সনেট সংখ্যা | ধুলিম্লান কবিতাগুচ্ছ | রিমঝিম আহমেদ

১.

মঙ্গল নিমিত্তে বাঁধা, খসে গেছে বাজুর তাবিজ

গভীর শূন্যতা, তবু পথ হাঁটি বনের শিখরে

হরিয়াল উড়ে যায় মুখে নিয়ে বসন্তের বীজ

ঘষা লাগে, ক্ষয় হয় জীবনের ভুল ব্যবহারে

 

কোনো এক সরু নদী খুঁজে যায় নিজ ইতিহাস

সমুদ্র দেখেনি সে তো, বুঝি চেনেও না কে তার মা

কে যে তার বাপ ছিল, এই ভেবে ঋতুচক্রে বাস

সিঁদুরের রঙ নিয়ে সেজে ওঠে পূজার প্রতিমা

মৃত্যুর তামাটে উট কাকে রেখে কাকে নেবে দূরে

স্মৃতিচিহ্ন ছাইদানি, শেষ কাপে চায়ের তলানি

রক্তের উত্তাপ শোভা লেগে থাকে তার কালো খুরে

ধুলিম্লান করপুটে নিভে আসে বাণী চিরন্তনী

একা একলা পুকুর। কালো জলে ছায়া। থৈথৈ করে।

এতই বাতাস তাও টান লাগে মদির হাপরে

 

 

 

২.

যে জীবন পেয়ে গেছি ভুলেভালে, সরল রুটিনে

তারও কিছু চাওয়া আছে, সম্ভাবনা। হয়তো অগোছালো।

পথছবি পাল্টে যাবে, সোজাসাপ্টা অথবা কঠিনে

ভাষার গলিত জল গাল বেয়ে কণ্ঠহার ছুঁলো

 

খিন্ন, আর্ত, তিক্ত ক্লেদ সবকিছু চায় অভ্যর্থনা

এই শীত মৎসগন্ধা আচম্বিতে আলভাঙা পথে

পাথরে রচিত হবে স্বরভরা জীবনের দানা

হোঁচট সরিয়ে যাই নিরুদ্দিষ্ট অচেনা শরতে

 

যে চৈত্র দগ্ধায় না তারও আছে বহ্নির অহম

জরাকে জরায়ু ভেবে রচিত হয়েছে আরাধনা

বিগত হয়েছে রাত তারও আছে স্মৃতি মনোরম

অগস্ত্যগোলাপ ফোটে ছড়ায় যৌবন; বিবসনা

 

কবিতার অর্ধসিদ্ধ শব্দগুলো বেছে তুলে রাখি

যেটুকু জীবন পাই সেও তো সময়ের চালাকি

 

 

 

৩.

কিছুই কি নেই? অসম্পর্ক কিংবা সুদিনের স্মৃতি

জ্বর, অতল প্রলাপ। সুরতাললয়হীন গান?

ফাঁকাঘরে বেড়ালের হেঁটে চলা, পোষ্যের সম্প্রীতি

সবই কি ফুরিয়ে গেছে! আত্মবোধ, প্রণয়ও কি ম্লান?

 

বাড়ন্ত দিনের ভাঁজে চাল-ডাল-লবণের দেনা

সেগুনের বনে তাও বৃষ্টি হয়, রেণু যায় ভেসে

ছায়াগুলো রৌদ্রগুলো কখনো তো পোশাক পরে না

পথ সব ডুবে যায় অন্তহীন পথের আবেশে

 

সবই কি ভণিতা ছিল মৃদু হাসি চোখের বিভূতি?

ভেজা ছাদে পাখি আসে দোল খায় আঁচল পতাকা

দুর্মর অহমে চর- বিচ্ছিন্ন নদীর পরিণতি

জলে ভিজে, রোদে পোড়ে। তাও ওড়ে নিষঙ্গ বলাকা।

 

সবকিছু চিহ্ন রাখে ধোয় না শতবর্ষার জলে

পৌর্ণমাসী উঁকি দেয় মাথাভাঙা গাছের আড়ালে

 

 

 

৪.

জ্বরের ভিতর কেউ ছুঁড়ে গেছে আমার আমিকে

কতদিন একাই ছিলাম! কত রাত ভোর হলো!

স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। ক্রমে যেন হলুদ ও ফিকে

হয়ে মরে যেতে যেতে, ছোঁ মেরে নিয়েছি আলো

 

চারদিক থইথই জল। এখনো বর্ষার ছেলে হিসি

করে বিছানা ভাসায়। শূন্য বাড়ি থেকে শেষ রাতে

গান ভেসে আসে। খুব মলিন বাতির নিশি

ডুবে যায় শিশুগাছের আড়ালে। তার ভেজা হাতে

নদী। সমুদ্র ছেড়ে যে অভিমানে চর হতে এসে

হয়ে গেছে মেঘ। বৃষ্টিলেখা খাতা। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে

দরজা খোলার চাবি হাত থেকে পড়ে গেছে খসে

প্রত্যাশা থেকেও উঁচু এক ছায়াবাড়ি আড়িপেতে

আমাকে ভাসাতে চায়। গ্রহণ করেছি তার সব

অন্তের শুরুও আছে নৈঃশব্দ্যে তুমুল কলরব।

 

 

 

৫.

নিজের বুকের গান একা একা কান পেতে শুনি

আধোভাঙা ঘর থেকে উড়ে আসে একাকী চড়ই

শোভাযাত্রা দেখেছি শৈশবে। আজও দেখি, রঙ ছাড়া

অতলান্তে ডুব দিয়ে বাতাসনির্ভর বেঁচে রই

 

ধীরে ধীরে মুছে যায় কত জন্ম আলোছায়াময়!

খনিজল ছেঁকে ছেঁকে পরিস্রুত ছায়ালিপি লিখি

একদিন রাত্রি ছিল, দিন ছিল, স্বপ্নে লাল বাড়ি

কল্পনায় জ্বলে ওঠে ক্ষুধার্ত ইঁদুর ধিকি ধিকি

 

জৈষ্ঠ্যে দাঁড়িয়ে দেখি বর্ষাকে, দেখি একাকী গোয়ালা

বনপথে হেঁটে আসে বিষণ্ন মেঘের ছাপ ধরে

আগুন ও সন্ধ্যা মেখে ভেঙে যায় পাখিদের মেলা

ভ্রমণ লাগে না আর, ঘুরে আসি গর্ভের দুয়ারে

 

নিজস্ব জামের বনে পাতা পড়ে, কুড়াই মর্মর

মহীরুহ বয়ে আনে অন্তরাল আজন্মের স্বর


রিমঝিম আহমেদ
জন্ম : ৮ জুলাই ১৯৮৫, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
পেশা : উন্নয়নকর্মী
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : লিলিথের ডানা [চৈতন্য, ২০১৬], কয়েক লাইন হেঁটে [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮], ময়ূরফুলের সন্ধ্যা [বাতিঘর, ২০১৯], সুবেহ তারা [তবুও প্রয়াস,২০১৯]
উপন্যাস : বিস্ময়চিহ্নের মতো [বাতিঘর, ২০২০]

ইমেইল: rimjhimahmed85@gmail.com


শেয়ার