“এই চামড়াপোড়া রোদে বেরোচ্ছিস তাহলে! ওসব কথা বলবার জন্য যেতেই হবে তোকে?” সন্তর্পণে দরজা খুলতে গিয়েও মায়ের কণ্ঠ শুনে থেমে যায় মণীন্দ্রা। বেশ অনেকদিন ধরেই মেয়ে সারাদিন বাসায় কেনো বসে থাকে বলে অভিযোগ করলেও আজ তাকে বের হতে দেখে কর্কশ হতে দ্বিধা করেন না উপলা দত্ত। ওদিকে বাইরে যাবার সময় অহেতুক ঝামেলা চায় না মণীন্দ্রা। তাই সুর নরম করে বলে, “সত্য কথাই তো মা, এক সময় না এক সময় জানবেই।“ “তাই বলে এভাবে লোক ডেকে নিজেকে ছোট করে না মানুষ! ছেলেটা তোর বাপিকে যেচে এসে প্রস্তাব দিয়েছে। তুই নিজেকে, তোর বাপিকে ছোট করিস না মণী,” বলে নিজের ঘরে ফিরে যান তিনি।
*****
পানিটা নোংরা। ঘোলা কাদায় পিঠ ডুবিয়ে কিলবিল করছে দাঁতালো কুমির। মোছলমানের দুনিয়ায় হিন্দু আর জয় হিন্দের ভূমিতে মোছলমান। শাড়ি ভেদ করে মণীন্দ্রার উজ্জ্বল বর্ণ ছড়িয়ে পড়ছিলো এই উৎকট রোদের বেলা ৩টায়। হুড তোলা রিকশার পেছন থেকে ব্লাউজ ছাপিয়ে তার রঙ কোনো কোনো রিকশাচারীকে এই পিঠের অধিকারিণীর মুখ মিলিয়ে দেখতে আগ্রহী করে। তার বর্ণ, তার গঠন তাকে ঘোলাপানির কুমিরদের সামনে এক বিভ্রান্ত বাছুরের মতো উপাদেয় করে রেখেছে সব সময়। নামটাও অমন, লুকাবার অবকাশ নেই। সারাটা জীবন সে নিজেদের বাড়িতে আটকে আছে আদাবর এলাকায়। যদিও পড়েছে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু পছন্দের কোনো বিষয়ে নয়। তার আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর অন্য মেয়েদের মতোই সে চেয়েছিলো এই প্রাত্যহিক জঞ্জাল থেকে দূরে চলে যেতে, যেখানে সে জানে শিউলি গাছের নিচে বসে লোকজন ভোরবেলা গান গায়। ভাগ্যটাও এমন, তার পরিবারে সঙ্গীত চর্চার রেওয়াজ ঘরে এসে ওস্তাদের শিখিয়ে যাওয়া পর্যন্তই। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের প্রকৌশলী বাপি তাকে মঞ্চে পর্যন্ত গান করতে দেননি কখনও। মোছলমানের জনসমুদ্রে মেয়ে ভুল কারো হাত ধরে বসে এই শংকায়; সাথে লোকজন সুযোগ পেলে ভেঙ্গে ফেলতে পারে তার এই কাচের পুতুলটিকে, এই ভয় ছিলো তার। অথচ যা হবার তা ঠেকানো যায় কি কখনও! খুব কম মানুষের সাথেই পরিতোষ দত্ত মেয়ের ব্যাপারে কথা বলেছেন। যতীন্দ্রনাথ নামের ছেলেটিকে দাপ্তরিক দায়িত্বে সুপারভাইজ করার সময়ে তাকে হলেও হতে পারতো পুত্র বলে অনুভব হতে থাকে তার। কেমন ফন্দিফিকিরহীন হাস্যোজ্জ্বল একটা ছেলে। এমন কি নিজের মেয়ের নামের সাথেও ছন্দমিল খুঁজে পান তিনি। নানান অজুহাতে তিনি মণীন্দ্রার কৈশোরকালীন গানের রেওয়াজের ভিডিও দেখিয়েছেন ছেলেটাকে। সব হয়তো খুলে বলেননি, কিন্তু মেয়ের বিষয়ে দুশ্চিন্তায় বলতেন “মেয়েটা গান ছেড়েই দিলো একদম, জানো! কী রকম চুপচাপ হয়ে গেছে। বাসায় নিজেদেরকে অপরিচিত লাগে ইদানিং!” সুপারভাইজারের মোবাইল স্ক্রিনে বারান্দায় বসে হলুদ সুতির শাড়ি পরা একটা কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়ের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইবার ভিডিও দেখে অস্বস্তিতে ভোগে যতীন। দিন এখন পালটে গেছে, ত্রিশের কাছে এসে এরকম বয়সের মেয়েদের দিকে তাকানোও সমস্যাজনক। কিন্তু এগুলো অনেক আগের ভিডিও জেনে সে মণীন্দ্রার প্রতি আগ্রহ বোধ করে। একটা রেকর্ডিং সে নিজের মোবাইলে ট্রান্সফার করে সুপারভাইজারের অনুমতি নিয়ে। সেটা দেখতে দেখতে “শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে” গাইতে থাকা মেয়েটার বিড়ালচোখ ক্রমেই তার কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে। বাস্তবে দেখা না হলেও মেয়েটার মুখ, মেয়েটার কণ্ঠ তার পরিচিত হয়ে ওঠে। কতো কারণই তো থাকতে পারে মানুষের চুপচাপ হয়ে যাবার, সেটাও কী মানুষ অতিক্রম করে যায় না! যতীন অনেক কিছু অতিক্রম করেই এতদূর এসেছে। শৈশবে তার বাবার মৃত্যুর পর পোলিওতে খুঁড়িয়ে হাঁটা মা তাকে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলো মামা বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে থাকবার অপদস্থতার চাপ নিয়েই সে লেখাপড়া শেষে প্রকৌশলী হয়েছে। কোনো খারাপ পরিস্থিতিই এখন আর অনতিক্রম্য মনে হয় না তার। মণীন্দ্রার এই হঠাৎ দেখা করতে চাওয়াও হয়তো তাদের ভবিষ্যতের জন্য চমকপ্রদ কোনো স্মৃতি হয়ে থাকবে ভেবে সে জ্যামে বসে দেরীর লজ্জায় ছটফট করে।
“চিকেন ফ্রাই অর্ডার করেছি,” বলে যতীন হাসলো। লোকটা একটু রোগাপাতলা গোছের, তবে দেখতে মন্দ নয় আর হাসলে তাকে সহৃদয় বলেই মনে হয় মণীন্দ্রার। ওদিকে ভিডিওতে পুরানো মণীন্দ্রাকে সে এতোবার দেখে ফেলেছে যে সামনাসামনি দেখা হওয়া মাত্রই বয়সের সাথে চেহারার পরিবর্তনকে দ্রুত আত্মস্থ করে ফেলে যতীন।
“দেখা করতে এলাম বলে আপনার অসুবিধা হয়নি তো?” মণীন্দ্রা বিব্রত হয়ে জানতে চায়।
“না না! আমি বরং স্যরি। কাজ জলদিই গুছিয়ে বের হয়েছিলাম, জ্যামের কারণে এতো দেরী হয়ে গেলো। তুমি কিছু বলতে চাইছিলে বোধ হয়।“
“হ্যাঁ। আমার আসলে বেশ কিছু কথাই বলবার ছিলো। আপনার কোনো কথা শেয়ার করবার মতো নেই?”
“হুমম, আছে। এ ধরনের সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্ট থাকাই ভালো। আমি একটা প্রেম করেছিলাম ভার্সিটি থাকতে। সিরিয়াস রিলেশন বলা যায়। তারপর সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলো। ওর নাম ছিলো তানজিনা, তানজিনা আলম। তো আমার গল্পটা বুঝতেই পারছো।“ শুনে মণীন্দ্রার মনে হলো লোকটার হয়তো তার গল্প বুঝতে পারার সম্ভাবনা আছে। অথবা নেই। অফিসের ঊর্ধ্বতনের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এরা কেমন লোক! এরকম লোকজনকে সন্দেহের চোখে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো সে। কিন্তু যতীনকে দেখে তার সহজ মানুষ বলেই মনে হতে থাকে।
“তারপরও গল্পটা বলুন না!”
