সাদাত। পুরো নাম সাদাতউদ্দিন আহমেদ এমিল। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায়। বর্তমানে ডেইলিস্টারের নিয়মিত কার্টুনিস্ট। দুহাতে কার্টুন আঁকেন। কমিকসও। সাথে চমৎকার চমৎকার সব প্রচ্ছদ-ইলাস্ট্রেশন। কার্টুনিস্ট-চিত্রকর সাদাতের সঙ্গে ফেসবুক ইনবক্সে করা আলাপচারিতা…
প্রশ্ন: আপনার কার্টুন আঁকার শুরুটা কিভাবে?
সাদাত: আমাদের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের কিছু কিছু ক্লাস খুব বোরিং হতো। ক্লাস সিক্সের দিকে, ক্লাসরুমে বিরক্তিকর লেকচার চলতে শুরু হলে, আমি সেই শিক্ষকের কার্টুন আঁকতে শুরু করতাম। বিশেষ করে অঙ্ক খাতায় আঁকবার মতো অনেক জায়গা থাকতো, আর ব্যাকা-ত্যাড়া করে সেই শিক্ষকের মুখ এঁকে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশও হতো। বন্ধুরাও এই ব্যাপারটায় খুব মজা পেতো। সেভাবেই শুরু।
প্রশ্ন: কখন মনে করলেন এটাকে পেশা হিসেবে নিবেন? এ পেশার অভিজ্ঞতা কি রকম?
সাদাত: কঠিন প্রশ্ন। বিস্তৃত উত্তর দিতে হবে। আসলে, কার্টুন পেশা হিসেবে নেয়ার তো পরের কথা, কার্টুন আঁকার কথাই আমি সেভাবে চিন্তা করিনি কখনো। আর স্কুল-কলেজ জীবনে ছাত্র হিসেবে আমি যথেষ্ট ভাল ছিলাম। আমাদের দেশে ভাল ছাত্রের যা হয়, আমিও নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করছিলাম। তবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই আচমকা একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। তখনকার প্রথম আলোর আবাসিক সম্পাদক আবুল মোমেন আমার ড্রয়িং দেখে আলোকিত চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমি এক বাক্যে সুযোগটা গ্রহণ করেছিলাম। ২০০১ এর সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ আমার প্রথম কার্টুন ছাপা হয় আলোকিত চট্টগ্রামের প্রথম পাতায়। একজন সদ্য কলেজে পা দেয়া ছাত্র আবিস্কার করলো যে, কার্টুন আঁকলে টাকাও পাওয়া যায়!!! সেই আনুষ্ঠানিক শুরু বলা যায়। তারপর টানা তিন বছর প্রতি সপ্তাহে প্রথম পাতায় কার্টুন দিয়েছিলাম। তবে পেশার কথা একবারো মাথায় আসেনি, তখনো আমি চট্টগ্রাম কলেজে গভীর মন(!!) দিয়ে সায়েন্স পড়ে যাচ্ছি, ইঞ্জিনিয়ার হবো বলে… কিন্তু আঁকাআঁকির ঝোঁক আমাকে নিয়ে আসলো চারুকলায়। তখন ভাবলাম পেইন্টার হবো, কার্টুন আর আঁকবো না। কিন্তু কিভাবে যেন আবার কার্টুনে জড়িয়ে গেলাম। তবে পেশা হিসেবে নেবার কথা চিন্তা করার আগেই থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় প্রায় একই সাথে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার পত্রিকায় চাকরির অফার পাই। পরে অনার্স শেষ হওয়ামাত্র ডেইলি স্টারে যোগ দেই।
আর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে এক কথায় বেশ মজার। দেশের হর্তা-কর্তাদের নিয়ে কার্টুন আঁকি, ছাপা হয়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। যাদের আঁকি, তারাও অনেক সময় প্রতিক্রিয়া দেখায়। সব মিলিয়ে বেশ রোমাঞ্চকর বলা যায়।
প্রশ্ন: আমাদের এখানে কাটুন আঁকায় কি কি সমস্যা ফেস করতে হয় একজন আর্টিস্টকে?
