স্লেজের শুভ্র বিষদাঁত ।। রেজুয়ান আহমদ

অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার আগ্রহ মানুষের স্বভাবজ। তাই আবিষ্কার আর কৌতূহলের নেশা তার ছুটে গেছে মেরুদেশেও। উত্তর-দক্ষিণ তো জয় হলো। তবু মানুষের প্রশ্ন অশেষ বরফের ফুল হয়ে ফুটতে থাকলো। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর মেরুদেশের রহস্য বেঁচতে লেখা হয়েছে শত-শত বই। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারের সেই বৃদ্ধটিকে মনে পড়ে? কুকুরের সঙ্গে থাকতে থাকতে যার স্বভাবটাও কুকুরের মতো হয়ে গিয়েছিল। আন্তন চেখভের কথাই ধরুন। তাঁর সেরা গল্পের তিনটিই তো কুকুর নিয়ে- বহুরূপী, সার্কাসের কুকুর এবং লেডি উইথ দ্য ডগ। ফ্রেড জিপসনের শিকারী পুরুষ গল্পটির প্রধান না হলেও অন্যতম চরিত্র ছিল একটি কুকুর। শুরুর দিকে যারা উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরু পাড়ি দেয়, কুকুরটানা স্লেজ ছিল তাদের প্রধান বাহন। মেরু অভিযাত্রী স্কটের প্রাণ রক্ষাকারী কুকুরের গল্পও সবার জানা। তবে মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডন অনবদ্য তাঁর ‘কল অব দ্য ওয়াইল্ড’ ও ‘হোয়াইট ফ্যাং’ উপন্যাসের জন্য।

প্রকৃতিবাদী জ্যাক আসলে জন গ্রিফিথ। তাঁর শৈশব কেটেছে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের এক বস্তিতে। একসময় ঝুপড়ি ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে, আর ধার করা টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন পুরোনো একটি জাহাজ, বনে যান ঝিনুকদস্যু। আর সে জাহাজ ডুবে গেলে বাধ্য হয়ে মৎস্যজীবীদের দলেও যোগ দেন কিছুদিনের জন্য। প্রথম জীবনে রাস্তায় পত্রিকা ফেরী করেছেন, রাধুঁনীর সহকারী হয়ে জাহাজে জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, স্বর্ণসন্ধানী হয়ে বুভুক্ষের মতো চষে বেড়িয়েছেন উত্তর মেরুর আলাস্কা, কাজ করেছেন শুঁড়িখানায় বিক্রেতার। ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অনেকবার জেল খাটতেও হয়েছে তাকে। জেল থেকে বের হয়ে তাঁর মনে হয়েছিল,পেশিশক্তির চেয়ে মেধাশক্তিতে শান দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর সেই গন্তব্যে সবচেয়ে বড় রসদ ছিল তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যার ওপর ভর করে তিনি লিখেছেন- ‘আগুন জ্বালতে হলে’, ‘এক টুকরো মাংস’ সহ আরো অনেক অনবদ্য ছোটগল্প।

‘কল অব দ্য ওয়াইল্ড’ হচ্ছে জ্যাকের সবচেয়ে নন্দিত উপন্যাস। লন্ডনের এই লেখাটি ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় একনায়ক তাদের দেশে নিষিদ্ধ করে। এমনকি ১৯৩৩ সালে অনেক দেশে জ্যাকের কাজগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। জ্যাক লন্ডন মূলত এই লেখার মাধ্যমে নিজেকে সমাজতন্ত্রের সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ‘কল অব দ্য ওয়াইল্ড’ এর নায়ক বাক-কে একটি স্লেজগাড়ির সফল কুকুর হয়ে উঠতে দেখা যায়। তারপর এমনকি নেকড়েদের নেতা হয়ে যায় বাক। সে নিজেই হয়ে ওঠে তাঁর ভাগ্যের ভগবান। এ ব্যাপারটি’ই শাসকশ্রেণির কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জ্যাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষেপিয়ে তোলার।