“আমি নিজে থেকে প্রস্তাব দেইনি ওকে। আমি জানতাম এক পর্যায়ে গিয়ে এরকম সম্পর্কগুলা সামাজিক চাপে ভেঙ্গে যায়। তাই অযথা একে অন্যের সময় নষ্ট করে কী লাভ! সে-ই এসেছিলো আমার কাছে। তবে কাউকে ভালো লাগবার পর কে আগে এসেছিলো, আর কে পরে এসেছিলো ম্যাটার করে না অতো। সে তুখোড় ছিলো, মিষ্টি ছিলো, গম্ভীর ছিলো, দাম্ভিকও ছিলো। ওকে ভালো না লাগবার মতো কোনো অণু-পরমাণু মনে হয় ছিলো না আমার শরীরে।“
“আপনি তাকে এখনও ভালোবাসেন তাহলে?”
“না না। ওটা বহু আগেই নষ্ট করে দিয়ে গেছে সে, অন্যদের সাথে নিজেকে জড়িয়ে। যখন বুঝতে পেরেছে আমি নতুন কিছু আর দিতে পারছি না তাকে, তখন সে সরে গেছে। হয়তো তাকে ভুলে যাবার সুবিধার্থেই করেছে এসব।“
“সে এখন কোথায়?”
“কোথায় আবার, মেধাবী লোকজন যেখানে চলে যায়! অন্য দেশে, অন্য মহাদেশে! তোমাকে নিশ্চিত করতে চাই যে আমি তার বা অন্য কারোর সাথে এটাচড না আর। হয়তো আমাদের স্মৃতিগুলোকে মনে করি এখনও। আমি স্মৃতি মুছবার দলের লোক নই যে কেউ চলে গেলো আর সেই সাথে নিজের জীবনের বড় একটা অংশ বিস্মৃতির ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসলাম। জীবনের যে ভার থাকে ওটা বহন করতে শিখতে হয়। তোমাকে জানালাম, কারণ নারীপুরুষ, শরীর বিষয়ে আমার খচখচানি নেই সেটা বোঝাতে। যদি তোমারও প্রাক্তন কেউ থেকে থাকে, আমি সেটাকে নেগেটিভভাবে নেবো না।”
মণীন্দ্রা বুঝবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। সোজাসাপটা কথাই সে শুনতে চায়, বলতে চায়। অথচ সোজা কথার শক্ত বাতাসে সে বরাবরই রোগা গাছের মতো নেতিয়ে গেছে।
“আমার গল্পটা একটু কমপ্লিকেটেড। আবার অতো কমপ্লিকেটেডও না,” বলে সে টেবিলের টমেটো ক্যাচাপের দিকে মনোযোগ দেয়। ফ্রাইড চিকেনে মাংশের কাঁচা গন্ধ এখনও যায়নি বলে তার মনে হয়, কিন্তু খাবার ফেরত দেবার সাহসও তার নেই। তাই বেশি করে সস মাখিয়ে গন্ধের অত্যাচারটা ভুলে যেতে চায় সে।
“ইউ হ্যাভ মাই ফুল অ্যাটেনশন ম্যাডমইজেল!” মণীন্দ্রার সরু চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে যতীন বলে ওঠে, “কিন্তু চিকেন ভালো না লাগলে জোর করে খেয়ো না। আমি অন্য কিছু অর্ডার করতে পারবো।”
মণীন্দ্রা অতো জটিলতায় না গিয়ে বললো, “আপনি আমার বাপিকে তো চেনেন।“
“আজ্ঞে, আমার সুপারভাইজারের নামে কটূক্তি করলে কিন্তু আমি হাতেনাতে ধরিয়ে দেবো তোমাকে!”
