকে আমি যখন আমার বইয়ে সূচিপত্রের দিকে তাকিয়েছি, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অর্ধেকেরও বেশি কবিতার শিরোনাম সুর কিংবা সুরের সমার্থক কোন ব্যাপার। বাকি কবিতাগুলোর শিরোনাম তেমন না হলেও মূলে ওই সুরই আছে। এটা অদ্ভূত ব্যাপার! ভেবে দেখলাম, আমি আসলে এই ব্যাপারটা থেকে কখনও বেরই হতে পারি নি! অথবা বের হওয়ার মতো সচেতন কোন প্রয়াসও ছিল না।

হামেদীঃ

বের হওয়াটা অত জরুরিও না আসলে। বরং বলা যায়, এটা একটা ভালো ট্রেন্ড হতে পারে। এই যে চারপাশে এতো খটোমটো ব্যাপার-স্যাপার, কবিতা পড়তে আইসাও যদি শব্দের দেয়ালে বাড়ি খাওয়া লাগে- তাহলে জীবনটাই নিরানন্দের হয়ে পড়ে। বরং একটু শান্তির, আত্মার আশ্রয়ের জায়গা হোক কবিতা। সেক্ষেত্রে ‘অন্তঃস্থ ছায়ার দিকে’ সমীহ জাগানিয়া হয়ে উঠবে আশা করি। বইটা নিয়ে কেমন প্রত্যাশা আপনার?

হুজাইফাঃ

আমিও তাই মনে করি। মানে, আমার কবিতার জগতটা হলো আমার অবসন্ন আত্মার বিশ্রামের জায়গা। এইখানে অন্য কোন জাগতিক কোলাহল প্রবেশ করতে দিতে চাই না। চারপাশের অন্যান্য ব্যাপার-স্যাপার আমি অন্যভাবেই মোকাবেলা করতে চাই। ফলে পরিবেশ পরিস্থিতির ক্রমবিবর্তন আর উত্থান-পতন আমার কবিতায় কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। সমাজে কবিদের অবস্থান বা রেসপন্সিবিলিটি কেমন হওয়া উচিৎ কিংবা এজাতীয় মোরাল রেটরিক আমার কানে পশেনি কোনদিনও।

বইয়ের ব্যাপারে আসলে কী প্রত্যাশা করবো সেটা বুঝতেছি না এখনো। ভাল কিছুই হোক, এটাই প্রত্যাশা করি। বিশেষ করে আমাদের সময়ে শিল্প-সাহিত্য যেভাবে পাঠকহীন অবস্থায় কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, সেসময়ে একটা কবিতার বই নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা থাকাও উচিৎ না আসলে। এই পাঠকশূন্য অচলাবস্থার অবসান ঘটানো যায় কিভাবে সেটা ভাবা দরকার।

হামেদীঃ

“আমাদের সামনে অপার নদী

এক দুঃখিত গজলের সুরে বহমান”– এইটা যেন আপনার কবিতারই পাঞ্চ লাইন। কিংবা সময়ের। বাস্তবতা এড়াতে গিয়ে পারা যায় না কখনও কখনও?

হুজাইফাঃ

আমি আসলে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বা পলিটিক্যাল কোন বাস্তবতার কথা বুঝাতে চাইনি মনে হয়। নদী এবং তার দুঃখিত সুরের কোন মেটাফরিকাল মিনিং নাই আমার কাছে, যা ওইসব বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে। কেন যেন, আমার কাছে মনে হয়েছে নদীর অন্তর্গত যে সুর আছে, আমরা যেটা শুনি, সেটা ওরকমই গজলের মতো সঙ্গীতময়, এবং প্রাচীনতম কোন দুঃখের কারণে বিষাদময়। মানুষ হয়তো সুন্দরতম সুর হিসাবে বিষাদময়তাকেই বোঝায়!

হামেদীঃ

আপনি কবিতাকে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে আলাদা করতে চান সচেতনভাবেই- এটা লক্ষ্য করি। কোনো ভয় কাজ করে? নাকি আধুনিক বাংলা কবিতার একটা প্রবাহ, যাতে কবিতাকে মানুষ ও সমাজের বাইরে এনে কবির নিভৃতি যাপনের বিষয় করা হয়েছে- তার প্রভাবে এটা তৈরি হয়েছে আপনার মধ্যে? কখনও সংশয় কাজ করে? কিংবা দায়বোধ?

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ, এটা সত্য কথা। আমি চেতনে-অবচেতনে এই কাজটা করি। আমার কবিতা এবং সমকালীন বাস্তবতার মাঝে চীনের প্রাচীর আছে একটা। ভবিষ্যতের কেউ এসব কবিতা পড়ে সামান্যতমও বুঝবে না যে একটা ফ্যাসিবাদি শাসনব্যবস্থার নিষ্ঠুর সময়ে বসে এসব সুরেলা কবিতা লিখেছি আমি। তবে এর পেছনের কারণ হিসেবে আপনি যেগুলো উল্লেখ করেছেন সেসব না, আমার যতটুকুন মনে হয়।

আমি আসলে প্রচণ্ড স্মৃতিকাতর মানুষ, স্মৃতিতাড়িতও। এইসব স্মৃতির প্রভাব আমার পরবর্তী জীবনে বেশ গভীরভাবেই পড়েছে। স্মৃতি বলতে আমি আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিকে বোঝাচ্ছি। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম সময় কাটিয়েছি তখন। সবারই হয়তো তাই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম বিষয় ঘটে গেছে। এর মাঝে একটা হলো, আমার সমগ্র শিল্পহৃদয়কে পরিচালিত করছে মূলত আমার শৈশবের অজস্র স্মৃতিরাশিই! এটা ঠিক কেমন, আমি হয়তো ভালো করে বোঝাতে পারবো না। কিছু স্মৃতি আছে এমন যেগুলো আমার মানসপটে একদম গেঁথে রয়েছে, এখনো এতটাই জীবন্ত হয়ে আছে যে, আমি কল্পনার চোখ দিয়ে তাদেরকে স্পষ্টতই দেখতে পাই, শুনতেও পাই।

