সালভাদর দালি: ক্ষ্যাপাটে এক সৃষ্টিশীল ।। মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

ছেলেবেলা থেকেই ছেলেটি ছিলো অদ্ভুত আর ব্যতিক্রম। এমন সব কাণ্ড-কারখানা সে করতো, তাতে লোকজনের দৃষ্টি তার উপর না পড়ে পারতো না। আর ছেলেটিও চাইতো তাই। সে চাইতো অবাক হয়ে বিস্ময় ভাব নিয়ে লোকে তাকে দেখুক। ছেলেটি চাইতো, যখন সে হেঁটে যাবে রাস্তায়, তখন লোকজন তাকে নিয়ে গুঞ্জন তুলুক। বলুক- ঐ যে যাচ্ছে!! এই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার সাধনা, পরিশ্রম ও উদ্ভট কর্মকাণ্ডের কখনো ঘাটতি ছিলো না। এমনকি যখন তাঁর বয়স জীবনাস্তের দিকে- তখনও নয়। বলছিলাম বিখ্যাত চিত্রকর এবং খেয়ালি মানুষ সালভাদর দালির কথা।

তাঁর পারিবারিক নাম সালভাদর ডোমিঙ্গ ফিলিপে জামিন্টো দালি ই ডোমেনেচ। ১৯০৪ সালের ১১ মে স্পেনের ক্যাটালোনিয়ার ফিগুয়েরেস শহরে দালির জন্ম। তাঁর বড় ভাইয়ের নামও ছিলো দালি। বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর যখন দালি জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর বাবা সালভাদর দালি আই কুসি ও মা ফেলিপা ডমেনেক ফেরেস বড় ছেলের স্মৃতি সংরক্ষণে নবাগত সন্তানের নাম রাখলেন দালি। তাঁরা বিশ্বাস করতেন দালি তাঁর বড় ভাইয়ের ‘ছায়া’ হয়ে জন্মেছেন। আশ্চর্য বিষয় এই, ছোটবেলায় তো বটেই, জীবনের শেষ বয়সে এসেও সালভাদর দালি নিজেই বাবা-মায়ের এই ধারণা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। নিজেকে তিনি ভাবতেন তাঁর বড় ভাই দালির ছায়া, যে বড় ভাই কিনা তাঁর জন্মের নয় মাস আগেই মারা গিয়েছিলেন! বিভিন্ন সময়ে, নানা প্রসঙ্গে বহুবার দালিকে দেখা গেছে তাঁর বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে। যদিও দালি তাঁর ভাইকে দেখেন নি, তবুও ভাই সম্পর্কে তাঁর ধারণা ও বিশ্বাস ছিলো শেকড় সম্বলিত, গভীর। সালভাদর দালি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘আমি ও আমার ভাই ছিলাম যেনো দুই ফোঁটা পানি, চেহারায় এমন সাদৃশ্য ছিলো আমাদের দুজনের কিন্তু আচার-আচরণে আমরা ছিলাম একদম ভিন্ন। আমার মতো (আমার মৃত ভাইয়ের চেহারাতেও ‘জিনিয়াস’-এর ছাপ ছিলো…।’

শৈশব থেকেই দালি ছিলেন বিচিত্র, অস্থির ও দুরন্ত। ছেলেবেলা থেকেই দালি চেয়েছেন সবাই তাকে দেখুক এবং এ দেখা হবে ভিন্ন দৃষ্টিসম্পন্ন। কৈশোর ও যৌবনে তিনি মানুষের দৃষ্টি তাঁর উপর আকর্ষণের জন্য এমন সব কাজ-কর্ম করতেন, যার জন্য সাধারণ মানুষ বা আত্মীয়রা তাঁকে ‘উন্মাদ’, ‘ফ্যানটিক’ হিসেবে জানতো। দালি যে কেবল সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন তা নয়, নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছেও তিনি ‘বিশেষ দৃষ্টি’ প্রত্যাশা করতেন। নিজের দিকে নজর ফেরাতে দালি কী করতেন, এমন একটি ঘটনা দালির বয়ানেই জানা যাক। দালি লিখেছেন : ‘একবার মাছের কাঁটা খেতে গিয়ে আমার শ্বাসরোধ হবার জোগাড়, তা দেখে আমার বাবা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দুই হাতে মাথা ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। শুধু বাবার ওই প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এর পরে আরো কয়েকবার আমি শ্বাসরোধ হবার অভিনয় করেছি। বলাই বাহুল্য, আমার নিজের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ পাওয়ার জন্যই এই কাজ করা।’