“বেশ, তাহলে আপনি অফিসে ফিরে যান। আমার গল্প শুনবার কী দরকার!” অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে যায় মণীন্দ্রার।
“রাগ থাকা ভালো, বুঝলে! হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন রাগী মেয়েরা সংসারী হয়।”
“হু, আমার বন্ধু অণিমা বলেছে ঘটনা উল্টো। বরঞ্চ সংসার করতে করতে মেয়েরা রাগী হয়ে ওঠে,” মণীন্দ্রা নকল ফোঁসফোঁস করে।
যতীন হেসে তাকে গল্প বলবার জায়গা করে দেয়।
একটু সময় নিয়ে মণীন্দ্রা বললো, “আমার আসলে বেশ কিছু কারণে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স আছে। দেখে হয়তো বুঝবেন না। কিন্তু ঝামেলা দেয় সেটা।”
“দেখে বোঝা অসম্ভব। তোমাকে দেখে বরং আমারই ইনফেরিওরিটি জেগে উঠছে।”
প্রশংসাটাকে পাত্তা দিলো না মণীন্দ্রা। বললো, “বাপি আমাকে কোথাও একা ছাড়তে চাইতো না, এমনকি আত্মীয়বাড়িও কখনও একা যেতে দেয়নি, সেই সিদ্ধান্তে মায়েরও শতভাগ সমর্থন। অবশ্য যৌক্তিক কারণ ছিলো তাদের দুশ্চিন্তার। কিন্তু এই আটকে রাখার ফলে আমার আসলে কিছু হয়ে ওঠা হয়নি। গান করবার ইচ্ছা ছিলো, হলো না। ভার্সিটি ঢুকে মঞ্চনাটক করতে যোগ দিয়েছিলাম একটা নাট্যদলে। ওখানে তাদেরকে না জানিয়ে যাওয়াতেই বিপত্তির শুরু।“
“কী হয়েছিলো?”
“না, সংগঠনের কোনো সমস্যা ছিলো না। ওখানে প্র্যাক্টিসের সময় ভার্সিটির এক সিনিয়র আমার পরিচয় খুঁজে বের করেন। লোকটা দেখতে স্বাভাবিক। চুল বড়, পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াতো; কিন্তু বাস্তবে স্টকার টাইপ। বাসার সামনে পর্যন্ত হাজির। আমার বিষয়ে তার আবদার, মেয়ে ভালো লেগে গেছে, জাতপাত মিলে গেছে, এবার প্রেম করে বিয়ে করে ফেলবো। আমার আগ্রহ না থাকলেও প্রেম করবে! এরকম ঘুরঘুর করা যে অন্যকে কতোটা স্ট্রেস দিতে পারে সেই বিষয়ে কোনো তোয়াক্কাই নেই!”
“সুন্দরী মেয়েদের জীবনের টিপিকাল জটিলতা। তুমি গেলে না কেনো?”
“সে জঘন্য লোক! পা-চাটা! ভ্যাকভ্যাক করে হাসে! আমি তার সাথে কথা পর্যন্ত বলতে চাইতাম না আর সে আমাকে বলে কি না বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে!”
“তারপর?”
“বাসায় জানানো গেলো না এরকম ঝামেলা হচ্ছে। কারণ বাপি-মা তারা তো জানেই না আমি মঞ্চনাটক করতে চাইছিলাম। এই উপদ্রব রিয়েলাইজ করে ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র এগিয়ে আসলো। তখন তাকে ভালো লেগে যায় আমার। হয়তো অতিরিক্ত স্ট্রেসের সময় একটু ভরসা দিতে পেরেছিলো বলেই। মানে আমাদের মাঝে একটা ঘনিষ্টতা, সময় গড়িয়ে প্রেম তৈরি হয় এরপর।”
“হুম।”
“ফয়সাল নাম তার, তো আপনার গল্পের সাথে একদিক থেকে মিল পাবেন।”
“আর কেউ ছিলো না? তোমাকে শেষে এসে ছেড়ে দেবে এমন লোকই খুঁজে-বেছে নিলে কেন?”
“আপনিও তো তাই! আসলে ছোটোবেলা থেকে আমি এতো অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত ছিলাম যে ফয়সালের মতো সুদর্শন কেউ আমার প্রতি আগ্রহ দেখাবে সেটাই আমাকে কনফিউজড করে দিয়েছিলো। তার এলিট চেহারা সাথে জিম করা শরীর, বাইক চালাতো সে। আর ফয়সাল ঘটনায় আসতেই নয়নদা মানে শুরুতে যে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলেছিলো আমাকে, সে লেজ গুঁটিয়ে পালিয়ে যায়।”
“বেশ বেশ! তার আর প্রশংসা করো না। অন্যের অতো প্রশংসা হজম করা কঠিন,” বলে যতীন কৌতুক করে চাপা দিতে চায় তার হালকা অপ্রতিভ অনুভূতি।
“আমি ভেবেছিলাম হয়তো শক্তপোক্ত লোক দেখে নয়ন পালিয়েছে। আসলে ফয়সাল ছিলো হায়ার লেভেলের ছাত্রনেতা। তার বাইকে করে ঘুরে বেড়াবার সময় লোকজনের সম্বোধন সম্পর্ক থেকে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় বিষয়টা।“
বাইকে চড়া বিষয়ে বেফাঁস একটা প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরোতে চাইলেও গিলে ফেলে যতীন। বলে, “তারপর?”
