বই: সূর্যের বাজনা
কবি: কিশোর মাহমুদ
প্রচ্ছদ: জাহিদুল হক রনি
প্রকাশক: চৈতন্য
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭
সূর্যের বাজনা
(চুয়াংসমুদ্র এলাচ পাহাড়ে সূর্য বাজনায় খ্যামটা নাচ)
গম্ভীর পাহাড়ের ভাঁজে শস্যের গান প্রাণ আঁকে, আগুন হুল্লোড়, পাথর নাচে উচ্ছ্বাসে, ওরা উড়বে জোছনায়, তারাখচিত ময়ূর ডানা ঝাপটায়, ঝরে রংধনু, মৃত্যুময় আনন্দে গান গায় ঘাস মগ্ন কবরে। জুয়াড়ির কররেখা জলে চলে জাহাজের গতি, কফিনে নাবিকের কঙ্কাল সমুদ্রশীর্ষে উড়ে যায়। শৈবালে জনপদের নকশা ছাপা ছিল, যারা গ্রহে গ্রহে গচ্ছিত রাখে উৎসব উত্তরপুরুষের
ধর্ম আফিমে, আঙুর ক্ষেতে ঘুমিয়ে পড়েছে যে পশুজীবী, লাঙল ফলায় গেঁথে দাও, রক্তলাভায় গলে যাক তীর্থভূমি, যে গোপনে পেতে রাখে কারাগার
রাস্তা, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ফেলে যাও, যার কামনায় দোল খায় রাজকন্যার হিরাবরণ। গোপনে সে গোসল করে ঝরণায়, ছিটকে-আসা ফোঁটা দেহপূর্ণ তৃঞ্চায় কাঁপে, সোডিয়াম বিভ্রমে যৌথ প্রেমিকার পথে হাঁটি, আপেল ঝগড়া থেমে যায় দূরের ফ্ল্যাটে
তোর হাসির চাতুরিতে ফোটে ডিজেলফুল, তেলপাখির ছায়া, আমাদের অবিশ্বাস প্রেমে ছড়ায় সুবাস, ক্লান্তির। যে স্থবির দালান, হয়রান পাখনার খোঁজে, অন্ধ ভিখারি লম্পট বিষাদ বোনে পালকে, পাহাড় ওড়ে মুগ্ধতায়, পশমে সূর্যের উল্লাস
হাসে ঝাড়লণ্ঠন নরকের আলো, স্বর্গীয় ইশারায় দূরে ভাসমান পার্লার, কৃত্রিম সংকেতে ডাকে, কত শতকের রূপ খসে পড়ে মশলার বনে। সুরা-শরাবের বাগিচায় দাস পৌরুষের বীর্য, শিকলের গিঁট খুলে ভাঙে বসনের তিক্ততা ঢেউ, আকাশপাড় দিগন্তে ভেজায় ফাঁসিকাঠ
ইশারায় মায়াবি ভুলে, সৈকতে ফেলে গেছো হ্রেষাসংগীত, সে মূর্ছনা বিস্মরণে কারিগর, গরাদের লোহা গেলে বানিয়েছে চাকা
উড়োজাহাজি, পারো স্থির ডানায় ভাঙো ভাসা বরফের চাক, কুচি শীতল শব্দে পান করি পুঁজ পচা মাংসের নদী। আর তোমরা গোসল করো আরব্য ঝরনায়। নিগ্রো শিশুর চোখে পোড়ে সভ্য সফলতা, যার ত্বকে শাদা ভবনের ছায়া
ওই যে শাদা তুলা, সুতার বাণ্ডিল, তুষারের ভারে ঝরে, ঠাণ্ডা অশ্রুধারা মরুতে বোনে সমুদ্রবীজ, তাকে পুলসেরাত পার করে দাও। চুলে অনেক আগুনরাত ঝুলে আছে, ছেঁড়া পোশাকে চোখ পেতে দেখেছি মেদহীন উজ্জ্বলতা
কারখানা চাকা সূর্য মেশিন, ঘামসমুদ্রে ডুব দিলে, পৃথিবী আলোর প্রপাতে হাসে, অবিরাম ব্যস্ত কাজে, চাঁদবুড়ির চোখ থেকে নেমে আসে ক্ষুধার্ত বাঘ
