পাণ্ডুলিপি থেকে গল্প
পাণ্ডুলিপি : মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিলো
প্রকাশক : চৈতন্য, অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যু ও মার্কেজের চিঠি
নূর সিদ্দিকী
হ্যালো আব্দুস সালেক একটা সিএনজি বা অ্যাম্বুলেন্স যা পাও তা নিয়াই তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসো। আমারে হাসপাতালে নিয়া যাইতে হইবো। এরপর আর বিস্তারিত শোনার অপেক্ষা না করেই আমি ফোনটা কেটে দিই। বুঝতে বাকি থাকে না যে লোকটার অবস্থা বেগতিক। কিন্তু কি এমন হলো যে তাকে হাসপাতালেই নিতে হবে? সেটা অনুমানের চেষ্টা করার আগে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরের পার্ক থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে মিরপুর রোডে চলে আসি। যদিও এই কয়েক মিনিটে আমার অনুমান করা সম্ভব হয়, ডায়রিয়া হতে পারে। যে গরম পড়েছে তাতে ডায়রিয়া হওয়া বিচিত্র কিছু হবে না। তার ওপর লোকটার আবার তরমুজ খাওয়ার বাতিক আছে। যদিও ডাবেই তার আসক্তি দেখেছি। আব্দুস সালেক চলো ডাব খাই- এটা তার কমন ডায়ালগ। হোক কারওয়ান বাজার, হোক শাহবাগ মোড়। ডাবের পানি বিষয়ে তার বয়ানও খুব মজার। ডাব হলো একটা আসল কুদরতি ফল, দেড় দুই তলা দালানের সমান উঁচা একটা গাছে এমন শক্ত খোলসের মধ্যে কি সুস্বাদু পানি, তেলেসমাতি ছাড়া আর কি। আমি কথাগুলো তার মুখে কম করে হলেও দুই-আড়াইশবার শুনেছি। ডাবের স্ট্রতে চুমুক দিয়ে তিনি কথাগুলো বলতে পছন্দ করেন। টিপু ভাইকে সেই অর্থে একজন ডাবাসক্তও বলা যায়।
শুধু টিপু ভাই বলে পরিচয় করানোটা ঠিক হচ্ছে না। তিনি সাখাওয়াত টিপু। দীর্ঘকায় মানুষ। নাকের নিচে বেশ পুরো একজোড়া গোঁফও আছে তার। স্বাস্থ্য মাঝারি। বঙ্গীয় কৃষ্ণবর্ণ। বুঝতে পেরেছি সাখাওয়াত টিপুর দেহগত পরিচয়ও তাকে চিনিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট নয়। তার মতো এমন দীর্ঘকায় গোঁফওয়ালা মানুষ এই শহরে অনেক আছে। আর তেমন মানুষের নাম সাখাওয়াত টিপু না হোক সাখাওত উল্লাহ বা সাখাওয়াত হোসেন বা সাখাওয়াত আলী হওয়া অবিশ্বাস্য হবে না। যাক তার পরিচয় আর একটু পরে দিলেও চলবে। আগে অ্যাম্বুলেন্স বা সিএনজির সন্ধান করি।
শহরের রাস্তায় খালি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া খুব কঠিন। যতগুলো আমার সামনে দিয়ে সেদিন গিয়েছিলো সবগুলোতেই রোগী ছিলো। রোগী ছিলো শতভাগ নিশ্চিত না হলেও যেহেতু বাহনটি সাইরেন বাজিয়ে চলছিল তাই ধরেই নিচ্ছিলাম রোগী আছে। অথবা এমন হতে পারে আমার ইশারা অ্যাম্বুলেন্স থামানোর জন্য যথেষ্ট নয়। রাসেল স্কোয়ারে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য চেয়ে যে মিনিট তিনেক সময় অপেক্ষা করলাম শেষমেষ তাও অকারণই মনে হচ্ছিল। ওই সময়ের মধ্যে মাত্র একটি অ্যাম্বুলেন্সকে দ্রুত ছুটতে দেখলাম পান্থপথের দিকে। ট্রাফিক পুলিশের থামানোর নির্দেশে যেন অ্যাম্বুলেন্সের গতি আরও বাড়লো। আমি বুঝতে পারলাম অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ভেবেছে