হলুদ চশমা ও গাছ | জাহেদ মোতালেব


সেই রাতে আরেক কাণ্ড। তুমি একটা স্বপ্ন দেখলে। নাকি তা স্বপ্ন নয়? একটি বড় সাম্পান, তুমি সাম্পানের মাইট্টে তেলের গন্ধ পাচ্ছ, ইঞ্জিনের পোড়া তেলের গন্ধ পাচ্ছ, মাঝির ঘামের গন্ধও। কর্ণফুলীতে সাম্পান চলা শুরু করল। তুমি দাঁড়িয়ে আছ মাঝ বরাবর।

 

আচ্ছা, তোমার উচ্চতা যতটুকু তুমি তার অর্ধেক বা তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে যেতে চাও? তাহলে এক কাজ করতে পারো। করোনার এই মহামারিতে প্রচণ্ড গরমের দুপুরে তুমি হেঁটে হেঁটে আন্দরকিল্লা চলে যাও।

তুমি হয়ত আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ ছাড়িয়ে আরো সামনের দিকে হাঁটবে। তোমার পায়ের কাছে ফুটপাতে ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন এক মা। শিশুর চোখে-মুখে ঘুম। বাঁ হাতটা ছড়ানো। আকাশের দিকে ছড়ানো ওই তালু কি কিছু পেতে চায়?

নখগুলোর ভেতরে ময়লার কালো পাহাড়। ওর মুখের ঘামবিন্দু দেখে তোমার মনে অদ্ভুত মায়া জন্মাবে। মুচড়ে উঠবে বুকটা। মনে মনে বলবে, আহা! কিছু একটা বলতে চাইবে, কিন্তু বলতে পারবে না। কিছু কথা মনের মাঝে মাথা কুটে মরবে।

তুমি এগিয়ে যাবে। জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের জায়গাটা প্রায় খালি। তখন মনে পড়বে, এখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়। তোমার মনটা কেমন করবে। তুমি এগোবে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকের বিল্ডিংয়ে ঢুকবে।

সিঁড়িতে লম্বা লাইন। তুমি দাঁড়াবে। ঘেমে একাকার। মাস্কের ভেতর ঘাম গড়িয়ে পিঁপড়ার মতো হেঁটে হেঁটে মুখে ঢুকে যাচ্ছে। মাস্ক ধরতে বা খুলতে পারছ না। হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে চেষ্টা করছ।

লাইনের সামনে-পেছনে সবার মুখে মাস্ক। কারো হাতে টাকা, কারো হাতে জমা বই। কেউ পা নাড়ায়, কেউ মোবাইলে আঙুল নাড়ায়। কেউ পাশ দিয়ে যাওয়া তরুণীকে দেখে। এক তরুণ ঝগড়া করে সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে।

মাস্কের ভেতর মুখ চুলকায়, কিন্তু তুমি কিছু করতে পারছ না। একটু পর মনে পড়ে এই বিল্ডিংয়ের উপরের ফ্লোরে একটা হোটেল আছে। সেখানে জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার ও নার্সরা কোয়ারেন্টাইনে থাকেন। সে কথা মনে পড়ায় তোমার শরীরটা শিরশিরিয়ে ওঠে। তুমি ভাবছ, একজন মানুষ যখন জানতে পারে তার করোনা পজিটিভ, তখন তার কেমন লাগে? সে কি খুব ভয় পায়! কান্না করে? আর কী ভাবে? মৃত্যুটা কি তার মনের ভেতর নড়াচড়া করে? সে মৃত্যুকে দেখতে পায়? মৃত্যু কি একটা পিঁপড়া হয়ে হেঁটে হেঁটে তার মনের কাছটিতে চলে আসে? এসে কুটুস করে কামড় দেয়? সেই কামড়ে একটু লাল হয়? ফুলে ওঠে? চুলকায়?

