ধোয়া কাচ
গায়ের পশমে মোষ মাখে রোদ—নরম পবন
খেরের পারার ফাঁকে শোনা যায় মন্দ্র খুনসুঁটি—
হাসির গভীরে যেন ধীরে নুয়ে পড়ে সোঁদা মন
আলো আর ছায়া মিলে বাঁধে দুয়ে মনোহর জুটি।
খালের নীরব পাড়ে বেড়ে ওঠে বাঁকা কোনো গাছ
শন আর কাশবন পিছে সিলভার রঙে আঁকা—
দুপুরের মুখ যেন পথে পড়ে থাকা ধোয়া কাচ
ভেসে থাকে খাল-বিল, ফুলঘ্রাণে ভারানত শাখা।
ছড়ায় ছড়ায় কেউ নীরবতা-ভেজা ঘুঘুডাক
ফাঁকা ঘরে ঘন হয় এঁদো হাওয়া, ঘোলা কার ছবি—
ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমে, বিস্মৃত গানের মৃদু রাগ
দূর পথে তবু যেন গেয়ে যায় নিমগ্ন বৈষ্ণবী।
দুপুর বহিয়া আনে কণ্ঠা ফুঁড়ে উড়ে আসা ধ্বনি
জংলার বাতাসে বাজে সেই সান্দ্র সুরের সিম্ফনি।
মহিষ ঘাটা
সরিষা বাটার পাশে জ্বলে তারাবাতি
উঠানে উঠানে নামে পরিদের দল।
নিরল দ্বীপের দেশে সুঁই চেরা রাতি
ফাঁকে ফাঁকে বুনে যায় দুধের ফসল।
মহিষ ঘাটার ওমে নদী ঢুলে ঘুমে
ছাতিম তলায় কারা অঘোরে ঝিমায়
যেন থেমে যায় তট ধীর মওসুমে
রুটি দোকানের আলো ঢেউয়ে ভেঙে যায়।
বেঁধে রাখা কার ডিঙা মৃদু মন্দ নাচে
হয়তো সে ডুবে আছে আনাচে কানাচে
ঘাস-লতা ছাওয়া কোনো লোককথা ঘরে
পালার গানের তালে চাঁদ নামে চরে
ফোলা ফোলা চোখ তার যেনবা মাতাল
খাবি খেতে খেতে বয় নদী চেরা খাল।
সমন
এখানে ভূমির দিকে ঝরে পড়ে নোনা অশ্রুদাগ
দস্যুর নামের শানে লোকে জ্বালে তারকা-চেরাগ
ধাঁধিয়ে গিয়েছে মন আলো আর হীরা-জহরতে
মানুষ মজেছে হীন ইহলোকি লোভের মৌতাতে;
জৌলুশে বান্ধিছে রুহ, কাচজারে যেন তাজা পাতা
অহমে উঁচায় সিনা ইগো-পীর এখানে বিধাতা
পটের তুলির পাশে পড়ে থাকে—না ফোটা যে ফুল
সেও দিয়ে যেতে হয়, দরগায় ঘ্রাণের মাশুল;
পরমের ধ্যানে নত নিখাদ আউল খুঁজে চলি
বাদাড়ে ছায়ায় ঘুমে বুনো বটপাতার শাল্মলি
তেমন নীরব কোনো মায়াবনতটে—প্রাণে ঋদ্ধ
রূপ-অবয়ব বুনে চলে গেছে কারা ধীর স্নিগ্ধ ;
গোধূলি সত্যের রঙে ভরে ওঠে জর দেহবন
ঝরে যায় আয়ুফল, ধেয়ে এলে শেষের সমন।
রাতের দরদে
ঘুমিয়ে পড়েছে ফুল ডালের নরমে রেখে মাথা
গুমোট মেঘের মতো আঁটোসাটো ঘেঁয়ো নিস্তব্ধতা।
রাতের দরদে ঝাঁপ ফেলে ফেরে একা দোকানিরা
তারা হাঁটে ধীর পায়ে, যেন ফোটে ফুলের পাপড়ি।
কানাড়ি রাগের তালে ছোটে অবসন্ন রেলগাড়ি
চাপা পড়া পাথরের সাথে ঘষা লেগে বাজে মন্দিরা;
কাঁটাঝোঁপ সচকিত হয়ে ওঠে সুরে—টোকা লেগে
শাখার গভীর থেকে নিদ্রিত পল্লব ওঠে জেগে।
টেনে নেয় হুইসিল, বহুদূর ধেয়ে আসা গান
সজিনা গাছের ডালে ঝুলে থাকে চাঁদছোঁয়া ঘ্রাণ।
সেতারের তারে গূঢ় কোনো ধ্বনি মেলে মায়া-পাখা
বহি: দুনিয়ার দিকে সমস্ত দুয়ার খুলে রাখা ;
আঙরাখা ছেড়ে কেউ চলে যায় একা—আলগোছে
পানি থেকে দেবে যায় ধীরে অপাংক্তেয় সব মাছে।
গুরুভার
অনীহা ধরেছে ঝেঁকে এই মারীময় আর্ত দিনে
চলে যায় বার-ঋতু, ফুল ফুটে ঝরেও গিয়েছে
সে স্মৃতি উদগম তৃণে। বন গহনের গূঢ় স্বর
আরো ঘন হয়ে পুনঃ পুলকিত গাছে আর রোদে
অন্তরীন কোনো দস্যু যেন আমি গৃহভৃত্যে বাঁচি
জানালা গলিয়ে আসে কারা ঐ আলোর নাচনে
দেয়ালে দেয়ালে ভাসে বহু দূরে বসে থাকা এক
অবসন্ন পাখির ছায়া; বোঁচা লেজ ঝোলে ডালে।
মনে হয় উড়ে যাই—মেঘ হয়ে ডুবে যাই ধীরে
ঘন বন গহ্বরে। সারাদিন ঝরি রিক্ততায়
শস্যের গোড়ায় নেমে মুছে যাই বিলে-জনশূন্য
সে নিখিলে কেউ বসে থাকে জাল ফেলে-গুরুভার
বয়ে চলে একা একা—কোনো ডুবো মাছ কথা কয়
টিমটিমে আলোর মতো মৃদু নড়ে লাল ফুলকাঝাড়।
মোস্তফা হামেদী
জন্ম : ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি. ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
পড়াশোনা : বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ, নোয়াখালী
প্রকাশিত বই:
১। মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ (কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫)।
২। তামার তোরঙ্গ (কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮)
৩। জড়োয়া (কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯)
৪। শেমিজের ফুলগুলি(কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০)