মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটা বিরাট অংশ লেখা হয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে। দেশভাগের পরপরই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রধানত শিল্পসাহিত্যের ভেতর মূর্ত হতে শুরু করেছিল। পঞ্চাশের দশক থেকেই বাংলাদেশের সাহিত্য, বিশেষ করে ছোটগল্প, জাতীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৩৫ সালে জার্মান কমিনটার্নের বিশ্ববরেণ্য নেতা ডিমিট্রিয়ফ্ সাহিত্যিকদের কাছে যে আবেদন করেছিলেন, ‘help us, help us the party of the working class, the commintern—give us a keen weapon in artistic form in poetry, novels and short stories—to use in this struggle’। সেই আবেদনে সাড়াও মিলেছিল বেশ। একইভাবে জাতীয় স্বার্থে আমাদের লেখকদের অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। কাজটা বাংলাদেশের লেখকদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। একদিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে শিল্পের প্রতি দায়। সাহিত্যে পুরানো গদ্যরীতি বা বিন্যাসরীতি বাতিল করে নতুন করে ভাষা ও বর্ণনাশৈলি নির্মাণ করতে হয়েছে এই সময়ের লেখকদের। কেবল স্বাধীন দেশ নয়, স্বকীয় সাহিত্যরীতি নির্মাণের যুদ্ধেও রত ছিলেন লেখকরা।
দশকভিত্তিক পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে বর্তমান ছোটগল্পের মূলপ্রবণতা সম্পর্কে একটা ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ দাড় করানো যেতে পারে। চল্লিশের দশকে কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারতের ছোটগল্পের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দেশবিভাগের মর্মান্তিক পরিণতি। একইসঙ্গে দেশবিভাগোত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তেতাল্লিশের মন্বন্তরও বাংলা গল্পের উপজীব্য হয়ে এসেছে। আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবু রুশদ (১৯১৯-) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) এ পর্বের খ্যাতিমান তিন গল্পকার। এঁদের ভেতর প্রথম দুজন প্রধানত গভীর সমাজমনস্ক ছোটগল্পের রচয়িতা। তবে ওয়ালীউল্লাহ সমাজ থেকে দৃষ্টি ফেরান ব্যক্তিত্বের নানান সংকটে। এ সময়ে আরো লিখেছেন ফজলুল হক (১৯১৬-১৯৪৯) ও সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২)-এর মতো লেখকরা।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পের প্রকাশভঙ্গী ও বিষয়বস্তু নির্বাচনে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন আসে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন এ-পর্যায়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা। ভাষা আন্দোলনের পরের বছরই কবি হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি। এ সময় গল্প লেখেন ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮-১৯৮১), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬), আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭), শাহেদ আলী (১৯২৫-২০০১), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৮), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২) প্রমুখ লেখক। এখন যাঁদের প্রধানত প্রবন্ধকার হিসেবে আমরা জানি—আনিসুজ্জামান ও রণেশ দাশগুপ্তও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছোটগল্প লিখেছেন। এই দশকে গোত্রভুক্ত থেকেও স্বকীয় ছিলেন শওকত ওসমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ।
ষাটের দশকে এসে বাংলাদেশের ছোটগল্পের একটা স্বকীয় ভিত তৈরি হয়। এই দশকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ১৯৫৮-র সামরিক শাসন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। লায়লা সামাদ (১৯২৮-১৯৮৯), সুচরিত চৌধুরী (১৯২৯-১৯৯৪), আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩১-), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫-), শহীদ আখন্দ (১৯৩৫-), আল মাহমুদ (১৯৩৬-), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-), আবুবকর সিদ্দিক (১৯৩৬-), শওকত আলী (১৯৩৬-), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (১৯৩৯-), হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-), হাসনাত আবদুল হাই (১৯৩৯-), রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-), মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮), রাহাত খান (১৯৪০-), বুলবন ওসমান (১৯৪০-), আবদুশ শাকুর (১৯৪১-২০১৩), বিপ্রদাশ বড়ুয়া (১৯৪২-), আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭), সালেহা চৌধুরী (১৯৪৩-), সেলিনা হোসেন (১৯৪৭-) প্রমুখ গল্পকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে এই দশকে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের নাম উচ্চারণ করতে গেলে এই দশক থেকে সবচেয়ে বেশি নাম উচ্চারিত হয়। সকলেই একই রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা দ্বারা দগ্ধ হওয়ার কারণে বিষয়বস্তু নির্বাচনে খুব বেশি বৈচিত্র্য না থাকলেও প্রকরণ ও ভাষাশৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন এই দশকের গল্পকারদের ভেতর দেখা যায়। সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুশ শাকুর সকলেই গল্পবলার স্বতন্ত্র ভাষা ও স্বর নিয়ে আসেন। এই দশকে সকলের ভেতর সমাজ ও সমষ্টি মুখ্য হয়ে উঠলেও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবদুশ শাকুর ও আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প ব্যক্তিপ্রধান হয়ে উঠেছে। এঁরা তিনজনেই গল্পের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ব্যতিক্রম ছিলেন ষাটের তরুণতম লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও।