কাগজ-পত্র চেক করার নামে হেনস্থা হতে হবে, অথবা ভেতরে কোন গুরুতর রোগী আছে। যাহোক অ্যাম্বুলেন্সের ভরসা নেই দেখে সিএনজি ধরার চেষ্টা করলাম। বত্রিশ নম্বর থেকে ইন্দিরা রোড হয়ে যেকোন হাসপাতালে যেতে হবে শুনেই সিএনজিওয়ালারা ছুটে পালায়। রোগী নিয়ে যেতে হবে শোনার পরও সিএনজির চালকরা যেতে রাজি না হওয়ায় একবার আমার মেজাজই বিগড়ে গিয়েছিলো। পা থেকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আমার কাণ্ড দেখে দু-একজন পথচারী সিএনজিওয়লার পক্ষে যেতে চাইলেও রোগীর কথা শুনে অনেকেই পক্ষ বদল করলো। কিন্তু তাতে সিএনজি পাওয়া খুব একটা সহজ হলো না। আরও মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করে বুড়োমত এক চাচাকে পেলাম। এই ফাঁকে সাখাওয়াত টিপু আবারও ফোন করেছেন একবার। আব্দুস সালেক কি হইলো আমি তো শ্যাষ হয়া গেলাম। এই তো আসছি বলেই সেই বুড়োমত চাচাকে প্রথমেই খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম- একজন কবি-লেখক-সাহিত্য সম্পাদক খুব অসুস্থ তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। চাচা রাজি হলেন। আমি সিএনজিতে চড়ে বসার পর চালক বুড়োচাচা বললেন- কবি না ল্যাখক কি সব কইলেন? আমি শুধু হুম করে একটা আওয়াজ ছেড়ে পথের নিশানা বাৎলে দিলাম। চাচা বললেন- আমার কাছে অসুস্থ মানুষটাই আসল কতা। বাকি পরিচয়ের দরকার নাই।
যাক সেদিন সিএনজিওয়ালা পরিচয় নিয়ে আগ্রহ না দেখালেও আজকে সাখাওয়াত টিপুর পরিচয়ে কিন্তু অনেকেরই আগ্রহ আছে। লোকটা এই ক’দিনেই মিথে পরিণত হয়েছেন। যদিও এমন কিছু একটা ঘটবে বা ঘটা উচিৎ তা আমি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। কথাটি কাউকে বলা হয়নি বলে এখন আর নতুন করে বলে নিজেকে সাখাওয়াত টিপুর খুব ঘনিষ্টজন প্রমাণের চেষ্টা করবো না। তবে এটুকু বলে রাখি তাকে কিন্তু বাসা থেকে হাসপাতালে আমিই ভর্তি করেছিলাম। সেই সন্ধ্যায় আমাকেই যেতে হয়েছিল তার ইন্দিরা রোডের ছয়তলার বাসায়।
সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যুর পর অনেকেই এটাকে সাধারণ মৃত্যু ধরে নিয়েছিল। লোকটার মধ্যে একটা পাওয়ার ছিলো। নাহলে একটা চিঠি তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। চিঠিটাকে সামান্য বস্তু ধরে নিয়ে প্রথম দিকে অনেকেই আমার কথাগুলো উড়িয়ে দিয়েছিলো – যাকে বলে একেবারে শিমুলতুলোর মত। যেহেতু আমিই সাখাওয়াত টিপুকে বাসা থেকে হাসপাতালে নিয়েছিলাম, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, তাই শেষ সময়ে তার কাছ থেকে অনেক কিছুই আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। এমনকি সেই চিঠিটিও আমার পকেটেই ছিলো।
