অপেক্ষা করেইছিলাম। যে-কোন দিক থেকেই আহত হবার সম্ভাবনা নিয়ে পাঠ করতে বসি — সুখী ধনুর্বিদ। পাঠের আগেই আমাকে যে-ভাবনা পেয়ে বসেছিলো তা হলো, শিকারের আনন্দ কি কেবল কবি একাই পেতে চান, না পাঠককেও তার অংশীদার করে নিতে চান? রাসেলের কবিতা সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম ধারণাও আছে তারা জানেন, তার কবিতা পড়তে গিয়ে অন্তত ক্লান্তির মুখোমুখি হবেন না, তিনি আপনাকে আঘাত করবেন, আপনার চিন্তায় ছুড়বেন বান। কিন্তু আপনি ক্লান্ত হবেন না। কোনো কোনো আঘাত আপনাকে বাঁচিয়ে তুলবে। আপনার মনোজগতে ও ভাবনায় তার চিন্তা প্রবিষ্ট করে দেবে। আপনাকে নিজের সংগে পরিচয় করিয়ে দেবে। যাকে আপনি চিনিতেন না।সিনেমায় দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি একসময় প্রচণ্ড আঘাতে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। চিকিৎসায় কোন কাজ হয় নি, হঠাৎ অকারণ আঘাতে স্মৃতিশক্তি ফিরে পায়। রাসেলের কবিতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অতীত। পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের সংগে নিজেকে। রাসেলের চিন্তার পথ ধরে নিজের রাস্তা খুঁজে পাই। কিন্তু তিনি চিন্তক নয়, কবি। আমাদের বিশ্বাসের মূল্য তিনি জানেন। জানেন আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি সম্পর্কেও। তার কবিতা অকারণ আঘাত নয়। তিনি জানেন কোন দিক থেকে ছুড়তে হয় বান। বিশ্বাস, অপবিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতা মিলে অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে জ্যোতিষবিদ্যা।অর্থাৎ তার বইয়ের প্রথম কবিতা, জ্যোতিষবিদ্যা, আপনাকে নানাভাবে আহত করবে। আপনি বালক থেকে হয়ে উঠবেন একজন ইতিহাস সচেতন পুরুষ। সেখানে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না, যখন দেখবেন আপনার সম্মুখে পুনরাভিনীত হচ্ছে ইতিহাস।
মিরন যখন সিরাজকে আঘাত করছিল, তখন সিরাজ ঠিক কোথায় তাকিয়ে ছিল :
— মিরনের হাতের দিকে, নাকি লক্ষ অভিব্যক্তিময় মুখের দিকে
আপনার সামনে যে-মুখটি ভেসে রইবে তার দিকে খুব ভালো করে তাকালে যা দেখবেন তা আপনাকে স্থিতি দেবে না।বরং হয়ে উঠবেন অস্থির। নিজের সম্মুখে যে গোপন আয়না ধরে রেখেছেন তার দিকে তাকালে দেখবেন– এক ক্রীতদাসের মুখ! ইতিহাস ক্রমাগত আপনাকে নিয়ে যাবে বাংলা ছাড়িয়ে সুদূর আফ্রিকায়, এক রহস্যের দেশে। কিন্তু সেখানেও মিলবে না মুক্তি।এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসবেন এক পরিনতির দিকে। কমলায় চোখ রেখে দেখবেন পৃথিবীর সবচে করুণ সেই দৃশ্য, যেখানে কমলালেবুর এক পাশে রাজার মুখ অংকিত, অন্যপাশে ক্রীতদাসের।মানুষের নানা বাতিক থাকে। সেই সব বাতিকের ভেতরেও থাকে বোধের নানা স্তরের পরিচয়। ‘ ইজিপশিয়ান কুইনের পোট্রেটে’র দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ দেখার অভিজ্ঞতা নেহায়েত অপ্রাপ্তি নয়। কিন্তু সে মুখ ক্রীতদাসের।
‘ইজিপশিয়ান রানীর হাতেও সেই আপাত অদৃশ্য কমলালেবু।… একটিতে রাজার মুখ অঙ্কিত। আর অন্য মুখটি আমার মতো দেখতে কোনো ক্রীতদাসের’
এই সব দেখতে দেখতে আমাদের মানসভ্রমণ এগিয়ে চলে। যেই মুহুর্তে নিজেকে ক্রীতদাস ভেবে হাঁপিয়ে উঠছেন, আপনাকে পেয়ে বসেছে ভয়, যখন আপনি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত, বিমর্ষ, তখনি দেখবেন তিনি আপনাকে নিয়ে গিয়েছেন এক অলৌকিকতার জগতে। কিন্তু তা খুব লৌকিক। দেখি তিনি আমাদের কোথায় নিয়ে যান।
‘রোজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে মহান ইমরুল কায়েস আসেব। আমরা গল্পগুজব করি। আমি মূলত শ্রোতা।
তিনি বলেন। বারান্দার গ্রিল বেয়ে সন্ধ্যার প্রভাবে ঈষৎ লাল যে রজনীগন্ধার ডাঁটা উঠে এসেছে ,
তিনি আমায় বলেন তাকে স্পর্শ করতে। আমি স্পর্শ করি’
অলৌকিকতা আর অলৌকিকের ভিন্নতা আপনি টের পাবেন আরও পরে। কায়েস আর তার শ্রোতার আলাপ এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের আলাপের প্রসংগ রজনীগন্ধার ডাঁটা ছাড়িয়ে সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে গাছে পানি ঢালার শব্দে এসে স্থির হয়। ঠিক সে মুহুর্তটাকে অনুভব করুন, কান পেতে শুনুন : পৃথিবীতে কেবল জল পতনের শব্দই শোনা যাচ্ছে! আর কিছু আপনি ভাবতে পারবেন না।
: সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে এই মুহুর্তে পানি ঢালছে গাছে, টের পাচ্ছ না? পারফিউমের ঘ্রাণ মুখস্থ হয় নি এতদিনে!’
আপনার নাকে এসে লাগবে সুবাস; স্পষ্ট অনুভব করবেন সেই ঘ্রাণ। কায়েস আপনাকে আপনার ভেতর থেকে বের করে আনবে , যাকে স্বীকার করতে আপনার বাধবে! সবুজ রং জীবনের প্রতীক। যৌবনেরও। কায়েস জানেন আপনি সেই মেয়েটার প্রেমে পড়ে আছেন। স্বীকার করতেই ভয়।
: নিশ্চয়ই জানো যে, মেয়েটির স্বামী ছয় মাস ধরে বাড়ি আসছে না?… তাও অজানা! স্বামী আসলে রজনীগন্ধার ডাঁটা এই বারান্দায় উঠে আসত?’