হয়তো অন্যপাশের কৌতুহল আন্দাজ করতে পারে মণীন্দ্রা। বলে, “হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে শারীরিক বিষয়-আশয় ছিলো। বয়সের দোষ বলবো না। আমার নিজেরই আগ্রহ ছিলো তার প্রতি।”
“তো, সে বিয়ে করতে না চাওয়ায় ভেঙ্গে পড়োনি?”
“ভেঙ্গে? নাহ! আমি তো তাকে বিয়ে করতে চাইনি! নয়ন লোকটা দূর হলো, সাথে বাপি আর মা’র কড়া শাসন থেকে কিছুদিন মুক্তি পেলাম, এর বেশি আর কী চাইবো! ফয়সাল খুব ম্যাটেরিয়ালিস্টিক ছিলো। ওর সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটালে নিজেকে জড়পদার্থ বলে অনুভব হতো।” বলতে বলতে শৈশবে গল্পের বইতে পড়া কুমিরের পিঠে চড়ে নদী পার হতে চাওয়া প্রাণীদের মতো বোকা আর হাস্যকর মনে হতে থাকে নিজেকে তার।
“তাহলে সে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলে?”
“সে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলো না, ঠিকভাবে সাথেও থাকা যাচ্ছিলো না বছর দুয়েক পর। দেখা হলে ঘুরে বেড়াতাম, স্টলে বসে চা-নাশতা খেতাম, ক্যাম্পাসে সবাই জানতো আমাদের বিষয়ে, তাই কেউ আমাকে ঘাটাবার সাহস করতে পারতো না। সম্ভবত, এই সাময়িক নিরাপত্তার ভরসাতেই আমি ছাড়াছাড়ির বিষয়ে কথা তুলিনি।“
“তারপর?”
মণীন্দ্রা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার সত্যি সত্যিই একটা প্রেম হয়েছিলো এরপর, সন্তুর সাথে, এই বিষয়টা সে সদ্য পরিচিত একটা লোককে বলবে কি না চিন্তা করে।
ততক্ষণে টেবিলে বিল চলে আসায় যতীন বলে, “চলো বাইরে গিয়ে রিকশা নিই। বিকাল শেষ হয়ে আসছে। অনেকদিন পর এই এলাকায় আসা পড়লো। আমার হাইস্কুল আছে এলাকার ভেতরের দিকে। মাঠে বসে আমাদের আজকের গল্প শেষ করি।”
*****
সন্তু এমন একটা সময়ে এসেছিলো, যখন ফয়সালের সাথে তার নৈকট্য ছিলো ক্যাম্পাসে দেখা হবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সম্পর্কের সামাজিক খোলসটা কমন সার্কেলের কারণে টিকে ছিলো শক্তপোক্ত হয়ে। বয়স বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে মানুষ যেভাবে নিজেকে হট্টগোল থেকে সরিয়ে নিতে থাকে, মণীন্দ্রা ভীড় এড়িয়ে সরে যাবার সময়েই সন্তুর সাক্ষাৎ পায়। কয়েকজনের মাঝে একটা গান গাইছিলো সন্তু। গানের নাম খোঁজ করতে সে প্রথম জানতে পারে, পৃথিবীতে এমন অসংখ্য গান আছে যার কোনো রেকর্ডিং নেই, যাতে জনগণের প্রবেশাধিকার নেই, ব্যক্তির সাথেই ওগুলোর বিনাশ ঘটে। শূন্য থেকে এসে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার মাঝে ধ্বনিত হওয়া ছাড়া যাদের ভিন্ন গতিপথ নেই। মণীন্দ্রা কেবলমাত্র রীতিশুদ্ধ সংগীত গেয়ে এসেছে এ যাবত। তার বিশ্বাস হতে চায় না নিজের কথার গান দিয়ে কেউ তার হাত ধরলো। এদিকে ফয়সালকে জানাতে গেলে কী প্রতিক্রিয়া আসবে সেই ভয়ে সে এগুতে পারছিলো না। আড়াই বছর তাকে নানাবিধ ঝামেলা থেকে বলতে গেলে এক প্রকার নিস্তার দিয়ে এসেছে এই ফয়সাল। শুরুতে তারাও নিজেদের মধ্যে বিস্ময় খুঁজে পেয়েছিলো, একে একে যেগুলো দৈনন্দিন হয়ে গেছে। মণীন্দ্রা তাকে ছাড়তে চাইলে সে অপমানিত হয়ে মণীকে সুযোগসন্ধানী বলে গালাগাল করতে পারতো। আবার হয়তো মণীন্দ্রাকে বিয়ে করতে যাবার ধর্মীয় সামাজিক ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে ফয়সাল মেনেও নিতে পারতো তাদের মৃতপ্রায় সম্পর্কের ইতি। রিকশায় যতীনের পাশে বসে তার মনে পড়ে সময়গুলোকে।