সিএনজি থেকে নেমে এক দৌঁড়ে টিপু ভাই’র ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি তিনি লুঙ্গি পড়ে খাটের ওপরে তেরছা হয়ে শুয়ে আছেন। গতর খালি। লুঙ্গির গিঁটও ঠিক নাই। আমাকে দেখে তিনি যেন সাহসী হয়ে উঠলেন। আমি চললাম, বলেই আবারও বাথরুমে গেলেন। তার মানে আমার অনুমান শতভাগ সত্যি। লোকটার ডায়রিয়াই হয়েছে। মিনিট দুয়েক পর বাথরুম থেকে ফিরে যা বললেন, তাতে এটাও পরিষ্কার যে তাকে হাসপাতালে যেতেই হবে। চিঠিতে সেরকমই লেখা আছে। চিঠির বিষয়টি আমার মাথায়ও খেলছিল না শুরুতে। টিপু ভাই’র হাত-পা তখন কালো হয়ে আসছিল। আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল।
গতকাল রাতে দুই টুকরা তরমুজ খাইছিলাম, বুঝলা তারপর থিকাই পেট ফাঁপা শুরু। সকাল ৮টা পর্যন্ত সব ঠিক আছিলো সামান্য ভুটোরভাটোর বাদে। ১০টার দিকে ডাক পিয়ন আইসা এই চিঠিটা দিয়া যাওয়ার পর বাথরুমে যাইতে যাইতে… ধ্যাৎ আবারও যাইতে হইবো, সিএনজি আনছো নাকি অ্যাম্বুলেন্স?’ কথাগুলো টিপু ভাই বললেন, নাকি হ্যাঙ্গারে ঝুঁলানো তার পাঞ্জাবি থেকে বের হলো বোঝা গেলো না। টিপু ভাই’র অবস্থা এমন।
টিপু ভাই বাথরুমে গেলে আমি চিঠির খামটা দেখি টেবিলের উপরে রাখা। একেবারে ম্যান্দা মেরে পড়ে আছে। অথচ টিপু ভাই’র জবানবন্দি অনুসারে ওই খামের চিঠিটাই তাকে বারবার বাথরুমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আগের যুগে চিঠির মধ্যে বিষ মাখিয়ে রাজা-বাদশাদের হত্যার জন্য পাঠাতো শত্রুপক্ষ। আরব্যরজনীর গল্পে এমনটা পড়েছি। তবে কি আমাদের সাখাওয়াত টিপুর কাছে কোন গুপ্তধন আছে? থাকতেও পারে। লোকটার রহস্যের অন্ত নাই। এই তো মাসখানেক আগে শাহবাগ থেকে ফিরছি, টিপু ভাই বললেন- বইমেলার সব বই কিইন্যা বাইছা বাইছা কিছু রাইখা বাকিগুলা পুড়াইয়া ফেলতে ইচ্ছা করে। নামের পাশে ল্যাখক তকমা লাগানোর জন্য কিছু মানুষ ছাপাখানার কালি আর কাগজের অপচয় করে। আজকে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে টিপু ভাই’র মধ্যে কিছু একটা ছিলো।
আগের চেয়ে আরও বেশি কাহিল চেহারা নিয়ে পুরো শরীর ঘামে ভিজিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে ঝড়ের বেগে একটা পাজামা আর একটা ফতুয়া পড়ে নিলেন তিনি। আমাকে ডেকেই হয়তো পোশাক নির্বাচন করে আলমিরা থেকে বের করে রেখেছিলেন। আব্দুস সালেক চলো। আমার কাঁধের ওপর পুরো ভর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি রসিকতা করে বলেই বসলাম- দেশের একজন প্রথিতযশা সাহিত্য সম্পাদক সামান্য এক লেখকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, একটা সেলফি তুলে রাখতে পারলে ভালো হতো। টিপু ভাই স্মিত হাসি না কি এক প্রকার হাসি গোঁফের নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন- ওই চিঠিটাও নিয়া নেও, পড়া শ্যাষ হয় নাই। আমি মুখ বন্ধ রাখতে পারি না- খাম খুলেই ডায়রিয়া বাকিটা পড়লে তো আপনি গায়েব হয়ে যাবেন। ধুর মিয়া তুমি বেশি কথা কও যা বললাম তাই করো। সম্পাদক মানুষ এইটুকু ধমক তো দিতেই পারেন। আমি হজম করলাম।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে জেনে নিই, তিনি কোন হাসপাতাল পছন্দ করেন। মহাখালীর উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র নাকি পান্থপথের কোন হাসপাতাল। উত্তর না পেয়ে ভাবলাম সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না বোধ হয়। