১৫.
হিউয়েন সাঙ, জনমিশ্রণের এই অত্যাশ্চর্য
জরায়ু ও জলবায়ু কোথাও দেখেছ? অত্যাচারী
শাসকের চোখ ভেঙেচুরে, আমার রক্ত ও ভাষা
পদ্মপাতায় টলমল করে এই শীতার্ত সকালে।
ভয় করি না রৌরব। দুঃখের প্রতিটি স্নায়ু বেয়ে
কোনো বজ্রনেতা আসে যদি, এই রক্ত আর ভাষা
তখন নিভৃতে মিশে যাবে ধানক্ষেতে, শ্লোক-বলা
রমণীর মুখের তাম্বুলে আর দুঃখের কার্পাসে।
নৌকাভর্তি শব্দ নিয়ে আমরা দিগন্তে যাব কোনো,
দেখা যাবে অস্তাচলে বধুরা গোধূলি হয়ে আছে—
আমরা বলব এই গোধূলির কথ্যভাষা দিয়ে
মাতৃভক্ত বর্ণমালা আদিরসে ভরে দাও প্রভু;
বুবুর শরীরে দাও লাল-কালো কিছু চন্দ্রবিন্দু,
মায়ের পালঙ্ক জুড়ে দাও কিছু ধানের স্তবক।
২০.
জৈন্তিয়া পাহাড় ডাকে—বতুতা! বতুতা! পৃথিবীর
শঙ্খনীল স্বপ্নের এ-সানুদেশে যার পা পড়েনি,
তার বৃথাজন্ম পড়ে থাক তবে সাহারা মরুতে।
স্বর্গ থেকে নেমে আসা অতি নিতম্বিনী এ সুরমা
রজঃস্বলা নদী। নৌকায় বসে দেখ বাঙ্গাল-প্রাচুর্য,
দেখ হরিকেল-প্রহেলিকা—জ্যোৎস্না দিয়ে জলসেচ,
পানিকল দিয়ে পড়ছে শিশির, দুইধারে দেখ
ফলের বাগিচা, নারিকেলবীথি, আর ঝিরিঝিরি
শিরিষ পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না এসে শুয়ে পড়ে
কুপি-জ্বলা রমণীর বুকের ওপর। হে বতুতা,
এখানে অর্ধেক রাত শস্যরা পাহারা দেয় ঘুম
অর্ধেক রাতের নীলে নারীরা আকন্দ হয়ে ফোটে,
এখানে ঢেঁকির কোলে কত চাল জ্যোৎস্না হয়ে জ্বলে,
এমন প্রাচুর্য তুমি কখনো দেখেছ নীলনদে??
২৯.
কোনো অস্ট্রিক যুবক একদিন কিছু বন্য ফুল
তুলেছিল আনমনে, সে-ফুলের কান্না হয়তো-বা
শুনে ফেলেছিল কোনো দ্রাবিড় যুবতী; সেই থেকে,
প্রণয়ের দীর্ঘশ্বাসে নিশিগান্ধা ফোটে দিকে দিকে।
পশুর হাড়ের আর শিঙের গয়না নিয়ে ছোটে
পেশল পুরুষ—জলপাত্রে ভেসে ওঠে যার মুখ
তাকে দেবে চিত্রল হরিণ, তাকে দেবে ভাত মাছ
আর নীলগাই। বর্তনে জ্যোৎস্নার মদ নিয়ে, একা,
অপেক্ষায় কাতর হয় তনুমধ্যা নারী, ধীরে ধীরে,
দ্বিপ্রহরে, দেহবিষ মিশে যায় ধনুকের তূণে।
বঙ্গেশ্বর, তুমি চেনো নাকি সেই ফুল, সেই মদ?
আগুনে পুড়েছে হাত তবু জ্যোৎস্না ছাড়েনি এ-ভূমি—
পথে পড়ে থাকা অনন্ত পৌরুষপ্রহেলিকা দেখে
লাজে ভয়ে আকবর নাকি ফিরে গেছে বারেবারে।
৩৭.
ঘুম যায় করুণ রায়ত, হেমন্তস্বপ্নরা আসে
শালিধান নিয়ে, আসে নিত্যদিন বীজ ও বলদ।
গোধূলি-বাথান থেকে রাজস্বের ব্যথা নিয়ে রোজ
ফিরে আসে পশুদল। ভূমিপুত্র স্মৃতিমর্মাহত,
তোমার সরিষা ক্ষেতে বেড়ে ওঠে হলুদ বঞ্চনা,
রাজস্বের চাপে রজঃস্বলাহীন তোমার বহিন।
বরই গাছের তলে কতগুলো রায়ত-কবর
জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শোনো, একটি কবর
আরেকটি কবরকে জিজ্ঞাস করছে ম্লানমুখে—
ফসলের দানা দেখে এখনো কি কান্না করো তুমি?
নায়েবের মুখ দেখে মনে পড়ে জমির নিশানা?
কিংবা ঘোড়া দেখে বীজতলা?—স্বপ্ন প্রলম্বিত হয়,
দেখে শালিধানে ভরে গেছে পিতার কবর, আর
পিতামহ মাপছে সে-ধান; কতটা রাজস্ব বাকি!!
৫৩.
আমারে দেখতে আসো দেহনদী-মরে-যাওয়া দিনে।
ভাসান পানির মতো দীর্ঘ হচ্ছে আমার নায়র—
লাউগাছ জড়িয়ে ধরেছে আজ আমার কোমর,
সুপারির নীল স্তনে চুমু ফেলে উড়ে গেছে পাখি।
শরীরে বিজুলি জ্বলে, কাহার ঠোঁটের জল খাব?
হেমন্তখড়ের আমি মধ্যে সমাহিত হয়ে আছি,
বেগানা বৃষ্টিরা এসে ছুঁয়ে ফেলার আগেই তুমি
সোমরসে সিক্ত করো নিশিলাগা আমার গতর।
নদীতে বজরা আসে, তবু দৃষ্টিতে পড়ে না ওগো
তোমার তনাই। আকাশে কদম্ব দোলে নাকি!
আমার দুঃখরা খায় প্রতিদিন মাছের ঠোকর।
চেয়ে দেখি উজানের পানি আজ না-ছুঁই নিঠুর!
কত-না শিলুক শুনি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ির ঝিয়ের—
নায়র দীঘল হলে দেহরসেও থাকে না দরদ।
জাকির জাফরান
জন্ম ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই গ্রামে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ব্যাডফোর্ডশায়ার থেকে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট-এ স্নাতকোত্তর। পেশায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। নেশা কবিতা ও গান। তাছাড়া ফটোগ্রাফিতেও মজে থাকেন নিরন্তর। অনুবাদ নিয়েও কাজ করেন সুযোগ পেলেই।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
সমুদ্রপৃষ্ঠা [২০০৭]; নদী এক জন্মান্ধ আয়না [২০১৪]; অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী [২০১৫]; অন্ধের জানালা [২০২০]; নির্বাচিত কবিতা [২০২০]
অনুবাদ : পাওলো কোয়েলহো এর “আকরায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি ” [২০১৫]