আসাদ গেটে পৌঁছে আমরা সাপটাকে দেখলাম। সুরসুর করে ফুটপাত থেকে নেমে যাচ্ছে। এমনকি পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারীকে কিছু না বলে। তারপর রাস্তার ওপর ফণা তুলে দুলতে থাকে ওটা। ফণার পটে ধূসর রঙের একটা স্বস্তিকা আঁকা।
রাত তখন ৭টা প্রায়। হারতাল-অবরোধের দিন। তাছাড়া ঘণ্টা দুই আগেই মাথার উপর দিয়ে বৃষ্টির একটা ঝাঁপি গেছে। রাস্তায় অফিস ফিরতি লোকজন, সাধারণ মানুষ সবই কম। দূরের বলতে সাভারগামী একটা বাস স্টপে থেমেছে মাত্র। যাত্রী তুলছে। যাত্রীর পেছন পেছন সাপটাও বাসে উঠতে চাইছে। অবিশ্বস্ত চোখে দেখছিলাম এই সব।
বাসটা যথারীতি ছেড়ে যাওয়ার পর কেমন ভোজবাজির মতো মুহূর্তেই সব পাল্টে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সাপটাও!
‘সাপ দেখলাম না!’ সম্বিৎ ফেরার মতো আমি বললাম।
‘তাই তো মনে হলো!’ মুখ খুললো কবির। এতক্ষণ কোথায় যেন ওর কথা চাপা পড়ে ছিল। ‘কিন্তু গেল কোথায়?’ সে যোগ করে।
‘সেটাই তো…!’ প্রায় সমস্বরে বললাম আমরা।
নিজেদের দ্বন্দ্ব দ্রুতই লুকিয়ে ফেলার জন্য আমরা পেপার স্টলের দিকে এগিয়ে যাই। স্টলের সামনে ঝুলিয়ে রাখা ম্যাগাজিনগুলো দেখি; পলিথিনে মোড়া আর ময়লাটে। পেপার বিক্রেতা ফকরুল মিয়া আমার পূর্ব পরিচিত। গত কয়েক বছর যাবৎ প্রতি শুক্র অথবা শনিবার সন্ধ্যার পর তার স্টলে আসি। এসে গত দিনের ৪-৫টি পত্রিকার সাহিত্য সামায়িকী নিয়ে যাই। কিন্তু ক্রমেই পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যা-ও আছে মানের দিক দিয়ে যা-তা অবস্থা। তাই এখন তেমন আসা হয় না। নতুন আসা ম্যাগাজিনের ওপরই চোখ বুলাচ্ছিলাম। এই দুর্দিনেও ফকরুল মিয়ার কাছে আমার সমাদর আর সাময়িকীর দাম একই আছে। প্রতি পিস ২ টাকা।
‘সাপ কনে দেখলেন মামা?’ এক খিলি পান মুখে পুড়ে দিতে দিতে তিনি বলেন।
‘না, এই তো’ আমি খানিক গুঁইগুঁই করি। আমরা তখনও নিশ্চিত নই যে, আমরা সাপ দেখেছি। ‘এই তো একটু আগে, বাসে লোকগুলো ওঠার সময় তাদের পেছনে দেখলাম।’ আমি বলি।
‘সাপ কনে মামা’ একটা টেনিস বল ছুড়ে দেয়ার মতো তিনি বলেন, যা দেয়ালে লেগে নিশ্চিতভাবে তার কাছে ফিরে আসবে। ‘এর মধ্যে আবার সাপ আইবো কন থ্যা। ওইডা না একটা ছোট ম্যায়ার আতে কাগজের সাপ!’