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তার হয়ে আমাকেই দেখতে হবে, সিদ্ধান্তও নিতে হবে এই আমাকেই । তার চোখের মনিটা স্থির হওয়ার অপেক্ষায় আছে মাত্র। আমি তখন চরম বেকুব। প্রায় মৃত একজন মানুষের সঙ্গে রসিকতা করা ঠিক হয়নি। সিএনজিতে উঠে তিনি আমার পকেট থেকে খামচি মেরে চিঠিটা নিয়ে নিলেন। আমার কাঁধে মাথা রেখে খাম থেকে চিঠি বের করে পড়ার চেষ্টা করলেন, যাকে ব্যর্থ চেষ্টা বলতে হবে। এই সময়ে আপনার চিঠিটা পড়ে শেষ করা কি খুব জরুরী? তাহলে দেন আমি পড়ে শোনাই। আমার এই প্রস্তাবে তিনি বেশ রেগে গেলেন বলে মনে হলো। কিন্তু রাগ দেখানোর মত শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই। হাত থেকে খাম ও চিঠি দুটোই পড়ে গেলো। বুড়োমত সেই সিএনজি চালাক চাচা- আপনের কি অয়, অবস্তা তো ভাল ঠেকতেছে না, কথাগুলো বেশ ঝাঁঝ মিশিয়েই বললেন। আশেপাশের কোন হাসপাতালে চলেন তো প্যাঁচাল বাদ দিয়া, আমি পাল্টা ধমকের আশ্রয় নেই। কারণ ততক্ষণে টিপু ভাই মানে আমার অতিপ্রিয় সাহিত্য সম্পাদক কবি সাখাওয়াত টিপু সংগা হারিয়ে ভিনদেশি কোন এক ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন। পৃথিবীর অনেক ভাষার সঙ্গেই আমার এক তরফা পরিচয় আছে, শুধু শুনেছি, শুনে মানে বুঝিনি, সাবটাইটেলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। কিন্তু এখানে টিপু ভাই যা বলছেন তাতে আমি ঘাবড়ে গেলাম দুটি কারণে, প্রথমত তিনি কি শেষ যাত্রায় পা রেখেছেন? আর দ্বিতীয়ত- টিপু ভাই’র মুখের ভাষা বদলে যাওয়া কিসের ইঙ্গিত তা ভেবে।
পান্থপথের একটা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে টিপু ভাইকে নিয়ে গেলাম। সরু স্ট্রেচারে তাকে শোয়াতে হলো না, শুয়ে পড়লেন। খুব অল্প বয়েসি এক ডাক্তার এসে নাড়ী-নক্ষত্র টিপেটুপে দেখে প্রথমে আমাকে একটা কড়া ধমক উপহার দিলেন। আমি চুপ। তবে মনে মনে ভাবলাম- তরমুজ খেলেন টিপু ভাই, চিঠিও আসলো তার নামে আর সব দোষ আমার?
ডাক্তার সাহেব নার্স ও বয়দের ব্যস্ত করে তুললেন। রোগীকে বাঁচাতে হলে দ্রুত অক্সিজেন লাগবে, স্যালাইন লাগাতে হবে গোটা তিনেক, একসঙ্গে। রক্তও লাগতে পারে। ইসিজি করাতে হবে এখনই। আমি প্রায় মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিলাম আমাকেও স্যালাইন দেন দুই তিনটা, রোগীর যদি উপকার হয়। বললাম না। ডাক্তারদের সঙ্গে রসিকতা করা যাবে না, তাহলে চুড়ান্ত রসিকতার স্বীকার হতে বিলম্ব হবে না।
স্যালাইন চলছে। ফাঁকে ফাঁকে ডাক্তারের ধমক উপভোগ করছি আমি। রোগীর সঙ্গে আর কেউ আছে কি না জানতে চাওয়া হলো। ডাক্তারের আমাকে রোগীর খুব ঘনিষ্ট কেউ বলে মনে নাই হতে পারে। বেসরকারী একটি হাসপাতালে একজন গুরুতর রোগীর ভর্তির জন্য যে চেহারা থাকা দরকার তা সেদিন আমার ছিলো না। দুই তিন দিনের শেভ না করা চেহারা, প্রতিদিন ব্যবহৃত অথচ পালিশ না করা জুতার মত চেহারা বললে কম বলা হবে। যাক, ঘন্টা খানেক পর ডাক্তার বললেন আপাতত ভয় নেই। ভর্তি করাতে হবে শুনে সোজা কাউন্টারে গিয়ে বুঝতে পারলাম কেবিন ভাড়া বাবদ অগ্রিম যা লাগবে তা আমার কাছে নেই। তাই শুধু চেহারার দোষ দিয়ে আর নিজেকে অপমান করলাম না।