যৌবনে যখন দালি আমেরিকায়, বলাই বাহুল্য তখন তিনি খুব পরিচিত মুখ ছিলেন না। নিউইয়র্কবাসীর কাছে নিজেকে তুলে ধরতে দালি রাস্তায় হাঁটার সময় হাতে ঘণ্টা রাখতেন। যখন মনে হতো পথচারীরা তাঁর উপর দৃষ্টি দিচ্ছে না, অথবা বেশি মানুষের সমাগম যেখানে- সেখানে তাঁর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে তিনি একটানা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন! যাতে তাঁর দিকে জনসাধারণ দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর এমন কাণ্ডের সুবাদে অল্প ক’দিনেই দালি হয়ে উঠলেন শহরের পরিচিত মুখ। মানুষ যখন দালিকে রাস্তায় হাঁটতে দেখতো, তারা আশঙ্কা করতো এবং সাথে সাথে উদগ্রীব থাকতো অদ্ভুত, পাগলাটে কোনো ঘটনার জন্য। কারণ ততদিনে তারা জেনেছে, দালি মানেই বেখাপ্পা কিছু ঘটবে, ঘটতে চলেছে…। তাই সিগমুন্ড ফ্রয়েড দালিকে দেখে বলেছিলেন- ‘স্পেনীয়দের মধ্যে এমন ফ্যানটিক আমি আর দেখিনি।’ দালির ভাষ্য মতে : ‘‘বিদায় নেয়ার আগে ভাবলাম, প্যারানয়া বা মস্তিষ্কবিকৃতিবিষয়ক আমার (দালির) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ তাঁকে (ফ্রয়েডকে) দিই। যে ম্যাগাজিনে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, পাতা বের করে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানালাম সময় পেলে তিনি যেন তা পড়ে দেখেন। পত্রিকাটির দিকে কণামাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে ফ্রয়েড আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি আগ্রহী হবেন এই ভেবে আমি বললাম, লেখাটি কোনো পরাবাস্তববাদী চালাকি নয়, বরং অতি উচ্চাশাপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ। লেখাটির নাম পুনরাবৃত্তি করে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়েও দিলাম। সম্পূর্ণ অমনোযোগী ফ্রয়েডের সামনে আমার গলা ক্রমশ উচ্চকণ্ঠ হয়ে আসছিল। তারপর, আমার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ অভিনিবেশ পরিবর্তন না করে স্তেফান জিভিগের দিকে তাকিয়ে ফ্রয়েড মন্তব্য করলেন, ‘আমি এর আগে এ রকম একজন আপাদমস্তক হিস্পানীয়কে দেখিনি। আস্ত পাগল!’

অবশ্য দালির এমন সব উদ্ভট আচরণের কারণে তিনি খুবই জনপ্রিয়ও ছিলেন। দালি লিখেছেন- ‘আমি যখন বাইরে যেতাম কিংবা ঘরে ফিরতাম, বহু উৎসুক মানুষ জড়ো হতো, আমাকে দেখার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠতো।’ তবে এসব কারণেই সে সময়ের কাউকে যদি তার প্রিয় চিত্রকরের নাম জিজ্ঞেস করা হতো নিঃসন্দেহে সেই নামটি হতো দালির। সেটা তাঁর চিত্রকর্মের জন্যই হোক বা তাঁর উদ্ভট কর্মকাণ্ডের জন্যই হোক।

চিত্রকর হিসেবে দালি যেমন ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান, তেমনি ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন বিস্ময় জাগানিয়া, ঘোর লাগা চরিত্র। দালির যখন মাত্র ছয় বছর তখন তিনি চাইতেন পেশাগত জীবনে তিনি পাচক হবেন। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই তিনি ঠিক করলেন তিনি হবেন নেপোলিয়ান। শৈশব থেকেই দালি খ্যাতি চাইতেন, উচ্চাশা ছিলো প্রচুর। তিনি পৃথিবী জয় করার স্বপ্ন দেখতেন। এ জয় করাকে দালি যে কোনো অর্থেই চাইতেন। তা হোক শিল্পী হিসেবে অথবা খেয়ালিপনার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে দালি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন খুব সহজে এবং একই সাথে অল্প সময়ে। অনেক সমালোচক তাই মন্তব্য করেছেন- দালি প্রথমে তাঁর বিচিত্র, অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দ্বারা আগে জনপ্রিয় হয়েছেন, পরে হয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী!

