থাকে আমাদের এমন অনেক অনুভূতি, ভাবনা-চিন্তা, যা অহং-সর্বস্ব নয়। মানে সবটা সামাজিক-রাজনৈতিক—বা ব্যক্তি-আমির সঙ্গে কারোর বা কোনও কিছুর সংঘর্ষজাত নয়। থাকে এমন কিছু চেতনা ও অনুভব যা এই বিশাল ব্যাপ্ত চরাচরের। দিক্-দিশাহীন মহাশূন্যের। আবার এত সহজে দাগিয়ে দেওয়া যায় না, এমনকি সেই চেতনা বা অনুভব যে কেন- কী- কিভাবে, কিছুতেই ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না—থাকে সেই পেরেকও। তখন এক করতে গিয়ে আরেক হয়। কেবল মরমের আগাপাশতলা বরাবর একটা পোকা হেঁটে যায়। তাকে ভুলে থাকা যায় না। (অথচ বস্তু-জগৎ তার একটু অবসর কিছুতেই মঞ্জুর করবে না।) গান শুনে, তর্কে মেতে, নানা আয়োজনে কিছুতেই যায় না সে মনের কাঁটা। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বাইপাসের নির্জন একটা রাস্তা। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে সে রাস্তা সামান্য পিছল। ল্যাম্পপোস্টের আলো ভিজে বাস্প হয়ে আছে। হঠাৎই আলো জ্বালিয়ে দূর থেকে একটা বাইক আমাকে পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তে। আর ভিজে রাস্তায় তার প্রতিবিম্ব ভেঙে ভেঙে গেল। এর মধ্যেই বর্ষার দু-একটা ব্যাঙ ডেকে উঠল। এসবের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, কান পেতে রাখতে রাখতে কী যেন একটা মনে পড়া বাকি আছে, খেয়াল হল। বাসের জন্য যে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা যেন আরেকটা জন্মের কথা। কী একটা মনে পড়া বাকি আছে—এই পেরেক অনেক বেশি প্রকট হয়ে থাকল, যতক্ষণ না বাসের হর্ণ ভালোমতো কান টেনে ফুটবোর্ডে পা তোলাল। কিন্তু কী মনে পড়া বাকি থেকে গেল? বিজ্ঞানের ভাষায় এটাই কি সেই omnipresent চেতনা?
‘In years to come, I would learn that the essence of consciousness pervades the Universe and that our brains may well be designed to tune into it and receive as much as we can, providing we are able to surrender the space.’ (Great Expectations: Code name God; Mani Bhaumik) কিংবা, কোয়ান্টাম থিয়োরির অন্যতম পথপ্রদর্শক Max Planck-এর কথা যদি দেখি—‘I regard consciousness as primary. I regard matter as derivative of consciousness.’ (ঐ)। অর্থাৎ চেতনাই হল প্রাথমিক এবং মৌলিক। আর চেতনা থেকেই বস্তু উদ্ভূত! আর আমাদের মস্তিষ্ক যদি সঠিকভাবে টিউনিং করা থাকে তবে, আমরা সেই চেতনাকে ধরতে, উপলব্দি করতে পারব। এরকম কিছুরই সঙ্গেই কি তবে আমাদের যাবতীয় মনে না পড়া জড়িয়ে থাকে? জড়িয়ে থাকে যাবতীয় অস্বস্তির পেরেক? রবীন্দ্রনাথের মস্তিষ্ক কী অনেকখানি সেই সুরে ও চেতনায় টিউনিং করা ছিল না? নাহলে কী ভাবে লিখলেন—‘ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম,/এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কী নাই।।’ তাই কি ‘কিছুতে যায় না মনের ভার’? বুদ্ধদেব বসু ‘মেঘদূত’-এর ভূমিকা অংশে ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর…’-এর তর্জমা করতে গিয়ে তাই কি খুঁজে পাবেন যথার্থ সংবেদন— “এই বেদনা শুধু কোনো নির্দিষ্ট দয়িতের জন্য নয়— ‘যে এলে আমার মন্দির পূর্ণ হবে তাকে আমি চিনি না,’ এই কথাটাও আছে।” অর্থাৎ এই ভরা বর্ষায় আমার ঘর খালি সত্য, কিন্তু কাকে পেলে যে আমার এ ঘর পূর্ণ হবে, আমি জানিনা। এই – ‘যে এলে আমার মন্দির পূর্ণ হবে তাকে আমি চিনি না, এই কথাটাও আছে।’ —এ সংবেদনশীলতা তো কেবল ‘দ্রষ্টা-কবি’র পক্ষেই সম্ভব। র্যাঁবো যাকে বলেছিলেন—‘Seer’।
আরও একটু বিশদ করা যাক। আপাত নিরীহ একটা দৃশ্য, হয়ত বৃষ্টিতে কেউ ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছে, বা সামান্য একটা পোকা ফাঁকা ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে— অনেকসময়, ভালো করে নিজেকে খেয়াল করলে দেখব, কী যেন একটা অব্যক্ত চাপ অনুভূত হচ্ছে। আমার চেতন-মনের সঙ্গে কী যেন একটা রসায়ন ঘটে যাচ্ছে। আমরা এরকম কোনও দৃশ্য বা ঘটনাকে অনেকসময় খুব মোটা অর্থে ‘ভালো লাগা’ বলে ধরে নিই। শব্দ-কারবারীরা অনেকসময় ধরে নেন ‘প্রণোদনা’ অর্থে। কিন্তু এইসব ‘ভালোলাগা, বা প্রণোদনা’ ছাড়িয়েও তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে থাকে। কতিপয় কবির র্যাডারে ধরা পড়ে তা। সেইসব কবিতার তাই পুরোটা বুঝিয়ে দেবার দায় থাকে না। দায় থাকে না পুরোটা বলে দেবার। কেবল ইশারাটুকু থাকে। বা অসহায়তাটুকু। অনেক সময়ই তাই থেকে যায় প্রকাশ আর ভাষার মধ্যেকার কিছু খামখেয়ালি, আরবিট্রারি সম্পর্ক। কেউ কেউ অবশ্য এই চেতনা বা অনুভবের অসহায়তাটাকে না বুঝে ভাষা আর প্রকাশের এই আরবিট্রারি-সম্পর্ককে উপরিতলের ব্যাপার হিসেবে দেখেন। ফলস্বরূপ নিজেদের কবিতায়ও ভাষা ও প্রকাশের এই অসহায়তাকে ফ্যাশ্যান হিসেবে তুলে আনেন। অনুভবের ফুলকিতে যেহেতু ফাঁক থেকে যায়, তাই তাদের লেখাতেও সেই ফাঁক আরও চিচিং হয়। বেলুন একসময় ফুটো হয়ে নেতিয়ে পড়ে। একটা সময়, হয়ত অনেক পরে, যখন সময় পার হয়ে গেছে, হতাশা আসে। কবি নিজের লেখার ব্যাখ্যা করতে অগ্রসর হন। ও পাঠককে অশিক্ষিত ভাবতে থাকেন। গিমিক, চমকে রাতভোর করেন। এবং জানলা-দরোজা-ঘুলঘুলিহীন চৌহদ্দিতে পাঠককে শ্বাসকষ্ট উপহার দেওয়াতেই মোক্ষলাভ বিবেচনা করেন। অক্সিজেনের জোগান রাখেন না। এমনকি পাঠকের সঙ্গে কোনও সংলাপেই যেতে রাজি নন। প্রশ্ন হল