আমার কবিতায় আপনি দেখবেন, কেবলই নৈঃশব্দ্য আর নির্জনতার কথা বলছি আমি। সুর, তাও নৈঃশব্দের সুর! সম্ভবত এর কারণ হলো, আমার শৈশবের এমন কিছু অদ্ভূত নির্জনতার স্মৃতি জমে আছে ভেতরে। একটা উদাহরণ দেই আপনাকে। আমার বয়স তখন সাত কি আট হবে। দিনমান কেটে যায় নানান দুরন্তপনায়। কিন্তু দিনশেষে, বিকেলের দিকে এমন এক আশ্চর্য শূন্যতা এসে ভর করতো আমাকে, আমি যেন পুরোপুরি অবশ হয়ে পড়তাম। গ্রামের নির্জন মেঠোপথে একা-একা আনমনে হাঁটতাম শুধু। পুরো পৃথিবীটাকেই তখন শূন্য আর নির্জন মনে হতো। আমাদের গ্রামে আগে প্রায়ই মাইক দিয়ে কুরআন খতম করার রেওয়াজ ছিল। বিকেলের দিকে খতম শেষ হয়ে গেলে তখন ক্বারী সাহেব গজল গাওয়া শুরু করতেন। সেই গজলের সুরে যে কি  দরদ আর বিষণ্ণতা ফুটে উঠতো, তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না এখন। কিন্তু ওইসময় যখন এই সুর শুনতাম তখন আমার মন চাইতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। মাঝেমাঝে একদৌড়ে আম্মার কাছে চলে যেতাম, এটা-সেটা বলে মনযোগ ফিরিয়ে রাখতাম অন্যদিকে। যেন নির্জনতা থেকেই পালাতে চাচ্ছি! তো, এই জাতীয় অসংখ্য নির্জনতার স্মৃতি আমি ধরে রাখছি। কবিতায় হয়তো সেটারই প্রতিফলন ঘটে!


জনমানুষকে উপেক্ষা করে শক্তিশালী শিল্প হয়তো তেমনভাবে দাঁড়াতে পারবে না। কোন না কোনভাবে মানুষের উপস্থিতি ঘটবেই, এবং এটাই স্বাভাবিক।


হাসান রোবায়েতঃ

আপনার সম্পূর্ণ বই পড়লে পাঠকের একটা বিষয় চোখে পড়বে—যেন আপনি কোনো দূরের বনে ঝরাপাতার জগতে আছেন, চারদিকে জ্যান্ত নৈঃশব্দ্য, সুর, পর্বতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্বপ্নরত ঘণ্টার ধ্বনি। এমন। হুট করে সেখানে আম্মা আর বুবু চলে আসেন। চলেও যান ফের। এমনটা কেন ঘটলো?

হুজাইফাঃ

বাহ সুন্দর বলেছেন! আসলেও ঠিক তেমনই ব্যাপারটা। আমার কবিতার জগতটাই এমন, জনমানবহীন কোন নির্জন বনের মতো, যেখানে কেবল আমিই আছি, অথবা আমিও নেই, যেন অদৃশ্য কেউ এই বনের নৈঃশব্দ্য আর পাতার মর্মরকে তুলে আনার চেষ্টা করছে। এটা আসলে আলাদা একটা জগৎ,যার নির্মাতা আমি।

আচ্ছা, কবিতায় আমরা কী করি আসলে? আমি মনে করি, কবিতায় মূলত আমরা সৌন্দর্যকেই নির্মাণ করি। যা সুন্দর তার সৌন্দর্য বয়ান করি, এবং আমাদের কল্পনায় যে সৌন্দর্যের রূপছবি গাঁথা হয়ে আছে, কিংবা আমরা যেরকম সৌন্দর্য দেখতে ভালবাসবো তারও নির্মাণ করি কবিতায়। এটা একটা দিক হতে পারে। আমার কবিতায়ও ঠিক তাই ঘটেছে, মানে এমন একটা কাল্পনিক সৌন্দর্যের জগতই আমি চেতনে-অবচেতনে নির্মাণ করতে চেয়েছি যেন! এছাড়াও আমি বলেছি, আমি কবিতার মূল প্রণোদনা সম্ভবত আমার শৈশবের অসংখ্য নির্জনতার স্মৃতি। যেগুলো আমি নিজের ভেতর পুষে রেখেছি নানানভাবে। কবিতায় নির্জনতার কথা বলে আমি সম্ভবত সেই স্মৃতির কাছেই ফিরে যাই বারবার।

আর, আম্মা ও বুবুর কথা বলছেন আপনি। তারাও মূলত সেইসব স্মৃতিরই অপরিহার্য অংশ। হয়তো সেই ধারাবাহিকতায় এসেছেন। বিশেষ করে বুবু কবিতাটার কথা যদি বলি। আমি আর আমার বোন পিঠাপিঠি বয়সের। আমার সমগ্র শৈশবজুড়েই সে জড়িয়ে আছে। ওই কবিতাটায় দেখবেন আমি বলছি, দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে অলস ট্রেনের গতি। এটা কিন্তু একদমই নিরেট স্মৃতি থেকে নেয়া। তখন দুপুরের দিকে একটা ট্রেন আসতো, তার হুইসেল শুনামাত্রই আমরা ভাইবোন দৌড়াতে দৌড়াতে বাঁশঝাড়ের কাছে চলে যেতাম, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখা যেতো। এটা ছিল আমাদের প্রতিদিনকার কাজ। তো, মূলে সে ব্যাপারটাই থাকে আরকি। আমি আমার স্মৃতির জালে আটকে আছি। কবিতায় সে ব্যাপারটা খুব বেশি অনুভব করি।

রোবায়েতঃ

কবিতায় জনমানুষের উপস্থিতিকে কিভাবে দেখেন আপনি? কেবলই কোলাহল মনে হয়?

হুজাইফাঃ

হা হা হা এভাবে ঠিক বলা যায় না। অন্যদের কবিতার ব্যাপারে তো বলতে পারবো না। কেননা জনমানুষের কোলাহলভর্তি অনেক কবিতাও আমার ভালো লাগে। তাছাড়া, জনমানুষকে উপেক্ষা করে শক্তিশালী শিল্প হয়তো তেমনভাবে দাঁড়াতে পারবে না। কোন না কোনভাবে মানুষের উপস্থিতি ঘটবেই, এবং এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু আমি নিজে এ ব্যাপারটায় বেশ অস্বস্তিতে ভুগি। যতটা সম্ভব মানুষকে এড়িয়ে গেছি। বলতে গেলে মানুষ পাবেনই না আমার কবিতায়। আমি হয়তো কখনো কোন অশ্বারোহীর কথা বলছি, নতুবা কোন মেষপালকের কথা বলছি, মানে এরকম যাদের কথা বলছি তারা হয়তো আমিই, নতুবা এমন কেউ যারা স্রেফ একজন নির্লিপ্ত দ্রষ্টা হিসাবে উপস্থিত। এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার বটে। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয়, মানুষ মাত্রই ঝামেলাপূর্ণ এবং তারা কোলাহলপ্রবণ। তারা আমার এই অখণ্ড নির্জনতার জগতটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলবে। শুনতে কেমন হাস্যকর শোনায়, না!

রোবায়েতঃ

তাহলে ইকবাল, মাহমুদ দারবিশ, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নজরুল এদের কবিতাকে কীভাবে দেখেন?