সাদাত: বেশিরভাগ কার্টুনিস্ট যেটা ফেস করে, সেটা হলো চাপিয়ে দেয়া আইডিয়া। মানে সম্পাদক, উপ-সম্পাদকের ইচ্ছা মতো কার্টুন আঁকবার অর্ডার। আমার সে সমস্যায় পড়তে হয়নি। আমি প্রায় স্বাধীনভাবেই কাজ করেছি সবসময় এবং শতভাগ নিজের আইডিয়াতে। বাঁধা বলতে যতটুকু পেয়েছি, সেটা আমাদের সমাজ, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্ম, আচার তথা সামাজিক বাস্তবতার কারণে। রাতারাতি কার্টুন এঁকে হাজার বছরে গড়ে ওঠা সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস বা গোঁড়ামি পাল্টে দেয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি না। এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রামের ব্যাপার। তাই কিছু বিষয়ে এখনো আমরা কার্টুন আঁকতে পারি না। এটা একটা সমস্যা।
আর রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট রাজনৈতিক চাপের মুখে থাকে সবসময়। এ সমস্যা ব্যখ্যা করা বিপদ!

প্রশ্ন: আঁকার সময় কোন কোন বিষয়কে প্রায়োরিটি দেন?
সাদাত: কার্টুন আঁকার শুরুতে আমার প্রথম কাজ মনে করি নিজেকে আমজনতা ভাবা। অনেকে বলেন যে, রাজনৈতিক কার্টুনিস্টকে কোন না কোন দলের সমর্থক হতে হয়। আমি মোটেও এটা বিশ্বাস করি না।আমি একজন সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে বলতে পছন্দ করি।
আর দেশ, দেশের স্বার্থ, সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান। মানে এমন কোন অবস্থান না নেয়া, যেটায় দেশের ক্ষতি।
প্রশ্ন: আপনার পছন্দের আর্টিস্ট কে কে? আমাদের এখানে বা বাইরে? তাদের কোন কোন দিক আপনাকে টানে?
সাদাত: পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট হিসেবে, ইকোনমিস্ট-এর কার্টুনিস্ট ‘কাল’-এর কাজ আমার ভালো লাগে। প্রথমত কাজের প্রতি তার যত্ন খালি চোখেই বোঝা যায়। অনেক ডায়লগ নির্ভর হলেও তার থিমগুলো ভাল লাগে। কালি তুলি কলমে আঁকেন, মানে নন ডিজিটাল। এ ব্যপারটাও আমার ভাল লাগে।
আরেকজন আছেন, জর্ডানের আমজাদ রাশমি। মজার ব্যপার হলো, আরব দেশগুলোর পলিটিক্যাল কার্টুন কিন্তু খুবই ভাল। যেটা আমরা অনেকেই জানি না। ওরা সরাসরি অনেক কিছু বলতে পারে না, যেটা সিম্বলিকভাবে প্রকাশ করে। ডায়লগ অনেক কম থাকে। আমজাদ রাশমিও সেরকম। ডায়লগ প্রায় নেই বললেই চলে, ফলে ভাষাগত বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশি হিসেবে তার বক্তব্য বুঝতে আমার মোটেও কষ্ট হয় না।
দেশে শিশির ভট্টাচার্য্য আমার প্রিয় কার্টুনিস্ট। আঁকার দক্ষতার সাথে শক্তিশালী থিম, এই দু’য়ের এতো চমৎকার মিশেল খুব সহজে পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: আপনি তো রাজনৈতিক কার্টুনই আকেঁন। আঁকতে গিয়ে কিরকম সেন্সরশিপের ভিতর দিয়ে যেতে হয়? কোন হুমকি-ধামকি কি শুনতে হয়েছে বা এরকম কোন অভিজ্ঞতা?