কবির আমার দিকে তাকায়। তার মানে হতে পারে, তেমন সাপ তো আমরাও দেখি। টিএসসি মোড়, শিশুপার্কগুলোর সামনে হরহামেশাই পাওয়া যায়। ফেরিওয়ালারা রাস্তার ওপর নাচিয়ে নাচিয়ে বিক্রি করে। নেহায়েত কাগজের সেগুলো, ভাঁজ করে করে বানানো। এক প্রকার ওরিগামি। তাতে কালো আর ধূসর রং দেয়া। নাকের ডগায় একটা সুঁতো বাঁধা। সুঁতো ধরে টান দিলে তির তির করে নেচে ওঠে আর কাগজের ভাঁজ সংকুচিত-প্রসারিত হয়ে একটু-আধটু করে এগিয়ে যায়। খুব ফিনফিনে, পায়ের বাতাসেই উল্টে-পাল্টে যায়। দমকা বাতাসে ঘুড়ির মতো উড়ে।
সন্ধ্যায় মৃদুমন্দ বৃষ্টির পর এখন বাতাস বইছে। রাস্তাঘাট ভেজা ভেজা। এর মধ্যে কাগজের সাপ ছাড়লে নির্ঘাত সলিল সমাধি। ‘কিন্তু ওটার পটে তো চিহ্ন ছিল।’ সন্দেহ লুকিয়ে রেখেই আমাকে বলতে হয়।
‘তাইলে ওইডা পিলাসটিকের সাপ, নাইলে রবারের হইবো। দেখতে একই রকম।’ ফখরুল মিয়া বলেন।
‘রাবারের সাপ হতে পারে। কিন্তু…’
‘আরে মামা, আপনেরা শিক্ষিত মানুষ, বুঝেন না ক্যা!’ তার কথায় আক্ষেপ ঝড়ে পরে। পানের বোঁটায় মাখানো চুন একবার জিভের ডগায় ছুঁইয়ে তিনি আবার শুরু করেন। ‘ওই ম্যায়াডা ইট্টু আগে বাপের আত ধইর্যা আমার দুকানে আইছিল। হ্যার আতে কি য্যানি দেকলাম। তহন আমি বেশি খেয়াল করি নাই। এ্যাহন সে বুঝলাম।’
‘চাঁদে পাওয়া’ কবির মতো তিনি বলে চলেন, ‘আর এই শুকনার দিনে সাপ আইবো কনথ্যা! বর্ষাকাল অইলে না হয় বুঝতামনি।’ একবার দম ফেলেন তিনি। আমি নিশ্চলভাবে তার দিকে তাকাই।
‘ওই লোকটা আমার পুরান কাস্টমার…!’ আমার দিকে তাকিয়ে একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি বলেন।
‘চলেন, এই দোকানে নেই, ওইটায় দেখি।’ প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যই কবির কথাটা বলে। সে আমাকে প্ররোচিত করে বিশ-ত্রিশ কদম দূরের স্টলে যেতে। সেখানে সব সময় সাহিত্য সাময়িকী পাওয়া যায়। দাম একটু বেশি, তিন টাকা।
‘সত্যি, সাপটা গেল কোথায়!’ মাঝের শূন্য ফুটপাতটুকু পেরুতে পেরুতে কবির বলে ‘আর দুইজনেই কি ভুল দেখব!’
‘হুম’ নাকে শব্দ তুলে এক রাশ বাতাস বেরিয়ে যায় আমার। ‘‘কুলদা রায়ের ‘মথিউদয়ের তারা’ গল্পটার কথা মনে আছে?’’ আমি বলি ‘তাতে সাপ দেখা নিয়ে মজার টুইস্ট আছে। একটা শ্লোকও আছে : অনিশ্চিতা যথা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা।/ সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদাত্মা বিকল্পিতাঃ’ সংস্কৃতিতে অনভ্যস্ত কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলে কবির।
‘মানে, অন্ধকারে কোনো দড়ি দেখে আমরা সাপ মনে করতে পারি, আসলে আলো নিয়ে এলে দেখবো সেখানে কোনো সাপই ছিল না। ওটা দড়ি। ওটা মায়া। এই তো।’ আমি মৃদু হাসি জিইয়ে রেখে বলি ‘একদম মুখস্থ করে ফেলেছো দেখছি।’