কাউন্টার থেকে সরে এসে পকেট হাতরাতে শুরু করলাম। বুক পকেটে সেই অভিশপ্ত চিঠি। প্যান্টের হিপ পকেটের মানিব্যাগের খবর আমি জানি। অন্য কোন পকেটেও কিছু থাকার কথা নয়। যদি গায়েবি কিছু না ঘটে থাকে। ফলে আমাকে চরম বেকুবের মত টিপু ভাই’র কাছেই যেতে হলো। আমার পাজামার পেছনের পকেটে মানিব্যাগে টাকা আছে যা লাগে খরচ করো- চোখ বন্ধ অবস্থায় কথাগুলো হয়তো টিপু ভাই-ই বললেন। আরও বেশি অবাক হলাম, আমি টাকা নিয়েই ভাবছি তা তিনি বুঝলেন কিভাবে? মানিব্যাগ হাতে নিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। হাজার টাকার নোট সব। লাখ টাকা তো হবেই। টিপু ভাই যে একেবারে তৈরি হয়েই এসেছেন বুঝতে পারলাম।
নন এসি সিঙ্গেল বেডের একটা কেবিন নিলাম। কিন্তু সেখানে উঠতে আমাদের অপেক্ষা করতে হলো প্রায় তিন ঘণ্টা। তিনটা করে মোট নয়টা স্যালাইন শেষ হওয়ার পর ডাক্তার আমাদেরকে কেবিনে যাওয়ার ইজাজত দিলেন। এই তিন ঘণ্টায় আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছিলাম। মারাত্মক অপরাধও বলতে পারেন আপনারা। এই অপরাধে হাবিয়া দোযখও হতে পারে আমার। তবে এখন আবার মনে হচ্ছে ওই অপরাধটা না করলে টিপু ভাই’র মৃত্যু নিতান্তই সাধারণ মৃত্যু হয়েই থাকতো, সমাজ ও দেশের কাছে। রোজ হাসপাতালে হাসপাতালে নয়তো ঘরে ঘরে হাজার হাজার মানুষ মরে যাচ্ছে, খুবই সাধারণ সেসব মৃত্যু। খুব ঘনিষ্ট স্বজনদেরও সেসব মৃত্যুতে শোক থাকে বড়জোর দুদিন, তৃতীয় দিনেই ভাবা শুরু হয়- তার থাকা না থাকায় কোন ফাঁরাক তো নেই! ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওইসব মৃত্যুর কোন মূল্য নেই। অথচ সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যু গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ, এই মৃত্যুতে গবেষকদের জন্য খুলে গেছে স্বর্ণ দুয়ার। বাংলাদেশে ভারত বা আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের সফরের মতই গুরুত্বপূর্ণ সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যু।
হাসপাতালে আর কেউ আসবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে। ভাবী বা তার পরিবারের কাউকে ফোন করে অসুস্থতার কথা জানানো যাবে না। টিপু ভাই’র নিষেধাজ্ঞা আছে। অসুস্থ্য হওয়াটা যেন অপরাধ, নয়তো মানহানিকর। যদিও ডায়রিয়া কোন সম্মানের রোগও নয়। হার্টের সমস্যা? রিং লাগাতে হবে? তবে বলতে পারেন রোগটি সম্ভ্রান্ত। লাখ লাখ টাকার কারবার। সামান্য ডায়রিয়া স্যালাইন-পানি খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে টিপু ভাই’র ধারণা ছিলো এমনই। ফলে স্ত্রী-ভাই- বোন বা শশুরকুলের কোন আত্মীয়ই হাসপাতালে আসছে না এটা আমি নিশ্চিত হয়েই সব দায়িত্ব গ্রহণ করি। আর সেই অধিকারবোধ থেকেই সেই অপরাধটা করে বসি।