সাদাত: একটা সময় বেশ ক’দিন আমার ঘুম ভেঙ্গেছে গালাগাল শুনে। যে পক্ষের বিরুদ্ধে কার্টুন ছাপানো হতো, সে পক্ষের কেউ হয় রাজাকার, নয় দালাল ইত্যাদি শ্রাব্য-অশ্রাব্য গালাগাল দিতো। বেশ কিছুদিন বুঝতে পারিনি এরা ফোন নাম্বার পেলো কি করে। অনেকদিন পর আবিষ্কার করলাম প্রথম যখন ফেসবুকে একাউন্ট করেছিলাম, তখন থেকেই আমার ফেসবুকেই ফোন নাম্বার দেয়া ছিল। সেটা অফ করার পর গালাগাল অনেক কমেছে।
আর সেন্সরশিপ তো আছেই। সবকিছু নিয়ে তো কথা বলা যায় না। এটা বাস্তবতা। আর হুমকি-ধামকি নিয়ে কিছু বলতেই চাই না। এটা নিয়ে আলোচনা আর তাদের গুরুত্ব এবং উৎসাহ দেয়া একই কথা।
প্রশ্ন: আমাদের এখানে একাডেমিতে কার্টুন শেখানো হয় না। বিষয়টা কিভাবে নেন? কতটুক দরকার এটার?
সাদাত: শেখানো তো পরের কথা, কার্টুনকে আর্টফর্ম হিসেবে স্বীকারও করা হয় না। আমি ছিলাম চারুকলার পাইন্টিং ডিপার্টমেন্টে। মাস্টার্সে রাজনৈতিক কার্টুন ও কার্টুনিস্ট নিয়ে একটা থিসিস করেছিলাম। সেটা করতে গিয়ে অনেক বাঁধার মুখে পড়েছি। কার্টুন যেহেতু আর্টফর্ম না, তাই এটা নিয়ে করা যাবে না! পরে আমি নিউইয়র্কের এক থিসিস পেপার যোগাড় করে নন্দনতাত্বিক আলোচনা করে দেখিয়েছি যে, এটা ‘আর্ট’ হবার সকল criteria ফুলফিল করে। খুব ভাল কিছু হয়েছে তা হয়তো নয়। কিন্তু কার্টুনকে বাংলাদেশের মাটিতে আর্টফর্ম হিসেবে দাবী করার মতো এটাই প্রথম পদক্ষেপ। হাহহা
তবে সবচাইতে জরুরি ব্যাপার হলো- কার্টুন আর্ট কি আর্ট না, এটা নিয়ে কার্টুনিস্টদের কোন মাথাব্যথাও দেখি না। সবাই কাজটা করে মজা পায় এবং ডেডিকেশন আছে সবার। তাই বলা যায়, এ গতিতে এগিয়ে গেলে ভাল কিছু কাজ হবে ভবিষ্যতে, তখন নিশ্চয় একাডেমিতে এটা নিয়ে পড়ালেখার চাহিদা তৈরি হবে। তখন আশা করি কেউ বলবে না- ‘তুমি তো আর্টিস্ট না, কার্টুনিস্ট!’
প্রশ্ন: আপনার কখনো কি মনে হয়েছে এখানকার রাজনৈতিক কার্টুন আমাদের এস্টাবলিশমেন্টকে কোনভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়? বা চেষ্টা আছে কোন?