হুজাইফাঃ

ইনাদের সকলেই আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি। কম-বেশি সবার কবিতাই পড়া হয়েছে। আরও একজনের কথা এখানে যোগ করা যেতে পারে, তিনি আগা শহীদ আলী। এর মাঝে হয়তো দারবিশের কবিতাই আমি সবচে বেশি পড়েছি। তাদের সবারই কমন একটা গ্রাউন্ড আছে, এবং সেটা হলো তারা প্রতিরোধের কবি। নজরুল, ফয়েজ, বৃটিশ উপনিবেশ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কলম হাতে সোচ্চার ছিলেন। ফয়েজ বামপন্থী, সে হিসাবে পুরো দুনিয়ার পুঁজিবাদি শোষনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। দারবিশ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একজন বীর লড়াকু সৈনিকের মতোই ছিলেন। তাদের কবিতা আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্রের কাজ দিয়েছে। তারা দুঃশাসনের ভীত নাড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তাদের কিন্তু নির্জনতা ও নৈঃশব্দ্যের আরাধনা করাটা সম্ভবপর ছিল না। যেহেতু এমন এক রক্তাক্ত বাস্তবতার দিয়ে প্রতিনিয়তই তাদেরকে অতিক্রম করতে হয়েছে, যাকে এড়ানো কারো পক্ষেই সম্ভব না হয়তো।

এটাই শিল্প ও সাহিত্যের আটমোস্ট শক্তি। এজন্যই আমি কিন্তু বলেছি,গণমানুষকে উপেক্ষা করে শিল্পের শক্তিশালি অবস্থান তৈরী করা অনেকটাই অসম্ভব। কিন্তু, আমার কবিতার প্রশ্নে ব্যাপারটা আমি আলাদাই রাখতে চাইবো। যেহেতু নিজের জগতটা কেমন হবে, বা কেমন দেখতে চাই এসব ব্যাপারে আমার একটা বোধ তৈরি হয়ে গেছে!

হামেদীঃ

আপনার বোধ তৈরি হয়ে গেছে ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আত্মরক্ষামূলকই মনে হলো। এবং কিছুটা কূটনৈতিকও। কারণ হচ্ছে, আপনার গদ্যে এবং আলাপে-সালাপে যতটুকু পাই আপনাকে, তাতে এই বঙ্গে ইউরোপীয় উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে বেশ জোরালো স্বর নিয়েই হাজির হন। কিন্তু কবিতায় তার ছিঁটেফোঁটাও পাই না। এটা হয়তো এমন যে, কবিতা বিষয়ে আপনি বেশ সংস্কারে ভোগেন। মনে করেন যে, কবিতা পবিত্র জিনিস। তাকে সবকিছু থেকে দূরে রেখে মনের একান্ত গহনে ঝেড়েপুছে রাখতে হবে। কবিতা বিষয়ে এই যে ঔপনিবেশিক সংস্কার, এটাকে আমল করেন অবচেতনে। নিজের এই দ্বিচারিতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ, নিজের ভেতরে এই দ্বিচারিতা আমি অনুভব করি বটে। কিন্তু একইসাথে আমি অপারগও। এই দ্বিচারিতা থেকে আমি বের হতে পারিনি। এটা একটা পার্সপেক্টিভ। এর আরেকটা পার্সপেক্টিভও আছে, আমার মনে হয় মাঝেমাঝে, তা হলো এখানে আসলে কোন দ্বিচারিতা নাই। আমার পলিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান সবকিছু আপনিতেই আমার কবিতা থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এটা কিভাবে হয়েছে তা হয়তো কিছুটা বলেছিও পূর্বে। তবে একথা অস্বীকার করবো না, কবিতার ব্যাপারে অনুভূতিগত পবিত্রতার একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা সংস্কার আছে আমার মাঝে। কিন্তু এটা কি ভালনারেবল? আমার তেমন মনে হয়নি আরকি। কবিতার ব্যাপারে যুগে যুগে মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা নানান দৃষ্টিভঙ্গির মতো এটাও একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে!

কিন্তু কবিতার বাইরে আমার সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান আছে। সেসব অবস্থান সম্বন্ধে আমার মতামতও আছে। বিউপনিবেশায়ন ও উপনিবেশোত্তর দেশ ও সমাজ নিয়ে আমার মতামত সেসবেরই অংশ। আমি কেবল বাংলার উপনিবেশায়নের কথা বলি না, বরং সামগ্রিকভাবেই কলোনিয়ালিজম, ইম্পেরিয়ালিজম এবং ওরিয়েন্টালিজমের ডিসকোর্সগুলো নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। কিন্তু আমার কবিতার জগতটাকেও এর অংশীদার বানাতে হবে, এমনটা মনে হয় নি কখনো। বরং আমি বলেছি, কবিতা হলো আমার আত্মার একান্ত বিশ্রামের জায়গা।

হামেদীঃ

আপনার কবিতা অনেক বেশি স্মৃতিশাসিত। যেটা আগেও বলেছেন। এই স্মৃতির এক পিঠে আছে, মা-বুবুর মতো একান্ত পারিবারিক সম্পর্কের বয়ান, পুঁইমাচায় চাঁদ শুয়ে থাকার মতো ইমেজ, এস্রাজ সুরে ঝরে যাওয়া করুণ পাতা, জলনুড়ির পথ, সহজ মেয়েলি গ্রাম, এরকম চেনা বিষয়াদি। আবার আরেক পিঠে আছে, ওকের ছায়ায় উদ্ভ্রান্ত মেষের পালয়িতা, স্থির হাওয়ায় নড়ে যাওয়া নাশপাতি বনের মতো দূরবর্তী ইমেজ। আমার আন্দাজ হলো, যাপনসূত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার সাথে পঠনপাঠনসূত্রে গঠিত স্মৃতি জড়াজড়ি করে আছে খুব সাবলীলভাবে। মনে হয় যেন, সুর কিংবা অনুভবের সূক্ষ্মতার জায়গায় আপনি যতটা হিসাবী ও সতর্ক, অনুষঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি উদার।

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ, অনেকটা এমনই। আমার কোনকিছুই আসলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ি ঘটে না, মানে আমি সেটা মেন্টেইন করতে পারি না। কবিতার বেলাতেও ঠিক তাই ঘটে। একটা প্রবাহের ভেতর নিজেকে ভাসিয়ে দেয়ার মতো ব্যাপার আরকি। যেদিকে যায় যাক।

তবে সবকিছুই আমাকে আক্ষরিক অভিজ্ঞতায় যাপন করে তারপর কবিতায় আনতে হবে, এ ব্যাপারে খানিকটা দ্বিমত আছে আমার। এমনকি আপনিও কবিতায় এমন অনেক অতিলৌকিক বা অতিন্দ্রীয় ইমেজ নির্মাণ করেন, যার সাথে নিছক কল্পনা ছাড়া আর কোন যোগসূত্র নাই আপনার! এমনটা কবিতায় ঘটে কিন্তু, প্রচুর পরিমাণেই ঘটে।