‘আমি ভাবছিলাম সংসদ ভবন থেকে বের হইচে’ কবির হয়তো রঙ্গ করার জন্যই বলে।
‘ভালই বলেছো। সংসদ ভবন থেকে সাপ বের হচ্ছে, হাজার হাজার সাপ। দলীয় সাপ, আন্তর্জাতিক সাপ, গণতন্ত্রের সাপ। সাপেরও বাহার জন্মেছে, দারুণ প্রতিকী। এটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারো। প্রতিকাশ্রয়ী গল্প।’ আমি রঙ্গটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলি।
বোধ শূন্য মাথা দোলায় কবির।
কবির সাহিত্য-উৎসাহী ছোট ভাই। গল্প লেখে। পাঠোভ্যাসের কারণে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর রহস্য গল্প ওর পছন্দ। এর মাঝেও গ্রামীণ প্রেক্ষাপট আনতে চায়। কথাও বলে প্রমিত বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক শব্দ মিলিয়ে। গত কয়েক বছরের শহরবাসে ওর এই পরিবর্তন।
কবির পরিবারের সঙ্গে থাকে, মিরপুর। এখান থেকে গাড়িতে ১৫-২০ মিনিটের পথ। পকেট খরচের জন্য একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়। বন্ধের দিনগুলোতে ফোন করে চলে আসে আড্ডা দিতে। বিকেল থেকে সাহিত্য নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিই। আড্ডা দিতে দিতে কখনো রাত হয়ে যায়। তারপর একসঙ্গে আসাদ গেটে এসে সাহিত্য সাময়িকী কিনি, তারপর ও ফিরতি বাসে ওঠে।
‘শুধু সংসদ ভবন কেন, দক্ষিণে ন্যাম ভবন, উত্তরে নেতার কবর, পূর্বে প্রধান কার্যালয়, সবখান থেকেই তো সাপ বেরুচ্ছে। সেই সাপের তাড়া খেয়ে সব এখন পশ্চিমমুখী হচ্ছে।’ একটা ম্যাগাজিনের ভেতরে আঙুল চালাতে চালাতে প্রসঙ্গটা কবির চাউর করে তোলে।
‘হ্যাঁ’ আমি যোগ করি, ‘দুনিয়া আর আখেরাতে দুই স্বর্গই তো আমাদের পশ্চিমে। ওই দিকে যাবে না তো কোন দিকে যাবে?’ নতুন স্টলের পাশে হাফ-চোকির ওপর ছড়ানো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাতে বুলাতে আমি বলি।
এই স্টলটা স্টেশনারি-কাম-পেপার স্ট্যান্ড। বামন পরিসরে এটি ভিঞ্চি হয়ে আছে। স্টলের ছোট ছোকড়াটা আমাদের ওপর নজর রাখছে, আমি খেয়াল করি। সহকারী হবে হয়তো। মালিক গোছের একজন আছেন, মোবাইলে ফ্লেক্সি লোড দিচ্ছেন। ব্যবসা জমানোর পলিসি হিসেবে এটা মন্দ না। ত্রিশোর্ধ যুবকটার মুখ ভর্তি দাড়ি। গোঁফ ছোট করে ছাটা। পশ্চিমা ধাঁচের হিপহপ পোশাক গায়ে। ডান হাতের ঢিলেঢালা ‘রিস্ট ওয়াচ’টা হাত ঝাঁকিয়ে মাঝে মাঝে কুনইয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল সে। কখনো কখনো সেও উঁকি দিচ্ছিল আমাদের দিকে।
আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা বলছে, ফুটপাতের দোকানিরা বেশিক্ষণ ভিড় পছন্দ করে না। টাকা দিবে পেপার নিবে, ব্যাস। ওয়ান স্টপ সার্ভিস। আমরা নেহায়েত পুরনো সাপ্লিমেন্টারি ম্যাগাজিন কিনতে এসেছি জানলে ভীষণ বিরক্ত হবে। তিন টাকার পত্রিকা, অহেতুক সময় নষ্ট- এমন।
আমি কয়েকটা সাহিত্য পত্রিকার নাম বলি। যা নিশ্চিতভাবেই ওর কাছে থাকবে না। তাতে স্টলের সামনে দাঁড়ানোটা সহজ হয়।
‘আমার চাচাতো ফুপু মনে হয় সাপের কামড়ে মারা গেছেন’ খানিকটা আদিষ্ট ভাষায় কবির বলে।
আমি একটা সাহিত্য পত্রিকা হাতে তুলে নেই। ‘ঘটনাটা কী রকম?’ পত্রিকার ওপর চোখ রেখে বলি।
‘ফুপু মারা গেছেন ১৯৮৫-৮৬’র দিকে।’ কবির শুরু করে।
কবিরের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। ওদের বাড়িতেও কম-বেশি যাওয়া-আসা ছিল আমার। সেই সুবাদে পারিবারিক অনেক কাহিনীই অল্প-বিস্তর জানি। তাই কবির যা বলে সহজেই মাথায় তার একটা দৃশ্যকল্প তৈরি হয়ে যায়।
কবিরের ফুপু তুলা রাশির মানুষ ছিলেন। আশপাশে কাউকে সাপে কাটলে হাত চালান দেয়ার জন্য তাকে ডাকা হতো। তিনি বাড়ি থেকে সাপ তাড়ানোর বিদ্যা জানতেন। তিনি যখন মারা যান, তখন তার তেমন বয়স হয়নি। ৩৫-৩৬ বছর হবে। তেমন অসুখও ছিল না, শুধু খালি-ঘরে শুয়ে থাকতেন।
‘তিনি তো ডিভোর্সি ছিলেন, তাই না?’ চোয়াল নাড়িয়ে আমি জিজ্ঞেস করি।
‘না। তবে আলাদা থাকতেন।’ নিরুত্তাপ কণ্ঠে সে বলে।
তখন জন্ম নিয়ন্ত্রণে ওভারিসিস পদ্ধতিটি গ্রাম পর্যায়েও চলছিল। একটা ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে ওভারি টিউব বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে সন্তান ধারণ বন্ধ করা হতো। তাতে ছয়মাস, এক বছরের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যেত না; করলে একেবারে পাকাপাকি, নয়তো না। পাকিস্তান আমল থেকে শিক্ষিত ও শহুরেদের মধ্যে এর চল থাকলেও স্বাধীনতার পর দেশে বিষয়টা ক্রমেই আলোচিত হতে থাকে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারের লোকজন গ্রামে গ্রামে সেই পদ্ধতি প্রচার করে বেড়াত। গ্রামের গণ্যমান্য লোকের উঠানে মিটিং করত। কবিরের ফুপু তখন গর্ভবতী ছিলেন। একবছরের মধ্যেই দ্বিতীয় বার মা হতে যাচ্ছেন। গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে তিনি একদিন গিয়েছিলেন সেখানে। তার কিছুদিন পরই ফুপুর এ্যাবরশন হয়ে যায়। এ জন্য ফুপা তাকে সন্দেহ করতো-তিনি নিশ্চয়ই কোনো ওষুধ খেয়েছেন। তার কিছু দিনের মধ্যে তার প্রথম সন্তানটাও মারা যায়। তারপরই তিনি সাপ তাড়ানো বিদ্যা শেখেন।