 


পুকুরে নামার সময় দুই হাতে পানি সরানোর মতো তুমি মৃত্যুকে সরিয়ে আন্দরকিল্লার দিকে হাঁটবে। ফুটপাত আর রাস্তার দোকানদার, বুড়া ভিক্ষুক, সবার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে শূন্যতার দিকে তুমি হাঁটবে। তোমার মনে পড়বে, লাখ লাখ লোক মরে যাচ্ছে।

 

তখন হয়ত তোমার মনে পড়বে গত রাতে কিংবা অন্য কোনো রাতে তুমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলে। বিশাল একটা মাঠ; লম্বা লম্বা সবুজ ঘাসে ঢাকা। লম্বা ঘাস বাতাসে দোল খাচ্ছে। সেখানে লাইন ধরে পড়ে আছে সব লাশ। ঘাসের জন্য তাদের দেখা যাচ্ছে না।

তখন তোমার মনে হলো, সিঁড়িতে যারা দাঁড়িয়ে আছে সবাই মরে গেছে। যার জন্ম হয় তার মধ্যে মৃত্যু থাকে। মৃত্যু এখন তোমাকেও খুঁজছে। তোমার মধ্যে বাসা বানাতে চায়। পুরনো তার, শুকনা ঘাস আর ছেঁড়া পলিথিন দিয়ে বানাবে একটি বাসা। ওখানে বসে গাইবে, করোনা/তুমি ছলনা।

গান শুনে তুমি চমকে তাকাবে; কিন্তু কে গেয়েছে তা বুঝতে পারবে না। তোমার খুব টেনশন হবে। তুমি তখন তোমার ছোট্ট মেয়েটির মুখ মনে করবে। সে কীভাবে তোমাকে খামছি দেয়, ভাববে। খুঁজলে এখনো কয়েকটা দাগ তোমার মুখে পাওয়া যাবে। ওখানে হাত দিয়ে মেয়ের ছোঁয়া নেবে। মেয়ের গন্ধে তোমার মন আইঢাই করবে।

মৃত্যুকে তুমি শোনাতে চাইবে একটা গল্প। তুমি বলবে, মৃত্যু ভাই, মৃত্যু ভাই…

সে মোটা গলায় বলবে, কী কইতাছস?

কেঁপে উঠে তুমি বলবে, না কিছু না। তোমাকে একটা গল্প বলতে চেয়েছিলাম। শুনবে?

গল্পের কথায় মৃত্যুর খুব লোভ হবে। সে বলবে, গল্ফ! আইচ্ছা ক’, শুইনা দেহি তুর গল্ফ।

তুমি সুযোগ পেয়ে বলবে, মৃত্যু ভাই, ধরো তুমি মাটি হয়ে গেলে। এক থালা রসালো মাটি। সেই মাটিতে আমি রোপণ করলাম একটি আমগাছ।

হো হো করে হেসে মৃত্যু বলবে, হ্যাঁ, দিনে দিনে সেই গাছ বড় হইব। তারফর আইব ফাগুন মাস। মুকুলে মুকুলে গাছটা ছাইয়া যাইব। কিছু ঝরব, কিছু থাকব। সেখানে ঝুলব অনেক অনেক মৃত্যুফুল। তুই অ্যাকটা-দুইটা লইবি?

ভয়ে কেঁপে উঠবে তোমার বুক। তুমি মৃত্যুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। দেখবে তোমার অদূরে সিঁড়ির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। তার কাঁধে ব্যাগ, হাতে ব্যাগ। মুখটা রোবটের মতো। ভ্রæ বিশ্রীভাবে প্লাগ করা। তাকে দেখে তোমার মনে হবে ও মৃত্যুর বোন। কোনো এক দূর দেশে থাকে। একটা কথা মনে পড়তে চাইবে, কিন্তু পড়বে না।

তুমি হয়ত ব্যাংকে ঢোকার সুযোগ পাবে। হয়ত টাকা পাবে না। তোমার হাতে কিছু পয়সা দেবে ওরা। বলবে আমাদের পয়সা বেড়ে গেছে। তুমি না নিয়ে ফিরে আসবে।