আমি যা করতে চেয়েছি, তা হলো ইমেজকে নির্মাণ করতে চেয়েছি নানান আঙ্গিকে। এক্ষেত্রে আমার চেনা জগতও সামনে ছিল, আবার দূর কোন পাহাড়ের সবুজ উপত্যকার কল্পনাও ছিল। এ দুয়ের মাঝে কোন ফারাক করতে চাইনি আসলে। আমার একটা কবিতা আছে, আরোহী নামে। সেখানে থিমটা এমন ছিল, একজন নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী নির্জন কোন পাহাড়ি উপত্যকার উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চলছে। তার বোধের সাথে মিশে যাচ্ছে চারপাশের যাবতীয় দৃশ্যাবলি। এরকম ছিল কবিতার থিমটা।

এটা লেখার বছরখানেক পরেই আমি কাশ্মীর যাই। অদ্ভূতভাবে সেখানে এমনই এক উপত্যকা দিয়ে আমি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অতিক্রম করি যা হুবহু আমার কবিতাকেই যেন কপি করছিল! সেই একই বোধ, একই দৃশ্যের মহড়া, যা আমি বছরখানেক আগেই কল্পনায় সাজিয়ে এসেছি! এটা আমাকে একদম বিহ্বল করে দিয়েছিল।

হামেদীঃ

মোটাদাগে, শিক্ষিত নাগরিকসমাজ বাংলা ভাষায় যে ধরনের কবিতার চর্চা করে, ‘আধুনিক স্কুলিংয়ের’ ভিতর দিয়ে গিয়াই করে। আমরা বেশিরভাগই সেভাবে আসছি। কিন্তু আপনার পড়াশোনা ‘কওমি ঘরানায়’। ভিন্ন রকম স্কুলিংয়ের ভিতর দিয়ে আসছেন। হয়তো ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আধুনিক কাব্যের পাঠ নিয়েছেন। দুইয়ের মধ্যে মেলাতে গিয়ে কী কৌশল নেন আপনি? আপনার কবিতায় আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব কতটা?

হুজাইফাঃ

এটা আগে বোঝা দরকার তাদের একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড এবং আধুনিক স্কুলিং তাদের কবিতাচর্চায় কতটা কাজে আসে? আমার তো মনে হয়, আর্ট-কালচারের কোন বিষয়েই প্রতিষ্ঠান তেমন কোন কাজে আসে না। তবে এটা সত্য আপনাদের এই “আধুনিক স্কুলিং” কবিতার জন্য যতটা সহায়ক হয়েছে আমার স্কুলিং তেমন ছিল না। তবুও আমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ ভাগ্যবান ছিলাম যে, আমাদের পরিবারে এমন একটা পরিবেশ সবসময়ই ছিল। যেখানে শিল্প-সাহিত্যের নানান বিষয়ে আমি বেশ ছোট থেকেই পরিচিত হতে পেরেছি। আমি যখন একদমই ছোট, তখন আমার ভাইয়ারা বাড়িতে দেয়ালিকা প্রকাশ করতেন নিজেরা মিলে। শিল্প-সাহিত্যের নানান বিষয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করতেন, আমি সেসব শুনতাম, এবং অংশগ্রহণও করতাম কখনো। তারা আমার বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন বইয়ের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন। মোটকথা আধুনিক শিল্প-সাহিত্যের স্কুলিং অনেকটা পারিবারিকভাবেই পেয়েছি আমি। ফলে এর জন্য আলাদা কোন স্ট্রাগলিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয় নি।

আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব আমার কবিতায় কোনভাবেই পড়েনি। এটা একদিক দিয়ে যেমন স্বস্তিদায়ক, মানে আমি যেমনটা চেয়েছি, কবিতাকে সবকিছু থেকে আলাদা রাখতে, তা হয়েছে। অপরদিকে আমার জন্য এটা দুঃখজনকও বটে। কেননা এমন অনেক কিছুই আমি লিখতে চেয়েছি, কিন্তু শেষমেশ পারিনি। যেমন আমি খুব চেয়েছিলাম, রাসূল সাঃ-কে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে, কিন্তু মনমতো একটা লাইনও লিখতে পারিনি। এটা বেশ হতাশাজনক ছিল আমার জন্য। তখন আমার মনে হয়েছিল, এইযে কবিতার বোধ তৈরি হয় আমাদের ভেতরে, এটা কে তৈরি করে এবং কিভাবে তৈরি করে? আমার কোন নিয়ন্ত্রণ কেন সেখানে নাই!

রোবায়েতঃ

প্রচ্ছদঃ রাজীব দত্ত

আপনি তো রিজালশাস্ত্র নিয়ে পড়ছেন এখন, তাই কি!

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ,আমার হাদিস বিষয়ক পড়াশোনার বড় একটা অংশজুড়ে রিজালশাস্ত্র আছে।

রোবায়েতঃ

হাদিস তো [আমি যেমনটা মনে করি] কেবল নিয়মকানুনের বিষয় না- হিউম্যান হিস্ট্রিও। তো, ইসলামিক হিস্ট্রির যে বয়ান বাজারে প্রচলিত আছে (যেমন: আব্বাসীয় টাইম, উমাইয়া টাইম) তার বাইরে গিয়ে মুহাদ্দিসগণ বা ইসলামিক স্কলারদের টাইম-বেইজড হিস্ট্রি কেন তৈরি হলো না, বা বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার সিলেবাসে তেমন বিষয় পড়ানো হয় না কেন?

হুজাইফাঃ

হাদিস প্রথমত ইসলামি শরিয়ার দ্বিতীয় উৎসস্থল। দ্বিতীয়ত হিউম্যান হিস্ট্রি, আপনি যেটা বলেছেন। হাদিসের বাইরে গিয়ে টাইম বেইজড হিস্ট্রি বলতে কি আপনি সার্বিক ইতিহাসের কথা বোঝাচ্ছেন? মানে আমির উমারাদের ইতিহাস ছাড়াও বাইরের যে জগত আছে সেটা?

রোবায়েতঃ

হ্যাঁ। আমি মনে করি, ইসলামের যে চারটা বা পাঁচটা স্কুল আছে যারা হাজার বছর হলো ইসলামি ও অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডের চর্চা করে আজকের অবস্থানে ইসলামি নলেজকে নিয়ে আসছেন তাদের টাইম পিরিয়ড ধরেই ইসলামি ইতিহাসের চর্চা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সেটা সম্ভবত হয়নি। কেন?