‘‘লোকে বলে, থইল্যা বন্ধ করলে কোনো দিন পাইল্যা বাঁচে না। তারপর ফুপু আর কখনো সন্তান নিতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত ফুপা বংশ রক্ষা হচ্ছে না দেখে আরেকটা বিয়ে করেন। সেই ঘরে একটা ছেলেও হয়েছিল। তবে আড়াই বছরের মাথায় এক রাতে কিসের কামড়ে যেন ছেলেটা মারা যায়। কেউ বলে ‘ঘরঘরনী’ সাপের কামড়ে মারা গেছে। বাড়ির উত্তর পাশে বাঁশ ঝাড়ের কথা মনে করে কেউ বলে ছেলেটাকে ‘বাঁশপাতারি’ সাপের কামড়ে মারা গেছে। বাঁশপাতারি সাপের কথা মনে করে তাকে ‘গাছমাটি’ দেয়া হয়।’’ কবির বলে যায়, ম্যাজিসিয়ানের মুখ থেকে অনর্গল সুঁতা বের করার মতো। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে আবার।
বাঁশপাতারি সাপ বাঁশ ঝাড়ে থাকে। চিকন আর হাত দেড়েক লম্বা হয়। বাঁশ যখন কোনো কারণে ফেটে যায় বা ছিদ্র হয়, বাঁশপাতারি সেখানেই আশ্রয় নেয়। কাউকে কামড়ানোর পর এই সাপ যদি বাঁশের মাথায় উঠে যায়, তাহলে বিষও রোগীর মাথায় উঠে যায়। তাৎক্ষণিক সাপটিকে বাঁশে উঠতে না দিলে কিংবা বাঁশ থেকে দ্রুত নামিয়ে আনতে পারলে রোগীর বিষও নেমে যায়। তখন ওঁঝা দিয়ে বিষ নামালেই রোগী বাঁচে। তাই বাঁশপাতারি সাপ কাউকে কামড় দিলে বাঁশতলায় কাফনে মোড়া কলাগাছ রেখে দেয়া হয়। তাই দেখে সাপ মাটিতে নেমে আসে। ততক্ষণে সাপে কাটা রোগী একেবারে মারা না গিয়ে থাকলে চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করার সম্ভাবনা থাকে। কবিরের ফুপাত ভাইয়ের বেলায়ও তাই করা হয়েছিল। কিন্তু বাঁচে নি।
‘লোকে বিশ্বাস করে, বাঁশপাতারি সাপ বাঁশ কামড়ে চলাফেরা করে। তাই এই সাপ কাউকে দংশন করলে সবাই গিয়ে বাঁশ ঝাড় নাড়ায় যেন সাপটা বাঁশে চড়তে না পারে।’ কবির বলে।
কবিরের বর্ণনা শুনে মনে হয় ও হয়তো সুঁতানড়ি সাপের কথা বলছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানান লোকগল্প। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি ‘তুমিও ওসব বিশ্বাস কর?’
কবির প্রথমে চুপ করে থাকে। তারপর আবার শুরু করে।
‘তখন থেকেই ফুপার দ্বিতীয় স্ত্রী ফুপুকে সন্দেহ করতো- এটা বড় বৌয়ের কোনো কাজ। হিংসে করে এই কাজ করেছে সে। আড়ালে অনেকেই অনেক কথা বলতো। ফুপু কিছু বলতেন না। একদিন কি কারণে যেন ফুপা তাকে খুব করে পেটায়। সেই রাতে ঘুমের ঘোরে ফুপাকেও কিসে যেন কামড় দেয়। রাতেই ফুপা মারা যায়। সবাই ফুপুর দিকে আঙুল তোলে। ফুপা মারা যাওয়ার পর সবকিছু থেকে ফুপু নিজেকে গুটিয়ে নেন। শেষের দিকে তো ঘর থেকেই বেরুতে চাইতেন না।’