দালি ছিলেন তাঁর চিত্রের মতোই রহস্যময়। সাথে সাথে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী একজন শিল্পীও। তাঁর বয়স যখন মাত্র পঁচিশ, তিনি নিজেকে ‘জিনিয়াস’ বলতেন এবং এ দাবিতে আত্মবিশ্বাসের কোনো ঘাটতি ছিলো না। তিনি ৩৭ বছর বয়সে আত্মবিশ্বাসের ডানায় ভর করে লিখেছেন ৪শ’ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী `Vie secrete de salvador Dali’ । পরে এই গ্রন্থটি ‘দি সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’ নামে ইংরেজিতে অনুদূত হয়। আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘…স্বীকার করছি, ১৯২৯ সাল থেকে আমি যে একজন জিনিয়াস, সে ব্যাপারটা সচেতনভাবে আমার কাছে ধরা পড়ে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন- ‘প্রতিদিন সকালে আমি যখন জেগে উঠি, আমি আমার সেই সর্বোচ্চ আনন্দ লাভ করি- সালভাদর দালি হবার আনন্দ।’ বিতর্ক থেকে বাদ যায়নি দালির আত্মজীবনীও। জর্জ ওরওয়েল এই বইটিকে ‘অসৎ ও বাগাড়াম্বরে পরিপূর্ণ কল্পকাহিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অবশ্য ওরওয়েলের এমন মন্তব্যে যথাযথ কারণও আছে। কারণ দালি তাঁর আত্মজীবনীতে বহু উদ্ভট কথা লিখেছেন। এও লিখেছেন যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্যও বটে। দালি তাঁর আত্মজীবনীর এক জায়গায় লিখেছেন- ‘অতিশৈশব থেকে যৌন বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিলো প্রবল।’ অন্যত্র লিখেছেন- ‘সাত বছর হতে না হতেই তিনতলার সেই সুন্দরীর প্রতি আমার সুতীব্র আগ্রহ জেগে উঠে।’ এমন অনুভূতি কি এই অল্প বয়সে হওয়া সম্ভব??

ছেলেবেলা থেকেই আঁকাআঁকি ভালোবাসতেন দালি। দিন যতো গড়িয়েছে ততই আঁকাআঁকি হয়ে উঠেছে তাঁর নেশা, সাধনা, সবকিছুই। বাবার ছেলেকে নিয়ে ভিন্ন স্বপ্ন থাকলেও মা ফেরেস ছেলেকে শিল্পচর্চায় উৎসাহ দিতেন, অনুপ্রাণিত করতেন বারবার। যখন দালির বয়স মাত্র ছয়, ১৯১০ সালে তিনি আঁকলেন ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস।’ নয় বছর বয়সে আঁকলেন ‘ভিলাবারট্রান’। যা কিনা দালির শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একটি। শৈশবে আঁকা ১৪ সেমি-৯ সেমি মাপের ছবিটি আজো শিল্পবোদ্ধাদের বিস্মিত করে, আবিষ্ট করে রাখে মুহূর্তের পর মুহূর্ত।