হুজাইফাঃ

সেটা হয়েছে, বরং প্রচুর পরিমাণেই হয়েছে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ পুরো মুসলিম জাতির ইতিহাসকে দুইভাবে বর্ণনা করেছেন। মানে ন্যারেশনের দুইটা ম্যাথডলজি বলা যেতে পারে। ত্ববারি, ইবনুল আসীর, ইবনে কাসীর, মাসউদি, বালাযুরি, ইবন খালদুন, প্রমূখ ঐতিহাসিকগণ খেলাফত বা আমির উমারাদের সময়কালকে সামনে রেখে ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে তারা সমকালীন পৃথিবীর পুরো টাইমফ্রেমটাকেই নিয়ে আসতে পেরেছেন।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটা হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনা। মানে, ইসলামি জ্ঞানের শাখা-প্রশাখাগুলোতে যেসব মনীষী বিপুল কাজ করে গেছেন তাদের সময়কাল ধরেও ইতিহাস চর্চা হয়েছে। হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনচরিত মোটামুটি ইসলামের প্রথম তিন/চার শতাব্দিতেই এসে শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে নিয়ে আরও যারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখে গেছেন, তাদের জীবনীকেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চার লিগ্যাসিও অনেক সমৃদ্ধ। এজন্য হাদিস, ফিক্বহ, সাহিত্য, ব্যাকরণ, তাসউফ, দর্শন প্রতিটি শাখারই আলাদা ইতিহাস রচিত হয়েছে। কখনো অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাসও রচিত হয়েছে। মানে ওই এলাকায় যেসব জ্ঞানী আছেন নির্বিশেষে তাদের জীবনী গ্রন্থিত হয়েছে। আমরা খতিবে বাগদাদি, যাহাবী, ইবনে রজব হাম্বলি, ইবনে হাজার প্রমুখদের ইতিহাস চর্চার দিকে তাকালে বিষয়টা ভালভাবেই বুঝতে পারবো। বরং এই পদ্ধতিতেই কাজ হয়েছে বেশি। আসলে মুসলিম ঐতিহাসিকদের বিচরণক্ষেত্র এতটাই বিস্তৃত যে আমাদের কল্পনা করতেও কষ্ট হয় সেটা। এবং ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে তারা যে বিস্ময়কর মেথড গ্রহণ করেছেন সেটাও একমাত্র তাদেরই আবিষ্কার। আমি এই সংক্ষিপ্ত কথায় এটা ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারছি না আসলে। কথা হলো, প্রথম পদ্ধতিটা বিভিন্ন কারণে হাইলাইটেড হয়েছে বেশি। ফলে ইতিহাসের সাধারণ পাঠকরা দ্বিতীয় পদ্ধতিটার ব্যাপারে মোটামুটি বেখবরই বলা চলে। এজন্য, ইবনে কাসীর বা ইবনে খালদুনরা ঐতিহাসিক হিসেবে যতটা পরিচিত হয়ে উঠেছেন সকলের মাঝে, যাহাবী বা খতিব বাগদাদিরা ওই পর্যায়ে চর্চায় আসেননি। এর অপূরণীয় একটা ক্ষতির দিক হলো, মুসলিম বিশ্বের আমির উমারাদের ইতিহাস জানা থাকলেও এসব জ্ঞানকাণ্ডের ইতিহাস আমাদের সামনে নাই।


চিন্তা ও সৌন্দর্য্যের কিছু বিষয় আছে, যেগুলো বৈশ্বিক। কোন অঞ্চলের ব্যারিয়ারে তাকে আটকে রাখতে পারবেন না।


রোবায়েতঃ

আমার প্রশ্ন ছিল কওমি মাদরাসায় এই ধরণের বিভাগ আছে কি, যারা স্পেশালি ইতিহাস পড়ায়?

হুজাইফাঃ

কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস এখনও নানান দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ। এর মাঝে এটাও একটা। সাধারণত দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়ার পর কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ওই ইতিহাসটুকু পড়তে পারে না। এরজন্য যে উচ্চতর পড়াশোনার প্রয়োজন ছিল, সেটার ব্যবস্থা এখনো হয়ে উঠে নি। এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। আমাদের ইতিহাস নিছকই ইতিহাস না, এর আরও নানান তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু এখানে আপনি স্বউদ্যোগে না পড়লে এতটুক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন না। এখন যারা কওমি মাদ্রাসার আধুনিকায়নের কথা বলছেন, তাদের সাথে আমার দ্বিমতের জায়গাটা এখানে। কেননা আধুনিকায়ন বলতে আমি এটাকেই বুঝি।

রোবায়েতঃ

এই যে হাদিস যেখানে মানুষের ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ তো হাদিসের ছাত্র হয়ে আপনি কেন কবিতায় ইয়োরোপিয়ান সলিচ্যুডের মধ্যে বসবাস করেন?

হুজাইফাঃ

হা হা হা আপনারা আমারে ইউরোপিয়ান বানাইয়াই ছাড়বেন দেখতেছি! এটা আরও বছর পাঁচেক আগে বললে খুব খুশি হতাম। তখন ইউরোপের সবকিছুর ব্যাপারেই আমার একধরণের মুগ্ধতা কাজ করতো, এবং ইউরোপে জন্মাইতে না পারার কারণে দুঃখিত হইতাম। কিন্তু ক্রমেই সেই ইউরোপমুগ্ধতা ইউরোপ-ফোবিয়ায় রুপান্তরিত হয়েছে। এখন ইউরোপের সবকিছুকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি। তাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং পুরো দুনিয়াকে শাসন করার নানান চক্রান্ত আমি যেন চোখের সামনেই দেখতেছি।

আমার কবিতার ভূগোল এবং এর যাবতীয় এ্যাপ্রোচ বিভিন্ন দিক দিয়েই হয়তো ইউরোসেন্ট্রিক মনে হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে আমার অবস্থানও ক্লিয়ার, আমার নিজের কাছে। আমি আগেও বলেছি, আমার বাইরের কর্মকাণ্ড ও চিন্তা জগত এবং কবিতার জগতটা সম্পূর্ণই আলাদা। একটা অপরটাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারে না। এই করতে না পারার পেছনে আমার সচেতন কোন প্রয়াস নাই। আমি মূলত সেসব দৃশ্য ও বোধের নির্মাণই করছি কবিতায়, যা একান্তই আমার। এখন একজন গ্রামীণ বাঙালি কবির মনোভূমি যদি ইউরোপিয়ান ভূগোলের সাথে অবচেতনে মিলে যায়, এবং কাকতালীয়ভাবে তারা যদি কোন যোগসূত্র তৈরি করে নেয়, তাহলে তার কী করার আছে এখানে! চিন্তা ও সৌন্দর্য্যের কিছু বিষয় আছে, যেগুলো বৈশ্বিক। কোন অঞ্চলের ব্যারিয়ারে তাকে আটকে রাখতে পারবেন না। আমার ভেতরে যে জগতটা তৈরি হয়েছে সেটা মূলত আমার নৈশঃব্দের স্মৃতি থেকেই জারিত হয়েছে। এবং আমি যে নৈঃশব্দ্য ও সুরের কল্পনা করি সেটা কিভাবে যেন এই ভাটি বাংলার সাথে ম্যাচ করে না! এমনকি কসমোপলিটান নাগরিকতার সাথেও না।

রোবায়েতঃ

আপনি কি লোরকার সুর দ্বারা প্রভাবিত?