ফুপুর কথা শুনতে শুনতে ফ্রিদা কাহলো’র ‘দ্য উনডেড ডিয়ার’ পেইন্টিংটার কথা মনে পড়ে আমার। বনের ভেতর একটা হরিণ, মুখটা ফ্রিদার নিজের। হরিণটার সিনায়, পিঠে, কোমরে বিঁধে আছে তীর। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। যন্ত্রণাকাতর হরিণটা হয়তো বনের ভেতর মুখ লুকাতেই চাইছে। পাতা ঝড়া গাছগুলোর পেছনে একটা সমুদ্র। রহস্য আর বিশালত্বের প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘মাঝে মধ্যেই ফুপু দু’তিনদিন ঘরের দরজা আটকে থাকতেন। এমনকি তিনি অনেককে বলতেন, মৃত্যুর পর তার সোনা-দানা সব দিয়ে যেন এই ঘরের ভেতরেই কবর দেয়া হয়। একবার তিনি সপ্তাহখানিক ঘরে থাকলেন।’ তির তির করে বলে কবির, ‘তারপর এক সকালে ফুপুকে মৃত পাওয়া যায়।’ এ কথা বলার পর পূর্ণ শ্বাস নিয়ে থামে সে।
‘ফুপুর মৃত্যুর সঙ্গে সাপের প্রসঙ্গ আসছে কোত্থেকে?’ আমি অধীর হয়ে বলি।
‘আছে। সাপের ঘটনা আছে।’ কবির মাথা নেড়ে বলল। ‘ফুপু মারা যাওয়ার পর সবাই ঘরে ঢুকে দেখে, ঘরের ভেতরে অনেক আলো। চারদিক একদম চকচকে-তকতকে। চৌকির ওপর নতুন চাদর বিছানো। বালিশ-কাঁথা, সবই নতুন। বলিশের গিলাফও নতুন। চৌকির ঠিক মাঝখানে শুয়ে ছিলেন ফুপু। তাকে যখন বালিশ থেকে তোলা হয়, দেখা যায়, বালিশের মধ্যে দুইটা ছিদ্র। সবাই আশ্চর্য হয়, নতুন বালিশে এমন ফুটো কেন?’ কবিরের চোখে-মুখে বিস্ময়। ‘তারা গিলাফ খুলে দেখে বালিশের উয়ারেও ছিদ্র। একেবারে এ-ফোঁড়, ও-ফোঁড় হয়ে গেছে। তারপর দেখা গেল ফুফুর মাথার মধ্যেই অবিকল দু’টি ছিদ্র। লোকে বললো, তাকে আগে থেকেই চুষে চুষে খেয়েছে। এখন দম বের হলো।’
সেদিন ফুপার দ্বিতীয় স্ত্রী উচ্চ নিনাদে বলতে লাগলো, এই মাগীই কাল নাগিনী। ও-ই আমার পুলা খাইছে, আমার স্বামী খাইছে। এখন নিজে মরলো। মাগী কুফরি কালাম জানতো, গোপনে মনসা পূজা দিতো, সাপ চালান দিতো।
দুধরাজ সাপের কথা আমি জানি। দুধেল গাভীর বান চুষে দুধ পান করে। সে বিষধর সাপ নয়। তাছাড়া সাপ কখনো দাঁত দিয়ে রক্ত চোষে না, বরং কামড় দিয়ে বিষ ঢেলে দেয়। শিকার গিলে খায়। কিন্তু কোনো সাপ মানুষের মাথা থেকে দিনের পর দিন রক্ত চোষে, এমন মিথ তো কোনোদিন শুনিনি। তারপরও ‘সাপে কাটার আর কি নমুনা পাওয়া গেল’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘গোসলের সময় তার স্তনেও নাকি চিকন চিকন আঁচড় পাওয়া গিয়েছিলো। গাভীর বানে যেমন থাকে। সবাই বললো, সে বুকের দুধে সাপ পুষতো। মিথন করে বুকের দুধ খাওয়াতো। এখন খাওন ফুরাইছে তাইতে মেরে ফেললো।’
মিথন কথাটা বহুদিন পরে শুনলাম ওর মুখে। আমাদের গ্রামের ঈমান ফকির কথাটা বলতেন। অমাবস্যা-পূর্ণিমার রাতে তিনি কি সব শিকড়-বাকড় খাইয়ে দেন। তারপর স্তন দুইয়ে দিলে প্রসূতিহীন নারীর স্তনেও দুধ আসে। একেই বলে মিথন। কবির তেমন কিছু জানে কি না জিজ্ঞেস করলে সে মাথাটা দুইবার ডানে-বামে কাত করে।
দৃশ্যটা আমার ভাবতে গিয়ে ফ্রিদা কাহলো’র সেলফ পোর্ট্রেটই চোখে ভাসে। দুটো সাপ তার স্তন চুষছে। ‘দারুণ গল্প তো!’ একরাশ দম ছেড়ে আমি বলি।কবির মাথা নিচু করে আছে।গল্পটি শেষ হয়েছে মনে হলো।