স্কুল পর্যায়ে পড়াশোনা শেষে দালি ভর্তি হলেন মাদ্রিদ একাডেমি অব আর্টে। কিন্তু দালির জীবন যে বড়ই বিচিত্র, বেখেয়ালি; তৎকালীন পরিবেশে অদ্ভুতও কিছুটা। সেখানে ভর্তি হবার কদিন না যেতেই দালি বলতে শুরু করলেন যে, একাডেমিতে একজন ছাড়া সব শিক্ষক শিক্ষকতা করার অযোগ্য! একবার পরীক্ষার হলে তিনি শিক্ষকদের বললেন- ‘দুঃখিত, কিন্তু  এখানে উপস্থিত তিনজন অধ্যাপকের চেয়ে নিজেকে অধিক যোগ্য মনে করি। অতএব, এই কমিটি দ্বারা পরীক্ষিত হতে আমি অস্বীকার করছি।’ ফলে এখানে পড়াকালীন সময়ে তিনি একবার জেলও খাটেন। পরবর্তীতে দালিকে ‘প্রথাবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের জন্য মাদ্রিদ আর্ট একাডেমি থেকে বহিস্কার করা হয়। ১৯২৫ সালে দালি আবার এখানে ভর্তি হন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তাঁকে আবারো একাডেমি ছাড়তে হয়। কেননা, ‘কর্তৃপক্ষ এবার স্বীকার করে বললেন, সালভাদর দালিকে শেখানোর মতো বিদ্যা এখানে আর কারও নেই।’ তখন সালভাদর দালির বয়স ছিলো মাত্র ২১ বছর!

দালি পরবর্তীতে ‘শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র’ প্যারিসে চলে যান। মহান শিল্পী পাবলো পিকাসো প্যারিসে থাকতেন আর দালি ছিলেন তাঁর ভীষণ অনুরক্ত। প্যারিসে তিনি নিজের আঁকা একটি ছবি নিয়ে পিকাসোর সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁকে বলেন- ‘আমি লুভ্যর মিউজিয়াম দেখার আগে আপনাকে দেখতে এসেছি।’ পরবর্তীতে শিল্পমনা আরো অনেককে সাথে পেয়ে দালির চিত্রকলার ধ্যান যেনো আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়। তাঁর সে সময়ের আঁকা ‘দ্য গ্রেট মাস্টার বেটর’, ‘দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমোরি’ প্রভৃতি ছবি তাঁকে স্যুররিয়ালিজমের অনন্য শিল্পী হিসেবে শিল্পবোদ্ধাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। দালি কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের মিশ্রণে যে স্যুরিয়ালিস্টিক আবহ সৃষ্টি করেন, তা সে সময়েই কেবল অভূতপূর্ব নয়, শিল্পকলা, শিল্পচর্চা ও শিল্প আন্দোলনের ইতিহাসেও বিস্ময়কর। ‘দ্য বাস্কেট অব বেড, দ্য ফেস অব ওয়ার, টুনা ফিশিং, মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস, দ্য বার্নিং জিরাফ, ভিলাবার্টিন, মর্ফোলজিক্যাল ইকো, স্টিল লাইফ মুভিং ফাস্ট, আন চিন এন্ডালু-এর মতো অসংখ্য বিখ্যাত চিত্রকর্ম দালিকে আজো বিশ্বের মানুষের কাছে অমর করে রেখেছে। একথা অস্বীকার করার জো নেই বিংশ শতাব্দির শিল্প আন্দোলনে সালভাদর দালি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, বিভৎসতা তাঁর মনে, শিল্পী মননে প্রভাব ফেলেছিলো ব্যাপকভাবে।

কিন্তু এত সাফল্যের পরেও কি দালির অস্বাভাবিক, উন্মাদের মতো কর্মকাণ্ড কি কমেছে কখনো? এত সিরিয়াস কাজের মধ্যে থেকেও? যায় নি। বোধকরি দালি এসব না করলে হয়তো কিছুই করতেন না। বিচিত্র দালির যে বস্তুটি তাঁকে আরো বিচিত্র করেছে সেটি হলো তাঁর গোঁফ। প্রাবন্ধিক সুমন রহমান এ ব্যাপারে একটি মজার মন্তব্য করেছিলেন- ‘বিংশ শতকে হিটলার, স্ট্যালিন ও চ্যাপলিনের মৃত্যুতে পৃথিবীর গোঁফ সাম্রাজ্যে যে শূন্যতা দেখা দিতে শুরু করেছিলো, দালির গোঁফ যেন সেই শূন্যতার ওপর সুররিয়াল প্রলেপ হয়ে এলো।’ দালি যে ধরণের গোঁফ রাখতেন, সম্ভবত বিশ্বের কেউ এর আগে এমন অদ্ভত সরু গোঁফ দেখেনি। অবশ্য দালির সাধনাই ছিলো এ নিয়ে। মানুষ যা করতো না, দালি তা করতেন হরহামেশাই। দালির ছবির মতোই তাঁর গোঁফ ছিলো জনপ্রিয়। গোঁফ ছিলো খুবই সরু, আর নানা ঢংয়ে বাঁকানো। তাঁর এই গোঁফের ব্যাপারে মানুষজনের আগ্রহ ছিলো প্রচুর। দালি একবার দর্শনার্থীদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন- ‘তারা কি আমার ছবি দেখতে আসে? মোটেও না! তাদের সবার আগ্রহ আমার গোঁফের ব্যাপারে। মহৎ চিত্রকল্প সাধারণ মানুষের দরকার নাই। দরকার খালি একটা জম্পেস গোঁফ!!’ তাই চিত্রশিল্পী দালি, ব্যক্তি দালি ও গোঁফঅলা দালির মধ্যে আনন্দপ্রিয় মানুষ হয়তো সবার আগে গোঁফঅলা দালিকেই বেছে নেবে। দালি নিজেই বলতেন, কোনোদিন মানুষ হয়তো এই গোঁফজোড়ার মতোই অদ্ভুত আরেকটা সত্য আবিষ্কার করবে- ও হ্যাঁ, সালভাদর দালি? ওই গোঁফঅলা? সম্ভবত ছবি-টবি আঁকত!!