তাহলে লেখা ছাপা কেন? কেউ কেউ আবার কবিতার পুরোটা বুঝিয়ে দেবার বায়না রাখেন। এরা এমনকি ব্যবহারিক জীবনে – শুধু বেঁচে থাকার যে নানা জটিলতা, কবিতায় তার ছাপ থাকুক চান না। তারা চান কাফসিরাপের মতো কবিতা হবে মিষ্টি ও একরৈখিক। অর্থাৎ এরা ধরেই নেন পাঠকের ঠান্ডা বা সর্দিজ্বরের বেশি ক্রাইসিস নেই। কাফসিরাপের মিষ্টির চেয়ে আর কোনও ভালোলাগা থাকতে নেই। তাদের গৃহস্থালিতে ইনহেলার এমনকি ভাইরালেরও কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। অর্থাৎ চূড়ান্তভাবে পাঠককে আন্ডার এস্টিমেট করাতেই তাদের কবিতাযাপন সাঙ্গ হয়। এই দু’দলই আসলে মুখোমুখি এসে মিলে যান কোনও একটা সময়ে। হয়ত দৃষ্টির দৃঢ়তায়। সরললেখায়।
কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল চলভাষ যন্ত্র মারফৎ। বন্ধুটির অভিযোগ ছিল, এখন আর কেউ কাউকে ধারাবাহিকভাবে পড়ে না। কথাটা যে বিশেষণে প্রায় ধ্রুবসত্য, এ কথা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কী তার কারণ? ভাবতে ভাবতে সেই মহীরুহকেই স্মরণ করতে হল—‘মোহ মেঘ তোমাকে দেখিতে দেয় না’। কী সেই ‘মোহ’? এক, মিডিয়াই এখন ঠিক করে দেয়, কী সাহিত্য, কী সাহিত্য নয়। কে সাহিত্যিক, কে নয়। কে নন্দিত বা নয়। যোগ্য-অযোগ্য- স-অ-ব। এবং সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে যায় ব্যক্তি লেখকের ক্যারিশ্মা বা দারিদ্র্য, সংকট, মহানুভবতা, ব্যক্তিপরিচয়। সাহিত্যের বিচারে এগুলো একপ্রকার অনুঘকের কাজ করে। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট’ বিক্রির পরিমাণ বিচার করলে, সেই সত্য রুমাল থেকে বিড়াল হয়ে প্রকাশ্য হয়। কিংবা, ভ্যান গঘের চিত্রকলা কেউ বুঝুক না বুঝুক, মিডিয়ার কল্যাণে ভ্যান গঘের আর্ট-নমুনা সংগ্রহ করা একটা ফ্যাসান। তার উপর ভ্যান গঘের নিজের সেই দুঃসহ জীবন, একটা অদ্ভুত রসায়ন তৈরি করে। যারা Irving Stone-এর Lust For Life পড়েছেন, তাঁরা জানেন, এই আত্মজীবনীমূলক বইটি ভ্যান গঘের চিত্রকলাকে অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে বাড়তি সাহায্য করে। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড-নোট’-এর সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না, কেননা সেখানে গসিপ জাতীয় ব্যাপারকে মূলধন করা হয় নি। সেখানে চিত্রকর ভ্যান গঘকে বুঝতে চাওয়াই উদ্দেশ্য। এখন কথা হল, এই তফাত করতে পারাটা খুব জরুরি। তবে আজকের পাঠক অনেক বেশি সচেতন, এইসব মোহগুলো কেউ কেউ বোঝেন, কাটাতেও চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে লেখকের সৃষ্টি-ছাঁচ ও সৃষ্টি-পরিমাণ একটা বাধা হয়ে কাজ করে। কীরকম?