ফয়সালের সাথে প্রেমের শুরুর দিকে মণীন্দ্রার একবার ধারণা হয় সে প্রেগনেন্ট। ফয়সালকে বললে সে বাইরে থেকে উৎকণ্ঠা দেখায় কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যস্ততায় ভুলে যায় বিষয়টা। আবার জানালে ফয়সাল বলে এমনিতেই সে নানান স্ট্রেসে থাকে, এই লেভেলের হিউমিলিয়েটিং জিনিস ডিল করতে সে এখনই প্রস্তুত নয়। মণীন্দ্রা ফার্মাসিতে গিয়ে টেস্ট কিট কিনে আনবার সময় দোকানদাররা ইশারা-ইঙ্গিতে সে যৌন ব্যবসায় জড়িত কি না জানবার চেষ্টা করে। আর বাসায় ফিরে সেই টেস্ট কিট খুলবার পর দেখা যায় কিটটাই নষ্ট। মণীন্দ্রা নিজে এবরশনে বিশ্বাস করে না, যে কারণে দিনকে দিন তাকে আতঙ্ক গ্রাস করতে থাকে। তাই মণীন্দ্রার এংজায়েটি বুঝে সেইবার সন্তু বললো, “ফার্মাসি থেকে কিছু কিনতে হবে না। আমি তোমার সাথে হাসপাতালে যাবো, তুমি টেনশন করো না তো!”
মেডিকেলের সময়টায় পরিচিত কারো সাথে তাদের দেখা হয়েছিলো বলে মনে করতে পারেনি মণীন্দ্রা। কিন্তু একই সপ্তাহে সন্তু হলের পুকুরে ডুবে মারা যায় কী করে! ফয়সাল বা ফয়সালের লোকজন কেউ যে সন্তুকে মেরে পানিতে ফেলে দেয়নি এই কথাই বা সে কী করে বিশ্বাস করে! দেশের সামগ্রিক বিচারহীন পরিস্থিতিতে বিনা কারণে একটা ছেলের পুকুরে ডুবে মারা যাওয়াটাই বেশি গ্রহণযোগ্য আর সবার জন্য কম ঝামেলার। মা আর বাপির নিয়ন্ত্রণের অত্যাচার, শহরে নিজেদের মতো বেঁচে থাকতে না পারার বদ্ধতা থেকে যেই মুক্তির আশ্বাস নিয়ে সন্তু এসেছিলো, অর্ধেক বছরেই তা বাতাসে মিলিয়ে গেলো। কোন পরিচয়েই বা সে লোকজনের কাছে সন্তুর মৃত্যুর বিষয়ে তলব করবে! মণীন্দ্রার অসুখ ফিরে এসেছিলো এরপর, ঘর থেকেও সে বের হতে চাইতো না অপ্রয়োজনে। ঘটনার কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে দেখা হলে ফয়সাল নিজে থেকেই হাসিমুখে সন্তুর মৃত্যুর বিষয়ে দুঃখ করে। তবে জানায় মণীন্দ্রার সাথে তার যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা মেরামত করার কোনো মানে নেই। এই গল্প যতীনকে বলতে সে এখনই নিরাপদ বোধ করছে না, হয়তো অন্য কোনোদিন বলবে। এমন কি তার মা-ও সন্তুর বিষয়ে জানেন না। তিনি ফয়সালের বিষয়ে জেনেছিলেন একদিন তাদেরকে একসাথে বাইকে দেখে। মণীর অসুস্থতা ফিরে আসা আর স্বেচ্ছায় ঘরবন্দীত্বকে তিনি ফয়সালের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ফলাফল হিসেবে ধরে নেন।
“তারপর?” যতীন স্কুলের বারান্দার ধুলো সরিয়ে বসবার বন্দোবস্ত করে।
পুরো রাস্তাটা চুপচাপ এসেছিলো তারা। গলিতে রিকশা ছেড়ে স্কুলে হেঁটে আসার সময় বরাবরের মতোই কিছু লোক মণীন্দ্রার শাড়ি পরা শরীরকে পর্যবেক্ষণ করে। বিরক্ত লাগলেও আর সব মেয়ের মতো এসবে গা সয়ে গেছে তার। বারান্দার মেঝের ধুলো সরাতে সরাতে সে বলে, “তারপর আর কি, ফয়সাল বললো সে মিথিলা নামের একজনকে বিয়ে করবে। বাসা থেকে ঠিক করেছে তাই সে মানা করতে পারবে না।“
“তুমি মেনে নিলে?”