দালি মনে করতেন তাঁর গোঁফ তাকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো গোঁফ-এর মধ্যে ‘পুত-পবিত্র’ একটি ব্যাপার আছে, যা তাঁর চিন্তা, চেতনা ও অনুধাবনকে আরো শাণিত করবে। দালির হাতে সবসময় মুক্তোখচিত একটি সিগারেটের কেস থাকতো। কিন্তু সেই কেসে সিগারেট রাখার পরিবর্তে রাখতেন বিভিন্ন আকারের গোঁফ। এসব গোঁফ নেয়ার জন্য তিনি তাঁর বন্ধুদের সাধাসাধি করতেন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- কখনো কোনো বন্ধু বা অন্য কেউ তাঁর গোঁফ নেয়া দূরে থাক, এসব ছুঁয়েও দেখতো না। আর এ ব্যাপারটি নিয়ে দালি খুব আনন্দ পেতেন।

দালি বিড়াল পছন্দ করতেন। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর দুটো বিড়াল ছিলো। দালির বন্ধুরা বলতেন- দালির বিড়াল যেনো দালির মতোই। দালির বিড়ালটি খুব কম সময়ই খোশ মেজাজে থাকতো। বিড়ালটির নাম ছিলো ব্যাবু। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার এক রাষ্ট্রপ্রধান দালি দম্পতিকে চিতাবাঘের মতো একজাতের দুটি বিড়াল উপহার দেন। দালি তাঁর বিড়ালটিকে ভালোবাসতেন। কোনো রেস্টুরেন্টে বা বন্ধুদের আড্ডায় দালি ব্যাবুকে নিয়ে যেতেন। ব্যাবু ছিলো মেজাজী। সবসময় দালির মতোই কিছু না কিছু করতো। রেস্টুরেন্টে গেলে ব্যাবু বাসন-কোসন ফেলে দিতো। একবার দালি প্যারিসের এক আর্ট গ্যালারিতে ব্যাবুকে নিয়ে গেলে বিড়ালটি সতের শতকের মূল্যবান একটি শিল্পকর্ম ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফলে দালিকে সেই শিল্পকর্মের দ্বিগুণ অর্থ জরিমাণা গুণতে হয়েছে। বিড়ালটির এমন কর্মকাণ্ড দালি হাসিমুখে সহ্য করতেন। দালির বন্ধুরা তাই বলতেন ব্যাবুর কাজকর্মে দালি হয়তো খুশি হতেন, আনন্দ পেতেন।