এদিকে একটি কুকুরের দূর্গম উত্তর মেরু থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসার গল্প ‘হোয়াইট ফ্যাং। উপন্যাসটি আসলে ‘কল অব দ্য ওয়াইল্ড’র জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে লেখা প্রায় অনুরুপ গল্পের আরেকটি আখ্যান; যা স্লেজের কুকুরদের নেতা শাদাদাঁতের অপ্রতিরোধ্য কুকুর হোয়াইট ফ্যাঙের। বাক ও হোয়াইট ফ্যাং এক ও অভিন্ন যেন। চরিত্র দুটির মধ্যে এতোটাই মিল যে, তাদের মধ্যে শুধু জন্মান্তরের দূরত্ব রয়েছে বলে মনে হয়। দুজনেই আধা কুকুর আধা নেকড়ে; আর দুজনের ভেতর রয়েছে বাস্তববাদী জ্যাক লন্ডনের ভূত।

হোয়াইট ফ্যাং এক বুনো কুকুর। আবার নেকড়েও বলা চলে। কারণ ওর বাবা ছিল নেকড়ে, আর মা ছিল আধা কুকুর আধা নেকড়ে। উত্তর মেরুর পাহাড়ী গুহায় ওর জন্ম। যেখানে ছয়মাস শীত আর বাকি দিনগুলি বসন্ত। দুটি মাত্র ঋতু। শীতকালে সূর্য ওঠে না। বলা চলে শীতকালে চব্বিশ ঘন্টাই রাত। এমন জায়গায় পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেই জীবন অতিবাহিত হয়। শীতকালে খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব হয়। একটা খরগোশ কিংবা ইঁদুর কী সজারু খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। ক্ষুধার চোটে যেখানে মনিব খেয়ে ফেলে কুকুরদের, আর কুকুরেরাও ফন্দি আটে মনিবকে খেয়ে ফেলার। এমন কঠিন সময়ে গ্রে বিভারের সাথে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা হয়েছিল কিচের। কিচ হলো হোয়াইট ফ্যাঙের মা। বিভার কিচের প্রাক্তন মালিক। কোনো এক সময় ক্ষুধার তাড়নায় কিচ পালিয়েছিল। যখন বিভার খাদ্য সংকটে ছিল। পালিয়ে না গেলে হয়তো বিভারের পেটে যেতে হতো। বিভারের আশ্রয়ে কিচ জন্ম দেয় হোয়াইট ফ্যাং-কে। হোয়াইট ফ্যাং অর্থ হলো শাদা বিষদাঁত। ফ্যাঙের শাদা ধারালো দাঁত দেখে এ নাম দেয় বিভার। ক্ষুধার নির্মম মৌসুমে বাপের আড়ালে রেখে ফ্যাঙকে বড় করতে থাকে স্নেহময়ী কিচ। বড় হয়ে ওঠে নেকড়েরুপী কুকুরছানা।