“খুশিই হয়েছিলাম। তাকে আর নেয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু আমি আসলে আপনাকে আমার পুরানো প্রেমের গল্পই শুধু বলতে আসিনি। ওটা হয়তো আপনি মেনেই নিতেন।“
“তাহলে?”
“আমার ধারণা বাপি আপনাকে আমার অসুখের কথা বলেনি। বলেছে?”
“ডায়রেক্টলি বলেননি। কিন্তু ইঙ্গিত করেছিলেন উনি এই বিষয়ে। কী অসুখ?” যতীন ইতস্তত করে।
“জানতাম, সে গোপন করে যাবে। আর আপনিও আছেন স্যার স্যার বলতে অজ্ঞান হয়ে।” মণীন্দ্রা দেখে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঢাকার গর্জনে সামান্য স্তব্ধতা। স্কুলের বারান্দায় দূরের কোনায় আরও কিছু লোকজন বসা। সেখান থেকে বাজে গন্ধ ভেসে আসছে।
“অসুখ থাকাও কোনো অপরাধ নয় মণীন্দ্রা! মানুষ তো কেউ নিজে থেকে অসুস্থ হতে চায় না! তোমার অসুখ যে আর কেউ মেনে নেবে না সেটাই বা তোমাকে কে বললো?” যতীনের তার মায়ের বাঁকানো পায়ের কথা মনে পড়ে। অনেক রাত তার মা পা ব্যথায় ঘুমাতে পারতো না যখন, সে পড়বার ফাঁকে ফাঁকে তেল গরম করে পা মালিশ করে দিতো সেই রাতগুলোর স্মৃতি টুকরো হয়ে ভেসে ওঠে।
সান্ত্বনা শুনে হয়তো প্রথমবারের মতো লোকটাকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় মণীন্দ্রার। সে যতীনকে আশ্বস্ত করতে বলে, “বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না। ছোটোবেলা থেকেই ট্রিটমেন্টের উপর আছি। তাই হয়তো স্বাভাবিক জীবন একেবারে অসম্ভব হয়নি।“
যতীন মণীন্দ্রাকে উত্তরে কিছু বলবার আগেই ভকভকে গন্ধ ছড়ানো ছয়সাতজন কমবয়সী ছেলে এসে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
“মামু অন্ধকারে মাইয়া আইনা নষ্টামি করেন?”
