খাটে বসতে বসতে ভাবি এ ঘরে আমি কালকেও আসবো। চোখে রোদ লাগলে পর্দা টেনে নেবো জানালার। সানগ্লাস খুলে রাখবো টেবিলে। এক কাপ চা খাবো।কোন বিস্কুট দিয়ে। লীলা এখনো তাকায় নি আমার দিকে । নিচু হয়ে কাপে চা ঢালে। ঘোমটা টানা মুখ। আমি খুব বেশি একটা দেখতে পাই না। লীলা চা দেয়। কাপের এক কোনা ভাঙা। আমি সাবধানে চুমুক দেই। পিরিচটা হালকা নীল। কাপটা সাদা। মিল নাই। জোড়া কাপ-পিরিচ নেই হয়তো । নাকি লীলা আমাকে এই ঘরে এভাবে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে ! আমাকে চা দেয়ার সময়ও লীলার হাত কাঁপে। কাচের চুড়ি পরা হাত।সবগুলো চুরি নড়ে ওঠে চায়ের কাপ নেয়ার সময়ও।কয়টা বেলা বিস্কুট ছিল সাথে। আমি খাই নি। বেলা বিস্কুট এখন আর আমি খেতে পারি না। কাল অন্য কোন বিস্কুটের প্যাকেট আনবো। সঙ্গে করে। লীলা মুখে কাপড় টানে। কেরোসিনের চুলা বন্ধ করতে করতে কী যেন ভাবে। আমি তাকাই। টিনের ফাকে রোদ এসে পড়ে। নাকফুলটা ঝলঝল করে লীলার। আরো লম্বা করে মুখ লুকায় মেয়েটা। ঘোমটা টানে।
হাতে একটা কিছু। মজনু ফিরে এলো। মুখে হাসি। ‘ভাইজান , এইটা খান, পিঠা আনসি।’ লীলা পিরিচটা ধুয়ে দেয়, হালকা নীল পিরিচ। ‘তুমি কই গেসিলা ? কথা আছে তোমার সাথে মজনু।” তারপর আমি বলার চেষ্টা করি। একটু একটু করে , মজনু বোঝে না তেমন। লীলা শোনে। মাঝখানে প্রশ্নও করে। আসলে ব্যাপারটাতো ওরই। খুব সহজ কাজ। প্রতিদিন দুপুর বারোটার দিকে নিয়ে যাবো আর বিকেল পাঁচটার দিকে ওকে ঘরে পৌছে দিয়ে যাবো আমি। শুধু সঙ্গ দেয়া। এইতো ! “আমারে ক্যান , অন্য কেউ নাই ?” লীলা হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দেয়। প্রশ্নের উত্তরে বলি , “কেন তোমার তো সারাদিন কোনো কাজ নাই। এইটা একটা চাকরী বুঝলা ? মজনু মিয়ার একলা রুজিতে কী চলে ! ” বেতন ঠিক করার সময় মজনু বলে, “আপনে খুশি হয়া যা দিবেন তাই সই।” স্বামীর দিকে একবার তাকালেও কিছু বলে না লীলা। কেরোসিনের চুলাটা ধপ করে নেভায়। রাগ করলো কী না মেয়েটা !
দরজাটা খোলাই ছিল। লীলাকে আমি আগে যেতে বলি। ও একটু ইতস্ত করে। বল্লাম, “যাও না ঘরে , কিচ্ছু হইবো না !” লীলাকে দেখেই শাকিল বিছানায় উঠে বসে। খুব হাসি হাসি মুখ। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। “আম্মা ওকে নিয়ে আসছো ভাল হইসে, অনেক ভাল হইসে! ” আম্মা তাকিয়ে থাকে শাকিলের দিকে। আজ কতদিন পর ও একটু হাসলো ! টিফিন ক্যারিয়ার খুলে স্যুপ দেয়। লীলা চেয়ারে দুই পা গুটিয়ে বসে থাকে দুরে। স্যুপের বাটিটা মুখের সামনে দিতেই শাকিল বলে, “ওর হাতে খাবো , তোমার হাতে না আম্মা।” আম্মা ইশারা দেয়। লীলা আস্তে আস্তে শাকিলের বিছানার পাশে বসে। স্যুপ খায় শাকিল। লীলা খাওয়ায়। সবটুকু স্যুপ শেষ করে ও।
বিকাল হয় ,হঠাৎ শীত পড়ে যায়। আম্মার আসরের নামায পড়া হলে আমরা হাসপাতাল থেকে বের হই। আম্মাকে বাসায় নামিয়ে লীলাকে পৌছে দিতে যাই। “কালকা দুপুরে রেডি থাইকো। শুনসো ? ” লীলা কোন উত্তর দেয় না। বাড়ি ফিরে যেতেই দেখি আম্মা গেটে দাড়ানো। “এই মেয়ে কে ? তুই ওরে শাকিলের কাছে নিয়া গেলি কেন ? আমার ছেলেটা কী খুশি হইলো ওরে দেইখা, আমি তো কিছুই বুঝলাম না রে।” “আমিও এত্ত কিছু জানি না আম্মা , পরে বলুম।” “ওর জামাই কই ? থাকে কই ? ” বস্তিতে ! বুড়া রিক্সা চালায় !”
