‘সাড়ে তিনশ’ বছর’ বইয়ের কবিতা | বীথি সপ্তর্ষি

মানুষ

 

শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বেদনা জমেছে বিশদ
তার সব ছেনে তুমি এখন বুনছ কামনা
যতটা বেদনা ঢেলে মসৃণ করেছ শিয়র
তার চেয়ে কিছু কম উত্তাপ
এই শীতে গৃহহীন লোকেরা পায়,
তারপর ছেড়ে চলে যায় অন্যখানে, নতুন সন্ধানে।

যে চুমু চেয়ে চেয়ে বহুকাল আগে-
রুমালে জল ঢেলে মুছেছি যোনি ছেঁড়া দাগ,
এঁটো ঠোঁটে চুমু বাকি রেখে,
তারাদের কানাকানি ফুরাল যখন
শোধ দিতে এসে দরজার বাইরে একমনে চাপছ কলিংবেল।
ঘরে নেই কেউ, বারান্দার টবে শুধু ফুলকপির কঙ্কাল।

নির্জন দ্বীপে একা যতবার খুঁজেছি মানুষ
তুমি থেকে গেছ গাছেদের দলে,
আরো বেশি করে গেছ একা,
পাখিদের গলায় গেয়ে গেছ গান।
আগুনের-বিজলীর শিকারীরা সন্ধান পেয়ে
এসেছে তখন সংসারসহ লোকালয়ে নিতে।

তুমি এসেছ তখনি প্রেমপত্র হাতে,
হাঁটুগেড়ে বসে চেয়েছ নি:সঙ্গ মানুষের হাত,
নি:স্ব মরুবন, বেড়ালের চোখ, কুমারীর স্তন।
যাবতীয় রাস্তা ফুরাল, আজ এই রাতই তবু শেষ রাত
এখনই ঘরে না গেলে ঝরে যাবে পৃথিবী অচেতন
মানুষের ভিড়ে এখন তোমারও একা হয়ে যাবার মৌসুম।

 

 

 

জন্মদাগ

 

আপনাদের মতো আমিও হেঁটে আসিনি পৃথিবীতে

মায়ের গর্ভে পৌঁছুতে দীর্ঘ-ক্লান্ত রাত্রির অবসর আমিও নেই্নি

আমার পায়ে তবু লেগে আছে জন্মদাগ।

মাননীয়া, আজ সে গল্প শুনতে হবে আপনাদের

শিথানে আরামের স্বপ্ন দেখবেন বলে

ছেঁড়া যোনী-বিক্ষত স্তনবৃন্ত অনায়াসে এড়িয়ে যান

তাতে কি তলপেটে ফোলা কিছু কমে,

রক্ততঞ্চন, ফাইব্রিজালের রূপান্তর কিছু ঘটে?

অথচ ভাবেন তো, এই স্তন জন্মাতে পারত আপনার বুকেও

আপনার সন্তানের ক্ষুধায় এই নিরূপায় স্তনের অর্ধেকটা

পড়ে থাকতে পারত যে কোন খাল অথবা ক্ষেতের ধারে,

এই লেবিয়ার টুকরো ছায়া দিতে পারত আপনার সন্তানের পথেও।

আপনি পাঁচ তারকার নাশতার টেবিলে বসে তাকে অগ্রাহ্য করে-

সারাদিন সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করে সারিয়ে তুলতে পারতেন?

মাননীয়া, এইসব ক্ষত সারতে ওষুধ লাগে

ডাক্তার, নার্স, রক্ত, প্রেসক্রিপশন, পয়সা আর

লোকের ছি:কার শোনার হিম্মত লাগে।

অথচ, আমিও আপনারই মতো জন্মেছিলাম

দশ মাস দশ দিন নির্ঝঞ্জাট বেহিসেবি যাপন শেষে

একই হাত পা, একই ফুসফুস আপনার মতো; আমারো।

তবু আমার- পায়ে লেগে আছে জন্মদাগ!