“এটা আমার হাইস্কুল,” বলে গলা চড়াতে যায় যতীন।
“বুইড়ায় আইছে ইস্কুলে পড়তে” দলবেধে হেসে ওঠে তারা।
“মণী ওঠো, আমরা এখান থেকে যাই” বলে মণীন্দ্রার হাত ধরতেই দু’জনকে দুই পাশে সরিয়ে দেয় ছেলেদের কয়েকজন।
“টাকা নিতে আসছো তো? টাকা নিয়ে বিদায় হও।” যতীন মানিব্যাগ বের করতে তার হাত থেকে ম্যানিব্যাগ আর মোবাইল কেড়ে নেয় কেউ। এরপর “বেদ্দপ বুইড়ায় আমগোরে ট্যাকার দেমাগ দেখায়! হুমুন্দির পুত!” বলে তারা ধাক্কা দিয়ে তাকে মাঠে ফেলে দেয়, মুখ বরাবর লাথি বসাতে থাকে কয়েকজন মিলে। মণীন্দ্রা ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিকমতো চিৎকার করে উঠতে পারে না। ধ্বস্তাধস্তির মধ্যে তারা তাকে অন্ধকার স্কুলঘরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে, হয়তো বারান্দাতেই শাড়ি খুলে পড়ে যায় তার।
তাকে মাটিতে ফেলে চড়াও হবার কালে কোনো একজন বলে, “আরে বাল্ব দে বাল্ব দে। বাত্তি ছাড়া মজা নাই।”
যতীন অর্ধজ্ঞানে অর্ধঅজ্ঞানে মণীন্দ্রাকে বাঁচাতে যেতে চায়। কিন্তু তাদের সংখ্যার সাথে পারবে না জেনে মাটিতে লুটিয়ে থাকে। শৈশবে মামাবাড়িতে কেউ তার মা’র সাথে তুচ্ছতাচ্ছ্বিল্য করলে সে ভাবতো বড় হয়ে সবাইকে শায়েস্তা করবে একদিন। অথচ এত বছর বাদে আজও সে অক্ষমই থেকে গেছে! কিছুই বদলায়নি। আগামীকাল সকালে স্যারকেই বা সে কী বলবে? কাপুরুষের মতো তাঁর মেয়েকে ফেলে পালিয়ে এসেছে সে? তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেই বা এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারতো! এই ভেবে সে সান্ত্বনা খোঁজে। পরক্ষণে একটা মেয়েকে স্কুলের মাঠে ডেকে আনবার মতো নির্বুদ্ধিতায় নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা হয় তার। সে এলাকার লোকজন ডেকে আনবার সিদ্ধান্ত নেয়।
“অই, বাত্তির সুইচ কই রে?”
“আরে আপ্পির মুখ দিয়া দেহি ফ্যানা উঠা ধরছে,” বাতি জ্বালাতে একজন দেখতে পায়।
“আরেহ বেডি দেখি কাঁপতাছে! জিব কাইটা রক্ত বাইরইতাছে শালির।“
“মিরগি রুগি?”
“ইস!”
“জুতা শুঁকতে দে অরে। রাস্তায় এরম দেখছি, এডি কইরা লাভ নাই। এরম ফরশা মাইয়া ফ্যানাফুনা তুললেও না চুইদা যামু না।“
“হ মাগনা নাকি? যামু না, অরে জুতা শোঁকা।“
তাদের কেউ একজন স্যান্ডেল খুলে মণীন্দ্রার নাকের দিকে এগিয়ে দেয়। উত্তেজিত ছেলের দল সার্কাস দেখার আনন্দ বিকৃতি নিয়ে অপেক্ষা করে। আরও কিছু সময় পর মণীন্দ্রার খিঁচুনি বন্ধ হয়। পেটিকোট উপরে তুলতেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরটায়।
“আরেহ, ইস সি সি সি, হাইগ্যা দিছে। মিরগি রুগিয়ে হাইগ্যা মুইত্যা গান্দা কইরা দিছে পুরা।”
“খানকি মাগীয়ে হাইগ্যা দিছে?”
“ইস।“
শিকারের মুখে ফেনা তারা মেনে নিতে পারতো, কিন্তু মলমূত্র মাখানো এক মেয়েকে দলবেধে লাগানো তাদের পরিকল্পনার বাইরে ছিলো। রাগে, বিরক্তিতে, ঘেন্নায় কেউ কেউ থুতু মারে মণীন্দ্রার শরীরে। একজন তার গায়ে পেশাব করে কিছুটা ঝাল মেটায়। তাদেরই কেউ মাটিতে পড়ে থাকা মণীন্দ্রাকে লাথি মারতে আসলে অন্য একজন বাদ দে, বাদ দে বলে সরিয়ে দেয়। ভাইরাল হবার আকাঙ্ক্ষায় আরেকজন মোবাইলের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে ভিডিও করতে উদ্যত হলে দ্বিতীয় দফায় খিঁচুনি শুরু হয় তার। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ছেলেরা এই পর্যায়ে পিছু হটে। স্কুলঘরে পড়ে থাকে মণীন্দ্রা তার একান্ত সঙ্গীসমেত।
রওনক মিরাশদার
জন্ম ১৯৮৯, ঢাকায়। পড়ালেখা ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, তড়িৎ প্রকৌশল ও শব্দবিজ্ঞানে। গদ্য ও গান তৈরির চেষ্টা করেন।