পুকুরে নামার সময় দুই হাতে পানি সরানোর মতো তুমি মৃত্যুকে সরিয়ে আন্দরকিল্লার দিকে হাঁটবে। ফুটপাত আর রাস্তার দোকানদার, বুড়া ভিক্ষুক, সবার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে শূন্যতার দিকে তুমি হাঁটবে। তোমার মনে পড়বে, লাখ লাখ লোক মরে যাচ্ছে। মানুষের স্বপ্নগুলো ভেঙে যাচ্ছে। অচল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সেখানে আবার আরেক দিক সচল হচ্ছে। পৃথিবীর যে হাওয়া তা বিশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর যে প্রাণ তার গলা টিপে ধরেছিল তোমার মতো দুই পায়ের মানুষগুলো। তার প্রাণ আবার ফিরে আসছে। সে হাসছে। এ রকম খিলখিল

হাসি কেউ দেখেনি। এমনকি তোমার দূরতম কল্পনায়ও ছিল না।

অপরদিকে আবার দুর্ভাবনার কালো মেঘও জমছে। এই যে এত এত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল, মাস্ক, পিপিই- এত বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে? এত এত ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হচ্ছে; পাউডার মিশ্রিত পানি কোথায় যাচ্ছে? খাল-বিল, নদী-নালা পেরিয়ে সবকিছু সাগরে গিয়ে শেষ হয়। তাহলে সাগরে যারা থাকে তাদের কী অবস্থা হবে? তুমি কি বুঝতে পারছ?

এর মাঝে তুমি এখনো বেঁচে আছ। তোমার আশেপাশে অনেকেই বেঁচে আছে। অনেকের চোখে বাঁচার আকুতি দেখে তোমারও ইচ্ছে হয় আরেকটু ভালো করে বাঁচতে। তাই তুমি দাঁড়ালে তাজ সায়েন্টিফিকের সামনে। কী চাও? একটা চশমা কিনতে চাও? কেন? ভাইরাস যদি তোমার চোখের দিকে আসে তাহলে তাকে আটকাবে?

এ সময় একটা লোক এসে তোমার ঘাড়ের উপর দিয়ে সেলসম্যানের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। লোকটার মুখে মাস্ক নেই। তোমার মনে হলো, এক দলা ভাইরাস সে তোমার ঘাড়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। রাগে শরীরটা শক্ত হয়। তুমি হাত মুঠো করো। এখনই যেন ব্যাটার মুখে একটা ঘুষি মেরে দেবে। কিন্তু তুমি এক পাশে সরে দাঁড়াও, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো। কারণ কথা বললে ওর মুখ থেকে থুতু বেরুবে।

লোকটা চলে গেলে তুমি আবার চশমার কথা বলো। প্লাস্টিকের ফ্রেম ও গ্লাস, একশ টাকা দাম। হলুদ রঙের চশমাটা এখন তোমার হাতে। তুমি কখনো চশমা পরোনি। ভাবছ, পরলে কেমন লাগবে? ভ্যাবলা, হাঁদারাম মনে হবে? নাকি চশমা পরলে তুমি পাল্টে যাবে? তোমার চোখ অন্যরকম দেখবে? মোটু-পাতলু কার্টুনের পুলিশ অফিসারটা একটা চশমা পরে। তোমার সেই চশমার কথা মনে পড়ল। তুমি হয়ত এখন মোড়ে দাঁড়িয়ে চশমাটা উপর দিকে ছুড়ে দেবে। সেটা নাচতে নাচতে নেমে এসে তোমার চোখের উপর বসে যাবে। তখন তোমার চোখে দুনিয়াটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তুমি কোনো ভাইরাসের পরোয়া করবে না। তুমি হয়ত তখন একটা মোটরসাইকেলে চড়বে। স্টার্ট দিয়েই শাঁ করে চালানো শুরু করবে।

তুমি কি কোনো ভাইরাসকে ধাওয়া করবে? যে ভাইরাসের ল্যাজ, হাত-পা কিছুই নেই! আছে অবিনাশী ক্ষিধে, মানুষের ফুসফুস দখল করার বাসনা।

বাটা ভরা পানের মতো তুমিও হয়ত ওকে কোনো গল্প শোনাতে চাইবে। কিন্তু কোনো গল্প তোমার মনে পড়বে না। কারণ গল্প তো তোমার নেই। তুমি আছ ভয়ে আর অবিশ্বাসে। কল্পনায়, আশ্বাসে-বিশ্বাসে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আবিষ্কারে তো নেই। কাউকে বিশ্বাস করতে পারো না। নিজেকেও কি করো?