ষাটের শেষ থেকে সত্তর দশকে আমরা পাই সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-), হরিপদ দত্ত (১৯৪৭-), কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২), হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১৩), শান্তনু কায়সার (১৯৫০-), মুস্তাফা পান্না (১৯৫২-), ভাস্কর চৌধুরী (১৯৫২-), মঞ্জু সরকার (১৯৫৩-), সুশান্ত মজুমদার (১৯৫৪-), ইমদাদুল হক মিলন (১৯৫৫-), আহমদ বশীর (১৯৫৫-), ইসহাক খান (১৯৫৫-), আহমদ মুসা (১৯৫৭-), মঈনুল আহসান সাবের (১৯৫৮-) প্রমুখ গল্পকারদের। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে ছোটগল্পের মূল বিষয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা ঘটনা ও নব্য দেশের স্বপ্ন-বাস্তবতার ভেতর দৃশ্যত-অদৃশ্যত যে ব্যবধান সেসব বিষয়। তবে দেশ স্বাধীন হলেও লেখকদের সংগ্রাম থেমে থাকেনি। ৭৫-এ সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জেলে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশে সামরিক সরকারের উত্থান ঘটে। মৌলবাদী রাজাকারদের ক্ষমতায় পুনর্বাসন ঘটে। এসব তো কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের চিত্র ছিল না। কাজেই নতুন দগদগে ঘা থেকে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়। সবমিলে সময়ের এই যে অস্থিরতা সেটি এই সময়ের ছোটগল্পের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।
আশির দশকে অনুবাদের ভেতর দিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার সাহিত্য বাংলাদেশে আরো ব্যাপকভাবে আসতে থাকে। এই দশকে স্বৈরশাসক ক্ষমতায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নভঙ্গ ঘটছে সামরিক শাসনের দুঃসহ বাস্তবতা, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা, নারীনির্যাতন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে। অনিবার্যভাবেই গল্পের বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গী ও ভাষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। আশি ও নব্বইয়ে আমরা পাই শহীদুল জহির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিশ্বজিত চৌধুরী, মহীবুল আজিজ, আনিসুল হক, মশিউল আলম, সেলিম মোরশেদ, হুমায়ুন মালিক, শাহাদুজ্জামান, ওয়াসি আহমেদ, রফিকুর রশিদ, আহমেদ মোস্তফা কামাল, পাপড়ি রহমান, ঝর্না রহমান, ফাহমিদুল হক, প্রশান্ত মৃধা, ইমতিয়ার শামীম, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, জাকির তালুকদার, শাহীন আখতার, শাহনাজ মুন্নী প্রভৃতি গল্পকারদের। উত্তরাধুনিক প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে আমরা পাই শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে ছোটগল্পের এই যাত্রাপথে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় শূন্য দশক থেকে শুরু করে দ্বিতীয় দশকের গল্পকারদের লেখায়। বাংলাদেশের ছোটগল্প এখন গণসাহিত্যবোধ থেকে সরে এসেছে। দেশের চলমান ঘটনার ওপর মিডিয়ার সার্বক্ষণিক ফলোআপের ফলে জাতীয় ঘটনা নিয়ে লিখিত গল্প-উপন্যাসে পাঠকের আর আগ্রহ থাকছে না। সাহিত্যের যে সংবাদ পরিবেশনের উপযোগিতা, সেটি আর নেই। ভাষার সরলীকরণের সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক চেতনা ও বিশ্ববোধ। বিশ্বসাহিত্যের আকরগ্রন্থগুলি অনুবাদ কিংবা ইংরেজি মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সমস্যা দানা বেঁধেছে অন্যখানে। মিডিয়ার আগ্রাসন, পুঁজিবাদের বিকাশ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, গ্রাম ভেঙে শহর হওয়ার প্রবণতা, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া—এসব কারণে ব্যক্তিক সংকট বেড়ে গেছে। এই সংকটটা বর্তমান ছোটগল্পের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
সমসাময়িক ছোটগল্পে ভাষা তার সব সাজসজ্জা ঝেড়ে খুব সাদামাটা ভাবে (as it is) উপস্থিত হয়েছে। ভাষার কাব্যময়তা কমে মেদহীন ঝরঝরে গদ্য এই সময়ের ছোটগল্পের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছেন : “ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট দুঃখ ছোট কথা/ নিতান্ত সহজ সরল,/ সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু-চারটি অশ্রু জল।// নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,/ নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।/ অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ।” বর্তমান ছোটগল্প সেখান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। বস্তুত, এখন আর ছোটগল্পকে কোনো সংজ্ঞা দিয়েই বেঁধে রাখা যাবে না। শিরিষের ডালপালার বর্তমান আয়োজনে সমসাময়িক ২২ জন তরুণ গল্পকারের গল্প পড়লে দ্বিতীয় দশকের ছোটগল্পের গতি-প্রকৃতি কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাবে। বলছি না, এঁরাই এই দশকের শ্রেষ্ঠ গল্পকার, তবে সময়ের বাক্ বদলের ইতিহাস যাঁদের গল্পে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে তাঁদের ভেতর নিশ্চয় এই গল্পকারদের নাম আসবে। এঁদের অনেকেই গল্পকার হিসেবে পরিচিত, কেউ কেউ সদ্য লেখা শুরু করেছেন। এঁদের ভেতর কে কে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হবেন সে-কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তাঁরা যে বাংলাদেশের ছোটগল্পের পালাবদলের ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে যাচ্ছেন, সে জন্যে তাঁদের অভিনন্দন দেওয়াই যায়।
শিরিষের ডালপালার এ আয়োজন পাঠকদের সামান্যতম তৃপ্তি দিলেও শ্রম সার্থক হবে। এ সংখ্যার জন্যেও দারুণ সব কভার করে দিয়েছেন রাজীব দত্ত। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
মোজাফফর হোসেন
সম্পাদক, বাংলাদেশের সমকালীন ছোটগল্প সংখ্যা
২২ জানুয়ারি, ২০১৭