হুজাইফাঃ

লোরকা আমার অত্যন্ত প্রিয় কবিদের একজন। লোরকার বিভিন্ন কবিতায় আমি যেন নিজেকেই খুঁজে পেয়েছি। লোরকা দ্বারা প্রভাবিত, একথা সরাসরি বলবো না। কেননা লোরকার কবিতার সাথে পরিচয় ঘটারও বহু আগে থেকেই আমি নিজের ভেতর এই ব্যাপারগুলো আবিষ্কার করেছি। মানে এই নিঃসঙ্গ সুরের যাত্রা। ফলে আলাদা করে লোরকা আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন, এমনটা মনে হয়নি। তবে একথা সত্য, আমি যে সময়টাতে একমনে লোরকার কবিতা পড়ছিলাম, সেসময়ে লেখা দুয়েকটি কবিতার ভেতর আমি তার প্রাদুর্ভাব টের পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো আঙ্গিক ও গঠনের দিক দিয়ে খুবই দুর্বল নির্মাণের ছিল, তাই শেষমেশ বইয়ে রাখতে পারিনি একটাও।

রোবায়েতঃ 

ধরেন,

‘কর্দোবা

বহুদূর আর একা’ [লোরকা]

 

পাশাপাশি আপনার:

‘পথের সংশয় কাটে না কোনদিন

বহুমুখী পথ

চিরকাল একা

আর বহুদূর!’

এই যে বহুদূরের মধ্যে একাকীত্ব বিলীনতার যে কয়েনেজ লোরকা ব্যবহার করছেন তেমন কয়েনেজ আমরা হুজাইফা মাহমুদকেও ব্যবহার করতে দেখছি, এটা কি কাকতালীয়?

হুজাইফাঃ

এটাকে আপাতদৃষ্টে কাকতালীয় বলা যায় না অবশ্যই। কিন্তু আমার সমগ্র কবিতার সুরের পরম্পরা থেকেও একে আলাদা করে বিবেচনা করা মুশকিল হবে। এই দূরগামীতা আর নৈঃসঙ্গের নির্জন যাত্রার সুর আমার সমস্ত কবিতাজগত জুড়েই ছড়িয়ে আছে। এটাকে অবচেতনের ঐক্য বলা যেতে পারে।

রোবায়েতঃ

আপনার কবিতার সকল সৌন্দর্য স্বীকার করেই আমার একটা অভিযোগ আছে।

হুজাইফাঃ

হা হা বলেন, কী অভিযোগ!

রোবায়েতঃ

আপনার কবিতা পড়লে মনে হয় যেন বিদেশী কোনো কবির অনুবাদ কবিতা পড়ছি। এটা আমার বিভ্রমও হইতে পারে।

হুজাইফাঃ

হা হা হা এই অভিযোগ মাথা পেতে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই আমার! ইতিমধ্যেই নিজেকে অনেক ডিফেন্স করে ফেলেছি! হা হা

রোবায়েতঃ

হা হা

‘তোমাদের কি আমি জানাব কার কাছে শয়তান অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর কাছে। তারা কান পেতে থাকে এবং তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী। এবং এ কবিদের অনুসরণ করে বিভ্রান্তরাই। আপনি কি দেখেন না তারা বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিটি উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। এবং তারা তো বলে যা তারা করে না। কিন্তু তারা ব্যতীত যারা বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে ও (কাব্য দ্বারা) অত্যাচারিত হওয়ার পর (কবিতার মাধ্যমে প্রত্যুত্তর দ্বারা) প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারকারীরা শিগগিরই জানবে কোন স্থানে তারা প্রত্যাবর্তন করবে।’

সুরা শুয়ারা’র এমন আয়াতের প্রেক্ষিতে অনেকেই (বিশেষ করে সেকুলারগণ) ইসলামকে কবিতাবিদ্বেষী বলে রায় দেন। আসলে ব্যাপারটা কি? কবিতা লিখতে গিয়ে এমন অভিযোগের সামনাসামনি কি আপনিও পড়েছেন?

হুজাইফাঃ

এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এবং আমি মনে মনে চাইতেছিলাম আপনাদের কেউ এটা করেন। হ্যাঁ, অনেকেই এই প্রশ্ন আমাকে করেছেন। সত্য কথা হলো, এটা খুবই বিরক্তিকর একটা প্রশ্ন। প্রশ্ন যারা করেন তারা সেটা প্রশ্নের ঢঙে করেন না, করেন আপত্তির সুরে।

এটা নিয়ে যারা আপত্তি তোলেন এবং ইসলামকে কবিতা-বিদ্বেষী হিসেবে প্রমাণ করতে চান, তারা হয় অজ্ঞতাবশত করেন, নতুবা হঠকারিতামূলকভাবে করেন। তাদেরকে আমার বলার কিছু নাই। যাই হোক, এ বিষয়ে যদিও বিস্তারিত বলার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আপাতত সে সুযোগ নাই, তাই সংক্ষেপে মৌলিক কয়েকটি বিষয় পয়েন্ট আকারে বলি –

১. সামান্য বুদ্ধির অধিকারি একজন মানুষও যদি আয়াতের পূর্বাপর খেয়াল করে পড়েন, তাহলে তার কাছে এটা আর কোন সমস্যাই মনে হবে না। এখানে স্পষ্টতই দুই ধরণের কবির কথা বলছেন আল্লাহ- প্রথমত যারা সেইসব অমুসলিম কবি, যারা কবিতার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে মানসিকভাবে পীড়ন করতো, রাসূল সাঃ-কে কষ্ট দিতো, তাদের কথা বলা হচ্ছে। পথভ্রষ্ট লোকেরাই কেবল তাদের অনুসরণ করে। আর যেহেতু তাদের ধর্ম-কর্মের কোন বালাই নাই, তাই লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরাফিরা করে বেড়ায়। তাদেরকে নিন্দা জানানো হয়েছে কঠোর ভাষায়।

দ্বিতীয়ত, সেইসব কবির কথা বলেছেন, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান এনেছেন এবং সৎকর্মে নিয়োজিত আছেন। তাদেরকে আল্লাহ সুসংবাদ দিয়েছেন এবং শান্তনার বাণী শুনিয়েছেন। তো, একজন মুসলমান কবি হিসেবে এ আয়াত নিয়ে আমার বিচলিত হবার কিছু নাই। যিনি কোরানের সাথে হঠকারিতামূলক আচরণ করছেন তারই কেবল বিচলিত হওয়া সাজে।

২. ইসলাম কবিতার ব্যাপারে স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক নীতিমালাও আমরা হাদিস থেকে গ্রহণ করতে পারি।