তারপর সারা দিন চশমাটার কথা তোমার মনে পড়ল না। ব্যাগের কোণে রয়ে গেল চুপটি করে।

পরদিন বিকালেই তুমি প্রথম চশমাটা পরেছ। পরার পরই ঘটল আশ্চর্য এক ঘটনা। তুমি বুঝতে পারছ না। প্রথমে এক পা, দুই পা ফেললে। আরো দুটি পদক্ষেপ দিলে। তারপর বুঝলে, ঘটনা সত্যি। সত্যি! হ্যাঁ, তুমি ছোট হয়ে গেছ। তোমার যে দৈর্ঘ্য তুমি তার প্রায় অর্ধেক হলে গেলে। হাঁটার সময় মনে হলো পা দুটি তুমি ফেলছ না, কোনো বনমানুষ ফেলছে। এ রকম হয় নাকি? এ কি চশমার নাকি ভাইরাসের গুণ?

আরেকটু হলে তো তুমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে।

তখন তুমি ভাবতে থাক, মানুষ আসলে খাটো, কিন্তু সে লম্বা বলে ভাব দেখায়। খাটো হয়ে গেছ তুমি। তুমি কি আর লম্বা হতে পারবে? পারবে তোমার চোখ থেকে ওই চশমা খুলতে?

নাকি তুমি আবার যাবে জেনারেল হাসপাতালের পাশে? যেখানে উড়ে যাওয়া কোনো ভাইরাস হয়ত তোমার দেখা পেয়েছিল। এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে চশমাটি কি তার চোখে পরিয়ে দেবে? তারপর? তারপর কী হতে পারে? ভাবতে ভাবতে একেকটি রাত শেষ হয়ে যাবে। তুমি কিছুই করতে পারবে না। চশমাটি কীভাবে তোমার হাতে এসেছে সেই কথা ভাববে গরমে ঘামতে ঘামতে।

ওখানে ডাস্টবিনে পড়ে থাকা ডাক্তারের পিপিইটা নিয়ে পরতে পারো। তখন কান্নাকাতর কণ্ঠে কেউ বলবে, শোন বেঁটে মানুষ, তোমার আশেপাশে মানুষ ছাড়াও ছোট-বড় আরো অনেক প্রাণী আছে। তাদেরকে তোমার মনের মধ্যে রেখো, অনুভব করো। তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু করো না। পাশাপাশি তোমার আশেপাশে যেসব গাছপালা আছে তাদেরও মনের মাঝে ছুঁয়ে রেখো। পৃথিবী তো তোমার একলার নয়।

 


সংকটকালে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়। উলঙ্গ হয় অনেক সত্য। কিন্তু ভয়াবহ ভয় তোমাকে গ্রাস করতে চাইছে। হয়ত ভাবছ, আমার ভেতরের মানুষটা না বাঁচলে আমি কীভাবে বাঁচব? তাই তুমি কাউকে বলতে চাইছ চশমার কথা।

 

হাঁটতে হাঁটতে তুমি চেরাগী পাহাড় মোড় পার হবে। লিচু বাগানের আগে দাওয়াত নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। এখন ভেঙে ফেলেছে। ওটার কয়েক বিল্ডিং পর একটা বিল্ডিং আছে। সেখানে সিঁড়িতে বসে আছে কয়েকজন তরুণ। কারো মুখে মাস্ক নেই। একজনের হাতে একটা গিটার। আঙুল নাড়ে আর টুং টাং সুরের হাওয়া বাতাসে ছড়ায়। সুরটা কোথায় তৈরি হয়? আঙুলে, গিটারে নাকি মনে? হঠাৎ তুমি চুনচুইন্যে মিষ্টি কাঁঠালের সুবাস পাও। মনে করো, তোমার বউ তোমার সামনে এক বাটি কাঁঠাল এনে রাখল। তুমি খেতে শুরু করলে। কী মিষ্টি! এমন মিষ্টি আর কিছুতে হয় না। আর সুঘ্রাণ কী! এ যেন আরেক সুর।