একটু আগে উপরে যে দু’ধরণের কবিতা-লেখকের কথা বলছিলাম, ভালো করে খেয়াল করলে দেখব এরা উভয়েই অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও আরামের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট স্ট্রাকচারের মধ্যে ঢুকে যান। আরও স্পষ্ট করে বললে একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে, একধরনের কবিতা-ঘরে। এই ছাঁচ হল তাদের কমফোর্ট-জোন। কারোর কাছে প্রতিমার গোলগোল, টানাটানা, পানপাতা, চাপাকলি এইসব, তো অন্যজনের কাছে ভেনাস, নগ্নমূর্তি, র্যঁদা, রামকিঙ্কর। যে যার রুচি-মেধা অনুযায়ী যে যার নিজস্ব কমফোর্ট জোন। এবং তাঁরা সচারচর সেই জায়গা থেকে বেরোতে চান না। তারা খেয়াল রাখেন না, মূর্তি থেকে মূর্তি কিভাবে বদলে যাচ্ছে রঙ-ভাঁজ-খেলা-খোদাই। সবচেয়ে বড় কথা কোথাও সপ্রাণতার অভাব ঘটছে কিনা। একঘেঁয়েমি আসছে কিনা। ভ্যান গঘ বা পিকাসো বা যোগেন চৌধুরী এক একটা শৈলীর ভিতরেই কত আলাদা উপস্থাপনে, ভুলে যান তাঁরা। তুলি ও রেখার আঁচড় একটি ঘরাণায় রেখেও কত বহুমুখী, চিন্তা-চেতনায়-খোঁজে-রঙের ব্যবহারে। এমনকি মাটির মূর্তি তৈরি করেন যেসব কারিগর, সেইসব পটুয়া বা পোটোদের থেকে অনেক কম আয়াসে অনেক বেশি স্থায়িত্ব চান এইসব কবিতা-লেখক। কেউ কেউ হয়ত পান। তবে অবশ্যই তাঁর জীবৎকালে। এখানে একটু সাবধানতার প্রসঙ্গে জানাই এখানে কারিগর বা পটুয়াদের তুলনা কোনওভাবেই তাদের হেয় করতে নয়। ইতালিতে এইসন কারিগরদের হাতেই ‘আর্ট’ জিনিসটার উৎপত্তি। অন্তত প্রমথ চৌধুরীর তাই অভিমত। অনুমান করতে পারি, এইসব কারিগরিতে যে স্বাধীনতার অভাব থাকে, তার হাত ধরে—সেই অভাববোধ থেকেই প্রয়োজন হয়েছিল আরও মুক্ত ক্যানভাসের। এবং অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্থায়িত্বের প্রশ্নও সেখানে জুড়ে ছিল। একটা সাদা পাতার চেয়ে উন্মুক্ত ক্যানভাস আর কী হতে পারে! বিশেষত কলম বা কি-বোর্ড ছাড়া যখন আর কোনও বাহ্যিক সহায়কের ভূমিকা নেই। রঙ-তুলি-স্বর-সুর-স্বাচ্ছন্দ্য-ভাঁজ-ঢেউ-কর্কশতা-ঘাম-রক্ত-কফ-হর্ষ-বিষাদ এইসব কিছুর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও শোষণ শক্তি সব একযোগে যেখানে রাখা সম্ভব সেই সাদা একটা পাতা, তার চেয়ে সম্ভাবনাময় আর কী থাকতে পারে! সূর্যরশ্মির তলায় একটা নির্দিষ্ট কোণে আতশকাচ রাখলে সাদাপাতায় যে আগুন লাগে সে কী নেহাতই কাকতালীয়! আমরা যারা লিখি কজনই বা অনুভব-কোরকে সেই সর্বত্র-বিচারণ সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে পারি?