বুক পকেট থেকে খামটি খুলে সাদা মসৃণ কাগজের চিঠিটি হাতে নিই। চিঠিতে কেমন যেন একটা ঘ্রাণ পাই। দীর্ঘদিন দেরাজে বন্দী ফাইলপত্রের কটুগন্ধও ভাবতে পারেন আপনারা। আবার এমনও হতে পারে চিঠি লেখার আগে লেখক বা লেখিকা হয়তো খুব কেঁদেছিলেন, আর সেই কান্নার জল শুষে নেওয়া চিঠি থেকে বের হচ্ছে এমন অনামা ঘ্রাণ, হতেই পারে। চিঠিটি যে কয়েক দশক আগে লেখা হয়েছে তাও আমার মনে হয়। তবে কয় দশক হবে বলতে পারছি না। টিপু ভাই’র সমান বয়সীও হতে পারে এই চিঠিটা।
খুব সাধারণ একটি চিঠি। সম্বোধন করা হয়েছে- প্রিয় সাখাওয়াত। দশ বারো লাইনের চিঠিটা মেয়েলি ধাঁচে লেখা। কিন্তু কথাগুলো মেয়েলি নরম সুরের নয়। চরম তাচ্ছিল্য যেমন আছে, তেমনি আছে কিছুটা কদরও । আবার স্নেহাবেশও আছে। চিঠিটির সঙ্গে ডায়রিয়ার কোন সম্পর্ক আমি প্রথম পাঠে আবিষ্কার করতে পারিনি। তবে মৃত্যুর আহ্বান স্পষ্ট ছিলো। একবার আমার মনে হয়েছিল চিঠিটি কোন মানুষের লেখা নয়, স্বয়ং মৃত্যুদূত লিখে পাঠিয়েছেন।
চিঠিটি সাবেক কোন প্রেমিকার নয় এই বিষয়ে টিপু ভাই বোধ হয় নিশ্চিত ছিলেন। নাহলে তাকে উতলা দেখা যেতো। বা তিনি সাবেক প্রেমিকাদের স্মরণ করে উদাস থেকেছেন এমনটাও হয়নি। এমনিতে সাবেক প্রেমিকাদের বিষয়ে আড্ডায় কথা উঠলে দশজনের কথা তিনি একাই বলতেন।
সাখাওয়াত টিপু যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন তার শয্যার পাশে থাকার দুর্ভাগ্য হয়নি আমার । কিছু কথা শুনেছি নার্সদের কাছে। একজন নার্স- কালিতারা। সে আমাকে বলেছিল- ডায়রিয়া প্রথম রাতেই সেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি ঘনঘন বাথরুমে যেতেন। একা একা হাঁটাচলাও করতে পারতেন। কালিতারা তার ১৩ বছরের নার্সজীবনে এমন রোগী দেখেননি এটাও আমাকে বলেছিলো। মেয়েটি যখন টিপু ভাই’র কথা বলছিলো তখন তাকে কখনও খুব হাস্যজ্বল আবার ক্রন্দন্মোখও দেখেছি। টিপু ভাই নাকি রাত গভীর হলেই চিঠিটা পড়তেন খুব উচ্চস্বরে। অনেকটা কবিতা আবৃত্তির মতো, অথবা কারও বিরুদ্ধাচরণ করে ভাষণ দেওয়ার মতোও মনে হয়েছে কালিতারার কাছে। আবার পত্র লেখকের সঙ্গে টিপু ভাইকে তিনি কথা বলতেও শুনেছেন।
হাসপাতালের অষ্টমতলার যে কেবিনে টিপু ভাই ছিলেন, সেটি খুব ছোট পরিসরের ছিলো না। বারান্দায় দাঁড়ালে ঢাকার বেশি কিছু অংশ দেখা যায়। হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আমি বাসায় ফিরেছিলাম রাত ১১টার দিকে। ফিরে ফোন করেছিলাম। বাসায় গেলা, চিঠিটা কই রাখছো? আমার খুব ছোট জবাব- বালিশের নিচে, এখন কি অবস্থা? কোন জবাব পাইনি, ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ ছাড়া। পরে কল ব্যাক করে টিপু ভাই বলেছিলেন- কেবিনের মধ্যে অসংখ্য পুকুর, আমার তো গোসল করতে করতে ফড়িং হওয়ার অবস্থা। আবার ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ।