ওদের এক বন্ধু রাস্তা পার হয়ে আসছে। ওকে দেখে গিটার বাজানো তরুণের পাশে বসা ছেলেটি গলা ছেড়ে গায়, পৃথিবী ভিড়েছে সুখের মোহনায়…। এত দরাজ গলা, সেই সুরে সবকিছু যেন ভেসে গেল। তুমিও আবার লম্বা হয়ে আগের উচ্চতায় ফিরে এলে।

সেই রাতে আরেক কাণ্ড। তুমি একটা স্বপ্ন দেখলে। নাকি তা স্বপ্ন নয়? একটি বড় সাম্পান, তুমি সাম্পানের মাইট্টে তেলের গন্ধ পাচ্ছ, ইঞ্জিনের পোড়া তেলের গন্ধ পাচ্ছ, মাঝির ঘামের গন্ধও। কর্ণফুলীতে সাম্পান চলা শুরু করল। তুমি দাঁড়িয়ে আছ মাঝ বরাবর।

মাঝিরা বলাবলি করছে, সুখের মোহনায় যাওয়ার জন্য তারা যাত্রা করেছে। তাদের সাথে জালও আছে। যাওয়ার পথে যদি কিছু মাছ পায় তাহলে ধরে নেবে।

সাম্পান এই ঘাট, সেই ঘাট পেরিয়ে সমুদ্রে ঢোকে। সমুদ্রে তো কোনো ঘাট নেই, অবিরাম চলছে তো চলছেই। কোথায় যাবে এই সাম্পান? প্রশ্নটা তুমি নিজেকেই করো। এই অবারিত সাগরের চারপাশে তাকিয়ে তোমার মনে হয় মানুষের থামার জন্য, একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একটি ঘাট দরকার। কিন্তু সাগরের কি কোনো মোহনা থাকে? মোহনা না পেলে কোথায় ঢুকবে সাম্পান? ওই যে ছোটকালে তোমরা বলতে, অ সাম্পান ক্যাঁ কুরুত/ক্যানে যাইয়ুম বব্বুরুত। তোমার বব্বু অর্থাৎ বড় আপা তো অনেক আগেই মারা গেছে। আর সাম্পানে এখন ইঞ্জিন সংযুক্ত হয়েছে। সারাক্ষণ ঘড়ঘড়, ভটভট আওয়াজ। সোনালি রোদের ঝিলিক আর ঢেউয়ের মাতাল গন্ধের মাঝে আওয়াজটা যেন বলছে, তোমরা বেঁচে আছ। তোমার আরো দূরে যেতে ইচ্ছে করে।

পরদিন সকালে তুমি একটা কাজ করো। তুমি আবার আন্দরকিল্লার দিকে হাঁটতে থাক। একজন থু করে তোমার সামনেই থুথু ফেলে। আরেকটু হলে তুমি লাফিয়ে উঠতে। নালার কাজ চলছে। তোমাকে হাঁটতে হয় রাস্তা দিয়ে।

তুমি ভাব, তাজ সায়েন্টিফিকে যাবে। গিয়ে বলবে, ভাই চশমাটা ফেরত নেন।

জবাবে সেলসম্যান কী বলবে? হয়ত সে একটা স্টিকার দেখাবে, যেখানে লেখা আছে, বিক্রিত মাল ফেরত লওয়া হয় না।

তখন তুমি কী করবে? চশমাটা চোখে লাগাবে। লাফিয়ে উঠবে একটা টেম্পোতে। তুমি কোথায় যাবে? তোমাকে ডাকছে কর্ণফুলী নদী। তুমি হয়ত অভয় মিত্র ঘাটে যাবে। গিয়ে কোনো সাম্পানে উঠবে। সাম্পানটা নদী পেরুতে চাইবে। তুমি বলবে, সাগরের দিকে চলো। বিশাল সাগরে হয়ত ভাইরাস নেই। ভাসতে ভাসতে তুমি বৃষ্টির প্রার্থনা করবে। বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তোমার মনে পড়বে মেয়ের কথা, স্ত্রীর কথা, মায়ের কথা, ভাই-বোন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের কথা।

সাম্পান ফেরাতে বলবে তুমি। সাম্পান ঘাটে ভিড়লে তুমি বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। তারপর হাঁটবে। মানুষের মাঝে তোমাকে যেতে হবে। মানুষের হাসিমুখ, বাসিমুখ, ভালোবাসামুখ না দেখলে তোমার ভালো লাগবে না।

তুমি ভাবছ, চশমাটা খুলে শার্টের বোতামের পাশে ঝুলিয়ে রাখবে। মুখে হয়ত একটা মাস্ক আছে। একটা-দুটা সুতা উড়ছে। জাদু দিয়ে তোমার চশমাটা চিকন করে মাস্কের চিকন সুতায় রেখে দিলে কেমন হয়?