লিখতে লিখতে অনেকসময়ই আমরা রোম জেগে যাওয়ার অনুভূতি থেকে দূরে সরে যাই। লেখা তখন অভ্যাসমাত্র। কম-বেশি প্রায় অনেক লেখকই পুনরুক্তি বা বেশি কথার দায়ে ভারাক্রান্ত থেকেন। এমনকি খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখব, রবীন্দ্রনাথও হয়ত এই ভারে কিছুমাত্রায় হেলে আছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেরই তিনটে বই-এর পর চতুর্থ বইটায় ঢোকারই ইচ্ছে চলে যায়। কারণ অভিজ্ঞতা বলছে দুটো বই-এর পর তৃতীয় বই-এ সেই কবি পুনরুক্তিতে জর্জরিত। একজন ঔপন্যাসিক বা প্রবন্ধকারের ক্ষেত্রেও এই সতর্কতা থাকা খুব জরুরি। পুনরাবৃত্তি, চিন্তার অভাব, অনাকর্ষণীয় ভঙ্গি—এসবই একজন পাঠকের কাছে অতীব গুরুভার। শুধু তাই নয়, এই অতি-র প্রসঙ্গে আরও একটি মোহ হল—প্রকরণের অতিরেক। কোনও কোনও লেখায় ছন্দের কারিকুরি এত বেশি চোখে এসে লাগে, যে তার হাড়- শিরা-উপশিরা বিসদৃশরকম উঁচু হয়ে ওঠে। রক্তমাংসে মিশে থাকার অন্তর্বর্তী প্রবাহ ও প্রাণটাই অনুপস্থিত থাকে। হাঁসফাঁস লাগে। একটা সহজ উদাহরণ দিই। বড় বেশি সাজানো গোছানো বাড়িতে ঢুকলে তা গৃহস্বামীর কাছে গর্বের হলেও, আমরা যারা বাইরে থেকে সে গৃহে প্রবেশ করি, আর সব উপস্থিত থাকলেও সে বাড়িতে আমাদের কাছে সপ্রাণতার অভাব চোখে (মনে) লাগে। আড়ষ্ট লাগে বসবাসের চিহ্ন অনুপস্থিত থাকে বলে। আবার এই ছন্দ ইত্যাদি রীতিকে নস্যাৎ করে আরেক দল বিরুদ্ধ প্রকরণ খাড়া করেন। অনেকটা প্রতিষ্ঠানকে বিরোধিতা করতে গিয়ে বিকল্প প্রতিষ্ঠান খাড়া করা। ক্ষমতার বিকল্প ভাবতে গিয়ে আরেক ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠা। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রকরণ ও সাজসজ্জা বড় বেশি বড় হয়ে ওঠে। এবার আসি ‘অলংকার’-এর কথায়। অলংকার মানে যথেষ্টীকরণ। যার সাহায্যে কোনও কিছুকে যথেষ্ট-তে পরিণত করা যায়। অলংকারের অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাগও আছে। কিন্তু অত কথায় না গিয়ে আমরা সার্বিক অর্থে অলংকার-কে সাজসজ্জা বা আচ্ছাদন হিসেবে যদি দেখি, তাহলে দেখব অনেক রসোত্তীর্ণ কবিতাই সেই অর্থে অলংকারহীন। আবার অলংকার আছে এমন রসোত্তীর্ণ কবিতায় কখনওই ‘অলংকার’ আলাদাভাবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে না। সে তখন অঙ্গসজ্জা থেকে খসে গিয়ে ‘অঙ্গ’-তে মিশে যায়। এই কথা বলার কারণ এই যে অঙ্গ—অর্থাৎ যা স্বাভাবিক। যেখানে কৃত্রিমতার স্থান নেই। যে ভাষায়- সংলাপে-পঙক্তিতে আমি আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাস এমনকি নখ-কাটা অব্দি স্থান দিতে পারি। অথচ যা রসোত্তীর্ণ। একটা ভাষা—যে ভাষায় আমি লিখছি তার যদি এই সাবলীলতা- শোষণ ও ধারণক্ষমতা না থাকে তবে সে লেখা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত –গীতা-পরবর্তী ক্লাসিক সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্য যে পরবর্তীতে কাব্যের দিক দিয়ে তত মহৎ-এর দাবীদার হতে পারল না, তার মূল কারণ ভাষা ও প্রকাশের কৃত্রিমতা। তার ভারবাহীতা। এই মূল্যায়ন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসুর।