ঠিক এই মুহুর্তে আপনি যে ধাক্কা খাবেন তা সামলে উঠা প্রায় অসম্ভব। রজনীগন্ধার ডাঁটায় মেয়েটার কামচেতনা ধীরে ধীরে আপনার দিকে আসছিলো। আসলে সেই রজনীগগন্ধা ছিলো আপনার লোভ। আপনি বুঝে যাচ্ছেন কায়েস জেনে গেছেন আপনাকে। আরও বিস্ময় তখনও অপেক্ষমান ছিলো।
:আর জেনে রাখো গূঢ় রহস্য , আমি তার স্বামী। বছরের পর বছর আমি নারীদের দাঁড় করিয়ে রাখি বারান্দায়। আর উপরে বসে তাদের গাছে পানি ঢালার শব্দ শুনি। পানিও জিকির করে তখন। সে জিকির পাঠের মাধ্যমে আমি আমার আয়ু বাড়িয়ে যাই , বেঁচে থাকি’
ইমরুল কায়েসের আয়ু নিয়ে আমরাও এগিয়ে যেতে থাকি ‘পুলসিরাতে’র দিকে। হাত আর পায়ের নখে বহন করছি জান্নাতের স্মৃতি। আমাদের ভুলে যাওয়া অতীত। পুলসিরাতের অপর পাশেই সেই হারানো বাগান। যেখানে ‘ উড়ন্ত হিরের ঘুঘু নেমে আসছে কমনীয় ভঙ্গিতে, চাইলেই তারা কাঁধে বসতে প্রস্তুত। প্রস্তুত ধীরলয়ে গাইতে অশ্রুতপূর্ব সঙ্গীত…’
কিন্তু পৃথিবী সঙ্গীতমুখর নয়। আমাদের নিত্যদিনের সমস্যাকবলিত পৃথিবীতে সংগীতের স্থান ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। পৃথিবী হয়ে উঠেছে এক ‘সার্কাস’। দর্শকের সারিতে নিজেকে রেখে যেখানে কখনোই উপলব্ধি করা যায় না কিছু, কেবল বিভ্রম বাড়ে। আমাদের বিভ্রান্তির সমানুপাতিক হারে যাদের জীবিকা সংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।আমাদের হাততালির ভেতর তাদের জীবন তলিয়ে যেতে থাকে। আধুনিক সমাজের দায় বহন করে করে আমারও ভেঙে পড়ি।জীবিকা খেয়ে নেয় আমাদের জীবন। রাসেল এই সত্য খুব ভালো করে জানেন।
তার কবিতা বস্তুনিরপেক্ষ নয়, আবার বস্তুর কাছে উৎসর্গীকৃতও নয়। তিনি কোন মতবাদ প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে আসেন নি। কিন্তু জীবনের দায়কে আত্তীকরণ করেছেন কবিতায়। তিনি এটাও জানেন কবিতা তত্ত্ব নয়। তাই তিনি আরও এগিয়ে যান। পাঠককেও দেন ‘নিরাময়ে’র আস্বাদ।
‘সে বাঘের-দাঁতবিদ্ধ — পাহাড়ফেরতবৃদ্ধ ফেরি করে মন্ত্র নিরাময় তার যেন পরজন্মে পূর্ণ জ্ঞানে-গম্যে তোমার আগেই জন্ম হয়।’
কিন্তু কবিতার শেষে এসে যখন পড়ি: উরুকে কুর্নিশ করা সাধ্যস্তীত শুঁড় নুয়ে আছে… ঠিক সেই মুহুর্তে ভাবছ , যুদ্ধে ঢাল অপেক্ষা অধিক আঘাতপ্রাপ্ত আর কে কে থাকতে পারে… — ‘আমি’ ”
এই আমিটাই প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষ। রাসেলের কবিতা সেই মানুষটির কথাই বলে। যেখানে একজন মানুষ রক্তবীজের মত বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। যাকে স্পর্শ করে যায় জীবন -জীবিকার-দায়-প্রেম-ভয়-আধ্যাত্মবাদ। যে যাপন করে নিজের জীবন, আবার অন্যেরও। আমাদের ভেতর যে জগত রয়েছে সেখানে অনেকের বাস। রাসেলের কবিতা আমাদেরকে সেই ‘আমাদের’ সংগে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘মনোপলি’ কবিতায় তাই দেখি’ যেখানে মুত্তিয়া মুরালিধনের মত দেখতে কেউ একজন দাঁতের মাজন বিক্রি করে, ফ্রিদা কাহলোর মত কাউকে দেখা যায় বাগেরহাট স্টেশনে স্যাক্সোফোনের মত বাদ্যযন্ত্র বাজাতে। আমাদের ভেতরের রাসেল হিব্রু ভাষায় লেখে ধর্মগ্রন্থ।