কী করবে বুঝতে পারছ না। তুমি হয়ত নিজের আকার বুঝতে পারছ না। সংকটকালে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়। উলঙ্গ হয় অনেক সত্য। কিন্তু ভয়াবহ ভয় তোমাকে গ্রাস করতে চাইছে। হয়ত ভাবছ, আমার ভেতরের মানুষটা না বাঁচলে আমি কীভাবে বাঁচব? তাই তুমি কাউকে বলতে চাইছ চশমার কথা। হয়ত তুমি খুলতে চেয়েও খুলতে পারছ না। তোমার চোখে সেটা সেঁটে গেছে। মনে হচ্ছে, তোমার ভেতরে মানুষ নেই। কিছুই অবশিষ্ট নেই। তুমি ছোট হয়ে যাচ্ছ, আরো ছোট। ছোট হতে হতে স্মৃতি হয়ে যাচ্ছ।

সেই কোন ছোটকালে নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে সকাল ১১টার দিকে রেলগাড়ির আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে পুকুরপাড়ে যেতে। দেখতে লক্ষ লক্ষ হাতির মতো দাপিয়ে এগিয়ে যাওয়া রেলগাড়িটা। পুকুরের পানি কাঁপত, তোমার পায়ের নিচের মাটিও কাঁপত। তুমি আশ্চর্য এক গতি অনুভব করতে করতে কেঁপে উঠতে। ভাবতে, আমি যদি ওই গাড়ির যাত্রী হতাম, কেমন হতো? ভাবতে ভাবতে তুমি হয়ত আরো ছোট হয়ে যাচ্ছ। কত ছোট বুঝতে পারছ না। না বুঝে হাঁটছ।

হঠাৎ জোরে ব্রেক কষল একটি মাইক্রোবাস। ঠিক তোমার পায়ের কাছেই। আরেকটু হলে পা মাড়িয়ে দিত। তুমি তড়াক করে লাফিয়ে দূরে সরে গেলে। সরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লে ফুটপাতের উপর। আরেকটু হলে মাথাটা ফেটে যেত।

গাড়ি থেকে নামল ওরা চারজন। ওদের চুল ছোট, চেহারা ভাবলেশহীন। তোমাকে ঘিরে দাঁড়াল। তোমার বুকটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। বুঝতে পারছ না কী করবে। ভাবলে, ওরা মনে হয় ভুল করে দাঁড়িয়েছে। তুমি উঠলে। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে।

ক্রিকেট বল ক্যাচ ধরার মতো একজন তোমার হাত ধরে বলল, এ্যাই ব্যাটা, কোথায় যাচ্ছিস?

তুমি বললে, কোথায় যাচ্ছি মানে!

সাদা শার্ট পরা লোকটা তোমার মাথার পেছনে একটা চড় মারল। বলল, চোখ নামিয়ে কথা বল।

কেন? কী হয়েছে?

একজন জিজ্ঞেস করল, হলুদ চশমা পরেছিস কেন?

এই প্রশ্নে তুমি এত অবাক হলে, কী জবাব দেবে ভাবতে পারলে না।

ও বলল, হলুদ চশমা পরা নিষেধ, তুই জানিস না?

না তো!

হলুদ চশমা ধরাও নিষেধ। জানিস না?

তোমার মুখ হাঁ। কোনো জবাব এল না।

তুই নিরাপত্তা আইনের কথা জানিস না?