দেড়শো বছর অতিক্রম করেও রবীন্দ্রনাথ যে আজও এত বেশি প্রাসঙ্গিক, গানে-প্রবন্ধে-চিঠিপত্রে-নাটকে তাঁকে বার বার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে তার প্রধান কারণ এই অকৃত্রিমতা। চিন্তার ভাষা, অনুভবের ভাষাই তাঁর লেখা-ভাষা। এমনকি তাঁর না-বলা-কথার একটা তাকানো বা ভঙ্গিও তাঁর লেখা-ভাষা। এখানে একটা কথা বলে রাখি—আমি কিন্তু ছন্দের বিরোধিতা করছি না, বিরোধিতা করছি ছন্দ-সর্বস্বতার। আঙ্গিকের নয়—বিরোধিতা করছি আঙ্গিক-সর্বস্বতার। বু ব’র কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলি—আঙ্গিক-সর্বস্বতার দ্বারা একজন ‘সম্পূর্ণ অকবি’র পক্ষেও যে ‘কাব্য’রচনা সম্ভব—এই উপলব্ধি যেন আমাদের হাত ছাড়িয়ে না যায়। আমাদের মনে পড়তে পারে হুয়ান র্যামোন হিমেনিথ-এর আঠারো লাইনের সেই বিখ্যাত কবিতাটা। যেখানে একজন পরিণত কবি সব অলংকার-আভরণ খসাতে খসাতে ক্রমে নগ্ন-নির্জন হয়ে ওঠার খোঁজ বরাবর হেঁটে যান। আসলে যেকোনও সহ-বাস সম্পর্কের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি। মোহগুলো কাটিয়ে আস্তে আস্তে গভীরে যাওয়ার এই প্রস্তুতি। অনেক সাজ-বাহার পরিপূর্ণ হয়েও মানুষ যদি তার অন্তরে শূন্য হয়, তবে তার কাছে যাবার কীই বা কারণ আছে? উপায়-ই বা কী? কবিতাও তাই। তোমাকে পড়তে পড়তে জানতে জানতে আসলে নিজেকেও জানতে জানতে এগোই।
কবিতায় প্রবেশের ক্ষেত্রে আরও একটি বাধা/ মোহ হল—নানা উপযোগবাদ। একজন রাজনীতিক কবিতায় খুঁজবেন তাঁর বিশ্বাস বা প্রত্যয়। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো রাজনীতি তো প্রতি পদক্ষেপে এমনকি শনাক্ত করা যায়। সেক্ষেত্রে একটা কবিতাকেও হয়ত শনাক্ত করা যায়। কিন্তু সেটা বাস্তবে কোনও ইজম বা মতের মতের সঙ্গে মিলতে নাই পারে। একটা লেখা একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। এখানেই কলমের তরবারি সমান ‘ক্ষমতা’। আবার, একজন সামাজিক মানুষ—সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গীর সূত্রে দেখতে চাইবেন একটা কবিতা। এটা দোষ বা গুণের কথা নয়। এগুলো এক একটা বাধা— কবিতায় প্রবেশের। কবিতার নিজস্ব যে ব্যকরণ আছে, সেই জায়গা থেকেই এই বাধাগুলো শনাক্ত করা যায়। জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’র কাছে যদি শরণাপন্ন হই, খুব সহজে হয়ত বুঝে নিতে পারব কথাগুলো। তবে কি কোনও কোনও লেখকের মতো ‘মৌলিকত্ব’ নিয়ে গলার পর্দা/ ডেসিবেল চড়াব? বা মৌলিকত্বের নামে কিছু চমক বা গিমিকে বিশ্বাসী হয়ে যাব? এক্ষেত্রে কবি ও প্রাবন্ধিক আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা উদ্ধৃতিসহ তুলে দিই—‘ ‘মৌলিক’ সাহিত্য নিয়ে বাঙালি সাহিত্যিকের গোঁড়ামির কোন ইয়ত্তা নেই। ছটা জেলা, দুটো রাজ্য, তিনটে দেশ, দুটো ভাষা টপকে যেতে পারলেই ‘মৌলিকত্বের’ ধারণা চুরমার হয়ে যায়। পার্লফ… একটা ভাষার মধ্যেই অসংখ্য উদাহরণ দেখাতে শুরু করেন যা প্রমাণ করবে বহু তথাকথিত দিকবিজয়ী কাব্যগ্রন্থ একাধিক অর্থে ‘অমৌলিক’। অথচ চূড়ান্ত প্রতিভার আগুনে সেঁকে সুগন্ধী, পুষ্টিকর, অতুলনীয়। অন্যলোকের লেখা থেকে নিয়ে লেখা ‘অতুলনীয়’ হয় কী করে? … এ প্রশ্নের উত্তর পাঠককে, কবিকে নিজের মতো করে খুঁজতে হবে। … কয়েক বছর আগে Where the Dreams Cross প্রবন্ধ সংকলনে অধ্যাপক চিন্ময় গুহ দেখিয়েছেন এলিয়েটের কবিতায় কিভাবে একাধিক ফরাসী কবির, বিশেষত ঝুল লাফর্গের প্রভাব ধরা পড়ে।’