ক. কবিতা সাধারণ কথার মতই একটা ব্যাপার। ভাল কবিতা হলে ভাল, মন্দ হলে মন্দ।

খ. কবিতায় কোন হারাম বিষয়কে প্রমোট করা যাবে না। মদ, জুয়া, যিনা-ব্যভিচার,ইত্যাদি। নারীদেহের রগরগে বর্ণনার মাধ্যমে একে সেক্সুয়ালাইজ বা ইরোটিসাইজ করা যাবে না। কারো বিরুদ্ধে হিংসা, কুৎসা, বদনাম বা বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না। কবিতার মাধ্যমে লোকজনের আবেগকে উস্কে দিয়ে কোন অন্যায় যুদ্ধের দিকে ডাকা যাবে না। কবিতার পেছনে পড়ে দ্বীন- দুনিয়া সম্পর্কে উদাসিন হওয়া যাবে না।

এ হলো মোটাদাগে কয়েকটি কথা।

আমার খুব লোভ হচ্ছিল রাসুল সাঃ ও তার সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কি পরিমাণ কবিতার চর্চা ছিল তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরতে। রাসূল নিজে কবিতা বলতেন না, কিন্তু শুনতে পছন্দ করতেন। ইসলামী জ্ঞানধারার সাথে সামান্যতম পরিচয়ও যার আছে, সে বুঝতে পারবে ইসলামী যুগে কবিতার চর্চা কতটা ব্যাপক ছিল!

রোবায়েতঃ

কবি হাসসান ইবনে সাবিতের জন্য আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তো মসজিদে আলাদা মিম্বার তৈরি করিয়েছিলেন।

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ, সেটাই। রাসূল (সাঃ) তাঁকে আদেশ করেছিলেন, তুমি কবিতার মাধ্যমে কাফেরদের কবিতার জবাব দাও। জিব্রাইল তোমাকে সহযোগিতা করবেন। অসংখ্য অগণিত ঘটনা আছে এমন। হযরত আলী রাঃ এর কবিতাগুলো এখন পর্যন্ত আরবী কবিতার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আপনি সাহাবাদের জীবনী পড়তে গেলে দেখবেন, কবিতা তাদের কাছে একদমই সহজাত একটা ব্যাপার ছিল।

রোবায়েতঃ

হ্যাঁ। আর তাফসির, হাদিস পড়তে তো আরবি কবিতা সম্বন্ধে উচ্চতর ধারণা রাখতে হয় যেমনটা দেখি ইবনে কাসিরে।

হুজাইফাঃ

একদম ঠিক। আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে সাবয়ে মুআাল্লাক্বাত এবং মুতানাব্বির কবিতা পড়ানোই হয় মূলত এই উদ্দেশ্যে, যেন সেসব কিতাবাদি সহজে বুঝা যায়।


এখন গুড মুসলিমের ব্র্যান্ড এ্যাম্বেসেডর বানানো হইছে রুমিকে, যিনি নামে-ধামে মুসলমান হইলেও মূলত “সর্বজনে প্রেম” জাতীয় সার্বজনীন একটা ধর্মের প্রবক্তা।


রোবায়েতঃ

আচ্ছা, একটা প্রাসঙ্গিক আলাপ তুলতে চাই। পশ্চিম যে সুফিবাদকে বিক্রি করে যেখানে মোহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এর প্রচারিত ইসলামের ব্যাপারে তাদের ফোবিয়া বিদ্যমান অথচ রুমি [র.] এর ইসলামের বিজ্ঞাপন করা হয় দেদারছে, এমন সুফিজম সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?

হুজাইফাঃ

এই সুফিজমের ব্যাপারে আমার এক শব্দের মন্তব্য হলো, এটা পপ সুফিজম। নট ইসলামিক সুফিজম। ইসলামি সুফিজম এবং সেসব মহান সুফিদের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও যদি তাদের থাকতো, তাহলে এটাকে নিয়ে এই পরিমাণ আদিখেতা দেখানোর ইচ্ছা থাকতো না আর। বস্তুত তারা একটা ইউটোপিয়ান সুফিজমের ভেতরে আছে। রুমি এবং অন্যান্য সুফিদের ব্যাপক মার্কেটিং শুরু হয় মূলত ৯/১১ এর পর থেকে। এই সময়টায় এসে তারা গোটা দুনিয়ার মুসলিম জাতিকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলে, এক হলো গুড মুসলিম, আরেক হলো ব্যাড মুসলিম বা র‍্যাডিকাল মুসলিম। এখন গুড মুসলিমের ব্র্যান্ড এ্যাম্বেসেডর বানানো হইছে রুমিকে, যিনি নামে-ধামে মুসলমান হইলেও মূলত “সর্বজনে প্রেম” জাতীয় সার্বজনীন একটা ধর্মের প্রবক্তা। মানে, মাওলানা রুমিকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে তারা, যেখানে তার মুসলমান পরিচয়টাই গায়েব হয়ে গেছে। রুমি যে একজন পাক্কা শরিয়ত অনুসারি মুসলিম দরবেশ, সেটা তাদের রুমি বিষয়ক লেখালেখি এবং অনুবাদ থেকে বোঝার উপায় নাই। যেন তিনি স্বতন্ত্র কোন ধর্মের প্রবক্তা! মূলত রুমির অনুবাদের মাধ্যমেই এই কাজটা করেছে তারা। বিপরীতে ব্যাড মুসলিমরা, যারা নবী মুহম্মদকেই সবার আগে মান্য করে, তারা নানানভাবে মূর্খ, হিংস্র, গোঁয়াড় এবং সন্ত্রাসী টাইপের লোক। এটা ছিল একটা বিশাল প্রজেক্ট। আমরা এখন হাতে-কলমে ধরে দেখিয়ে দিতে পারবো, কিভাবে ইসলামিক সুফিজমের ডি-ইসলামাইজেশন করে তাদের কল্পিত ইউটোপিয়ান সুফিজমে পরিণত করেছে। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নমূলক বিকৃতিগুলো একদমই স্পষ্ট। আমার আক্ষেপ হয় যখন আমরা মুসলমানরাও এই পশ্চিমা ফাঁদে পা দিয়ে ফেঁসে যাই।

রোবায়েতঃ

ইকবাল বলেছিলেন,

‘Tasawwuf is always the sign of decline of a nation. Greek mysticism, Persian mysticism, Indian mysticism—all are signs of decline of these nations, the same is true of Islamic mysticism…Any philosophy or religious teaching that prevents the blossoming of the human personality is worthless.’