না।

আরেকজন গোঁফ নাড়িয়ে বলল, আরে ব্যাটা, তুই কীভাবে পাদ দিবি না দিবি সেটাও ওখানে বলা আছে।

 


তুমি ভাববে, পাঁচশ বছর পর এই শহর, এই স্থান কি এ রকম থাকবে? থাকবে না। থাকার কথা না। বহু বহু বছর পর হয়ত এই পথ দিয়ে একটি নদী বয়ে যাবে। সেই নদীর পানি ঝরনার পানির মতো।

 

আরেকজন বলল, তোর বউ হাসপাতালে কাতরাচ্ছে আর তুই চশমা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ছাগল কোথাকার।

আমার বউ বাসায়। আর আমি কেন ছাগল হতে যাব?

তাহলে তোর বউ মারা গেছে।

আরেকজন বলল, শোন, তোর কাছে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। তুই মানুষের মাঝে করোনা ছড়াতে যাচ্ছিলি। ঠিক আছে? তাই তোকে আমরা বাঁচতে দেব না।

কী বলেন!

ঘি বলি। ঘি তোর পাছায় দেব।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কাছে এল। রেগে গিয়ে বলল, তুই কচু জানিস। বলে ঘাড় ধরে তোমাকে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল। বলল, চল আমাদের সাথে। ভালো করে জানতে পারবি।

গাড়িতে তোলার পর তুমি আরেক দফা হতবাক হও। তোমার বোধশক্তি লোপ পেতে থাকে। কী করবে বুঝতে পারো না।

তোমাকে মাঝখানে বসিয়ে দুই পাশে দুজন বসেছে। সামনে একজন, পেছনে আরেকজন। মাথা, মুখ ঢেকে দেওয়া একটা কালো টুপি পরানো হয়েছে। এখন তুমি কিছুই দেখতে পাচ্ছ না। অদ্ভুত এক আঁধার তোমার আশেপাশে। কিছু দেখতে না পারায় মনের চোখ জ্বলে ওঠে। তুমি কিছু দেখার চেষ্টা করো। যদিও তোমার হৃদপিণ্ডটা ঢিপঢিপ করছিল। মনে হচ্ছিল, লাফিয়ে এখনই পড়ে যাবে।

তারা তোমাকে চরকির মতো ঘোরাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ঘোরানোর পর এক জায়গায় মনে হয় থেমেছে। ততক্ষণে তোমার উত্তেজনা, ভয় সব কোথায় চলে গিয়েছিল। এমন এক নির্লিপ্তি, মন বলছিল, দেখিই না কী হয়।

এ সময় তারা কালো কাপড়টা সরিয়ে নেয়। অনেকক্ষণ কিছু না দেখায় ধাঁধিয়ে যায় তোমার চোখ। তারা তোমার মাস্ক, চশমা নিয়ে ফেলে দেয়। চশমা নিতে গিয়ে কানে ছিঁড়ে যায়। তারপর ছোট্ট ধারালো চাকু নিয়ে পেছন থেকে টান দিয়ে কাপড় কেটে তোমাকে উদম করে দেয়। তোমাকে সিরাজউদ্দৌলা রোডের মাথায় ফেলে দিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে মাইক্রোটা চলে যায়।

সেই যে অনেক বছর আগে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব ছিলেন; মনে আছে? ইংরেজের হাতে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েছিলেন। তাঁর দীর্ঘশ্বাস আর কষ্ট তো এখনো রয়ে গেছে বাংলার আকাশে-বাতাসে। হয়ত দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ কানে আসবে। তখন হেসে উঠবে জগৎ শেঠ। তার হাসিটা কান্নার মতো শোনাবে! আর হাসতে হাসতে মাথার চুল ছিঁড়বে মীরজাফর।

তোমাকে ফেলে ওরা চলে গেল। বুঝতে পারছ না তুমি জীবিত কি মৃত। হয়ত তুমি মৃত। মাছের মতো খোলা চোখ। সারা শরীর রক্তাক্ত। জমাট বাঁধতে থাকা টকটকে লাল রক্ত থেকে কয়েক ফোঁটা রস হয়ত গড়িয়ে পড়েছে।

 


শ্যাওলা জড়ানো গা; আশ্চর্য এক জলজ প্রাণীর মতো তুমি। তোমাকে দেখে তারা চমকাবে। কেননা তোমার গায়ে কিছুই নেই।