রাস্তা থেকে কিনি ।এটা, ওটা। শাকিলের জন্য। চিপস ,কেক, চানাচুর, পেয়ারা এই সব। হাসপাতালের খাবার খায় না ও।আম্মা তৈরি হচ্ছে। সিএনজি আসবে একটু পরে। গিয়ে দেখি লীলার ঘরে দরজা বন্ধ। আমি কড়া নাড়ি। ভেতর থেকে বন্ধ। মজনুতো এই সময় বাইরে থাকার কথা ! ঘরে কি অন্য কেউ ? লীলাকে ডাকি,” দরজা খুলো। আমি।” দাড়িয়ে থাকি । লীলা খুলে দেয় ১০ মিনিট পর । মাথায় কাপড় টেনে রাখে। উসকো খুসকো চুল। “তুমি ঘুমাও ? এইটা কি ? তুমি রেডি হও নাই, যাইবা না হাসপাতালে ? ” না , আমি আর যামু না, আপনার ভাই যদি কিছু করে ?” কি বলো এইসব, কি করবো ?” “হেয় তো পাগল !” “না আমার ভাই পাগল না, ওর অসুখ !” ” যদি মাইর ধর করে! আমি যামু না।” “শুনো লীলা , চলো, তোমার জামাই তোমারে মানা করছে ? ” ” তারে কিছু কই নাই , হাসপাতালে ক্যামনে ক্যামনে তাকায় আর হাসে , আইজকা আমার ভয় লাগসে ! ” আমি ফিরে আসি বস্তি থেকে । আম্মাকে বলি লীলার কথা। আমরা হাসপাতালে যাই। লীলাকে খোঁজে শাকিল। আমাকে আর আম্মাকে বারবার জিজ্ঞেস করে। আমি চুপ করে থাকি । শাকিল কিছুই খায় না। আম্মা বলে, “কালকে নিয়া আসবো ওরে।এখন একটু খাও আব্বা।”
সেদিন বিকালেই আমি লীলার ঘরে যাই। মজনু আমাকে দেখেই দোকানের দিকে যায়। লীলা চুপচাপ ঘরের কোনে বসা। “লীলা , আমারে একটু চা দিবা ?” “চিনি নাই” , চিনি ছাড়াই দেও”। তুমি কী আমার উপর রাগ করসো ?, আমি এমনি আইসি, মনটা ভাল না।আচ্ছা শাকিলরে তো ভয় পাও, আমারেও ভয় পাও তুমি? “না আপনে তো পাগল না।” বলে মুচকি হাসে লীলা। চা বানায় । কাচের চুড়ি ঝনঝন করে। আজকে আমার সাথে একটা প্যাকেট আছে। কাপ-পিরিচ সাজায় লীলা। চিনি ছাড়া দুধচায়ে চুমুক দেই। প্যাকেট টা খুলে দেয় লীলা। “তোমাদের কতদিন হইলো বিয়া হইসে ? ” ছয় বচ্ছর । একলগে থাকি চাইর বচ্ছর। আমার সতিন আমগো দেশে থাকে। বিক্রামপুর। হের লগে আসিলো এতদিন মজনু মিয়া।” ঘোমটা নেই আজ। চুল খোলা।গোছা চুল। লীলাকে এইভাবে দেখি নি কখনো। খুব চেনা চেনা লাগে। শাকিলের কথা মনে মনে ভাবি ।সেদিনের কথা মনে পড়ে যায় ! যেদিন লীলার সাথে আমার প্রথম দেখা।
আমাদের এলাকারই রিক্সা। আমি আর শাকিল উঠি। রিক্সাটা নতুন । মজনু মিয়া জোরে টানে । যশোর থেকে আম্মা শাকিলকে নিয়ে সেদিন সকালেই ঢাকা আসে। অসুখটা যে কী বুঝে উঠতে পারছি না ! ডাক্তারও ভালমত কিছু বলছে না। আমরা রিক্সায় গল্প করি। শাকিল আমার বড় হলেও আমি ওকে নাম ধরেই ডাকি। কত আর বড় হবে, দুবছরের হয়তো। মজনু মিয়া বলে, “কই যাইবেন ? ” আরে চালাও না মিয়া, অনেকদিন পর দুইভাই ঘুরতাসি। মজনু মিয়া প্যাডেল চালায়। শাকিল বলে, আমি শুনি।