কবির ভাষায়:… রাসেল জানে, হিব্রু ভাষায় ধর্মগ্রন্থ লিখছে আরেক রাসেল, ইসরায়েলে’
ইসরায়েলের কথা এলেই মনে পড়ে ফিলিস্তিনের কথা, রাসেল না বললেও আমারা জানি আদতে রক্ত দিয়ে আধুনিক ধর্মগ্রন্থ লেখে যাচ্ছে ফিলিস্তিন।
দুই লাইনের ‘প্রতিশোধ ‘ কবিতায় শরনার্থী সমস্যার কথা ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন আধুনিক বিশ্বের সংকট। যদিও কবিতার ভাষা উচ্চকিত নয়।
‘মাছ হয়ে জন্মাইনি, তাই
শব হয়ে জলে সাঁতরাই।
আমাদের মনে পড়ে আয়লান কুর্দির কথা। সেই বাচ্চা ছেলেটি যার ভূমধ্যসাগর তীরে সলিলসমাধি সমাধি ঘটে। সে মরে গিয়ে বেঁচে গেলেও জাতিভেদে বিভিক্ত মানুষের বিভাজন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ‘সুখী ধনুর্বিদে’ আটত্রিশটি কবিতা আছে। যার সবগুলোই কবিতা। সচরাচর যা ঘটে, বেশির ভাগ কাব্যগ্রন্থে খুব কমই কবিতা পাওয়া যায়। যদিও কবিতার মত অনেক লেখাই থাকে, যা কবিতা নয়। মানুষের ভাষা দুই ধরনের। কবিতার ভাষা আর অকবিতার ভাষা। রাসেল আয়ত্ত করেছেন কবিতার ভাষা। আয়ত্ত করা শব্দটা ঠিক তার জন্য প্রযোজ্য নয়। নদীর স্রোত যেমন বয়ে চলে তেমনি রাসেলের কাব্যভাষাও স্বতস্ফুর্ত, স্বাভাবিক। আর কে না জানে স্বাভাবিকার মত আর কিছু নিয়ে।
ধনুর্বিদের প্রসংগ এলে আমাদের মনে পড়ে অর্জুনের কথা। সেই মিতভাষী, ন্যায়বান পাণ্ডবের কথা, যিনি দ্রোনাচার্যের তুষ্টিসাধন করে তাঁর থেকে লাভ করেছিলেন ব্রহ্মশির নামে এক অমোঘ অস্ত্র। আর দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় চক্রমধ্যে মৎস্য লক্ষ্যবিদ্ধ করে তিনি তাকে লাভ করেন। তার ন্যায় ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী কেউ ছিলো না।কিন্তু তিনি সুখি ছিলেন তেমন কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে কি?
এই জিজ্ঞাসা সামনে রেখে যখন পড়ি: পদক্ষেপ ধীর করো। আরও ধীর। প্রলম্বিত লয়ে ডেকে যাচ্ছে ক্ষীণ যে ঝিঁঝিঁ, তার ভাষা বোঝো। সেই সুখী ধনুর্বিদ হও, তির ছোড়াতেই যার সমূহ আনন্দ।
………….
মাছের চোখের বদলে যার তির বিদ্ধ করে রমণীর হৃদয় সেই সুখী ধনুর্বিদই সাক্ষাৎ পাবে এই সুফির সুবেহ তারা, তার আগে প্রকাশ করো সেই ম্রিয়মাণ মাহুতের নাম’
তখন আমরাও বুঝি অর্জুন আসলে নারীর হৃদয় জয় করেছিলেন। আর রাসেলকে দেখি তিনি আর অগ্রসরমান, আনন্দের উৎসারণই যার আপাত লক্ষ। আমরাও সন্তর্পণে তার সংগী হতে চাই। আর কে না জানে কবির সত্যিকার সংগ পাওয়া যায় কবিতায়। তার কবিতা আনন্দের বার্তা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে পাঠকের, আর এও জানি কবিতার রস আস্বাদনের পর পাঠকই অন্বেষণ করবে সুখী ধনুর্বিদের আস্তানার — যেখানে কবির ভেতর খোঁজে নেবে সুফিতত্ত্বের মন্ত্র। আদতে কবিতার।