শিল্পী জীবন তথা পেশাগত জীবনেও দালি যেখানে গেছেন, যে কাজ করেছেন মানুষের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টি করে গেছেন। একবার মরিস নামে এক ব্যবসায়ী তাঁর নতুন শোরুম সাজসজ্জা করার জন্য দালিকে নিয়োগ করলেন। মরিসের উদ্দেশ্য ছিলো বিখ্যাত কাউকে দিয়ে শোরুমের সাজসজ্জা করতে পারলে মানুষজন তাতে আকৃষ্ট হবে। তার ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রচার হবে। তাই তিনি দালিকে ঠিক করেছিলেন। কারণ দালি ততদিনে জনপ্রিয়, বিশ্বের মানুষের কাছে আগ্রহের অন্যতম বিষয়। কিন্তু শোরুম উদ্বোধনের দিন যতই এগুচ্ছে, মরিস দেখলেন দালি কোনো কিছুই করেননি। মরিস জানতে চাইলে দালি বলেন, উদ্বোধনের দিনই তাঁর কাজ সুসম্পন্ন হবে। শোরুম উদ্বোধনের দিনে আবারো সেই দালিচিত কাজটি হলো। সবাই এসে দেখলেন স্যুররিয়ালিজমের মহান শিল্পী শোরুমের একটি কাচের পাত্রে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! আর এ খবর পেয়ে সাংবাদিক, কৌতুহলী মানুষজন ছুটতে লাগলেন মরিসের শোরুমের দিকে। হাজার হাজার মানুষ সেদিন এলো দালির এই কাণ্ড দেখতে। দালি মরিসকে হেসে বললেন- কেমন হলো সাজসজ্জা!! পেশাগত জীবনে দালি এমনই ছিলেন!

শিল্পী জীবনের মতো বৈবাহিক জীবনেও সালভাদর দালি ছিলেন ভিন্নরকম। ১৯২৯ সালে দালির পরিচয় হয় ফরাসি স্যুরিয়ালিস্ট কবি পল এ্যালুয়ারের স্ত্রী গালা এ্যালুয়ারের সাথে। এক সময় এ পরিচয় প্রেমে রূপ নেয়। পরিণতিতে ১৯৩৪ সালে নিজের চেয়ে ১০ বছরের বড় গালাকে বিয়ে করেন দালি। গালাকেই দালি ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্যাথলিক আইনে বিয়ে করেন। দালি ক্যান্ডাওলিজম চর্চা করতেন। তিনি নিজের স্ত্রীকে অন্যের সামনে এক্সপোজ করে ফ্যান্টাসি অনুভব করতেন। ফলে দালির ইচ্ছাতেই গালার বেশ কজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সাথে সাথে এও সত্য, গালা ছিলেন দালির ছায়াসঙ্গী, আর শিল্পচর্চায় গালা সালভাদর দালিকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। ১৯৮২ সালে গালা মারা গেলে দালি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এর প্রভাব পড়ে তাঁর শিল্পচর্চায়ও। ১৯৮৩ সালের মে মাসে দালি তাঁর শেষ ছবিটি এঁকেছিলেন।

দালি মনে করতেন খেয়ালিপনাই হলো তাঁর নিয়তি। তিনি ভাবতেন সব অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তিনি করেন না। তাঁর সাথে যেন খেয়ালীপনা প্রকৃতিপ্রদত্তভাবেই এসে পড়ে। তাই তিনি বলতেন- ‘আমি চাই বা না চাই, খামখেয়ালিপনা আমার নিয়তি।’ এ কথা তিনি গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন। তিনি ভাবতেন তিনি নিয়তিকে এড়াতে পারছেন না। আত্মজীবনীতে তিনি এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন : ‘‘১৯২৮ সালে আমার নিজের শহর ফিগেরাসে আমি আধুনিক চিত্রকলা বিষয়ে একটি ভাষণ দিচ্ছিলাম। শহরের মেয়র সে অনুষ্ঠানের সভাপতি, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত। বেশ ভিড় হয়েছিল বক্তৃতা শুনতে। লক্ষ্য করছিলাম, লোকজন কিছুটা বিস্ময়মিশ্রিত আগ্রহে বক্তৃতা শুনছে। আমার সব কথা বিশেষত শেষ বাক্য তারা বুঝেছে, তা মনে না হওয়ায় আমি গলা ফাটিয়ে বললাম, ‘ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আমার বক্তৃতা এখানেই শেষ।’ ঠিক তখন, মেয়র ভদ্রলোক, যাকে শহরের মানুষ সত্যি খুব ভালোবাসতো, আমার পায়ের কাছে মৃত অবস্থায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এতে কী কাণ্ড হলো আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কোনো কোনো পত্রিকা রস করে লিখল, আমার ভাষণের গভীরতার ভার সইতে না পেরে মেয়র সাহেব মারা গেছেন। অথচ ব্যাপারটা ছিল হৃদপীড়াজনিত কারণে আকস্মিক মৃত্যু। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘটনাটা ঘটে ঠিক আমার বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই!”