এক হাজার একরাত ভোর হলে পরির সাথে খেলা করবে আমাদের শিশু
মা আমার সন্তান যেন বাঁচে মদ মাংসে
হরিণাস্ত বেলায় সুন্দরী মা
শ্যামলা জলে হরিণের লুটোপুটির মতো হাসে দুধের শিশু, তুমি তাকে কোলে নাও, বুকে তোলো, নাভীতে নামাও, ফিরিয়ে নাও যোনিপথ ধরে। বনের গভীরে যারা বসাবে আলোর মেশিন, বনময় ফিরছে তাদের চাকা।
আবার যখন হরিণোদয়ের বেলা, কাঁচা পায়ের চুমায় আদর জাগবে বনে, দুধের শিশু ফুলের বেশে বাতাসে দোল খাবে, তাদের সুবাস জমাট হবে হরিণের নাভিমূলে
এখন প্রবল বিদ্যুতায়িত খুরে খুন হইছে সুন্দরী মা-র ছেলে, সোনার জলে হরিণ অস্ত যায়
কয়লা আকাশের তলে
কয়লার ফুল
কয়লার ফল
কয়লার পাখি
কয়লার মতো শব্দ শোনা যায়।
সুন্দরী মা’র কান্না শুনে ভাঙছে বাঘের ঘুম
সমুদ্র তারে পাঠাইছে এবার তরঙ্গে শানানো দাঁত
মা তোমার দুধের শিশু বুক পেতে ধরছে
বজ্রপাত
টিনের জাহাজ
আর ততদূর দেখাবে না পাতার দুরবীন
সূর্য-চাঁদ-নক্ষত্র-মাছ-পাখি-শাদামেঘ-কালোমেঘ
দিনরাত মেখেছো চামড়ায়, বাতাস রেখেছো লোমকূপে,
জল বিলি কেটে করেছো বাণিজ্যবিস্তার, সবুজ
সোনালি-রূপালি-লাল-নীল দ্বীপে দ্বীপে
সে নকশা হারিয়েছো
জোয়ার থেমে আছে সাবান ফেনায়
উত্তাল ধীরে ধীরে হয়েছে স্থির
বন্দর-রূপসীরা বিস্মৃতি খুলে রেখেছে ঘাটলায়
রূপ লুকিয়ে রেখেছে শ্যাওলায়
তাদের কচি দুধে বিঁধেছে হাঙরের দাঁত
আর তত দূর দেখাবে না পাতার দূরবীন
ভুলে যাও মৎস্যমেয়ের চোখ
ভুলে যাও কাঠের মাস্তুল
হে নাবিক, তোমার মরিচা পড়া টিনের জাহাজ তুলে
রাখো
বেশ্যালয়
পৌত্তলিকতা ভালোবেসে
কত দেবীর দেহে ফুল তুলেছি
ত্রিশূল
কত দূর বিঁধে আছো
পুুরুষের ক্ষুধা থেকে উৎসারিত পশুর পাল
খুরে ধাবমান মৃত্যু গেঁথেছে লালে
মাটির বাসনা খুঁড়ে দেখেছি কঙ্কাল
বাৎসল্য ভেঙে মাংস বুনেছি
খড়ের কাঠামো জুড়ে
আরো ধাবমান মৃত্যু ফুঁড়ে
কত দূর বিঁধেছ ত্রিশূল
লাল আরো সশব্দ হয়
এই তরঙ্গময় জবাফুলে
পবিত্র উপাসনালয়
দেয়ালে চিত্রিত শীৎকার
যেন পুরুষেরই ক্ষুধা থেকে উৎসারিত পশুর পাল
ছুটছে অসীমে
বসন্ত ফিরিয়ে আনে অস্ত্র মাজার দিন
পুরুষের বিষণ্নতায় প্রস্ফুটিত আকাশ, তোমার পথ
ধরে যারা অস্ত্র নামায়, তাদের তৈলাক্ত ইশারায়
মরুবসন্ত করুণ হয়েছে। নিহত বন্ধুর পাশে
পুরুষের অশ্রুপাত, আর তুমি তারপিন-দাহ্যতায়
কামনা করো ঝুলে-পড়া নারীত্ব নিয়ে কেউ খেলা
করুক। আমার কেবলই মনে পড়ে কৃষকদের কথা
তাদের ভাঙাচোরা কৃষিযন্ত্রের কথা, মনে পড়ে
নর্দমায় সাঁতরানো ভ্রুণ, আজ কোন মাঠে রোপণ
করো রক্তবীজ?
