সমুদ্র সিরিজ ও মৌলিক মায়ার ফুল | সাগর শর্মা

সমুদ্র সিরিজ 

 

রাস্তা থেকে দ্রুত সরে গেলে ট্রেন 
পরিদৃশ্যমান পরছায়া থেকে—
পথিকের ছায়া উড়ে আসে ঘাসে
অমলধবল বিচালির পাশে।
পথ থেকে পথে সরে গেলে ছায়া
কেবল ধূসর হয়ে আসে শীতে;
কুয়াশাপ্রবণ ভোরের এ-মায়া—
ফেলে ট্রেন ছুটেছে ধীর গতিতে।
তবু দূর থেকে মনে হয় কেউ—
হাতের ইশারা করে ডাকে একা;
ভোরের সময় দেখা, আচমকা!
সমুদ্র তুলেছে এই মাত্র ঢেউ।
জল থেকে সরে জলের সিম্ফনি
ভায়োলিনে বাজে ঢেউ’র-গোঙানি।

 

০২.

এইসব রোদের ভেতর শঙ্খচিল—
মেঘেদের বিশদ বিস্তারে, মেলে ডানা
বহুদূর সমুদ্রের ফেঁপে ওঠা জলে;
নাবিক ফেলেছে সাময়িক সামিয়ানা। 
চারদিকে অথই সমুদ্র—শুকায়াছে
গলা। এত জল তবু পানযোগ্য নাই;
আকাশে চাতক, নাবিক তাকায়া আছে
ছলচ্ছল নোনাভরা এই দরিয়ায়।
পুড়ে গেলে জল, অথই জলসাগরে—
দরিয়া কেবল জানে কতটুকু নুন;
বালিয়াড়ি জুড়ে ধু-ধু, আগুন আগুন
যেন-বা চাতক দিশেহারা—ভবঘুরে।
চাতকিনী জল ভরে দরিয়ার ঘাটে—
চাতক উড়ে বেড়ায় মেঘেদের মাঠে।

 

০৩.

নত হয়ে বসে থাকি—সমুদ্রের পায়ে
বালুকাবেলায় নাচে ঝিনুকের ঘ্রাণ;
পঙ্কিলতা ধুয়ে নেয়, সজল ঢেউয়ে
এপারে সমুদ্র—অইপারে আসমান। 
ঢেউ এসে আছড়ায় মাটির শরীরে
আকাশ পরেছে টিপ—পূর্ণিমার চাঁন,
ঢেউ’র ‘পর ভাসাই শরীরসাম্পান
এপার তাকায়া আছে ওপারের মোহে।

ঢেউ এসে ঢেউ খেলে ঢেউ’র উজানে
চরে এসে সাঁতরায় ঢেউ’র চিৎকার,
ঢেউ কেন আছড়ায়, শারসিনা জানে;
সমুদ্র সঙ্গমে মন—ঢেউ’র শীৎকার। 
সমুদ্র সঙ্গমে একা, তুমি যাবা সাথে?
বালুচরে ঢেউ খেলে রাতের প্রপাতে।

 

০৪.

মেরিনড্রাইভে হেঁটেছি অভয়মিত্র ঘাট
কর্ণফুলির কিনারে মন—ফেলেছি নোঙর;
প্রজাপতি পার্কে প্রেমের প্রথম পাঠ—
এখানে পেতেছি মন—সোনাদিয়াঘর।
পতেঙ্গা সৈকতে গেছে, আটকে জাহাজ—
সেকথা লুসাই জানে, আর জানে কর্ণফুলি;
যেন নদীর ওপারে ভাসে—একা রাজহাঁস
বুকের ভেতর ঘাই মারে এক বুলবুলি। 
এখানে অভয়মিত্র ঘাট—কর্ণফুলির কিনার
কেবল রয়েছে পড়ে একা একটি জাহাজ
বহুদিন বাঁধা পারে—মাস্তুলে জমেছে ঘাস;
জাহাজ থেকেও দেখা যায় কুতুবমিনার।
বাণিজ্যের ছলে এসে কি পেয়েছো মন?
আজীবন দরিয়ায় বেয়েছি সাম্পান—
পাইনি তোমারে, তুমি এক স্বপ্নের মতন;
বুকের ভেতর বাজে খালি—দাঁড়ের আজান।

 

০৫.

