সতীতালয় | অস্ট্রিক ঋষি


সতীতালয় ২৮-৩৫


২৮

প্রেমে কোনো ঋজু পথ নেই, প্রার্থনায় নেই কোনো হ্রস্ব প্রবিধান

আলোর পিছনে ছুটছো, দেখো, তোমাকে ধাওয়া করছে স্ব-ব্যঙ্গ প্রকারভেদ,
                                                                          ক্রমবর্ধমান ছায়া

সেই যে যুদ্ধাহত সৈনিক, শত্রুপক্ষের শুশ্রুষাকুটিরে—নিবিড় পরিচর্যায়
ক্ষতে ক্লিষ্ট তবু সেবিকার সহৃদয় স্পর্শে, ইশারা ও উস্কানির প্রতিভায়
নিরাময়ের কক্ষের ভিতর—বহুদিন অপেক্ষার শেষে পরস্ত্রী-প্রেমিকাকে
টান দিয়ে বুকে জড়ানোর তীব্রতর স্বপ্ন নিয়ে বাড়িয়েছিল ব্যাকুল হাত,
                                            চিঠির বদলে সে পেয়েছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ

আমি তার অশ্রুর উষ্ণতা, কপোল বেয়ে আটকে গেছি ওষ্ঠের পরিখায়

তুমি সেই ফুল—দূরের ব্যালকনিতে ক্লিপে আঁটা ব্রায়ের উপর
কোমল সুতোর কারুকার্যে ফুটে আছো, অস্পষ্ট, তবু সুগন্ধ পাওয়া যায়।
এত যে দুলে দুলে ওঠো, ওসবই ফুঁ-য়ের ব্যাকরণ; পাড়াতো বারান্দায়
অজস্র কিশোর, হাওয়ায় মিশিয়ে দিচ্ছে নাড়িয়ে দেয়ার দুরাকাঙ্ক্ষা।

ঘরের কোণে তুলসি রাখি, বাড়ির কোনে নিম, মনের কোণে তোমাকে


২৯

তোমাকে হাসতে দেখে হেসে উঠছে শিশু, কান্না দেখে করছে অশ্রুপাত

আমি যাব ছলাজননীর বিরুদ্ধে, গুটিকয়েকে, স্বৈরপতনের আন্দোলনে

লাঠিচার্জে অনড় ছেলেটির স্পর্ধ-ললাটের দিকে তাকিয়ে, অপলক
বিমুগ্ধ এগিয়ে আসছে যে নির্দেশনা, নিশানাছিদ্রের ফাঁক দিয়ে
যারা দেখে ফেলেছে রক্ত ও ঘামের একাত্মবোধ, তাদের কল্পগঙ্গায়
সন্তানের মুখ হয়ে ভেসে ওঠো তুমি, আঘাতগুলো মাংসে লাগুক

রমণপূর্ব আদরে, লেহন মন্ত্রণার সংবেদে স্ফিত সদুগ্ধ চুঁচির মতো
শক্ত হ’য়ে উঠছে যে ন্যায্য দাবী, তুমি তার চারপাশে চক্রাকারে বসো

যারা গেছে পৌর নন্দনের সভায়, পার্লার চত্বরের গলিতে; যারা গেছে
স্বর্ণপট্টির ঘুঁটঘুঁটে চায়ের দোকানে, তাদের জিপারের প্রান্তদেশ ফুঁড়ে
ফুটে ওঠা আর্দ্র অংশের বৃত্ত দেখে ফিক ক’রে হেসে ফেলবে তুমি
সে হাসি ছড়িয়ে পড়বে বাজারের কিনারে কিনারে, খুপরিতে ও খাটে