দালি মনে করতেন তাঁর বক্তৃতার সাথে অনিশ্চিত, খারাপ কিছু জড়িত আছে। অশুভ কিছুর যেন তাঁর বক্তৃতার সাথে গভীর সম্পর্ক আছে।  ১৯৩৭ সালে বার্সেলোনায় তিনি যখন ‘শয্যাপাশে টেবিলের পরাবাস্তববাদী ও প্রপঞ্চক রহস্য’ বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন, ঠিক সেদিনই শহরে এক এনারকিস্ট বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন যারা দালির বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন তাঁরা অনুষ্ঠান ভবনে আটকে পড়েন। কেননা বাইরে গোলাগুলি হচ্ছিল। আরেক বছর বার্সেলোনায় একটি নাট্যশালায় দালির বক্তৃতা রাখার কথা ছিলো। যেদিন বক্তৃতা দেয়ার কথা সেখানে সেদিন সকালে আগুন ধরে যায়।বার্সেলোনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে দালি একবার একজন ডাক্তারের ক্রোধের আগুনে পড়েন। ডাক্তার দালিকে খুন করতে উদ্যত হয়। এমন অসংখ্য ঘটনা যেমন দালির জীবনকে বর্ণিল করেছে, তেমনি করেছে রহস্যময়।

জীবনকে দালি উপভোগ করতে চেয়েছেন, উপভোগ করেছেনও। তাঁর অদ্ভুত জীবনাচরণের জন্য তিনি বলতেন- – ‘There is only one difference between a mad man and me. The mad man thinks he is sane. I know I am mad.’ তবে জীবন খেয়ালিভাবে পার করলে ছবি আঁকার বেলায় তিনি ছিলেন মনোযোগী, দক্ষ শিল্পী। নিজেই প্রায় বলতেন- যদি চিত্রকলাকে ভালোবাসতে না পারেন, তাহলে নিজ প্রেমিকার ভালোবাসাসহ সকল ভালোবাসা গুরুত্বহীন হয়ে ধরা দেবে আপনার কাছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে সালভাদর দালিই একমাত্র চিত্রশিল্পী যাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে দুটি মিউজিয়াম রয়েছে। প্রথমটি ‘দ্য সালভাদর দালি মিউজিয়াম ফ্লোরিডা’ আমেরিকায় এবং দ্বিতীয়টি ‘দালি থিয়েটার অ্যান্ড মিউজিয়াম।’ একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, গ্রাফিক ডিজাইনার বিচিত্র মানুষ সালভাদর দালি ১৯৮৯ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পেনে তাঁর জন্মভূমিতে মারা যান। অসম্ভব এ প্রতিভাবান মানুষটিকে তাঁরই গড়ে তোলা মিউজিয়াম ‘দালি থিয়েটার অ্যান্ড মিউজিয়াম’-এর ভূগর্ভস্থ কক্ষে সমাধিস্থ করা হয়। দৈহিক মৃত্যু হলেও শতবর্ষ পেরিয়ে দালি আজো চিত্রকলার অবিচ্ছেদ্য অংশ, দালি মিশে আছেন তাঁর তেলরঙ, স্কেচে। তিনি মিশে আছেন শিল্পকলাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে, শিল্পসত্তায়।



তথ্যসূত্র :

১। অন্তর্জাল

২। The Secret Life of Dali : ভাষান্তর : হাসান ফেরদৌস

৩। ভিলবারট্রানের শতবর্ষ : আন্দালিব রাশদী

৪। সুদূর অর্কেস্ট্রা : সালভাদর দালি/ ফেরদৌস নাহার

৫। বুনুয়েল-দালির পরাবাস্তব যাত্রা/রুদ্র আরিফ।

৬। সালভাদর দালি : গোঁফ নিয়ে বলা কথা/ সুমন রহমান।

৭। পাগলাটে চিত্রকরের গল্প/ আমির খসরু সেলিম।

শেয়ার