জন্ম-মৃত্যুর রজতরেখা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে আমারই পাড়ায়

এই কঁকিয়ে ওঠা রৌরব আপনার দূ:স্বপ্নেও না আসুক।

গ্রীবা, কণ্ঠ, বিত্ত, নখ-দন্তদহীন কাতর একটা মহল্লা পুড়ে ছারখার হয়ে যাক

আপনাদের রিপোর্ট, ফান্ড, কর্মসংস্থান বাকি রয়ে গেছে।

পায়ে জন্মদাগ নিয়ে জন্মেছি, আপনাদের প্রয়োজনেই

হেঁটেহেঁটে সে দাগের প্রায়শ্চিত্ত করে যাব।

 

 

 

পথ

 

ফেরার কথা বলে পথ হারিয়ে বসে আছি অজোয়িক যুগ থেকে
যে জোনাকি লণ্ঠনের মতো জ্বলেছিল পথ দেখাবে বলে তাকে নেভানো হয়নি।
ফিতের মতো মেপেছি তোমাদের হৃদয় পেরুনো জীবন
আহ্ কি ছোট, অপচয়ে ভেসে যাচ্ছে সব এ বেলা ও বেলা
বহমান হৃৎপিণ্ড বেঁধে রেখেছ নোংরা পোতাশ্রয়ে
তাকে তুলে রাখবে বলে ভুলে গেছ, নোঙর ফেলেছ আলগোছে
প্রাচীন শরীরে নামে ঈশ্বর, পৃথিবীতে নামে না তবু মায়ার সফেন ঢল!
তোমরা কেবলই ঘৃণা কর, জোনাকির আলো গিলে ফেল
নষ্ট কর গাছেদের ঘর, পাখিদের সংসার
ঈশ্বরের কথা ভেবে ভুলে যাও পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকা ক্ষীণ ঈশ্বর

তোমরাও তাই ফেরার কথা বলে পেরিয়ে যাও মহাকাল
কেবল যাও, যেতে থাক
পথ হারালে বুঝে নিও এটাই পথ, মানুষের কোন পথ থাকতে নেই
অরণ্য, সমুদ্র, আকাশ ব্যাপী তার পথ, পথ না হারালে এর সন্ধান পাওয়া যায় না।

 

 

 

তুষার

 

গত হিমযুগ শেষে তোমাকে তুলে এনেছিলাম।
এই প্রবল শীতে
নিবিড় জড়িয়ে ঘুমোব
একশ’ আশি দিনের হাইবারনেশন,
বিবস্ত্র অন্তর্ধানের মাঝামাঝি, মাঝরাত থেকে
তোমার ধর্ম গলবে মোমের মতো
মোম থেকে জল, জলও অতল
তুমি শীতলতা ভুলে
ভিসুভিয়াস, ফুজিয়ামার মতো উত্তাপ শেখো
উত্তপ্ত লাভা দোয়াতে ভরে
সমগ্র ধর্মগ্রন্থে আমাকে লেখো।
তোমার আচরণ শীতলতা নয়, হোক আমি।
আমার চেয়ে বড় ধর্ম
তোমার আর কিইবা হতে পারে?

 

 

 

উত্তরাধিকার

নাম মনে নেই আমার, বয়স ২২
৬২ হাজার গ্রাম, তার একটি আমার
আমি বুলেটের উত্তরাধিকার।

৭১ এ পিতামহ,
স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে
বুকে জমিয়ে রেখেছিল বুলেট একটা।

আদ্ধেকদিন হাঁটুভেঙ্গে পড়ে থেকে
বিবাগী দুপুরে চললেন সূর্যের পানে,
খাড়া আকাশের দিকে।

থেকে থেকে তখনও স্টেনগান,
টাইপ ফিফটি সিক্স অ্যাসল্ট রাইফেল,
আরপিজির উদভ্রান্তি কপালের নিচে, চক্ষুকোটরে

স্বাধীনতা বড় দামী
কিস্তিতে এখনো শুধছি তার ঋণ
ছোট কুঁড়েঘর, ১৩ ছটাক জমি।

কয়লার বলে জলের স্তর হল মায়ের কপাল
তলাল সমান, তারপর গেল তিনজন
পিতার বুকেও লেগেছিল বুলেট।

মা বলেছিল আমাদের স্বাধীনতা পতাকায়, জাতীয় সঙ্গীতে
বলেনি, স্বাধীনতা সেঁটে থাকে বুলেটেও।
বুকে এসে লাগলেই মুক্তি।

আর আমি মাইনে কিছু চেয়েছিলাম বেশি,
গেল কাপড়ের নকশায় বুলেট-ছাপা রক্ত-মুক্তি
বুলেট, মাকেও দেখে রেখো। চেনোনি, আমি বুলেটের উত্তরাধিকার!