সাদাত: হুম খুব গুরুগম্ভীর প্রশ্ন। সহজভাবে যদি বলি, কার্টুন আসলে একটা আন্দোলন। আশেপাশের অসংগতির বিরুদ্ধে আঁকাআঁকির মাধ্যমে প্রতিবাদ, দৃষ্টি আকর্ষণ। তাই কোন না কোনভাবে এটা এস্টাব্লিশমেন্টকে চ্যালেঞ্জ তো করেই। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা হয়তো খুব খালি চোখে বোঝার মতো নয়।
এর কারণ হিসেবে যদি বলি, রাজনৈতিক কার্টুন হয় রাজনীতি নিয়ে। আমাদের এখানে এখনো যে মানের রাজনীতি হয়, সেই রাজনৈতিক পরিবেশের বেশিরভাগ বাসিন্দা এত তাত্বিক বিষয় বোঝার মতো পরিপক্ক হয়নি। কার্টুন যেহেতু গণমানুষের আর্ট, তাই সর্বস্তরের মানুষ যাতে বোঝে, সে ব্যপারটি মাথায় রাখতে হয়। ফলে খুব উচ্চমানের উচ্চ ভাবের কোন কার্টুন, সে যতো ভালই বা বিশ্বনন্দিত হোক, আদতে নিজের সমাজে সেটার কোন প্রভাব পড়বে না, যতক্ষণ না লোকে সেটা বোঝে। ব্যাপারটা আমি ব্যাখ্যা করি এভাবে – হিব্রু, আরবি বা চাইনিজ ভাষায় যদি অবশ্যপাঠ্য কোন রচনা বা কবিতা, প্রবন্ধ তৈরি হয়ে থাকে, সেটা ততক্ষণ আমার কাছে মূল্যহীন যতক্ষণ না তা আমার কাছে বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ হয়ে আসে।
মানে হলো, আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও শিক্ষার মানের উন্নতির ওপর নির্ভর করে আমাদের কার্টুনের মানও। এমন অনেকবারই হয়েছে যে, ভাল মানের একটা কার্টুন মানুষ বুঝতেই পারেনি, কিন্তু খুব কমন হাল্কা থিমের কার্টুন হিট হচ্ছে। তাই আমাদের দেখার চোখ তৈরি করতে আরো কিছু সময় লাগবে। তখন আশা করি এই এস্টাবলিশমেন্টকে চ্যলেঞ্জ করার প্রচ্ছন্ন ব্যপারটা আরো পরিস্কার করার সুযোগ তৈরি হবে।
প্রশ্ন: আমাদের এখানে কমিক্স অইভাবে দাঁড়ায় নাই। কারণ কি হতে পারে এটার? আর এখন যারা এ মাধ্যমটা নিয়ে কাজ করছেন, তাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাদাত: বলে রাখা ভাল আমাদের এখানে কার্টুন চর্চা অনেকটা বিচ্ছন্নভাবে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০০ পর্যন্ত কার্টুনকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছে ২-৩ জন। ফলে কমিক করার জন্য যে সামাজিক আর্থনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজন, সেটা যে ছিল না তা অনুমান করা কষ্টকর কিছু না। ২০১১ তে আমরা যখন কার্টুনিস্ট এসোসিয়েশন ফর্ম করলাম তখন দেখলাম জীবিত সব কার্টুনিস্টের নাম লিস্ট করেও সংখ্যাটা ৩৫ এর বেশি হয়নি। এর মধ্যে বেশিরভাগই অনিয়মিত বা অন্য পেশায় নিয়োজিত। আমি বলতে চাইছি কমিক করার জন্য একদল পেশাদার আর্টিস্ট প্রয়োজন। যারা এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহের মতো আত্মবিশ্বাসী হবে। কমিক এমন একটা কাজ যেটা আর দশটা কাজের ফাঁকে ফাঁকে করার মতো না। এখন সেই পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। কমিক শুরু হয়েছে। আমি নিজে বেসিক আলী-খ্যাত শাহরিয়ার খানের সাথে মিলে সোমোর অভিযান ১ এবং ২ করেছিলাম ২০০৮-২০১০ এ। এরপর ঢাকা কমিক্স এসে তো কমিকের জোয়ার আরো বাড়িয়ে দিলো। ইতোমধ্যে তারা অনেক ভাল কাজ করছে। ৪-৫ বছর পর এই মান অন্তত তথাকথিত বিশ্বমানে চলে যাবে বলে আমি মনে করি। শুরু যখন হয়েছে, বাঁধা না পেলে এটা একটা উচ্চমানে পৌঁছাবে, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।