… (সম্পাদকীয়–আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ঃ কৌরব অনলাইন-৪২)।
আসলে সত্য বা মিথ্যা যেমন আপেক্ষিক। আমার কাছে মৌলিকত্ব ব্যাপারটিও তেমনি। ব্যক্তিমানুষের জানা না-জানা সাপেক্ষে মৌলিকত্ব নির্ভর করে। জানা, না-জানা বাদ দিলে পড়ে থাকে কল্পনা ও তার সূত্রে চিন্তাসূত্র।বা এই লেখাটার শুরুতে যে ‘চেতনা’র কথা বলেছিলাম, তেমন কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ‘চেতনা’-সূত্র। যার মর্মোদ্ধার আমরা নিজেরাই করতে পারি না বেশিদূর। আমি সর্বোচ্চ কতটা ভাবতে পারি? একটা মহাকাশ? সেই মহাকাশ অব্দি ভাবতে গেলেও তো আমাদের কল্পনার চোখ কোথাও না কোথাও আটকে যাবেই। একটা চাঁদোয়া বা শামিয়ানা, দেখা পৃথিবীর অনুকরণে পথ আটকাবেই। যা দেখিনি, তা কি কখনও ভাবতে পারি? যেমন ছোটবেলায় যে কোনও জঙ্গলের বর্ণনা পড়তে গেলে আমার চেনা কোনও ঝোপজঙ্গল সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে নিত মস্তিষ্ক। বা আরও অনেক অনেক বর্ণনা যা পরবর্তীকালে পেয়েছি, সবই চেনা একটা প্রেক্ষাপট-এ মস্তিস্ক অটোমেটিক্যালি ডিকোড করে নেয়। অর্থাৎ সবসময় আমরা তাই-ই অনুবাদ করি, ভাবি যা ভূতপূর্ব। অভূতপূর্বের কোনও কল্পনা হয় না। ‘অভূতপূর্ব’ কথাটাও– সবসময়ই আমার দেখা-জানার সাপেক্ষে।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বিজ্ঞান যতদিন আলো দেখাতে পারে নি, আদম-ইভ ততদিন অব্দি ধর্মবিশ্বাসের ন্যায়। মানুষ চিরকালই যতদূর কার্য-কারণ ব্যাখ্যা পেয়েছে ততদূর ভয়হীন। বাকিটা অর্থাৎ না-ব্যাখ্যার জায়গাটা স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়েছে। এটা একটা অনুভূতি। আর এই ভয়-অনুভূতি, না-দেখা, না-জানাটাই ঈশ্বর। কিন্তু সেই ‘ঈশ্বর’ও কী তত মৌলিক? প্রকাশভঙ্গী বা অনুবাদে বা কল্পনায়? সেও তো কোথাও মানুষের অবয়বে— কোথাও একটা, কোথাও বা একাধিক মাথা, মুখ, চোখ; কোথাও বা পশুর অবয়বে। তবে হ্যাঁ, অভূতপূর্বের অনুভূতি হয়। সেক্ষেত্রে ধরে নিলাম, আমার অনুভূতি– আমার ভয়, রাগ, প্রেম, যৌনতা, ঘাম, বিদ্রোহ কেবল আমারই মতো। আর কারও মতো নয়। (?? বিজ্ঞান কী বলে? কিংবা হরমোনের সংজ্ঞা?) তাও তার প্রকাশ তো এই সবার রোদ-জল-সূর্য-ধুলো-মাটি-শব্দ-অক্ষর থেকেই খুঁজে নিতে হবে! এবার যা পড়ে থাকে, তা প্রকাশভঙ্গী। তাও তো হাতফেরতা। মুখফেরতা। এর মধ্যেই সেলাইমেশিনের মিহি কাজ। দু-একজনের। কেউ কেউ অবশ্য প্রকট হতে চেয়ে, জুতো সেলাই-এর সূচ দিয়ে বড় বড় এফোঁড়-ওফোঁড় সেলাই চালান। সেটাও আপেক্ষিক। রুচির। একজন কবি