 

 

 

ঘরে ফেরা

 

আমি ঘরে ফিরি
যখন ভাঙা কাঁচের শহরের শেষ বাসে ড্রাইভার হেল্পার ঝগড়া করে।
প্যাসেঞ্জারের দেওয়া দু’এক টাকা বাড়তে বাড়তে
কনডেন্সড মিল্কের চায়ের দাম হয়,
পাঁচটা বিড়ির চেয়ে দু’চার টাকা হয় বেশি।
ভাগাভাগির টাকার হিসাব মেলে না যখন।

আমি ঘরে ফিরি
যখন রাস্তায় রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের
নষ্ট ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে চাঁদের আলো ঝরে।
ফুটপাতের খালি গা বৃদ্ধ করুণ চোখে তাকায়।
হাঁটি বলে যে ফুটপাথে ঘুমাতে গিয়ে,
আমার জুতোর শব্দে চোখ লাগে না।

আমি ঘরে ফিরি
যখন ক্লান্ত ট্রাফিক সিগন্যাল ছেড়ে
একচালার টিনের নিচে কাঠের বেঞ্চিতে বসে
জুতো খুলে হাত বুলায় পায়ে।
বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় ফেরারি বাসে,
গাঁজার গন্ধ আর লাল চোখ পথচারী দেখে অপূর্ণ কৌতূহল।

আমি ঘরে ফিরি
যখন কড়া লাল লিপস্টিক আর ঝকঝকে ইমিটেশন
ফুটপাতের ওপর বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

যখন রিকশার মোড় খালি হয়ে আসে,
যাযাবর কুকুরেরা সঙ্গী খোঁজে যে যার মতো।
চেনা ঘ্রাণে শান্ত চোখ খুঁজে পায় ছেঁড়া জুতো আর পাটের ব্যাগ।

আমি ঘরে ফিরি
যখন টং দোকানে নিভে আসে কেরোসিনের চুলো,
বাসি কেক আর পচা সবরি কলা ঝোলায় ঢোকে ঘুমোবে বলে।

আমি তখনও হেঁটে চলি ঘরে ফিরব বলে।
মোড়ের চিলেকোঠার আলোটা দপ করে নিভে যায়,
আঁধারে লেখা হতে থাকে না দেখানো গল্পসমগ্র।

আমি ঘরে ফিরি
যখন আমার ব্যাগ ভার হয়ে আসে মাটির গন্ধে,
কাঁচাবাজারের মুরগির গন্ধে।
নাক ভার হয়ে আসে পোড়া মরিচ আর ডাস্টবিনের গন্ধে।

আমি ঘরে ফিরি
অনন্তকাল ধরে হেঁটে হেঁটেও যে ঘরে ফেরা হয় না।
তবুও ফিরি!

 

 

 

পুরুষ

 

তোমাকে ভালবাসি। যখন খুব করে মন ভাঙ্গে তোমার,
আথালে পাথালে শীতের পিঠার মতো নরম অভিমানে
আর ততোধিক অভিমানে এলিয়ে পড়ো-
সাতশ’ বিলিয়ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নির্জনে।
লোকে বলে অপুরুষ,
লোকে বলে ভীরু,
লোকে বলে কলঙ্ক।

তক্ষুনি বুকে তুলে নিই তোমাকে, বিচ্ছিন্ন গাঢ় মমতায়।
শূন্য পকেটের তোমাকে বড় আপন মনে হয়।
হন্যে হয়ে সিভির ফাইল হাতে নাজেহাল
কিংবা নিছক আরামে ঘুমোবে বলে ঘরের বাহিরে যাও না।
নির্মোহ প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকো বেহিসেবি তুমি।
খুব করে ভালবেসে ফেলি তোমাকে।