টিপু ভাই বিশ্বাস করতেন চিঠিটি তাকে লিখেছিলেন মার্কেজ। আমাকে তিনি বলেছিলেনও। বিশ্বাস করিনি। মার্কেজের সঙ্গে সাখাওয়াত টিপুর পরিচয় কিভাবে হবে অথবা মার্কেজ বাংলায় চিঠি লিখবেন কেন? তারচে বড় কথা মার্কেজ মারা গেছেন সাখওয়াত টিপুর মৃত্যুর ৩৩দিন আগে। টিপু ভাই বলেছিলেন- সতের বা আঠারো বছর আগে একবার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নাকি বাংলাদেশে এসেছিলেন। পান্থপথের চায়ের দোকানে বসে তারা একসঙ্গে চা খেয়েছেন আড্ডা ও তর্ক করেছেন টানা সাত ঘণ্টা। তর্কের বিষয় ছিলো সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি আর নিঃসঙ্গতার বোধের রঙ নিয়ে। শেষাবধি মার্কেজ নাকি টিপুর যুক্তি মানতে না পেরে রাগ করে চলে গেছেন।
আমি খুব করে হেসেছিলাম কথাগুলো শুনে। টিপু ভাই’র উপস্থিতিতেই। আমার হাসিতে তার রাগ হলে ভালো লাগতো, বুঝতাম টিপু ভাই সুস্থ। তিনি রাগ করলেন না- তোমার হাসি গুন্টার গ্রাসের মতো, অথবা ডিমপাড়া ইলিশের মতো। এরপর অনেকদিন আমি হাসতে পারিনি। গুন্টার গ্রাস আর ডিমপাড়া ইলিশের মিল যে আকাশ-পাতাল মিল তা বুঝতে পারি। এই আকাশ-পাতাল মিলের কথাটি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যারের মুখে শুনেছি।
সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যু হয়েছিল সন্ধ্যায় নাকি খুব ভোরের নরম আলোয় তা কেউ বলতে পারে না। এমনকী নার্স কালিতারাও নয়। হাসপাতালের চর্তুথ দিন আমি গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার দিকে গিয়ে দেখি মোবাইলে কথা বলছেন টিপু ভাই। আমাকে ইশারায় বসতে বলে তিনি বারান্দায় চলে গেলেন। কিন্তু কাঁচের দরজা বন্ধ করলেন না। ফলে আমি সবই শুনতে পেলাম ইচ্ছে না করলেও।
আপনি লিখেছেন- আমার জন্ম পৃথিবীর কাছে একটা সকালের মতো, অথচ আমি তো বিশ্বাস করি প্রতিটি মুহূর্তের একটি সকাল থাকে। সন্ধ্যা বা রাতও থাকে। হ্যাঁ বুঝেছি আপনার কথা। আপনি কি তুলতুলে বিকেলের আলোয় আকাশের দিকে কোন মাগুড়মাছের ছানাকে উড়ে যেতে দেখেছেন? যেভাবে ধানের বীজ থেকে চারা গজায়, ঠিক সেরকম করে আমি ফিরে যাবো, এই কথার মানে তো আমার জন্ম হবে আবার, মৃত্যু নয়। আপনি কি আমার প্রেমিকা হতে চেয়েছিলেন? ঠিক আছে আমার এক বন্ধু এসেছে ওর সঙ্গে কথা বলে আবার কল করবো। বলেই তিনি কেবিনে ফিরে এলেন।
তুমি তো মিয়া আমারে ফাঁসায়া দিয়া গেছো। এই হাসপাতালের সেবা সবচে খারাপ। তোমার টিভিতে রিপোর্ট করো। দুই একটা নার্স ছাড়া সবগুলার পেট ভর্তি খালি শয়তানি। টিপু ভাইর অভিযোগের বহর বড় হওয়ার আগে আমি বললাম- ঠিক আছে, আমি তাহলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আসি। ধুর মিয়া একটু পরে যাইও, বসো কথা আছে, কে ফোন করছিল জানো? মার্কেজ। নামটা বলে খানিকক্ষণ খুব উচ্চস্বরে হাসলেন টিপু ভাই। আরও বললেন- লোকটার সঙ্গে কথা বলে খুব আরাম লাগে।
আমি আবার চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। খুব মন দিয়ে টিপু ভাইকে দেখি। চেহারায় অসুস্থতার কোন ছাপ নেই। নার্স কালিতারা আমাকে ইশারায় বাইরে ডেকে নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। স্যার, টিপু স্যারের কিন্তু ডায়রিয়া ভাল হয়ে গেছে, তিনি পুরোপুরি সুস্থ। ডাক্তাররাও তাকে চলে যেতে বলেছেন। আপনি বুঝিয়ে নিয়ে যান। ঠিক আছে আমি দেখছি, বলে আবার কেবিনে যাই।