পরক্ষণেই কবিরের ঠোঁট নড়তে দেখে বুঝতে পারি, তার গল্প শেষ হয়নি।
‘আমাদের বাড়ির পাশে যে একটা খালি ভিটা’ কবির আমার চোখে-মুখে তার ছাপ খুঁজে ‘লোকে বলে সাপা ভিটা, ওইটাই ছিল ফুপুদের বাড়ি।’ কবির বলে।
‘ফুপু মারা যাওয়ার পর, তার কথা মতো, তাকে ঘরের ভেতরই কবর দেয়া হয়। কিন্তু তার এক বছর পর একজন সাপুড়ে এসেছিল ফুপুর ভিটায়। সেই নারিস্যা-মেঘালয় থেকে। তাকে কেউ চেনে না। সে ভিটার উপর তিনটা চাপড় দিয়ে বলে, ফুপুর ঘরটা সে খুঁড়তে চায়।’
‘কেন?’ আমি বলি।
‘সাপুড়েটা এসেছে মনসা মঙ্গলা সাপের খোঁজে। সে নাকি স্রেফ স্বপ্নে দেখে এখানে এসেছে। এই ঘরের ভিটায় নাকি সেই সাপের গন্ধ পেয়েছে। তার ধারণা ওই ঘরেই সাপটা আছে।’
‘খুঁড়তে দিল?’ এক নতুন উৎকণ্ঠায় আমি বলি।
‘নাহ্’ হাফ ছেড়ে বলে কবির ‘আমার চাচারা দেন নাই। সাপুড়ে কোনো কোনো রাতে খোঁড়ার চেষ্টা করেছে। পাশের বাড়ির মানুষ টের পেয়েছে। সকালে সবাই ঘরের ভিটিতে খোঁড়ার চিহ্ন দেখেছে।’
ওই ঘরটা এখন নাই, অনেক আগেই ভেঙে গেছে। ’৮৮, ’৯৮-র বন্যা তো আলাদা করে আর চেনা যায় না। ওটা এখন শূন্যভিটা মাত্র। একবার দুই গাঙ ভাঙনি এসেছিল থাকতে। লোকজনের কাছে শুনে তারাও চলে গেছে। ‘ভয়ে কেউ থাকে না।’ কবির জানায়।
‘এ নিয়ে শুধু একটা গল্প হতে পারে।’ আমি ওকে বলি।
ও মাথা মৃদু আগ-পাছ করে। চোখ পিট পিট করে কিছুক্ষণ, আর কী যেন ভাবে। এরপর আমরা গল্প নিয়ে কথা বলি। আমরা নিজেদের খুঁড়ে খুঁড়ে বুঝতে চেষ্টা করি, কীভাবে একটা পরিবারিক ঘটনা সততই গল্প হয়ে উঠতে পারে। আমরা সাপ দেখা, না-দেখা নিয়ে সত্য ও মায়া বিষয়ে দার্শনিক চিন্তার বিস্তার ঘটাই। আমাদের মনে হয়, সত্যই সেখানে সাপ ছিল। কিন্তু আমরা মায়ার বশবর্তী হয়ে গিয়ে ছিলাম।
এরই মধ্যে একজন লোক আমাদের পাশে এসে ঠেলে জায়গা করে দাঁড়ায়। ‘এ্যাই তোমরা কেমন আছো’ নাটুকে গলায় কথা বলে সে। কথার মধ্যে খানিকটা গদগদ আর ভাঁজ করা ভাব আছে। দোকানি ছোকরা দু’টোর চেহারা চকচক করে ওঠে। দ্রুতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে বড় ছেলেটা। আমাদের উপস্থিতি উপেক্ষা করেই লেজ ফোলানো বেড়ালের মতো লোকটার আশপাশে ঘুরঘুর করে।
‘এই ছেলেরা, তোমরা এখানে বসে আছো আর ওখানে কত বড় একটা সাপ মেরে ফেললো, টেরই পেলে না।’ শেষ চমকের মতো লোকটা বলে।
কবির আর আমি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। আমাদের সন্দেহ গাঢ় হয়, ‘আমরা কি তাহলে সত্যি সাপ দেখেছিলাম?’ আমরা নিজেদের অবিশ্বাস করতে শুরু করি।
এগিয়ে দেখি সত্যি একটা সাপ। গাড়ির চাকায় থেতলে আছে। তবে ডোরা না গোখড়া বোঝা গেল না।