পরিণতিহীন লক্ষ্যে দেহতে বন্দি দেহ তোমাদের,
পণ্যায়নের হ্রদে ডুবেছে সজ্জিত মুখ, তারপিন
দাহ্যতায় আদরের মাংস খসে পড়ে। খুলে
লজ্জাকরুণ ঘের বসন্ত ফিরিয়ে আনে অস্ত্র মাজার
দিন, মাংসল ফুলে ফোটে প্রিয়তম বেশ্যার মুখ,
মুঠিতে চেপে-ধরা পিস্তল থেকে ছিটকে যায় কত
রেশমি ঘোড়া
তারা কি ভুলেছে, লোহাবোঝাই কত অরণি কাঠের
ক্যারাভ্যান ক্রমাগত সূর্য ভেঙে গেছে সময়হীনতার
দিকে
বসন্ত ফিরিয়ে আনো পিস্তল মাজার দিন
খোঁজ
(নুরী চান’কে)
ঘননীল ময়ূরীর সাথে সন্ধ্যা হয়েছিলাম
পশ্চিমে তার হাসি নিভেছে পূর্বেকার
ধীরে ডানার ডাকে উজল হইছে চাঁদ
ঝলমল কইরছে সোনাইল ফুলের হার
গাঢ় অঙ্গে খেলছে আমার চোখ
আঙুল পেঁচিয়ে যাচ্ছে চুলে
আমাদের দেহ ডুবে যাচ্ছে ফুলে
ঘাটলায় তখন থেমেছে বাসন মাজার হাত
তারার সাথে খেলছে মাছের দল
জলের মতো ছিটিয়ে পড়ছে আলো
ওই যারা বকুলতলে বাজায় ঢোল
মন্দিরা
করতাল
তাগোরও কাজ ফুরায়া গ্যাছে বুঝি?
নেচে নেচে চাঁদের নিচে আমি আমার ময়ূর খুঁজি
ভাঙা শঙ্খের দ্বীপ
কুরূপার বিষাদে ভরেছে আকাশ
তারা নয়
গণনারহিত লাশ ফুটে আছে
মৃত চোখ দেখে বিষাক্ত শরীর
বাতাসে ছোবল মেরে
হয়েছে নিথর
উঁচু মেঘের মিনার যদি তুমি
শূন্যে সমুদ্র বানাও
অনন্ত গর্জন ভুলে চুপ হয়ে যাব
রক্ত ছুঁয়ে ফিরে যায় বিষণœ জল
প্রবল সূর্যপ্রবাহে
গলে যায় বরফের ডানা
রেবতী রুবাই
ফিরব না, ভাঙা শঙ্খের দ্বীপে
কালো জাহাজের উপকথা: পর্ব এক
(বন্ধু শাফিনুর শাফিনকে)
বসন্তে মুখরিত প্রাচীন জনপদ, তার মুখশ্রী-ছিঁড়ে-আসা ক্রন্দন নিয়ে ঘুমিয়েছো, ঘুমে শুশ্রুষা নিয়ে জাগছে যার বাতাসে-বোনা মুখ, তুমি কি তাকে অস্বীকার করো?