সঙ্গে যারা যেতে চাও—খালি হাতে এসো, জামা থেকে ঝেড়ে ফেলো
 
                                                                  সম্পর্কের ধুলো


৩০

সম্পর্ক এমন পুকুর, একটা কচুরিপানা এক মাসে ঢেকে দেয় জল

দেবীর প্রভিন্ন বুকের তলে লেলিহান হ’য়ে আছে যে পার্বতী প্রদীপ
তার শিখার তীব্রভাপে অনায়াস বেরিয়ে আসছে জিভ, লালাসংক্রমিত
বিহ্ব্ল বালকের মনে আচমকা পিসির মুখ ভেসে উঠলে মণ্ডপের ধোঁয়ায়
তন্দ্রাবেশে বুজে আসা চোখের মতো কেঁপে উঠছে শুকনো পাতার ঢিবি
তার নিচে শীর্ষ সংবাদ, উলঙ্গ মহিলার মাই-কাটা নিথর শরীর

আমি সে কাদার লেই, প্রতিমার পরিত্যক্ত দলা; যেকোনো রৌদ্রের দিনে
 
                                                                     নির্বিশেষে ধুলো হ’য়ে যাবো

কাকে দেবে ভালোবাসা? উদ্ভিন্ন শরীর দেখে যে বাজি রেখেছে সমুদয়
তার প্রণোদিত চুম্বনের বিনিময়ে, প্রতিজ্ঞায় তবু স্ফুর্তে প্রকটিত নিনাদ
অথবা কোনো কল্পনামদির প্রেমিকের সপ্রশংস চাওনির অবকাশে
ক্রমশ কাতর চক্ষু, ব্যাঘ্রবেগে, লাফিয়ে পড়ার অনুভূতি, সূচনাপরাস্ত
    
                                                           কিন্তু সম্পাদ্যে আনাড়ি

যাকে চেনো কড়া নাড়ার শব্দে, সে পরিমিতির ছাত্র; ঠান্ডা মাথার খুনি


৩১

সত্য দু’রকম; খুনের পরের ঘটনা, আর, দ্বিতীয়টা আগের কাহিনী

তুমি তো মর্গপদ্ম, পঞ্চমুখে প্রশংসিত; ফুটে আছো তদন্ত-টেবিলে

আবহাওয়া গুমোট; যেন সদ্যযুবতী কোনো অগ্রজ সহোদরার সাথে
অপ্রস্তুত কিন্তু পুলকে স্পৃষ্ট এক দৃশ্যফাঁসে মুখোমুখি, বয়ঃসন্ধিকালীন
দূরত্বের ঘটনা নিয়ে সন্ধ্যার পাঠের টেবিলে—এক দ্বিধান্বিত কিশোর
খাতাজুড়ে এঁকে রাখছে অনুশোচনার স্কেচ। তাকে দাও ক্ষমার চুম্বন,
সন্তর্পণে, মেঘের ঘাড়ের কাছে ব্যেপে দাও বৃষ্টির গলনাংক,
                                                                      মার্জনার মৌসুসী নিঃশ্বাস

কেউ যদি নারী, তবে, যতগুলো তিল তার ততগুলো কলঙ্ক-মহিমা

মাংসের গন্ধ শুকেই যেসব বৃদ্ধা ব’লে দিতে পারে অতিথির পরিচয়
তাদের অভিজ্ঞ ঘ্রাণশক্তির সীমা থেকে দূরে, একান্তে যেতে পারো
শ্রাবণ রিসোর্টে, যেখানে শ্যালকপত্নীরা মাথা রাখে নন্দাইয়ের কোলে,
তুমিও কাঁদতে পারো স্বামীর বিরহে, স্বেচ্ছায় দেখাতে পারো প্রবাসী আতর