আরএন রোডে লাইব্রেরীর ছাদ, এ্যাকোরিয়ামের গল্প, দোকান ছেড়ে দেয়ার গল্প । আরো কী সব , যার কোন মানে আমি বুঝি না। মজনু রিক্সা থামিয়ে বলে , “স্যার আমার বাড়িত যাওন লাগবো , একটা জিনিষ দিতে ঐবো, দশ মিনিট। রিক্সা গলির মোড়ে থামে। একটা মেয়ে আসে। “আমার বউ স্যার, লীলা ” অস্ফুট কণ্ঠে সালাম শুনি । “আরে তুমি ? কেমন আছো ?’ শাকিল এক লাফে রিক্সা থেকে নেমে পড়ে! কাছাকাছি দাড়ায় লীলার ! মেয়েটা ঘরে চলে যায় দ্রূত ।” ও কই গেলো , ওর সাথে আমার কথা আছে ! এই রিক্সা দাড়াও”। কী বলো শাকিল, তুমি কি ওকে চেনো ? ” হ্যাঁ চিনিতো ! ” আমি লজ্জায় পরে যাই। সামনে রিক্সা টানে মজনু। রিক্সা চলতে থাকে। কিছু ভাবলো কিনা মজনু ! বার বার ভাবি। পুরো এলাকা ঘুরে বেড়াই দুই ভাই। শাকিল লীলার কথা বলে শুধু। কথাগুলো অসংলগ্ন। বুঝি না। আমি থামিয়ে দেই। লীলা বিষয়ক কথাগুলো এড়িয়ে যাই।। চারটার দিকে বাড়িতে পৌছে দেয় মজনু। রিক্সা ভাড়া দেয়ার সময় বুঝলাম সেতো কানে শুনে না ভালো ! মজনুমিয়া সরল লোক। মনটাও নরম! আরো কিছু টাকা দেই আমি।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি শাকিল বাসায় নেই। বেড়িয়ে গেছে কোথাও। সবার চিন্তা একটাই। খুঁজতে বের হই আমরা। দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো শাকিল। সন্ধ্যার দিকে খুঁজে পাই । বস্তির কাছেই। বাড়ি নিয়ে আসি। সারারাত ছটফট করে। লীলার কথা বলে আমাকে। বারান্দায় হাঁটে। আম্মাও ঘুমায় না সেই রাতে। এভাবে বাসায় থাকলে একা একা কোথায় যে চলে যায় শাকিল ! চিন্তা হয়। আম্মা একা সামলাতে পারবে না। পরদিনিই হাসপাতালে ভর্তি করে দেই।
সকালে মানিক ভাই এলো যশোর থেকে। ভোরের বাসে। ষ্টেশন থেকে সোজা হাসপাতালে। একটা চেয়ার নিয়ে সকাল থেকে বসে আছেন তিনি। শাকিল কোন কথাই বলছে না ! দিন দিন প্রকট হচ্ছে ওর অসুখটা ! মানসিক , শারীরিকও। মাানিক ভাইকে চিনতেই পেলো না ! শাকিলের হার্ডওয়ারের দোকানে কী যে আড্ডা হতো উনাদের! মনে পড়ে। যশোর থানার পাশেই ছিল দোকান। আরএন রোডে মানিক ভাইদের বাড়িতে আমিও যে কতবার গেছি শাকিলের সাথে। ওরা কলেজের বন্ধু। সেদিন অনেক কিছুই বলছিলেন মানিক ভাই , আমি আর আম্মা শুধু শুনছি। বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে তাঁর। আম্মা উঠে গেলে মানিক ভাই মারোয়ারী মন্দিরের কথা বলে! ছোট ছোট ঘর।বাহারী মেয়েমানুষ। দুইবন্ধুর অালো আঁধারের স্মৃতি। শুরুতে একটু অপ্রস্তুত হলেও আমি জিজ্ঞেস করি , “ওখানে কোন মেয়ের নাম মনে আছে ? মানে শাকিলের পরিচিত ?” নাম টাম মনে নেই , হয়তো দেখলে চিনতে পারি। কেন বলোতো ?” আমি চুপ করে থাকি। লীলার কথা ভাবি ! ওখানেই কি ওদের পরিচয় ? দুর ! এভাবে ভাবাটা কী ঠিক হচ্ছে! থাক মানিক ভাইকে না বলাই ভালো। লীলার এখন সংসার হয়েছে ! তাছাড়া শাকিল যে কদিন বেঁচে আছে ,লীলা যদি তাকে একটুও ভাল রাখতে পারে , কেন নয় !