তোমাকে ভালবাসি,
কিচেন অ্যাপ্রন গায়ে শক্ত বুকের নিচে
নরম কলিজা তাতিয়ে যখন চুলো ঘেঁষে দাঁড়াও।
পাতলা জল-ঝোলের মাঝামাঝি স্বাদের তোমাকে
প্রেমের মতো অবিরাম অমৃত-ক্ষরণ মনে হয়।
মনে হয়, প্রেম আর মশলার মাঝখানে
কত নিবিড় হয়ে জ্বলছ ঘন হবে বলে।

জঠোরের দায়ভাগী তুমিও যখন প্রণয়ের ডায়াপার বদলে
কোলে তুলে নাও, নিজের দায়ে।
একবারও ভাব না, সাহায্য করছ।
ভাব না, এ তোমার নয়
ভাবছ না, তোমার-আমার আলাদা আকাশ।
মাটি-পৃথিবী, ফলন ভিন্ন।

তোমাকে আঁকড়ে ধরি
যখন ক্লান্ত প্রেমিকার স্তন পেরিয়ে স্পর্শ করো হৃদয়।
শুশ্রূষায় সারিয়ে তোলো বেদনার ক্ষত।
তোমার মতো অমন করে আর কেউ ছোঁয় না,
হাতের রেখা মুখস্থ রেখে অন্ধকার হাতড়ে
খুঁজে আনে না কেউ হাড়ের কঙ্কাল।

তোমাকে জড়িয়ে রাখি শিশ্নহীন, বিত্তহীন, প্রেমহীন।
পরাজিতের অসমস্বত্ত, সবটুকু নিজের বিষাদে ঢেলে আকণ্ঠ পান করি।
তোমাকে ভালবাসব বলে শরীর কেটে রক্ত জমাই,
তোমার ক্ষতবিক্ষত নরম হৃদয়ের কাঁটাতারে ঘেরা
একটা দেশ, একটা মহাদেশ, একটা মহাবিশ্ব হোক।
মানচিত্রের সীমানা-প্রাচীরে
অপুরুষত্বে-অসহায়ত্বে তোমাকে দিনরাত ভালবাসব।

 

 

 

প্রেমিক অথবা

 

একটা সরল রাত্রির মধ্যবর্তী বিরতিতে
তোমার ভাঙ্গা রোদ-অমানিশা পেয়ে বসি প্রায়ই।
তোমার ঢ্যাঙ্গাবেলার পাতা কুড়নো দিন,
বন্ধু হারানো নদীর নাম
নদীতে জমানো সমূহ বিপদ, মামলা পালানো শৈশব-কৈশোর।
অথচ তোমার তখনো বয়সই হয়নি-
প্রেমিক কিংবা আসামী হবার।
তবু পালিয়ে বেড়াচ্ছ আশৈশব,
যৌবনের যাবতীয় রতি-আরতির দোনামনা আর বিভ্রাটে
যুবতী অন্তর্বাস খুলে দিলে
এক প্রহর যদি নিজেকেও ভুলে যেতে পারো,
তবে ওটুকুই তোমার থলের তলানি।
এর বেশি চাইলে জেলার কিংবা নিরুপায় প্রেমিকার কেউই
চাবির গোছা হাতে তুলে দেবে না।
সরল রাত্রির ব্যাংকে যা জমিয়েছ আয়ুরেখা ঘেঁষে,
সম্বল যা কিছু আছে তাতে নিজেকেই টেনে তোলো।
পুলিশ আর আবেগী প্রেমিকারা বয়স মানে না
অথচ তখনও তুমি শিশু,
এখনো বয়স বেড়েছে বলে সব বেদনা ভুলে না গেলে
তোমার বুকটা শিশু হয়ে আছে।
একটা সরল রাত্রির মধ্যবর্তী বিরতিতে
তোমার বয়স্ক শরীরে শিশু নেমে আসে।
মৃত বন্ধুর অঙ্কের খাতা যত্নে তুলে রাখো।
খাতা-চুরির মামলায় ফাঁসি হয় না বলে তুমি এভাবেই বেঁচে থাকো।
আমিও এইসব ফিকে তারাফুল-জোনাক সাজানো রাত্রির বিরতিতে
তোমার ভাঙ্গা রোদ-অমানিশা পেয়ে বসি প্রায়ই।



বই: সাড়ে তিনশ’ বছর

কবি: বীথি সপ্তর্ষি

প্রকাশক: চৈতন্য

প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান

শেয়ার