তোমার স্কন্ধে তিল, একটাই বিয়ে কিন্তু রাশিচক্রে অনেক প্রেমিক


৩২

কে কতটা সেঁটে ছিল অবিবেচ্য সব, স্মরণে রেখেছে যারা তারাই প্রেমিক

শীতে—পত্রঝরা যে বৃক্ষটির ডালে ডালে বসেছিল অসংখ্য টিয়ে;
যেন টিয়ে নয়, শীতও নয়, যেন তরুণ বসন্তকালে ফাল্গুনী সবুজ মেখে
                                                               ছেয়ে যাওয়া অসংখ্য পাতা;
সেই বৃক্ষটি—তার আনন্দ, কৃতজ্ঞতা ও প্রেম প্রকাশের জন্য
দুদণ্ড কাঁদতে চেয়েছিল, কিন্তু চোখ নেই। চৈত্রের প্রখর দুপুরে
এই যে জুড়িয়ে যাচ্ছো হাওয়ায়; এ হলো গাছের অশ্রু, কৃতজ্ঞক্রন্দন

প্রকীর্ণ বৃক্ষটিকে দেখো, ঠোঁটে ক’রে যার বীজ এনেছিল ধানশালিক,
তারই প্রসন্ন ডালে—ঘুঘুকে খাঁচায় রেখে ফাঁদ পেতে বসেছে মানুষ

প্রতিদানের আসরে, ঘটকের এঁটো হাত চেপে ধ’রে বসেছে যে বচসা-পিসে
তার সমতাবিধানের তাড়নার পিছে স্ত্রীর অনুরোধের মতো আকুতি নিয়ে
তুমি যাকে আসতে বলেছিলে, সেও আজ অন্য কক্ষপথে; মৌনজগতে
প্রেম হলো—দুইটি গ্রহের মাঝে চিরন্তন দূরত্ব-হেতু অভিকর্ষ টান

কেউ কেউ সমার্থক শব্দ, মাত্রা রক্ষার দায়ে কবিতার বাইরে চলে যায়


৩৩

আমি অনির্বাচিত কবিতা; ছন্দ আছে, মিলও আছে, কিন্তু কী যেন নেই

যার কিছু নেই তার দরিদ্রতার মতো বড় তোমার মন, মহাবিশ্বে লীন

লিখতে না পারার অনিদ্রায় রক্তিমাভ দুটি চোখ, যার নৈরাশ্যশিরায়
যন্ত্রণা আঁকতে আঁকতে ঘুম সংবরণ করছে এক নবিশ চিত্রকর
তার অসতর্ক তুলি থেকে রঙের অতর্কিত লাফিয়ে পড়ার ক্ষিপ্রতা নিয়ে
ঝাপিয়ে পড়েছে অথৈ জলে, মিথ্যা অপবাদে, এক সদ্য-তালাকপ্রাপ্তা;
তাকে কোন ছন্দে মানায়? তুমি তার অন্ত্যমিলে কী শব্দ বসাবে?

আমি মাঘের জরায়ু থেকে আরেকটু গভীরে সরে যাবো, শৈত্যপ্রবাহে,
                                                                     কিন্তু ফাগুনে যাবো না

মায়ের পালকির দিকে চেয়ে ওই যে অঝোর বালক, সন্দিগ্ধ চোখে
অনন্তদৃশ্যের ফ্রেমে বাঁধিয়েছে বিচ্ছেদ, তার ভাঙা ভরসার ঘাঁয়ে
যে নারীটি লেপে দিচ্ছে ছলনাবাক্যের মলম, তার থেকে মিথ্যা শিখেছি,
তাই বুঝি ধরা প’ড়ে যাই, লুকাতে গিয়েই আরও সমুচ্চারে ফাঁস ক’রে ফেলি

কবিতা আড়াল চায়; তুমি চাও পাগলামো, আর আমি তো পুরুষ


৩৪

আমি তো পুরুষ, বিষণ্ণ কপোল থেকেও সম্প্রচার করি হাসি, বিজ্ঞাপিত সুখ

তোমার চরণ তলে এঁকে দিয়েছি নীল নায়িকার উরুর মসৃণতা

যেতে যেতে থমকে দাঁড়ানো বিড়ালটির কুকুর দেখে পথ পরিবর্তনে
বেরিয়ে আসছে যে ঐতিহাসিক সত্য; খড়ের স্তুপের নিচে, ভ্যাপসা গরমে
সে ছিল আত্মগোপনে, এই বর্ষায় সেইসব লাল লাল কেন্নোগুলোকে
জুতোর নিচে ডলা দিয়ে মারা হবে। ঘুরপথে তুমি এসে দাঁড়াতেই
কে যেন অবুঝ প্রেমিক—হেসে বলবে, ‘পাথরটাও ঠাকুর হ’য়ে গেল,
                                                                   তুমি কি-না পুতুল হয়েছো