মজনুও ছিল সেদিন। আম্মা আমাকে নিয়ে গেলো লীলাদের ঘরে । ” আমার ছেলের যে কী হইসে ,বাঁচবোই বা কয়দিন, লীলা আমি জানি না তোমাদের কী সম্পর্ক তবে তুমি থাকলে ও একটু ভালো থাকে , চলো না মা আমার সাথে ! ” আম্মার এ কথা শুনে অবাক হয় নি আমি! তবে মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। শাকিলের কী আর চিকিৎসা হবে না ! আমার সামান্য চাকরী, আম্মার কাছেও জমানো কিছু টাকা। তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রায়। আব্বার চাকরীর কারনেই আমাদের যশোরে থাকা। ওখানেও তেমন কিছু আর নেই।
“এইটা আপনার ভাই দিসে আমারে !” একদিন একটা শাড়ি পড়ে আসে লীলা। হলুদ। “কবে ? কোথায় ? যশোরে থাকতে ?” আমার হাত চেপে ধরে লীলা , এতো কথা জানতে চান ক্যান ? হেইদিন আইসিলো আমার ঘরে , যেই দিন হেরে খুঁজতাছিলেন !” আমি আর কিছু বলি না। লীলার হাতটা ধরে রাখি অনেকক্ষণ। শাকিলের জন্য কষ্ট হয় খুব। আমার। লীলারও হয়তো। চোখ লাল। টাই ঠিক করতে করতে আয়নাতে লীলাকে দেখি আরেকবার।
ফুরফুরে চুল, শ্যাম্পু করা। এখন আর ঘোমটা টানে না লীলা। মজনুর রিক্সাতেই আসে। শাকিল স্যাুপ খায় ওর হাতে। ওরা কী সব বলে আর হাসে। মাঝে মাঝে শীত পরে। লীলা কম্বল টেনে দেয় শাকিলের গায়ে । পা পর্যন্ত।শাকিল পাশে বসিয়ে রাখে ওকে। আমি আর আম্মা মাঝে মাঝে যেতেও পারি না। লীলা নিয়মিত আসে। হাসপাতালে আম্মা গেলে আসরের নামাজের পর আমরা বাড়ি ফিরি।
এখনও কোন কোন সন্ধ্যায় যাই লীলার ঘরে। চা খেতে। ভাঙা কাপটায় সাবধানে চুমুক দেই। শীতে ওর মুখটা শুষ্ক হয়ে থাকে প্রায়। লীলার জন্যে নিভিয়া ক্রীম কিনি। কিন্তু ওটা পকেটেই থেকে যায়। তবুও যে সুগন্ধী ছড়ায়! গন্ধটা ফুলের নয়, পাতারও না। শার্ট বদলাই। বুকের কাছটা ভারী লাগে। নিভিয়ার কৌটাটা আটকে থাকে বলেই হয়তো।
লীলার শরীরটা আজকাল ভাল যাচ্ছে না। মজনু রিক্সা থামায় আমাদের বাড়ির দরজায়। আম্মার সাথে দেখা করতে আসে লীলা। আমি দুর থেকে দেখি ! এই লীলাকে আমি যে আর চিনতে পারি না ! শাকিলের দেয়া হলুদ শাড়ির আঁচলটা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করে শরীর। আম্মার পায়ের কাছে বসে লীলা। পেটটা বেশ উঁচু হয়েছে ওর। ৬/৭ মাসতো হবেই। আম্মা সালাম ফিরিয়ে লীলার মুখটার দিকে তাকায়। জায়নামাযে বসেই চোখ মুছতে মুছতে লীলার মাথায় হাত রাখে আম্মা।