হুজাইফাঃ

হ্যাঁ, ইকবাল যথার্থই বলেছেন, তবে তার কথা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। প্রথমত, তাসাউফ ইসলাম বহির্ভুত কোন বিষয় না। যেকোন মুসলমানেরই কাঙ্খিত বিষয় হওয়া চাই সেটা। তাসাউফের মূল দাবী হলো, সর্বোতভাবে আল্লাহমুখী হয়ে যাওয়া। ইবাদাতের ক্ষেত্রে উচ্চতর অবস্থায় উন্নীত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকা। এক হাদিসে রাসুল সাঃ বলেছেন, ইহসান হলো এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করা, যেন তুমি তাকে স্বচক্ষে দেখছো। যদি ওই পর্যায়ে না পৌঁছাতে পারো তাহলে অন্তত এটা মনে করো যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।

এখান ইহসান বলে তাসাউফকেই বোঝানো হয়েছে মূলত। তো, এই পর্যায়ের তাসাউফ কিন্তু সকল মুমিনের কাছেই কাঙ্খিত হতে হবে। পরবর্তীতে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে আরও নৈকট্য লাভের চেষ্টায় রত থাকা।

ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দী পর্যন্ত তাসাউফের ধারণা একে কেন্দ্র করেই বহাল ছিল। কিন্তু তারপরে যখন মুসলমানরা ব্যাপকভাবে গ্রীক দর্শন ও ভারতীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হতে লাগলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাসাউফের ধারণায়ও নানান পরিবর্তন ও বিকৃতি দেখা দিতে লাগলো। ফলে, প্রথম তিন শতাব্দীতে যে তাসাউফ তার বিশুদ্ধতা ও অথেনটিসিটির উপর ছিল পরবর্তিতে তা অনেকটাই রেটরিকাল হয়ে গেছে। সুফিগন বিভিন্ন তাত্ত্বিক গূঢ় কথাবার্তা বলা শুরু করলেন, অনেক আচার-আচরণও গ্রহন করলেন অন্যদের কাছ থেকে।

ইকবাল মূলত এই বিকৃতি পরিবর্তনের কথাই বলছেন।

রোবায়েতঃ

আপনার কবিতাকে কিন্তু ভবিষ্যতে পশ্চিমারা রুমির উত্তরাধিকার বলবে! শুধু সাইলেন্স! নো ক্যাওস! এই সাইলেন্সকেই এখন বেচতেছে পশ্চিম।

হুজাইফাঃ

হা হা হা গৌতম বুদ্ধের শিষ্যও বলতে পারে! চেহারা দেখলে বলবে না।

হামেদীঃ

কোরানের আয়াত, হাদিস কিংবা ক্বিয়ামের ক্ষেত্রে সুর, তাল, লয়ের দারুণ মিশেল লক্ষ্য করা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনার মধ্যে এর প্রভাব পড়তে পারতো। কিন্তু আপনার কবিতায় সুর থাকলেও, তাল-লয়ের সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারে সচেতনতা বা আগ্রহ দেখি না। প্রথাগত ছন্দে আপনার অনীহার কারণ কী?

হুজাইফাঃ

হা হা কথা সত্য, এসব আমাকে নানানভাবেই প্রভাবিত করার চান্স ছিল। কিন্তু কেন যেন করে নাই। এমন কি যেসব কবিতা আমার ভাল লাগে, সেগুলোর ছন্দের দিকে খেয়াল করা ছাড়াই ভাল লাগে আমার। ছন্দ আমার কাছে আলাদা কোন রোল প্লে করেনা!

কবিতায় ছন্দ, তাল, লয় এসব নিয়ে আমি হয়তো কোনদিন সিরিয়াসলি ভাবিইনি। হয়তো ভাবতে চেয়েও পারিনি। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, কবিতায় ছন্দ হলো একটা টেকনিক বা কৌশলের ব্যাপার। এর জন্য আলাদা কসরতের প্রয়োজন পড়বে। তো, কবিতায় এই কৌশলগত টুলস নিয়ে নাড়াচাড়া করার কোন আগ্রহ কখনই আমি পাইনি। আর এক ধরণের ফোবিয়া কাজ করে আমার ভেতর, যদি ছন্দটা আমি শিখেই ফেলি, এবং কবিতায় সেটার ব্যবহারও শুরু করি, তাহলে আমি হয়তো নানানভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়বো। এখন যে উন্মুক্ত স্বাধীনতা ভোগ করছি সেটা আমি আর পাবো না। অক্ষর গুনে গুনে মাত্রা মিলিয়ে মিলিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবলেও আমি আতঙ্কিত বোধ করি! এটা শুনতে হাস্যকর লাগলেও, আমি সেটা আসলেই অনুভব করি। ফলে, অপরের ছন্দের দোলা যতই ভালো লাগুক নিজে কখনো ওইদিকে পা বাড়ানোর ইচ্ছাও করি না! হা হা হা

হামেদীঃ

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় ছন্দের চর্চা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

হুজাইফাঃ

কোন কবিতায় ছন্দের উপস্থিতি আমি একমাত্র তখনই বুঝতে পারি, যদি সেটা ছড়া জাতীয় হয়। যেহেতু, ছড়া আমার পছন্দের জিনিস, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়তে খুব ভাল লাগে। কিন্তু এছাড়া কোন কবিতায় আপনারা দুনিয়ার আরও যতসব ছন্দের নাম বলেন সেগুলো থাকলে আমি টেরও পাই না। ছন্দ থাকা না থাকা আমার কবিতা পাঠকে কোনভাবেই প্রভাবিত করে না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের কবিরা ছন্দে লেখুক আর দ্বন্দ্বে লেখুক আমি ওসব পর্যবেক্ষণ করি না, এ নিয়ে আমার কোন বক্তব্যও নাই! মূলত কবিতার টেক্সটই সবার আগে আমার হৃদয়ে পশে, ছন্দ না! হা হা হা

হামেদীঃ

এখন তো শীতের মৌসুম। ওয়াজেরও। ছোটবেলায় আমরা দলবেঁধে ওয়াজ শুনতে যাইতাম। নানান স্মৃতি আছে ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে। ওয়ায়েজীনদের ব্যাপারে বেশ ফ্যাসিনেশন কাজ করতো। কবি-মাওলানা হুজাইফা মাহমুদ মাহফিলে বয়ান করতেছে, এ দৃশ্য দেখতে কেমন হবে ভাবতেছি।

হুজাইফাঃ

হা হা এরকম দৃশ্য মনে হয় না কোনদিন তৈরি হবে। কেননা, আমি মারাত্মকরকমের আড়ষ্ট মানুষ। লোকজনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস একদমই নাই। ঘরকুনো ব্যাঙের মতো শুধু কোণা খুঁজি। এসবের জন্য আলাদা যোগ্যতা লাগে, আমার সে যোগ্যতা নাই, এমনকি আগ্রহও নাই!

হামেদীঃ

নিদেনপক্ষে ঘরোয়া বৈঠকে আপনার বয়ান শুনবো একদিন। হা হা

শুভরাত্রি।

হুজাইফাঃ

গরীবকে সময় দেয়ার জন্য বহুত বহুত শুকরিয়া।

শেয়ার