হোয়াইট ফ্যাং খুব মুশকিলে পড়ে। এই নতুন জন্তুগুলোকে তো আর সহ্য করা যায় না। এরা ক্রমেই মাথায় চড়ে বসছে। হঠাৎ করেই একদিন ওর পায়ে কামড় বসিয়ে দেয় তারা। সাথে সাথেই মাথার ওপর সজোরে একটি থাবা। রাগে ক্ষোভে ওর কান্না চলে আসে। কুকুরের প্রধান শত্রু নেকড়ে। তাই বিভারের দলে থাকা কুকুরগুলি, বিশেষ করে অল্প বয়সের অনভিজ্ঞ কুকুরগুলি ফ্যাঙের উপস্থিতি মেনে নিতে নারাজ। তাই প্রথম থেকেই ওরা হোয়াইট ফ্যাঙের পিছু নেয়। এই দলের নেতৃত্বে থাকে লিপলিপ। লিপলিপ ফ্যাং-কে অস্থির করে তোলে। মানুষের সহযোগিতায় পার পায় ফ্যাং। তাই মানুষের সাথে ওর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মানুষ জন্তুগুলোকে যতো চিনছে সে, ততোই বাড়ে তার বিস্ময়। দোপেয়ে ঈশ্বরগুলো যেমন রাগ করতে পারে, তেমনি পারে ভালোবাসতেও। এদের সব কিছুতে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। এমনকি কেঁটে গেলে রক্তও ঝরে এদের গা থেকে। চুপিচুপি গিয়ে সে চেখে দেখে,মানুষের রক্তের স্বাদও অন্যান্য রক্তের মতোই। ফ্যাং আবিষ্কার করে, মানুষের সমস্ত ইচ্ছের পেছনে রয়েছে শক্তি, যে শক্তি আঘাত হানে। যে শক্তি ঘুষি, গদা, উড়ন্ত পাথর আর চাবুকের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। অবিরাম তুষার ঝরছে। একহাত দূরেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বিভারের যাত্রাস্থল মেকেজি নদী। এবারের যাত্রায় দুটি দল থাকবে। দুটি স্লেজ গাড়ি। একটির নেতৃত্বে বিভার নিজে। আর একটি চালাবে ওর ছেলে। ওই দলে থাকবে লিপলিপ, হোয়াইট ফ্যাং সহ বাচ্চা কুকুরগুলি। লিপলিপ অভিজ্ঞ কুকুর। আগেও স্লেজ চালিয়েছে সে। তাই লিপলিপ থাকবে দ্বিতীয় স্লেজের সামনের সারিতে। লিপলিপ’ই এই স্লেজের দলপতি। এই দলে সাতটি কুকুর। লিপলিপ সবার আগে। তারপর হোয়াইট ফ্যাং। এভাবে পরপর বাঁধা। পেছনের কুকুর সামনের কুকুরের পা আর লেজ ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। পেছন থেকে মনে হবে সামনের কুকুরটি বুঝি পালিয়ে যাচ্ছে। তাই সামনের কুকুরটিকে সব সময় পেছনের কুকুরটি কামড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। এজন্য গতি বাড়াতে হবে। এক’ই সাথে পিছনের কুকুরটিকেও গতি বাড়াতে হবে। এই প্রশিক্ষণ মনিবেরা দিয়ে থাকেন স্লেজের কুকুরদের। যাতে দলের কুকুরেরা দলছুট কুকুরদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে আর তাকে ধরে আনে। অনেকটা সম্মুখযুদ্ধের সেনাদলের নিয়মের মতো। এটি’ই স্লেজের গোপন এঞ্জিন। এবার হোয়াইট ফ্যাঙের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। এ ক’দিনে ও বেশ চালাক হয়ে উঠেছে। কখন পালাতে হবে আর কখন আক্রমনে ঝাপিয়ে পড়া উচিৎ তা শিখে নিয়েছে সে। অন্যের দূর্বল মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, আর সঠিক মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়তে হয়। নিজেকে অনিরাপদ রেখে বিশ্রাম নেওয়া বোকাদের’ই সাজে। প্রতিকূল পরিবেশে অলসতা আর বোকামির আরেক নাম মৃত্যু। এসব এখন ফ্যাঙের জানা। যাত্রা শুরু হয়েছে স্লেজের। হোয়াইট ফ্যাং বারবার কামড়ে রক্তাক্ত করছে লিপলিপকে আর  শরীর দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে।

অন্য কুকুরগুলো ভয় পাওয়া শুরু করে ফ্যাং-কে। লিপলিপ আর ওর পেছনে লাগে না। বরং দূরে দূরেই থাকে। কুকুরদের ঝগড়া হলে শাসন করে ফ্যাং, প্রভুর সম্পত্তিও আগলে রাখে। আর এভাবেই তৈরী হয় মানুষ আর কুকুরের বন্ধুত্বের এক  ইতিহাস। প্রথমবার মনিব বদলের আগে অব্দি আধা কুকুর আধা নেকড়ে হোয়াইট ফ্যাং হয়ে ওঠে মেরুদেশের কুকুরদের দলনেতা। বরফদেশের নিঃসঙ্গ প্রহরে হোয়াইট ফ্যাঙের কেশরে লাগে উত্তরমেরুর উদ্ধত হাওয়া।

শেয়ার