 

অথবা নিজেকে তুমি জীবিত ভাবো। তোমার হাত-পা বাঁধা। কোনোমতে গড়াতে গড়াতে উঠে বসেছ। আদিম মানুষ যেভাবে বসে চারা রোপণ করে, অনেকটা সুলতানের ছবির মতো; তেমন করে বসেছ তুমি। তোমার কান্না পায়। মুখ লুকিয়ে রাখ মাটির দিকে। তুমি হয়ত ভাবতে পারো, চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়বে। নিচে পিচঢালা রাস্তা নয়, নরম মাটি। পানির স্পর্শ পেয়ে মাটির নিচে একটি বীজ জেগে উঠবে। বীজটি গা মুচড়াবে। মাটির উপরে আসার জন্য ছটফট করবে। তুমি জানবে না তা। জানবে না বীজটি কীসের।

তুমি ভাববে, পাঁচশ বছর পর এই শহর, এই স্থান কি এ রকম থাকবে? থাকবে না। থাকার কথা না। বহু বহু বছর পর হয়ত এই পথ দিয়ে একটি নদী বয়ে যাবে। সেই নদীর পানি ঝরনার পানির মতো। নদীর স্রোতে তুমি সবুজ শ্যাওলার মতো ভেসে উঠবে। স্বচ্ছ জলের ছোঁয়া পেয়ে মাছের মতো জাগবে। বুক ভরে নেবে মিঠেকড়া রোদের মিষ্টি গন্ধ। বাতাসের ঘ্রাণে পাগল হয়ে পানি থেকে উঠে আসবে তুমি। দেখবে, চড়জুড়ে তরমুজ আর বাঙ্গি। তুমি হাঁটবে। পাকা তরমুজ আর বাঙ্গির মন আকুল করা ঘ্রাণ পেয়ে অনেক বছর আগের কোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করবে।

হাঁটতে হাঁটতে তুমি ক্লান্ত। পা আর চলছে না। এক জায়গায় আলে বসে কয়েকজন কৃষক গল্প করছে। তারা তরমুজ, বাঙ্গি কেটে খাচ্ছে।

শ্যাওলা জড়ানো গা; আশ্চর্য এক জলজ প্রাণীর মতো তুমি। তোমাকে দেখে তারা চমকাবে। কেননা তোমার গায়ে কিছুই নেই। একজন হয়ত তার মাথা থেকে গামছাটা খুলে তোমাকে দেবে। তুমি কোমরে জড়াবে। কিন্তু গিঁট দিতে পারবে না। বসে পড়বে তাদের পাশে। তারা তোমাকে তরমুজ দেবে, বাঙ্গি দেবে। খেতে খেতে তোমার মনটা ভরে উঠবে। মনে পড়বে একটি সড়কের কথা। যে সড়কে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মৃত কিংবা জীবিত তুমি বসেছিলে। তোমার পায়ের নিচে মাটিতে একটা বীজ আকুলি-বিকুলি করেছিল। বীজটা কি পৃথিবীতে এসেছে? ওটা এখন বড় গাছ? গাছটা কোথায়? তোমার সেই গাছটা দেখতে ইচ্ছে করবে। তুমি উঠে হাঁটতে থাকবে। মনে মনে গাছটার একটা নাম দেবে।

জুন-জুলাই ২০২০


জাহেদ মোতালেব
জন্ম ১৯৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ধলই গ্রামে নানাবাড়িতে। নিজ গ্রাম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পূর্ব ফরহাদাবাদ। পেশা : সাংবাদিকতা।

প্রকাশনা
গল্পগ্রন্থ : খেলাবুড়া, লাল পা, বিকেল অথবা বাঘের গল্প (অণুগল্প), মারিয়া পালমা
উপন্যাস : রক্তরেখা, অন্যজন, ধানশি, জয়নালের ইতালিযাত্রা
গদ্য : চালতা পোড়া গদ্য, তোমায় বড় ভালোবাসি
শিশুদের বই : লা লা পা পা, মুড়ি বুড়ি, বক মানুষের দেশে, গুপ্তধন, রামানুষ, পোকা বিজ্ঞানী

শেয়ার