এখন বলো, কোন জগতটা বেশি বড়—বিশ্বজগত, নাকি চিন্তাজগত?
আমি তো বিধৌত পথে হেঁটে যেতে যেতে জিভ ও যোনির সন্ধিক্ষণে
পিছলা খেয়ে প’ড়ে যাওয়া আনাড়ি পথিক, আরক্ত চিবুক থেকে
তিলের লাবণ্য নিয়ে ফিরে যাবো ব’লে, তবু প্রতিজ্ঞায় উঠে দাঁড়িয়েছি,
সারাগায়ে কাদা মেখে আমিও তো মাটির মানুষ, সদিচ্ছায় পুতুল হয়েছি

এতই সাধারণ হতে চাই, যেন আমার কবরে ঘাস জন্মায়, ফুল ফোটে—


৩৫

ওই যে সবুজ ঘাস, নীল ফুল দুলে উঠছে কবরে, ও সবই মৃতের চিন্তা
                                                                   অব্যক্ত ইশারারাজি

গোরস্তানের গাছে, বহুজ ব্যথায় পক্ব সুতরাং অনন্য মিষ্টতায় ভরা
সবচেয়ে বড় আতাটির দিকে তাকিয়ে, উদাস হ’য়ে আছে যে খোদক,
পায়ের নখে ছত্রাকের সহবাস ছাড়া যার কোনো নিকটাত্মীয় নেই,
আহার্যের অভাবে ক্লান্ত, সে কি পেড়ে খাবে ওই সতেজ আতাটি?
স্ত্রীর মাথার উপর—সে তো চেয়েছিল পাখি এসে কাকলি করুক।

তুমিও গোরের ফল, রসের ডুমুর, বখাটে পিঁপড়ের সাথে মিতালি করেছো

বনের গভীরে—যেখানে নদীর পাশে গাছেদের অবসরে ঘাসের সারল্য
সেখানে ঢিবির ‘পরে অস্তমিত সূর্যের আভায়, দুইটি পুরুষ সিংহ
পরস্পরকে চাটছে প্রমোদে, এই পর্ববিরতির ফাঁকে— নির্ভাবনায়
ঘুমন্ত খরগোশ যেন তুমি; নদীর ওপার থেকে ভেসে আসছে সমীরশাবক
                                                                 স্তন্যপানের অভিলাষে

আমি উপমাবৃক্ষের ডালে নিঃসহায় বোঁটা, না থাকা ফলের ভারে নত

প্রচ্ছদশিল্পীঃ শামীম আরেফিন
প্রচ্ছদশিল্পীঃ শামীম আরেফিন

পরিচিতি :

অস্ট্রিক ঋষি—জীবজগতের এমন এক অস্ফুট মাখলুকাত, যে তার ভিতরের কিয়দংশ মানুষটাকে কাদামাটির দলার মতো ক’রে, খামচে ধ’রে, ছুড়ে ফেলবার বাসনায় ব্রত। একেকটা কবিতাকে সে এমনভাবে টেনে-ছিঁড়ে হাজির করতে চায় যেন নিজের স্বরটাকে দিতে পারে প্রকৃষ্ট ঘেউ-রূপ; এই আশায়, যেন মৃত্যুর পর তাকে সারমেয় হিসেবে মেনে নেয় মানুষ।

প্রকাশিত বই:

নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে, কবিতা, চৈতন্য প্রকাশন (২০২২)
সতীতালয়, কবিতা, কিংবদন্তী পাবলিকেশন (২০২৪)

শেয়ার