অস্বীকার করো তোমার দু-হাত ভরেছে তারাবাইন মাছে? পুরুষ-লাঞ্চন তোমারই আত্মা চিরে আসা রিরংসা, সকল প্রেম ছিল হারানো জাহাজের
নক্ষত্র ফোটার আগে-খুলে তরঙ্গশিকল, সুমহান মাতালের মতো আপন মুখশ্রী আমিও করেছি পান। কালো কালো নাচে জেগেছে কাঠের পাতাটন, জং-ধরা সে স্বর যারা ফিরিয়ে আনো এই শস্যতীরে
ফিরিয়ে আনো শ্যাওলায়-ঢাকা ক্ষতচিহ্ন সব ক্ষুধায় উৎপাদিত আরো অধিক মুনাফা আকাশে— শোনো, উল্লাস ছিল কালো জাহাজের, ক্ষুধা ছিল না, ক্ষুধার স্বপ্ন ছিল মনে
তবু আজও তোমার দেহের মতো অবিকল জাহাজেরা নোনা বন্দর ছেড়ে যায়
কালো জাহাজের উপকথা: পর্ব দুই
দেবায়ন ঘিরে যার নয়নের নকশা-করা অন্ধকার, তার আত্মা খুঁড়ে যত কঙ্কাল ভেঙেছি, তাদের কোটরে ছিল শাদা বন্দর। বিউগল থেকে দূরে তোমার অন্দরে নোঙর করে যার বিস্মৃত হাসি, তার মুখের মতো নির্জন এই বনেদি কুটির যে লাফাঙ্গা আজও শিস ছুঁড়ে দেয়, তার আত্মার মতো বিষাক্ত হয়েছি তোমার ঘোলা চোখ দেখে
মেঘ মেঘলায় নিমজ্জিত কুটির, নেশায় চুর হয়ে কক্ষ-কক্ষান্তরে খোদাই করেছি বেণীবাঁধা তা তা থই থই দিন। ব্যালকনিতে কুসুমিত জল, জলে ভাসমান বিউগল, আধডোবা দূর্বায় পিঁপড়ের চলাচল, তারও বেশি নৈঃশব্দ্যে শোধিত কাঞ্চাতনে হলদে শিহরণ ছিল
কত তর্জনী উপেক্ষা করে ফুটেছে রক্তফুল, সুরভিত উরুর হিল্লোলে তুলকালাম জলাধার, তার বাষ্পায়িত বাসনায় মেঘ আরো সজল হয়েছে
ছড়ানো শঙ্খের দ্বীপে, ভুলে শীস হারানো ব্যথা, তুমুল পদধ্বনির মতো বৃষ্টিতে ভিজে আরো কত রূপকথা কল্পনা করা যায়, সেসব কথার মতো সজ্জিত বনেদি কুটির, যার নয়নের নকশা করা অন্ধকারে নিমজ্জিত, আমি তারই অতলে তলাই
আজ কোথায় রে লাফাঙ্গা তুই, হারানো জাহাজে ভেঙে আলোর কঙ্কাল, কার শয়নভঙ্গির মতো শাদা বন্দর, তোকে ফিরিয়ে দেয় করুণ সাগরে, আয় শীস দেই
রূপকথা-দুই
তরঙ্গ তার ক্ষুধা বয়ে আনে
খণ্ড স্বর্ণের চাঁদ মাংস ভেবে
রাতের নদীতে ডুবেছে যে বাঘ
তাকে পাড়ে ডেকে আনো
মধুমাখা ঘাস খেতে দাও
ও হরিণ, এসেছি লোকালয় থেকে
এ গল্প নিয়ে যাব
সবুজ ভূমি চিরে লাল নদী
যেখানে মাটি খুঁড়লেই হাড়
যদিও তাদের মাংসের পাহাড়
ওই বরফের দেশে
এ বনে আসার পথে, ফুল
পায়ের তলায় গুড়িয়ে গেছে ঘ্রাণ
মচমচে বিষণ্ন সুরে
ও হরিণ, বনে বনে হাড় খুঁজে ফেরো
এ গল্প শোনাব যাদের
তারাও মাংসলোভী
দেখ, চোখ হিম
বরফদেশ থেকে আসা ও বাতাস
লেগে ঘাসে কাঁপছে অন্ধকার
ও রূপশালী চামড়ার পোশাক
চোখে করে নিয়ে যাব
কস্তুরী গন্ধে মাতোয়ারা
যে জনপদ জাগে ফসলের ঘ্রাণে
পাটায় শিং ঘষে, তারা শিশুদের মুখে দুধ তুলে দেয়
নাচে-গানে তাদেরই নিয়ে যাব বসন্তের দিকে
ও হরিণ খণ্ড স্বর্ণের চাঁদ ডুবে যাক মাংসপাহাড়ে