অবশ্যই তাঁর ‘জিভের অল্প লাল ভাষা’টার খোঁজ করবেন। কিন্তু ‘লালে’র আগে ওই ‘অল্প’ কথাটা অনেকখানি অনুভবের। নির্মমও কিছুটা। যেভাবে বেদনা যে সংবেদনও, তাকে অনুভবের জন্য ধমনী ও স্নায়ুকেও অনেকখানি যোগ্য হয়ে উঠতে হয়! কিছুদিন আগে এক অগ্রজ কবি কবিতার কথাপ্রসঙ্গে বারবার ‘নিরুচ্চার’ কথাটা তুলে আনছিলেন। শব্দটা উচ্চারণ করার সময় শেষ র-এর উপর কোনও স্পষ্ট জোর বা চাপ ছিল না। আলতো করে শেষ র-টা ভাসিয়ে রাখছিলেন। এমনভাবে যেন হয়ত আরও কিছু বলে উঠতে চান, কিন্তু সেইমুহূর্তে বলে উঠতে পারছিলেন না। আমার এই শব্দটা নিয়ে ভাবার প্রধান কারণ হয়ত বা ওই উচ্চারণভঙ্গি। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, যে কোনও অনুচ্চারের ভেতর আমরা খুব তীব্রভাবে ইন্দ্রিয় টানটান করে অপেক্ষা করি- কান-প্রাণ-মন পেতে দিই। ফিসফিস তাই এত হাস্কি। আবেদনময়। এটা কেবল মানুষের নয়, যেকোনও জীবের ইন্সটিংক্ট। বিজ্ঞান। আগ্রহ। কবিতারও।
শেষপর্যন্ত একটা কবিতা কী দিতে পারে? আসলে এই কী ও কেন’র মাঝবরাবর সুতোটায় হেঁটে চলে যাওয়াতেই যুগপৎ আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছেপূরণ তার। অপরূপ দেখার দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে দেখে যাদুকরের মুন্সিয়ানা। খুব দূরেও না, আবার কাছেও না সে দাঁড়ায় ব্যালেন্সটুকুতে ভর করে। যাকে অনুভবের জন্য চোখ বা কান বা ত্বকের আলাদা আলাদা ইন্দ্রিয় কুঠুরির প্রয়োজন হয় না। একইসঙ্গে ইন্দ্রিয়ের একক উপস্থিতির বিলুপ্তি ঘটে আবার সকল ইন্দ্রিয় একযোগে প্রখর হয়ে ওঠে। যাকে অনুভবের/ধারণের জন্য মনে হতে পারে আমি আমাকে ছাপিয়ে গেলাম। বা এসব-এতকিছু না হয়ে কোথাও পূর্ণিমা নেই, তবু কবিতাটা পড়ার পর—জ্যোস্নারাতে খুব ফাঁকা লাগতে পারে, মনে পড়ে যেতে পারে ভুলে আছি— যে জীবন তেষ্টার। এত কথা বলে তবুও কী ঠিক মতো ঠাহর করা যায়! যা বলবে, বলবে; আর যা বলবে না- সেই ইশারাটুকু নিয়ে জলের মতো তাই ঘুরে ঘুরে একা কথা কবে। হাওয়া-জল-রোদ থেকে একটু একটু জমে উঠবে জমাট মেঘের মতো। কিংবা এসব—এতসব কিছু না হয়ে, কিচ্ছু না হয়ে সে হয়ত বড়জোর কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা পোকা।
সঙ্ঘমিত্রা হালদার
জন্ম—১৯৮৪, ১৩ সেপ্টেম্বর
শিক্ষা—বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর
লেখালিখির শুরু ২০০০ সাল নাগাদ।
প্রিয় অভ্যেস—বই পড়া, গান শোনা আর নিজের সঙ্গে সময় কাটানো।
বিশ্বাস করেন— খিদে ঘুম তেষ্টা ও যৌনতার মতো ভাবনাও একটি প্রবৃত্তি।
এই পর্যন্ত তিনটি বই (কবিতা)— নামানো রুকস্যাক (২০১০), পত্রলেখা প্রকাশনী।
দীর্ঘ-ঈ (২০১৪), পাঠক প্রকাশন। হে একটি সম্বোধন- সৃষ্টিসুখ (২০১৫)।
দীর্ঘ-ঈ বইয়ের জন্য ২০১৭ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কার পেয়েছেন।
এ বছর প্রকাশ হচ্ছে প্রথম গদ্যের বই ‘রন্ধনশালার শিস’; প্রকাশক ‘বাহান্ন প্রকাশ’