আমিও গিয়েছি কবেকার পতেঙ্গা সৈকতে
এখানে মোহনা মিলে গেছে পারকির চর;
যেখানে ছড়িয়ে আছে ঝাউবন পথে পথে—
সাম্পানের পালে হাওয়া—উড়িছে তেপান্তর। 
সেখানে গিয়েছিলাম আমি কবেকার শীতে
আঁচলের হাওয়ায় যেন দুলেওঠে মন;
যেন ঝাউপাতা কাঁপছিলো জলের শার্শিতে—
হাওয়া এসে লাগতেছিল নোনা শিহরণ। 
আঁচল তবু উড়তেছিল সাম্পানের বুকে
চুলের গন্ধ যেন তার বহুদিনের চেনা—
যেন-বা দেখেছি তারে কোনো গোপন অসুখে;
সাম্পানের চারদিকে জল, সাদা সাদা ফেনা।
না জানি সাঁতার আমি, চারদিকে শুধু জল—
ডেকেছিল গোপনে এক হাওয়ার আঁচল।

 

 

 

মৌলিক মায়ার ফুল

 

কবিতাগ্রন্থ বের হলে কবিদের নিরুদ্দেশ চলে যাওয়া উচিত! এইসময় পাঠিকাদের চোখ এড়িয়ে—পাখিদের সাথে ডানা মেলে দেয়া যেতে পারে। বালিয়াড়ির নগ্ন ঢেউয়ের সাথে যারা স্নানে নামে তাদের সাথে বরং সখ্য করা ভালো। কেননা, বহু বছর পর যারা সমুদ্রে বেড়াতে আসে; তাদের শরীর থেকে বের হওয়া নোনাগন্ধের শ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকে সেইসব বালিহাঁস! তারপর তারা ডানার বিস্তারে লিখে রাখে অযুত রংয়ের মায়া।

 

০২.

মানুষের আছে পালিয়ে যাওয়া স্বভাব। ঘর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে ঘরে। এও তো এক পলানো স্বভাব। পারলে পৃথিবী থেকেও পালিয়ে যায় মানুষ। ভালোবাসা পেলে কে পালাতে চায় না, বলুন! আমিও সারাদিন বনে বনে ঘুরে একদিন ঠিক সন্ধ্যায় পালিয়ে এসেছিলাম গৃহে। সংসারের আঁচলে ফেলে এসেছিলাম যে সন্ন্যাস—অরণ্যে-বোধি-সত্ত্বায় বুঝেছি, সংসারেই ফেলে এসেছি তার যাবতীয় ধ্যান! মানুষ আদতে সংসার টংসার কিছু নয়, মায়ায় জড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি!

 

০৩.

পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে বরং নৈকট্যে থাকা ভালো। পালিয়ে যাবেই-বা কোথায়…! চারিদিকে বেড়া—কাঁটাতার! মানুষ পালিয়ে গেলেও তার স্মৃতি থেকে সে পালাতে পারে না কোনোদিন! তবু সে পাগল হয়—পালিয়ে যায়। এইরূপ পাগল হয়ে থাকতেই মানুষ পছন্দ করে বেশি ! 

কেননা, ভালোবাসার চেয়ে দুর্মূল্য পৃথিবীতে কিছুই নেই আর! 

 

০৪.

পৃথিবীতে মানুষ চিরদিন একা থাকতে চেয়েছে। ভীড়ের মধ্যে একলা হারিয়ে যেতে চেয়েছে বারংবার। তবু পলাতক পেন্ডুলাম বেজে ওঠে একা! একার হাত ধরে মানুষ পালাতে পারে না বেশিদূর। তার চাই খুব একা হবার এক নির্জন সাধন-সঙ্গী। সবাই পায় না! যারা পায় তারা বড় সৌভাগ্যবান, যারা পেয়ে হারায় পৃথিবীতে তাদের মতো নিঃসঙ্গ মানুষ নেই আর!

 

০৫.

পৃথিবীতে মানুষ তার নিজের সঙ্গই পছন্দ করে খুব। যদিও সে তার সাথে চায় নিজস্ব এক ব্যক্তিগত সঙ্গী। তবু মানুষ নিজের একলা সঙ্গের জন্য মরিয়া থাকে একা—ঈশ্বরের ন্যায় একান্ত গোপন। কিংবা মানুষের আসলে হওয়া উচিত বুদ্ধের ধ্যানের মত নিঃসঙ্গ! একা থাকলেই সে ভালোবাসতে চায়—কাছে আসতে চায়, কারো জন্য জীবন ফুরিয়ে দিতে চায়। 

পৃথিবীতে ভালোবাসা ছাড়া আদতে মানুষের মৌলিক কোনো প্রার্থনা নেই।


সাগর শর্মা
জন্ম: ২৯ অক্টোবর ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ, কক্সবাজার।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থঃ ঝাউপাতার ভায়োলিন
ই-মেল: sagarsharma1833@gmaI.com

 

শেয়ার