প্রেসক্রিপশনটা দেখলাম। লম্বা বিশ্রামের কথা লেখা আছে। ঘুমের ওষুধ দিয়েছে খুব হাল্কা মাত্রার। টিপু ভাই, তাহলে চলেন বাসায় যাই। এখানে আর বিল বাড়িয়ে লাভ কি। তুমি কি টাকার জন্য ঘামতেছো এখনই, ওইসব নিয়া ভাইবো না, বাসায় গেলে মার্কেজের লগে আলাপটা জমবো না, আবার কে চিঠি লিখে পাঠাবে তার ঠিক আছে? তবে মনে রাইখো রবীন্দ্রনাথের চিঠি আসলে কিন্তু গণ্ডগোল হয়া যাইবো। শালা সাম্প্রদায়িক লোকটা কিভাবে মহৎ হয়ে উঠলো বুঝলাম না। আমি আবারও বলি- তা ঠিক আছে হাসপাতালে কমফোর্ট ফিল করলে থাকেন আরও দুই-চার দিন। আরে নাহ্, অতদিন লাগবে না। আজ রাতেই ফাইনাল আলাপ হয়া যাইবো। কিছু বিষয় এখনও মীমাংসার বাইরে রয়ে গেছে। যেমন ধরো- গদ্য-পদ্যের দায় ও দায়মুক্তি কিসে কিংবা সাহিত্য যারা করেন তারা আদৌ মানব সমাজের অংশ কীনা ইত্যাদি। তুমি মার্কেজ আর আমার আলাপ শুনলে মজা পাইতা। এইগুলা লেইখা রাখতে পারলে খুব ভাল হইতো। ইতিহাস হইতা তুমি আব্দুস সালেক।
রাত ১২টারও পরে আমি হাসপাতাল থেকে বের হই। পান্থপথে অনেকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল, দূর থেকে শেয়ালের হুক্কাহুয়াও শুনছিলাম, খুব দ্রুত ছুটে চলা বাতাসেরা কলাগাছের পাতায় ধাক্কা খেয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করছিল। আমি সত্যিই পান্থপথে দাঁড়িয়ে ছিলাম কীনা তা বুঝতে আবারও হাসপাতালে ঢুকে পড়ি। লিফটে উঠে দেখতে পাই গোটা তিনেক চিত্রল হরিণ, ওরা খেলা করছিল জ্যোৎস্না আর জোনাকীর সঙ্গে। ভয়ে জমতে জমতে আমি বাঘ হয়ে উঠি। হরিণগুলো জোনাকীর মত দুম করে আলো নিভিয়ে পালিয়ে গেলে আমি চলে যাই সোজা অষ্টম তলায়।
পরদিন সকাল ৯টার দিকে আরেফিন ফয়সালের ফোনে আমার ঘুম ভাঙে। ভাই হাসপাতালে আসেন। টিপু ভাই তো চলে গেছেন। চলে গেছেন শুনে আমি ভেবেছিলাম তিনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন কাউকে কিছু না বলে। হতেই পারে, দুই-একজন নার্স ছাড়া গোটা হাসপাতালের ওপরই ক্ষিপ্ত ছিলেন টিপু ভাই। সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দেন খবরটা, আর আপনাদের টিভিতে স্ক্রল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন- ফয়সালের এই কথার পর আমার সন্দেহ মোড় নেয়। সর্বনাশ হয়ে গেছে তাহলে।
সাখাওয়াত টিপুর লাশ তার কর্মস্থলে নেওয়ার পরই আমি কথাটা বলেছিলাম। তার মৃত্যুর সঙ্গে একটা চিঠি জড়িত। পরদিনের পত্রিকায় শোক সংবাদের সঙ্গে চিঠিটিও ছেপে দেয় পত্রিকাটি। এরপর টিভিগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একাধিক টিভিতে আমি ইন্টারভিউ দেই। যা শুনেছি ও দেখেছি তাই বলি। সারা দেশের মানুষ জেনে যায়, একজন মৃত লেখকের চিঠি আরেকজন লেখকের মৃত্যুর যোগসূত্র হতেই পারে।
এরপরও পান্থপথের চায়ের দোকানগুলোয় টিপু ভাইকে চা খেতে দেখেছি আমি। মার্কেজ না হোক অন্য কারও তেমন একটি চিঠি হয়তো আমার জন্যও লেখা হচ্ছে।